Ajker Patrika

‘কাল দেখা হইবে, ভালো থাকিস’—ছেলেকে বলেছিলেন গণপিটুনিতে নিহত প্রদীপ

শিপুল ইসলাম, রংপুর 
রংপুর-দিনাজপুর মহাসড়কে রূপলালের লাশ রেখে এলাকাবাসীর বিক্ষোভ। ছবি: আজকের পত্রিকা
রংপুর-দিনাজপুর মহাসড়কে রূপলালের লাশ রেখে এলাকাবাসীর বিক্ষোভ। ছবি: আজকের পত্রিকা

‘বাবা, তোর নানার সাথে দেখা হইছে। রাতে এখানে থাকব। কাল দেখা হইবে, ভালো থাকিস।’ বাবা প্রদীপ লালের সঙ্গে হওয়া শেষ কথা বলতে বারবার থমকে যাচ্ছিলেন দুলাল কুমার (২৪)। তাঁর চোখের কোণে জমে থাকা জল যেন আটকে ছিল বুকের ভেতরের হাহাকারে।

৪৫ বছরের প্রদীপ লাল ছিলেন এই পরিবারের সূর্যের মতো। যাঁর আলোয় সংসার চলত। নিজের বসতভিটা না থাকায় অন্যের জমিতে বানানো দুই কক্ষের ঘর, স্ত্রী, এক ছেলে ও দুই মেয়েকে নিয়ে ভালোবাসায় ভরা সংসার ছিল। সড়ক দুর্ঘটনায় ডান পা হারান পাঁচ বছর আগে। তবু হাল ছাড়েননি। ভ্যান চালিয়ে প্রতিদিন হাতে অল্প কিছু টাকা নিয়ে ক্লান্ত মুখে তৃপ্তির হাসি নিয়ে ঘরে ফিরতেন।

গতকাল শনিবার রাতে ভ্যান চালিয়ে মামাশ্বশুর রুপলালের বাড়ি যাওয়ার পথে তাঁর জীবন থেমে গেল এক অপবাদে। প্রদীপ লালের বাড়ি রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার গোপালপুর ছড়ান বালুয়া গ্রামে।

পরিবার সূত্রে জানা গেছে, বড় ছেলে দুলাল কুমার এসএসসির পর অভাবের কারণে লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়েছেন। তাঁর মেয়ে পলাশী রানী এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছেন। ছোট ছেলে আপন বাবু গোপালপুর দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। স্ত্রী দুলালী রানী সংসারে অভাব দূর করতে এবাড়ি-ওবাড়ি কাজ করেন।

দুলাল কুমার জানান, সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় মোবাইল ফোনে তাঁর সঙ্গে বাবা প্রদীপ লালের কথা হয়। তখন তিনি খামারে ঘাস কাটছিলেন। পরে রাত সাড়ে ৯টায় প্রদীপকে ফোন দিলে তাঁর ফোন বন্ধ পান। পরে খবর পেয়ে রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতালে যান। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আজ ভোরে তাঁর মৃত্যু হয়।

দুলাল কুমারের সঙ্গে তারাগঞ্জ থানায় আসা মিঠাপুকুরের মিলনপুর ইউনিয়নের (ইউপি) সদস্য ফুলবাবু বলেন, ‘প্রদীপ লালের বসতভিটাও নেই। অন্যের জমিতে বাড়ি করে ভ্যান চালিয়ে স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে জীবনযাপন করতেন। তাঁকে নির্মমভাবে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। সে প্রতিবন্ধী ভাতা পেত।’

পরিবার, পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র জানায়, মিঠাপুকুর উপজেলার শ্যামপুর এলাকার এক তরুণের সঙ্গে রুপলাল দাসের মেয়ের বিয়ে কথাবার্তা চলছিল। আজ রোববার বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক করার কথা ছিল।

এ জন্য মিঠাপুকুর থেকে নিজের ভ্যান চালিয়ে আত্মীয় রুপলাল দাসের বাড়ির উদ্দেশে রওনা হন প্রদীপ লাল। কিন্তু গ্রামের ভেতর দিয়ে রাস্তা না চেনায় প্রদীপ লাল সয়ার ইউনিয়নের কাজীরহাট এলাকায় এসে রুপলালকে ফোন করেন। রুপলাল সেখানে যান। তাঁরা দুজনে ভ্যানে চড়ে রুপলালের বাড়ি ঘনিরামপুর গ্রামের দিকে রওনা হন।

রাত ৯টার দিকে তারাগঞ্জ-কাজীরহাট সড়কের বটতলা এলাকায় পৌঁছালে ভ্যান চোর সন্দেহে তাঁদের দুজনকে আটকান স্থানীয় কয়েকজন। এরপর সেখানে লোক জড়ো হতে থাকে।

একপর্যায়ে স্থানীয় লোকজন প্রদীপ লালের ভ্যানে থাকা বস্তা থেকে চারটি প্লাস্টিকের বোতল বের করেন। সেগুলোতে চোলাই মদ ছিল বলে পরিবারের ভাষ্য। একটি বোতল খুললে ভেতরে থাকা তরলের ঘ্রাণে সেখানকার দুই ব্যক্তি অসুস্থতা বোধ করেন বলে জানান। এ ঘটনায় লোকজনের সন্দেহ আরও বাড়ে।

অজ্ঞান করে ভ্যান চুরি সন্দেহে তাঁদের মারধর শুরু করেন। বটতলা থেকে মারতে মারতে বুড়িরহাট উচ্চবিদ্যালয় মাঠে নিয়ে আসা হয় তাঁদের। মারধরের একপর্যায়ে অচেতন হলে সেখানে ফেলে রাখা হয়।

পরে রাত ১১টার দিকে তাঁদের উদ্ধার করে পুলিশ তারাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়। হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক রুপলাল দাসকে মৃত ঘোষণা করেন। প্রদীপ লাল রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আজ ভোরে মারা যান।

এ বিষয়ে তারাগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এম এ ফারুক বলেন, ‘নিহত রুপলালের স্ত্রী ভারতী রানী বাদী হয়ে ৫০০ থেকে ৭০০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেছেন। আমাদের তদন্ত কার্যক্রম চলছে। কিছু আলামত পেয়েছি, সেগুলো যাচাই বাছাই চলছে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

খালার সঙ্গে শত্রুতা মুহাম্মদ ইউনূসের, আমি ‘কোল্যাটারাল ড্যামেজ’: টিউলিপ সিদ্দিক

এনসিপি নেতার বাড়িতে কাফনের কাপড়, চিরকুটে লেখা—‘প্রস্তুত হ রাজাকার’

৪০ পুলিশ কর্মকর্তার পদক প্রত্যাহার, অর্থ ফেরতের নির্দেশ

গণশুনানিতে দুদক চেয়ারম্যানের প্রতি ক্ষোভ দেখালেন মৎস্যচাষি

যাচ্ছিলেন বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক করতে, গণপিটুনিতে প্রাণ হারালেন জামাই-শ্বশুর

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত