চিররঞ্জন সরকার
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সভাপতি পদ যেন পরিণত হয়েছে এক অলিখিত বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে—যেখান থেকে বিরোধ, অভিযোগ আর অস্থিরতার যেন শেষ নেই। নাজমুল হাসান পাপনের দীর্ঘ শাসনের পর এলেন ফারুক আহমেদ, আর এবার আলোচনার কেন্দ্রে আমিনুল ইসলাম বুলবুল। প্রশ্ন জাগে, সত্যিই কি এই পদ মানুষকে বিগড়ে দেয়? নাকি এর ক্ষমতা ও দায়িত্ব এতটাই ভারী যে বিতর্কের সৃষ্টি অনিবার্য?
নাজমুল হাসান পাপন টানা ১১ বছর বিসিবির সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন। এই দীর্ঘ সময়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট কিছু সাফল্য অর্জন করলেও তাঁকে ঘিরে বিতর্কের ভান্ডারও ছিল সমৃদ্ধ। অর্থ কেলেঙ্কারি, স্বজনপ্রীতি এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে একক আধিপত্য—সব মিলিয়ে তাঁর শাসনকাল সব সময় আলোচনার কেন্দ্রে থেকেছে। কোচ নিয়োগ থেকে শুরু করে দল নির্বাচন—প্রতিটি স্তরে তাঁর অতিরিক্ত হস্তক্ষেপের অভিযোগ উঠেছে বারবার। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পাল্টে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর দেশত্যাগ ও পদত্যাগ এসব অভিযোগকে আরও জোরালো করে তোলে।
পাপনের বিদায়ের পর অন্তর্বর্তী সরকার ফারুক আহমেদকে বোর্ডের হাল ধরার দায়িত্ব দেয়। একজন অভিজ্ঞ ও ক্রিকেটপ্রেমী হিসেবে তাঁর আগমনকে অনেকে আশার আলো হিসেবে দেখেছিলেন। কিন্তু ছয় মাস না যেতেই তাঁর বিরুদ্ধেও অর্থ কেলেঙ্কারির গুরুতর অভিযোগ উঠে আসে। গুঞ্জন ছড়ায়, সরকারের শীর্ষ মহলের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েনই ছিল তাঁর বিদায়ের মূল কারণ। তাঁর এই স্বল্পস্থায়ী মেয়াদ আবারও বোর্ডের আর্থিক স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে, যা বিসিবির ভবিষ্যতের জন্য এক অশনিসংকেত।
বিসিবির সভাপতির পদটি নিছক একটি প্রশাসনিক পদ নয়। এটি দেশের ক্রীড়াঙ্গনে অত্যন্ত প্রভাবশালী ও ক্ষমতাধর একটি অবস্থান। এই পদের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে বিপুল পরিমাণ ক্ষমতা, আর্থিক সম্পদ এবং নীতিনির্ধারণের প্রভাব, যা একে শুধু ক্রীড়া প্রশাসনের নয়, একটি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তিকেন্দ্রে পরিণত করে।
এই বিপুল ক্ষমতা ও আর্থিক লেনদেনই অনেক সময় বিতর্ক ও সমালোচনার জন্ম দেয়। বিসিবির আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া প্রায়ই অস্বচ্ছ থেকে যায়, যার ফলে দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির সুযোগ তৈরি হয়। সভাপতি হিসেবে যিনি আসেন, তিনি কেবল একজন সংগঠক নন, তিনি হয়ে ওঠেন ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। ফলে ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের অভিযোগ বা প্রভাবশালী মহলের প্রভাব খাটানোর প্রবণতা দেখা যায়।
এ ছাড়া বিসিবির মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ রাজনৈতিক প্রভাবের বাইরে থাকে না। অনেক সময় সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ী সভাপতি নিয়োগ বা অপসারণের ঘটনা ঘটে, যা বোর্ডের স্বায়ত্তশাসন ও স্থিতিশীলতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। একই সঙ্গে জবাবদিহির ঘাটতির কারণে সভাপতির কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কোনো অনিয়ম হলেও তার যথাযথ প্রতিকার পাওয়া কঠিন হয়।
এই প্রশাসনিক বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত হয় ক্রিকেট দলের পারফরম্যান্সের ওঠানামা। বাংলাদেশ দল কখনো কখনো প্রতিভার ঝলক দেখালেও পারফরম্যান্সে ধারাবাহিকতার অভাব রয়েছে। ঘরোয়া টুর্নামেন্টে ভালো করা দল বা খেলোয়াড়েরা আন্তর্জাতিক মঞ্চে প্রায়ই হতাশ করেন। বিশেষ করে এশিয়া কাপ বা বিশ্বকাপের মতো বড় আসরে প্রত্যাশা তৈরি হলেও ফলাফল হতাশাজনক হয়। ক্রিকেট এখন বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত সমাজে সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলায় পরিণত হয়েছে, ফলে প্রত্যাশার চাপও অনেক বেশি।
যখন দল ভালো করে না, তখন শুধু খেলোয়াড়েরাই নয়, বোর্ড কর্মকর্তারাও সমালোচনার মুখে পড়েন। আর বোর্ডের সর্বোচ্চ ব্যক্তি হিসেবে সভাপতি তখন সহজেই জনরোষের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন। বলা যায়, এই পদে বসার সঙ্গে সঙ্গেই একজন ব্যক্তি যেমন বিপুল ক্ষমতা লাভ করেন, তেমনি তাঁকে বহন করতে হয় এক অদৃশ্য কিন্তু ভারী প্রত্যাশার বোঝা।
এবার বিসিবির নেতৃত্বে এসেছেন বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিয়ান, সাবেক অধিনায়ক আমিনুল ইসলাম বুলবুল। একজন সাবেক ক্রিকেটার হিসেবে তাঁর প্রতি জনমানুষের আস্থা ও প্রত্যাশার পরিমাণ বিশাল। তবে সেই প্রত্যাশার কারণে তাঁর সামনে চ্যালেঞ্জও পাহাড়সম। তিনি এমন এক সময় বোর্ডের দায়িত্ব নিয়েছেন, যখন আন্তর্জাতিক র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থা চরম হতাশাজনক। টি-টোয়েন্টি, ওয়ানডে কিংবা টেস্ট—কোনো ফরম্যাটেই বাংলাদেশ দল ভালো অবস্থানে নেই। এমনকি আফগানিস্তানের মতো অপেক্ষাকৃত নতুন দলও র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের ওপরে অবস্থান করছে। এই বাস্তবতায় দলকে ঘুরে দাঁড় করানো শুধু কঠিন নয়, প্রায় অসম্ভব এক কাজের নামান্তর।
এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বুলবুলের প্রথম কাজ হবে বোর্ডের প্রতি হারানো জন-আস্থা পুনরুদ্ধার করা। দীর্ঘদিনের অনিয়ম, স্বচ্ছতার অভাব ও বিতর্কিত সিদ্ধান্তের কারণে বিসিবি সাধারণ ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে একটি অবিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এই বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হলে বুলবুলকে দৃঢ়ভাবে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও নৈতিকতার প্রশ্নে আপসহীন থাকতে হবে। পাশাপাশি, বিগত সভাপতির আমলে যে অর্থনৈতিক নয়ছয়ের অভিযোগ উঠেছে, তার নিরপেক্ষ তদন্ত ও সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করাও তাঁর দায়িত্ব। এটা প্রমাণ করতে হবে যে তিনি দুর্নীতিকে কোনোভাবে প্রশ্রয় দেবেন না।
বুলবুলের আরেকটি বড় দায়িত্ব হবে বিসিবির ক্ষতবিক্ষত ভাবমূর্তি পুনর্গঠন করা। আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের ক্রিকেট প্রশাসন অনেক সময়ই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, কখনো স্বজনপ্রীতির অভিযোগে, কখনো রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে। তাই বিতর্ক থেকে সরে এসে তিনি যদি প্রকৃত ক্রিকেট উন্নয়নে মনোযোগ দিতে পারেন, তাহলেই বোর্ডের ভাবমূর্তি ধীরে ধীরে বদলাবে। এর জন্য প্রয়োজন হবে তৃণমূল থেকে শুরু করে জাতীয় দল পর্যন্ত, প্রতিটি স্তরে কার্যকর পরিকল্পনা এবং পেশাদার ব্যবস্থাপনা। এ কাজ করতে গিয়ে রাজনৈতিক চাপ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা তাঁর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে। তিনি যদি বোর্ডের সিদ্ধান্তগুলো কেবল ক্রিকেটের স্বার্থে নিতে পারেন, তবে বোর্ড সত্যিকার অর্থেই একটি পেশাদার ও স্বাধীন প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে পারবে।
তবে সবচেয়ে বড় বাস্তবতা হলো—বুলবুলের সময় খুবই সীমিত। সামনে বিসিবির নির্বাচন, আর তাঁর হাতে সময় মাত্র চার মাস। এই স্বল্প সময়ের মধ্যে তাঁকে এমন কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে হবে, যা অন্তত প্রমাণ করতে পারে যে তিনি একটি ভিন্নধারার নেতৃত্ব আনতে সক্ষম। তাঁর অতীত ক্রিকেট অভিজ্ঞতা ও আন্তর্জাতিক জ্ঞানের পাশাপাশি দরকার হবে দৃঢ় মানসিকতা, আপসহীন সততা এবং প্রতিটি সিদ্ধান্তে পেশাদারত্বের ছাপ।
এই মুহূর্তে বিসিবি বিশ্বের অন্যতম আয়সমৃদ্ধ বোর্ড। আইসিসির অনুদান, সম্প্রচার অধিকার, বিপিএলের আয় ও স্পনসরশিপ মিলিয়ে বোর্ডের বাৎসরিক বাজেট হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি। অথচ এই বিপুল অর্থ ব্যবস্থাপনার কোনো আধুনিক, কার্যকর বা স্বচ্ছ কাঠামো নেই। কোনো বার্ষিক অডিট রিপোর্ট জনসমক্ষে আসে না, টেন্ডার প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ, আর অর্থব্যয়ের পেছনে যুক্তি বা অগ্রাধিকারের স্পষ্টতা নেই। ফলে বিসিবি যেন টাকার দিক থেকে ধনী হলেও ব্যবস্থাপনার দিক থেকে একরকম দেউলিয়া প্রতিষ্ঠান। তাই কেবল নেতৃত্ব পরিবর্তন করলেই পরিবর্তন আসবে না—প্রয়োজন বিসিবির গোড়ায় কাঠামোগত সংস্কার।
এই সংস্কার আসতে পারে কয়েকটি মৌলিক পরিবর্তনের মাধ্যমে: একটি স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনী প্রক্রিয়া, যেখানে সত্যিকারের ক্রিকেট প্রতিনিধিরা বোর্ডে আসতে পারেন; সভাপতির ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, যাতে একটি ব্যক্তির ইচ্ছায় নয়, বরং একটি পেশাদার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বোর্ড পরিচালিত হয়; নিয়মিত আর্থিক অডিট ও প্রতিবেদন প্রকাশ; খেলোয়াড়দের বোর্ডে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা; এবং তৃণমূল, জেলা ও বিভাগীয় ক্রিকেটে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ। এসব বাস্তবায়ন করতে পারলেই কেবল বোর্ডের ভিত্তি মজবুত হবে এবং বাংলাদেশ ক্রিকেটও পাবে একটি স্থায়ী ও উন্নয়নমুখী দিকনির্দেশনা।
যদিও আমিনুল ইসলাম বুলবুল আপাতত অস্থায়ীভাবে এসেছেন, দেশের ক্রিকেটের এই সংকটকালে তাঁর মতো অভিজ্ঞ, পেশাদার ও সৎ নেতৃত্বেরই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। তাঁর ভেতরে সেই সম্ভাবনা রয়েছে—তিনি চাইলে এই চার মাসেই বোর্ডকে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দিতে পারেন। তিনি শুধু একটি সময়ের প্রতিনিধি নন—নিজ যোগ্যতায় হয়ে উঠতে পারেন বাংলাদেশের ক্রিকেটের ভবিষ্যতের রূপকার। বিসিবির সভাপতির চেয়ার অভিশপ্ত নয়, এটি অভিশপ্ত হয়ে উঠেছে কেবল ব্যক্তিনির্ভরতা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং জবাবদিহির অভাবে। এই কাঠামো যদি বদলানো যায়, নেতৃত্বও বদলাবে। এবং একদিন সেই নেতৃত্বই হয়তো আমাদের নিয়ে যাবে বিশ্ব ক্রিকেটের শীর্ষ চূড়ায়।
লেখক:–গবেষক ও কলামিস্ট
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সভাপতি পদ যেন পরিণত হয়েছে এক অলিখিত বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে—যেখান থেকে বিরোধ, অভিযোগ আর অস্থিরতার যেন শেষ নেই। নাজমুল হাসান পাপনের দীর্ঘ শাসনের পর এলেন ফারুক আহমেদ, আর এবার আলোচনার কেন্দ্রে আমিনুল ইসলাম বুলবুল। প্রশ্ন জাগে, সত্যিই কি এই পদ মানুষকে বিগড়ে দেয়? নাকি এর ক্ষমতা ও দায়িত্ব এতটাই ভারী যে বিতর্কের সৃষ্টি অনিবার্য?
নাজমুল হাসান পাপন টানা ১১ বছর বিসিবির সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন। এই দীর্ঘ সময়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট কিছু সাফল্য অর্জন করলেও তাঁকে ঘিরে বিতর্কের ভান্ডারও ছিল সমৃদ্ধ। অর্থ কেলেঙ্কারি, স্বজনপ্রীতি এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে একক আধিপত্য—সব মিলিয়ে তাঁর শাসনকাল সব সময় আলোচনার কেন্দ্রে থেকেছে। কোচ নিয়োগ থেকে শুরু করে দল নির্বাচন—প্রতিটি স্তরে তাঁর অতিরিক্ত হস্তক্ষেপের অভিযোগ উঠেছে বারবার। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পাল্টে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর দেশত্যাগ ও পদত্যাগ এসব অভিযোগকে আরও জোরালো করে তোলে।
পাপনের বিদায়ের পর অন্তর্বর্তী সরকার ফারুক আহমেদকে বোর্ডের হাল ধরার দায়িত্ব দেয়। একজন অভিজ্ঞ ও ক্রিকেটপ্রেমী হিসেবে তাঁর আগমনকে অনেকে আশার আলো হিসেবে দেখেছিলেন। কিন্তু ছয় মাস না যেতেই তাঁর বিরুদ্ধেও অর্থ কেলেঙ্কারির গুরুতর অভিযোগ উঠে আসে। গুঞ্জন ছড়ায়, সরকারের শীর্ষ মহলের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েনই ছিল তাঁর বিদায়ের মূল কারণ। তাঁর এই স্বল্পস্থায়ী মেয়াদ আবারও বোর্ডের আর্থিক স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে, যা বিসিবির ভবিষ্যতের জন্য এক অশনিসংকেত।
বিসিবির সভাপতির পদটি নিছক একটি প্রশাসনিক পদ নয়। এটি দেশের ক্রীড়াঙ্গনে অত্যন্ত প্রভাবশালী ও ক্ষমতাধর একটি অবস্থান। এই পদের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে বিপুল পরিমাণ ক্ষমতা, আর্থিক সম্পদ এবং নীতিনির্ধারণের প্রভাব, যা একে শুধু ক্রীড়া প্রশাসনের নয়, একটি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তিকেন্দ্রে পরিণত করে।
এই বিপুল ক্ষমতা ও আর্থিক লেনদেনই অনেক সময় বিতর্ক ও সমালোচনার জন্ম দেয়। বিসিবির আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া প্রায়ই অস্বচ্ছ থেকে যায়, যার ফলে দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির সুযোগ তৈরি হয়। সভাপতি হিসেবে যিনি আসেন, তিনি কেবল একজন সংগঠক নন, তিনি হয়ে ওঠেন ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। ফলে ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের অভিযোগ বা প্রভাবশালী মহলের প্রভাব খাটানোর প্রবণতা দেখা যায়।
এ ছাড়া বিসিবির মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ রাজনৈতিক প্রভাবের বাইরে থাকে না। অনেক সময় সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ী সভাপতি নিয়োগ বা অপসারণের ঘটনা ঘটে, যা বোর্ডের স্বায়ত্তশাসন ও স্থিতিশীলতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। একই সঙ্গে জবাবদিহির ঘাটতির কারণে সভাপতির কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কোনো অনিয়ম হলেও তার যথাযথ প্রতিকার পাওয়া কঠিন হয়।
এই প্রশাসনিক বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত হয় ক্রিকেট দলের পারফরম্যান্সের ওঠানামা। বাংলাদেশ দল কখনো কখনো প্রতিভার ঝলক দেখালেও পারফরম্যান্সে ধারাবাহিকতার অভাব রয়েছে। ঘরোয়া টুর্নামেন্টে ভালো করা দল বা খেলোয়াড়েরা আন্তর্জাতিক মঞ্চে প্রায়ই হতাশ করেন। বিশেষ করে এশিয়া কাপ বা বিশ্বকাপের মতো বড় আসরে প্রত্যাশা তৈরি হলেও ফলাফল হতাশাজনক হয়। ক্রিকেট এখন বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত সমাজে সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলায় পরিণত হয়েছে, ফলে প্রত্যাশার চাপও অনেক বেশি।
যখন দল ভালো করে না, তখন শুধু খেলোয়াড়েরাই নয়, বোর্ড কর্মকর্তারাও সমালোচনার মুখে পড়েন। আর বোর্ডের সর্বোচ্চ ব্যক্তি হিসেবে সভাপতি তখন সহজেই জনরোষের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন। বলা যায়, এই পদে বসার সঙ্গে সঙ্গেই একজন ব্যক্তি যেমন বিপুল ক্ষমতা লাভ করেন, তেমনি তাঁকে বহন করতে হয় এক অদৃশ্য কিন্তু ভারী প্রত্যাশার বোঝা।
এবার বিসিবির নেতৃত্বে এসেছেন বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিয়ান, সাবেক অধিনায়ক আমিনুল ইসলাম বুলবুল। একজন সাবেক ক্রিকেটার হিসেবে তাঁর প্রতি জনমানুষের আস্থা ও প্রত্যাশার পরিমাণ বিশাল। তবে সেই প্রত্যাশার কারণে তাঁর সামনে চ্যালেঞ্জও পাহাড়সম। তিনি এমন এক সময় বোর্ডের দায়িত্ব নিয়েছেন, যখন আন্তর্জাতিক র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থা চরম হতাশাজনক। টি-টোয়েন্টি, ওয়ানডে কিংবা টেস্ট—কোনো ফরম্যাটেই বাংলাদেশ দল ভালো অবস্থানে নেই। এমনকি আফগানিস্তানের মতো অপেক্ষাকৃত নতুন দলও র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের ওপরে অবস্থান করছে। এই বাস্তবতায় দলকে ঘুরে দাঁড় করানো শুধু কঠিন নয়, প্রায় অসম্ভব এক কাজের নামান্তর।
এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বুলবুলের প্রথম কাজ হবে বোর্ডের প্রতি হারানো জন-আস্থা পুনরুদ্ধার করা। দীর্ঘদিনের অনিয়ম, স্বচ্ছতার অভাব ও বিতর্কিত সিদ্ধান্তের কারণে বিসিবি সাধারণ ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে একটি অবিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এই বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হলে বুলবুলকে দৃঢ়ভাবে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও নৈতিকতার প্রশ্নে আপসহীন থাকতে হবে। পাশাপাশি, বিগত সভাপতির আমলে যে অর্থনৈতিক নয়ছয়ের অভিযোগ উঠেছে, তার নিরপেক্ষ তদন্ত ও সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করাও তাঁর দায়িত্ব। এটা প্রমাণ করতে হবে যে তিনি দুর্নীতিকে কোনোভাবে প্রশ্রয় দেবেন না।
বুলবুলের আরেকটি বড় দায়িত্ব হবে বিসিবির ক্ষতবিক্ষত ভাবমূর্তি পুনর্গঠন করা। আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের ক্রিকেট প্রশাসন অনেক সময়ই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, কখনো স্বজনপ্রীতির অভিযোগে, কখনো রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে। তাই বিতর্ক থেকে সরে এসে তিনি যদি প্রকৃত ক্রিকেট উন্নয়নে মনোযোগ দিতে পারেন, তাহলেই বোর্ডের ভাবমূর্তি ধীরে ধীরে বদলাবে। এর জন্য প্রয়োজন হবে তৃণমূল থেকে শুরু করে জাতীয় দল পর্যন্ত, প্রতিটি স্তরে কার্যকর পরিকল্পনা এবং পেশাদার ব্যবস্থাপনা। এ কাজ করতে গিয়ে রাজনৈতিক চাপ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা তাঁর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে। তিনি যদি বোর্ডের সিদ্ধান্তগুলো কেবল ক্রিকেটের স্বার্থে নিতে পারেন, তবে বোর্ড সত্যিকার অর্থেই একটি পেশাদার ও স্বাধীন প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে পারবে।
তবে সবচেয়ে বড় বাস্তবতা হলো—বুলবুলের সময় খুবই সীমিত। সামনে বিসিবির নির্বাচন, আর তাঁর হাতে সময় মাত্র চার মাস। এই স্বল্প সময়ের মধ্যে তাঁকে এমন কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে হবে, যা অন্তত প্রমাণ করতে পারে যে তিনি একটি ভিন্নধারার নেতৃত্ব আনতে সক্ষম। তাঁর অতীত ক্রিকেট অভিজ্ঞতা ও আন্তর্জাতিক জ্ঞানের পাশাপাশি দরকার হবে দৃঢ় মানসিকতা, আপসহীন সততা এবং প্রতিটি সিদ্ধান্তে পেশাদারত্বের ছাপ।
এই মুহূর্তে বিসিবি বিশ্বের অন্যতম আয়সমৃদ্ধ বোর্ড। আইসিসির অনুদান, সম্প্রচার অধিকার, বিপিএলের আয় ও স্পনসরশিপ মিলিয়ে বোর্ডের বাৎসরিক বাজেট হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি। অথচ এই বিপুল অর্থ ব্যবস্থাপনার কোনো আধুনিক, কার্যকর বা স্বচ্ছ কাঠামো নেই। কোনো বার্ষিক অডিট রিপোর্ট জনসমক্ষে আসে না, টেন্ডার প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ, আর অর্থব্যয়ের পেছনে যুক্তি বা অগ্রাধিকারের স্পষ্টতা নেই। ফলে বিসিবি যেন টাকার দিক থেকে ধনী হলেও ব্যবস্থাপনার দিক থেকে একরকম দেউলিয়া প্রতিষ্ঠান। তাই কেবল নেতৃত্ব পরিবর্তন করলেই পরিবর্তন আসবে না—প্রয়োজন বিসিবির গোড়ায় কাঠামোগত সংস্কার।
এই সংস্কার আসতে পারে কয়েকটি মৌলিক পরিবর্তনের মাধ্যমে: একটি স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনী প্রক্রিয়া, যেখানে সত্যিকারের ক্রিকেট প্রতিনিধিরা বোর্ডে আসতে পারেন; সভাপতির ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, যাতে একটি ব্যক্তির ইচ্ছায় নয়, বরং একটি পেশাদার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বোর্ড পরিচালিত হয়; নিয়মিত আর্থিক অডিট ও প্রতিবেদন প্রকাশ; খেলোয়াড়দের বোর্ডে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা; এবং তৃণমূল, জেলা ও বিভাগীয় ক্রিকেটে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ। এসব বাস্তবায়ন করতে পারলেই কেবল বোর্ডের ভিত্তি মজবুত হবে এবং বাংলাদেশ ক্রিকেটও পাবে একটি স্থায়ী ও উন্নয়নমুখী দিকনির্দেশনা।
যদিও আমিনুল ইসলাম বুলবুল আপাতত অস্থায়ীভাবে এসেছেন, দেশের ক্রিকেটের এই সংকটকালে তাঁর মতো অভিজ্ঞ, পেশাদার ও সৎ নেতৃত্বেরই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। তাঁর ভেতরে সেই সম্ভাবনা রয়েছে—তিনি চাইলে এই চার মাসেই বোর্ডকে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দিতে পারেন। তিনি শুধু একটি সময়ের প্রতিনিধি নন—নিজ যোগ্যতায় হয়ে উঠতে পারেন বাংলাদেশের ক্রিকেটের ভবিষ্যতের রূপকার। বিসিবির সভাপতির চেয়ার অভিশপ্ত নয়, এটি অভিশপ্ত হয়ে উঠেছে কেবল ব্যক্তিনির্ভরতা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং জবাবদিহির অভাবে। এই কাঠামো যদি বদলানো যায়, নেতৃত্বও বদলাবে। এবং একদিন সেই নেতৃত্বই হয়তো আমাদের নিয়ে যাবে বিশ্ব ক্রিকেটের শীর্ষ চূড়ায়।
লেখক:–গবেষক ও কলামিস্ট
পাবনার ঈশ্বরদী ও নাটোরের লালপুর এলাকা দুটি লাগোয়া। এই দুই এলাকার দুটি হাসপাতালে দিন দিন ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। ফলে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। হঠাৎ কেন ডায়রিয়ার প্রকোপ বেড়েছে, তা এখনো অজানা। তবে ব্যাপারটি দুশ্চিন্তার বটে। এ নিয়ে ২ জুন আজকের পত্রিকায় একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে ৭-এর পাতায়।
২১ ঘণ্টা আগেবাজেট নিয়ে এখন আর আগের মতো শোরগোল হয় না। কেউ মাথায় ছাতা রেখে টিভির সামনে বসে থাকেন না। সামাজিক মাধ্যমে দু-একটি চটকদার পোস্ট হয়, তারপর সেটিও থেমে যায়। অথচ বাজেট তো একটি রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক নকশা—কে কতটা পাবে, কে কতটা দেবে, কার ঘাড়ে কতটা চাপ বাড়বে, কার ঘরে ভাত-তরকারি থাকবে, কে থাকবে না খেয়ে।
২১ ঘণ্টা আগেচার দিনব্যাপী পাকিস্তান-ভারত সামরিক সংঘাতে পাকিস্তান শুধু নিজেকে সফলভাবে রক্ষা করতেই সক্ষম হয়নি, বরং পেহেলগামে সন্ত্রাসী ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় সামরিক সমাধান চাপিয়ে দেওয়ার ভারতের উদ্দেশ্যকেও ব্যর্থ করে দিয়েছে। পারমাণবিক যুদ্ধের সীমার নিচে প্রচলিত যুদ্ধের পরিসর বাড়ানোর ভারতীয় অপচেষ্টা সফল হয়নি।
২১ ঘণ্টা আগেগত কয়েক দশকের রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের আচার-আচরণ মোটের ওপর বিশ্লেষণ করলে মোটা দাগে বলা যায়, গত শতাব্দীর রাজনীতিবিদদের চেয়ে তাঁরা আলাদা বৈশিষ্ট্যের। রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের এই পরিবর্তনের কারণগুলো বিশ্লেষণ করা দরকার।
২ দিন আগে