Ajker Patrika

মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র হাতে লড়েছিলেন বলেই কি জামিন পেলেন না অধ্যাপক আনোয়ারা

হুসাইন আহমদ
আপডেট : ০২ জুন ২০২৫, ১৫: ০৭
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আনোয়ারা বেগমকে বৃহস্পতিবার কারাগারে পাঠানো হয়। ঢাকার আদালত প্রাঙ্গণে। ছবি: সংগৃহীত
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আনোয়ারা বেগমকে বৃহস্পতিবার কারাগারে পাঠানো হয়। ঢাকার আদালত প্রাঙ্গণে। ছবি: সংগৃহীত

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক বীর মুক্তিযোদ্ধা ড. এস এম আনোয়ারা বেগমকে জামিন না দিয়ে কারাগারে পাঠানোর ঘটনায় ক্ষোভ ও বিস্ময় প্রকাশ করেছে মানবাধিকার সংগঠনসহ বিভিন্ন সচেতন মহল। জুলাই অভ্যুত্থানের সময়কার একটি মামলায় সন্দেহজনকভাবে তাঁকে জড়িয়ে গত ২৯ মে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত জামিন না দিয়ে কারাগারে পাঠান। অথচ একই ধরনের মামলায় জনপ্রিয় অভিনেত্রী নুসরাত ফারিয়া মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে জামিনে মুক্তি পান। ফলে প্রশ্ন উঠছে, সেলিব্রিটি অভিনেত্রী বলে জামিন, আর বয়স্ক মুক্তিযোদ্ধার জন্য কারাগার—এটা কেমন বিচার।

ড. আনোয়ারা বেগম ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন কিশোরী বয়সেই। ছোট বোন মনোয়ারা বেগমের সঙ্গে অস্ত্র হাতে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে। ঝুঁকি নিয়ে উদ্ধার করেছিলেন নির্যাতিত নারীদের। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে তিনি নিজেকে শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়োজিত করেন, দীর্ঘ ৩৫ বছরের কর্মজীবনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপনা করেন এবং পরবর্তী সময়ে পিএসসির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

তাঁর বিরুদ্ধে করা মামলা অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ১৯ জুলাই ঢাকার রায়সাহেব বাজার এলাকায় ছাত্রদলের এক নেতা গুলিবিদ্ধ হন। প্রায় সাত মাস পর ২০২৪ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি এই ঘটনায় মামলা করা হয়, যেখানে আনোয়ারা বেগমের নামও যুক্ত করা হয়। অভিযোগ অনুযায়ী, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের একজন’ হিসেবে হামলায় প্ররোচনা দেন।

একই ধরনের মামলায় অভিনেত্রী নুসরাত ফারিয়াকে ১৮ মে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁকে আদালতে হাজির করা হলে জামিন আবেদন ঝুলিয়ে রেখে আদালত তাঁকে কারাগারে পাঠান। বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। সংস্কৃতি অঙ্গনের বহু প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব এ নিয়ে সরব হন। সমালোচনার মুখে আদালত ধার্য করা শুনানির আগেই (২০ মে) তিনি জামিনে মুক্তি পান।

অন্যদিকে, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আনোয়ারা বেগমের জামিনের পক্ষে মানবিক, আইনি ও নৈতিক বহু যুক্তি থাকা সত্ত্বেও আদালত তাঁর জামিন আবেদন নামঞ্জুর করেন। তাঁর বিরুদ্ধে কোনো সহিংসতায় সরাসরি উপস্থিত থাকার প্রমাণ উপস্থাপিত হয়নি, এমনকি চার বছর ধরে তিনি অবসরে রয়েছেন এবং কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন বলেও জানান তাঁর আইনজীবীরা।

এই ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়ে হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশ (এইচআরএফবি) বলেছে, ‘৬৯ বছর বয়সী একজন নারী, যিনি মুক্তিযোদ্ধা এবং অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক—তাঁকে জামিন না দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে, এটা অত্যন্ত হতাশাজনক ও উদ্বেগজনক।’ অথচ, ফৌজদারি কার্যবিধি ৪৯৭ ধারা অনুযায়ী নারী ও বয়োবৃদ্ধদের জামিনের বিষয়টি আদালত বিবেচনায় নিতে পারেন।

সংগঠনটি আরও আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছে, ‘এই ধরনের মামলায় বাছবিচারহীনভাবে মানুষকে অভিযুক্ত ও গ্রেপ্তার করা হলে প্রকৃত অপরাধীদের বিচার প্রশ্নবিদ্ধ হবে এবং মামলাগুলো হয়রানিমূলক বলে মনে হতে পারে।’

আনোয়ারা বেগমের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু অভিযোগ থাকলেও সেগুলোর প্রকৃতি প্রশাসনিক আচরণের সঙ্গে সম্পর্কিত। এই অভিযোগগুলোর তদন্ত হওয়া উচিত নিরপেক্ষভাবে, তবে হত্যাচেষ্টা মামলায় তাঁর জড়িত থাকার অভিযোগকে অনেকে ‘অতিরঞ্জন’ বলে মনে করছেন।

বিশিষ্ট আইনজীবী সারা হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘বিচারব্যবস্থা যদি জনমত বা সামাজিক মিডিয়ার প্রতিক্রিয়ায় প্রভাবিত হয়, তাহলে তা ন্যায়বিচারের মৌলিক ধারণাকে বিপন্ন করে। কারা জামিন পাবেন আর কারা কারাগারে থাকবেন, সেটা যেন পরিচিতি বা প্রভাব দিয়ে নির্ধারিত না হয়।’

বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে নারীর অংশগ্রহণ ছিল অনস্বীকার্য। সেই ইতিহাসের এক বীর সৈনিককে স্বাধীন দেশের আদালতে জামিন না দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর পেরিয়ে এসে এমন ঘটনায় অনেকে হতাশা প্রকাশ করছেন। কেউ কেউ বলছেন, মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীনতা এনেছিলেন বলেই কি আজ এই হেনস্তা?

লেখক: সহকারী বার্তা সম্পাদক, আজকের পত্রিকা

আরও খবর পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত