ড. মইনুল ইসলাম

ব্রিকস হচ্ছে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার ইংরেজি আদ্যাক্ষর নিয়ে গঠিত সংস্থার নাম। সম্প্রতি রাশিয়ার কাজানে ব্রিকসের সম্মেলন সমাপ্ত হয়েছে। ব্রিকসের ১০ সদস্যদেশসহ মোট ৩৫টি দেশের প্রতিনিধিরা সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। সম্মেলনে ব্রিকসের সদস্যদেশগুলোর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ডলারের পরিবর্তে ব্রিকসের নিজস্ব মুদ্রা ব্যবহারের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে, যা বিশ্ববাণিজ্যে ডলারের আধিপত্য অনেকখানি খর্ব করবে। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর অর্থনীতির মালিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সাম্রাজ্যবাদী হাতিয়ার হলো মার্কিন ডলার। তৃতীয় বিশ্বের কোনো দেশের ডলারের নাগপাশ থেকে নিজেদের মুক্ত রাখার সুযোগ নেই। ১৯৪৭ সালে সৃষ্ট ইন্টারন্যাশনাল মনিটরি ফান্ডের (আইএমএফ) মাধ্যমে এই হাতিয়ারের জাল বিস্তার শুরু হয়েছিল এর পূর্ববর্তী ব্রিটিশ পাউন্ড-স্টার্লিংয়ের পরিবর্তে মার্কিন ডলারকে বিশ্বের যাবতীয় আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, বিনিয়োগ, মুদ্রা বিনিময় ও অর্থ লেনদেনের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ও বহুল ব্যবহৃত মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে। আইএমএফের সিস্টেমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একক গ্যারান্টির ভিত্তিতে ৩৫ ডলারে এক আউন্স সোনার দাম নির্ধারণ ও স্থিতিশীল রাখার মাধ্যমে এই ‘ফিক্সড এক্সচেঞ্জ রেট সিস্টেম’ চালু হয়েছিল। ১৯৭২ সাল পর্যন্ত আইএমএফের ফিক্সড এক্সচেঞ্জ রেট সিস্টেম কাজ করলেও বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকের শেষের দিকে ‘ডলার ক্রাইসিস বা গোল্ড ক্রাইসিস’-এর সময় সিস্টেমটা ভেঙে পড়ে।
স্বর্ণের দাম ওই সময় হু হু করে বাড়তে বাড়তে ১ আউন্স ৩০০ ডলার ছাড়িয়ে গেলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ডলারের দাম স্থিতিশীল রাখার দায়িত্ব পালনে অক্ষমতা প্রকাশ করে, যার ফলে আইএমএফের ‘ফিক্সড এক্সচেঞ্জ রেট সিস্টেম’ ভেস্তে যায়। এর পরিবর্তে চালু করা হয় ‘ফ্লোটিং এক্সচেঞ্জ রেট সিস্টেম’, যেখানে স্বর্ণের দাম এবং বিভিন্ন দেশের মুদ্রার বৈদেশিক দাম নির্ধারণ আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়। (২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ১ আউন্স স্বর্ণের দাম ২৬০০ ডলার ছাড়িয়ে গেছে)। গত ৫২ বছরে এই ‘কারেন্সি কেনাবেচার বাজারে’ মুদ্রা লেনদেন প্রতিদিন ৪ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাচ্ছে, যেখানে এক বছরে ‘ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট’ (এফডিআই) হয় ৮০০ বিলিয়ন ডলারের মতো। চলমান তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লবের কারণে আন্তর্জাতিক মুদ্রাবাজারের দক্ষতা আকাশচুম্বী হয়ে পড়ছে ক্রমেই। বিশ্ব মুদ্রাবাজারের সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য ১৯৭২ সাল থেকে ৫২ বছর ধরে বহাল রেখেছে মার্কিন ডলার।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিশ্বের জনগণ প্রায় পাঁচ কোটি মানুষের প্রাণহানিসহ যে ভয়াবহ ধ্বংসলীলার সম্মুখীন হয়েছিল, তার ফলে ঔপনিবেশিক কাঠামো পরিত্যাগ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়েছিল মনে করা হলেও প্রকৃতপক্ষে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে সাম্রাজ্যবাদ শুধু রূপ ও কৌশল পরিবর্তন করেছে, সাম্রাজ্যবাদ এখনো বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতির প্রধান নিয়ামক হিসেবে অটুট রয়ে গেছে। তৃতীয় বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ ১৯৪৫-৭৫ পর্বে সরাসরি ঔপনিবেশিক দখলদারি থেকে ভৌগোলিক স্বাধীনতা অর্জন করলেও সাম্রাজ্যবাদী-রাজনৈতিক আধিপত্য ও অর্থনৈতিক পরনির্ভরতার এক অবিচ্ছেদ্য জালে প্রায় সব দেশ ৭৯ বছর ধরে আটকা রয়েছে। বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের এই ‘আধিপত্য-পরনির্ভরতার’ জটাজালে সবচেয়ে ক্ষমতাধর অধিপতির ভূমিকা পালন করে চলেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যাদের বিশ্ব আধিপত্য (হেজিমনি) এখনো বহাল রয়েছে।
মার্কিনদের রপ্তানি আয় আমদানি ব্যয়ের চেয়ে প্রতিবছর অনেক কম হওয়ায় তাদের ব্যালেন্স অব পেমেন্টসের কারেন্ট অ্যাকাউন্টে নিয়মিতভাবে ঘাটতি সৃষ্টি হচ্ছে। অন্য কোনো দেশ এ রকম ঘাটতিতে পড়লে ওই দেশের মুদ্রার বৈদেশিক মানে ধস নামত, কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে একেবারেই ব্যতিক্রম। তাদের মুদ্রা ডলার যেহেতু বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের প্রধান অংশ, তাই কোনো দেশই চায় না ডলারের বৈদেশিক মানে ধস নামুক। উদাহরণ হিসেবে চীনের ব্যাপারটা উল্লেখ করা যেতে পারে: চীন এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের মালিক হওয়া সত্ত্বেও তারা নিজেদের মুদ্রাকে ডলারের সঙ্গে একটা স্থিতিশীল সম্পর্কে বহাল রাখতে চায়। নয়তো একদিকে তাদের কাছে ডলারের যে বিশাল মজুত রয়েছে, তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, অন্যদিকে তাদের রপ্তানি পণ্যের প্রতিযোগিতা-সক্ষমতা ক্ষুণ্ন হবে। বিশ্বের সবচেয়ে ঋণগ্রস্ত দেশ হয়েও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনো বিশ্বের অর্থনৈতিক আধিপত্য অক্ষুণ্ন রাখতে সমর্থ হচ্ছে মার্কিন ডলারের এই ‘আনচ্যালেঞ্জড হেজিমনি’র কারণে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের মুদ্রা টাকার বৈদেশিক মান ডলার-প্রতি অফিশিয়ালি ৪.৭৬ টাকা হলেও আনঅফিশিয়ালি ছিল ১৫ টাকা। এখন ১ ডলারের বাজার দাম বাংলাদেশ ব্যাংক-নির্ধারিত বাজারে ১২০ টাকা, আর কার্ব মার্কেটে প্রতি ডলার বিক্রি হয় ১২৩ টাকায়।
গত তিন বছরে ডলারের তুলনায় টাকার বৈদেশিক মান ৪২ শতাংশের বেশি অবচয়ন হয়েছে। এর ফলে আমাদের অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি বিপজ্জনকভাবে বেড়ে গেছে এবং আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও বড়সড় ধস নেমেছে। অথচ আমরা এখনো ‘ফ্রিলি-ফ্লোটিং এক্সচেঞ্জ রেট সিস্টেম’ চালু করিনি, ক্যাপিটাল অ্যাকাউন্টে টাকা এখনো অবাধে বিনিময়যোগ্য করা হয়নি। আমরা ‘ক্রলিং পেগ’ নীতি অনুসরণ করছি ডলারের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে। তবু এ ক্ষেত্রে ডলারের দাম টাকার অঙ্কে ক্রমে আরও বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা বিদ্যমান। ডলারের দামকে স্থিতিশীল রাখার জন্য সব দেশের সরকার সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে প্রয়াস জারি রাখা সত্ত্বেও দিন দিন ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার এই প্রক্রিয়াকে থামাতে অসমর্থ হচ্ছে প্রায় সব দেশ। (পাকিস্তানে ১ ডলারের দাম এখন ২৮০ রুপির আশপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে, যার ফলে পাকিস্তানের মূল্যস্ফীতির হার এখন ৩০ শতাংশে পৌঁছে গেছে)।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ এজেন্ট আইএমএফ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর ওপর সার্বক্ষণিক চাপ অব্যাহত রেখে চলেছে ক্রমেই ডলারের দাম দেশীয় মুদ্রায় বাড়ানোর ব্যাপারে। তাদের মতে সব তৃতীয় বিশ্বের দেশে ডলারের তুলনায় মুদ্রাগুলো ‘অতিমূল্যায়িত’ রয়ে যাচ্ছে, তাই মুদ্রার অবচয়ন (ডেপ্রিসিয়েশন) আইএমএফের প্রধান দাবিগুলোর মধ্যে সব সময় অন্তর্ভুক্ত থাকে। আইএমএফের এই দাবি মার্কিন ডলারকে মদদ দেওয়ার জন্য। ব্রিকস সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে মার্কিন ডলারের বিশ্ব আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করার প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করেছে। ব্রিকস দেশগুলোর সম্মিলিত জিডিপি এখন বিশ্বের মোট জিডিপির ৪৭ শতাংশে পৌঁছে গেছে এবং এই অনুপাত ক্রমবর্ধমান। বিশ্বের জনসংখ্যার ৫৭ শতাংশ ব্রিকসের সদস্যদেশগুলোর অধিবাসী। এবারের কাজান সম্মেলনে আরও ১৩টি দেশকে ব্রিকসের ‘পার্টনার কান্ট্রি’ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। মনে হচ্ছে, আগামী এক দশকে ডলারের বিশ্ব আধিপত্য খর্ব হয়ে যাবে।
আমরা অনেকেই খেয়াল করি না যে বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি পুঁজি পাচার হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। বিশ্বের সব দেশের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের কাছে অভিবাসনের স্বর্গরাজ্য বিবেচিত হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর যে ১৪-১৫ বিলিয়ন ডলার চারটি প্রধান প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে বলে ধারণা করা হয়, সেগুলোরও প্রধান গন্তব্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এই চারটি প্রক্রিয়া হলো: ১) আমদানিতে ওভারইনভয়েসিং, ২) রপ্তানিতে আন্ডারইনভয়েসিং, ৩) রপ্তানি আয় দেশে ফেরত না আনা এবং ৪) হুন্ডি পদ্ধতিতে প্রবাসীদের রেমিট্যান্সের বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে রেখে দিয়ে তার বিনিময়ে দেশের পুঁজি পাচারকারীরা হুন্ডিওয়ালাদের কাছে সমপরিমাণ টাকা পরিশোধ করে সহজেই অর্থ পাচার সম্পন্ন করা।
সাবেক হাসিনা সরকারের আমলে এই হুন্ডি প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বেশি ব্যাংকের ঋণ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছিল এবং প্রথমোক্ত তিনটি প্রক্রিয়ার তুলনায় ওই সময় হুন্ডি পদ্ধতিতে অর্থ পাচার সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত প্রক্রিয়ায় পরিণত হয়েছিল। গত ২ নভেম্বর টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান দাবি করেছেন যে গত ১০ বছরের প্রত্যেক বছর বিভিন্ন পন্থায় বিদেশে ১২ বিলিয়ন ডলার থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়ে গেছে। অর্থনীতির ওপর শ্বেতপত্র প্রণয়নের জন্য গঠিত কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের মতে, বিগত সরকারের শেষের দিকে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ১৬ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়ে গেছে। এর মানে, পূর্বের যেকোনো সময়ের তুলনায় বাংলাদেশ এখন ডলার-সাম্রাজ্যবাদের অনেক বড় শিকারে পরিণত হয়েছে, যেটাকে সাবেক সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে লাই দিয়েছে। ডলারের এহেন দ্বৈত বাজার এ দেশের অর্থনীতিতে ব্ল্যাক-ইকোনমির প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দখল করে ফেলেছে। পতিত স্বৈরশাসক হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশ ব্রিকসের সদস্য হওয়ার জন্য আগ্রহী হলেও সফল হয়নি। এখন ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার যেহেতু মার্কিনপন্থী সরকার, তাই এখন বাংলাদেশ ব্রিকসের ব্যাপারে হয়তো কোনো আগ্রহ দেখাবে না। তবে এটুকু বলতেই হবে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিশ্ব আধিপত্য খর্ব করে ভবিষ্যতে যদি ব্রিকস একটি ‘মাল্টি-পোলার ওয়ার্ল্ড’ গড়ে তুলতে পারে, তাহলে একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশও ‘ডলার সাম্রাজ্যবাদের’ একটি বিকল্প খুঁজে পাবে।

ব্রিকস হচ্ছে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার ইংরেজি আদ্যাক্ষর নিয়ে গঠিত সংস্থার নাম। সম্প্রতি রাশিয়ার কাজানে ব্রিকসের সম্মেলন সমাপ্ত হয়েছে। ব্রিকসের ১০ সদস্যদেশসহ মোট ৩৫টি দেশের প্রতিনিধিরা সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। সম্মেলনে ব্রিকসের সদস্যদেশগুলোর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ডলারের পরিবর্তে ব্রিকসের নিজস্ব মুদ্রা ব্যবহারের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে, যা বিশ্ববাণিজ্যে ডলারের আধিপত্য অনেকখানি খর্ব করবে। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর অর্থনীতির মালিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সাম্রাজ্যবাদী হাতিয়ার হলো মার্কিন ডলার। তৃতীয় বিশ্বের কোনো দেশের ডলারের নাগপাশ থেকে নিজেদের মুক্ত রাখার সুযোগ নেই। ১৯৪৭ সালে সৃষ্ট ইন্টারন্যাশনাল মনিটরি ফান্ডের (আইএমএফ) মাধ্যমে এই হাতিয়ারের জাল বিস্তার শুরু হয়েছিল এর পূর্ববর্তী ব্রিটিশ পাউন্ড-স্টার্লিংয়ের পরিবর্তে মার্কিন ডলারকে বিশ্বের যাবতীয় আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, বিনিয়োগ, মুদ্রা বিনিময় ও অর্থ লেনদেনের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ও বহুল ব্যবহৃত মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে। আইএমএফের সিস্টেমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একক গ্যারান্টির ভিত্তিতে ৩৫ ডলারে এক আউন্স সোনার দাম নির্ধারণ ও স্থিতিশীল রাখার মাধ্যমে এই ‘ফিক্সড এক্সচেঞ্জ রেট সিস্টেম’ চালু হয়েছিল। ১৯৭২ সাল পর্যন্ত আইএমএফের ফিক্সড এক্সচেঞ্জ রেট সিস্টেম কাজ করলেও বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকের শেষের দিকে ‘ডলার ক্রাইসিস বা গোল্ড ক্রাইসিস’-এর সময় সিস্টেমটা ভেঙে পড়ে।
স্বর্ণের দাম ওই সময় হু হু করে বাড়তে বাড়তে ১ আউন্স ৩০০ ডলার ছাড়িয়ে গেলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ডলারের দাম স্থিতিশীল রাখার দায়িত্ব পালনে অক্ষমতা প্রকাশ করে, যার ফলে আইএমএফের ‘ফিক্সড এক্সচেঞ্জ রেট সিস্টেম’ ভেস্তে যায়। এর পরিবর্তে চালু করা হয় ‘ফ্লোটিং এক্সচেঞ্জ রেট সিস্টেম’, যেখানে স্বর্ণের দাম এবং বিভিন্ন দেশের মুদ্রার বৈদেশিক দাম নির্ধারণ আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়। (২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ১ আউন্স স্বর্ণের দাম ২৬০০ ডলার ছাড়িয়ে গেছে)। গত ৫২ বছরে এই ‘কারেন্সি কেনাবেচার বাজারে’ মুদ্রা লেনদেন প্রতিদিন ৪ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাচ্ছে, যেখানে এক বছরে ‘ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট’ (এফডিআই) হয় ৮০০ বিলিয়ন ডলারের মতো। চলমান তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লবের কারণে আন্তর্জাতিক মুদ্রাবাজারের দক্ষতা আকাশচুম্বী হয়ে পড়ছে ক্রমেই। বিশ্ব মুদ্রাবাজারের সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য ১৯৭২ সাল থেকে ৫২ বছর ধরে বহাল রেখেছে মার্কিন ডলার।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিশ্বের জনগণ প্রায় পাঁচ কোটি মানুষের প্রাণহানিসহ যে ভয়াবহ ধ্বংসলীলার সম্মুখীন হয়েছিল, তার ফলে ঔপনিবেশিক কাঠামো পরিত্যাগ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়েছিল মনে করা হলেও প্রকৃতপক্ষে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে সাম্রাজ্যবাদ শুধু রূপ ও কৌশল পরিবর্তন করেছে, সাম্রাজ্যবাদ এখনো বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতির প্রধান নিয়ামক হিসেবে অটুট রয়ে গেছে। তৃতীয় বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ ১৯৪৫-৭৫ পর্বে সরাসরি ঔপনিবেশিক দখলদারি থেকে ভৌগোলিক স্বাধীনতা অর্জন করলেও সাম্রাজ্যবাদী-রাজনৈতিক আধিপত্য ও অর্থনৈতিক পরনির্ভরতার এক অবিচ্ছেদ্য জালে প্রায় সব দেশ ৭৯ বছর ধরে আটকা রয়েছে। বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের এই ‘আধিপত্য-পরনির্ভরতার’ জটাজালে সবচেয়ে ক্ষমতাধর অধিপতির ভূমিকা পালন করে চলেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যাদের বিশ্ব আধিপত্য (হেজিমনি) এখনো বহাল রয়েছে।
মার্কিনদের রপ্তানি আয় আমদানি ব্যয়ের চেয়ে প্রতিবছর অনেক কম হওয়ায় তাদের ব্যালেন্স অব পেমেন্টসের কারেন্ট অ্যাকাউন্টে নিয়মিতভাবে ঘাটতি সৃষ্টি হচ্ছে। অন্য কোনো দেশ এ রকম ঘাটতিতে পড়লে ওই দেশের মুদ্রার বৈদেশিক মানে ধস নামত, কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে একেবারেই ব্যতিক্রম। তাদের মুদ্রা ডলার যেহেতু বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের প্রধান অংশ, তাই কোনো দেশই চায় না ডলারের বৈদেশিক মানে ধস নামুক। উদাহরণ হিসেবে চীনের ব্যাপারটা উল্লেখ করা যেতে পারে: চীন এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের মালিক হওয়া সত্ত্বেও তারা নিজেদের মুদ্রাকে ডলারের সঙ্গে একটা স্থিতিশীল সম্পর্কে বহাল রাখতে চায়। নয়তো একদিকে তাদের কাছে ডলারের যে বিশাল মজুত রয়েছে, তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, অন্যদিকে তাদের রপ্তানি পণ্যের প্রতিযোগিতা-সক্ষমতা ক্ষুণ্ন হবে। বিশ্বের সবচেয়ে ঋণগ্রস্ত দেশ হয়েও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনো বিশ্বের অর্থনৈতিক আধিপত্য অক্ষুণ্ন রাখতে সমর্থ হচ্ছে মার্কিন ডলারের এই ‘আনচ্যালেঞ্জড হেজিমনি’র কারণে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের মুদ্রা টাকার বৈদেশিক মান ডলার-প্রতি অফিশিয়ালি ৪.৭৬ টাকা হলেও আনঅফিশিয়ালি ছিল ১৫ টাকা। এখন ১ ডলারের বাজার দাম বাংলাদেশ ব্যাংক-নির্ধারিত বাজারে ১২০ টাকা, আর কার্ব মার্কেটে প্রতি ডলার বিক্রি হয় ১২৩ টাকায়।
গত তিন বছরে ডলারের তুলনায় টাকার বৈদেশিক মান ৪২ শতাংশের বেশি অবচয়ন হয়েছে। এর ফলে আমাদের অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি বিপজ্জনকভাবে বেড়ে গেছে এবং আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও বড়সড় ধস নেমেছে। অথচ আমরা এখনো ‘ফ্রিলি-ফ্লোটিং এক্সচেঞ্জ রেট সিস্টেম’ চালু করিনি, ক্যাপিটাল অ্যাকাউন্টে টাকা এখনো অবাধে বিনিময়যোগ্য করা হয়নি। আমরা ‘ক্রলিং পেগ’ নীতি অনুসরণ করছি ডলারের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে। তবু এ ক্ষেত্রে ডলারের দাম টাকার অঙ্কে ক্রমে আরও বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা বিদ্যমান। ডলারের দামকে স্থিতিশীল রাখার জন্য সব দেশের সরকার সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে প্রয়াস জারি রাখা সত্ত্বেও দিন দিন ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার এই প্রক্রিয়াকে থামাতে অসমর্থ হচ্ছে প্রায় সব দেশ। (পাকিস্তানে ১ ডলারের দাম এখন ২৮০ রুপির আশপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে, যার ফলে পাকিস্তানের মূল্যস্ফীতির হার এখন ৩০ শতাংশে পৌঁছে গেছে)।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ এজেন্ট আইএমএফ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর ওপর সার্বক্ষণিক চাপ অব্যাহত রেখে চলেছে ক্রমেই ডলারের দাম দেশীয় মুদ্রায় বাড়ানোর ব্যাপারে। তাদের মতে সব তৃতীয় বিশ্বের দেশে ডলারের তুলনায় মুদ্রাগুলো ‘অতিমূল্যায়িত’ রয়ে যাচ্ছে, তাই মুদ্রার অবচয়ন (ডেপ্রিসিয়েশন) আইএমএফের প্রধান দাবিগুলোর মধ্যে সব সময় অন্তর্ভুক্ত থাকে। আইএমএফের এই দাবি মার্কিন ডলারকে মদদ দেওয়ার জন্য। ব্রিকস সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে মার্কিন ডলারের বিশ্ব আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করার প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করেছে। ব্রিকস দেশগুলোর সম্মিলিত জিডিপি এখন বিশ্বের মোট জিডিপির ৪৭ শতাংশে পৌঁছে গেছে এবং এই অনুপাত ক্রমবর্ধমান। বিশ্বের জনসংখ্যার ৫৭ শতাংশ ব্রিকসের সদস্যদেশগুলোর অধিবাসী। এবারের কাজান সম্মেলনে আরও ১৩টি দেশকে ব্রিকসের ‘পার্টনার কান্ট্রি’ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। মনে হচ্ছে, আগামী এক দশকে ডলারের বিশ্ব আধিপত্য খর্ব হয়ে যাবে।
আমরা অনেকেই খেয়াল করি না যে বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি পুঁজি পাচার হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। বিশ্বের সব দেশের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের কাছে অভিবাসনের স্বর্গরাজ্য বিবেচিত হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর যে ১৪-১৫ বিলিয়ন ডলার চারটি প্রধান প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে বলে ধারণা করা হয়, সেগুলোরও প্রধান গন্তব্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এই চারটি প্রক্রিয়া হলো: ১) আমদানিতে ওভারইনভয়েসিং, ২) রপ্তানিতে আন্ডারইনভয়েসিং, ৩) রপ্তানি আয় দেশে ফেরত না আনা এবং ৪) হুন্ডি পদ্ধতিতে প্রবাসীদের রেমিট্যান্সের বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে রেখে দিয়ে তার বিনিময়ে দেশের পুঁজি পাচারকারীরা হুন্ডিওয়ালাদের কাছে সমপরিমাণ টাকা পরিশোধ করে সহজেই অর্থ পাচার সম্পন্ন করা।
সাবেক হাসিনা সরকারের আমলে এই হুন্ডি প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বেশি ব্যাংকের ঋণ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছিল এবং প্রথমোক্ত তিনটি প্রক্রিয়ার তুলনায় ওই সময় হুন্ডি পদ্ধতিতে অর্থ পাচার সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত প্রক্রিয়ায় পরিণত হয়েছিল। গত ২ নভেম্বর টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান দাবি করেছেন যে গত ১০ বছরের প্রত্যেক বছর বিভিন্ন পন্থায় বিদেশে ১২ বিলিয়ন ডলার থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়ে গেছে। অর্থনীতির ওপর শ্বেতপত্র প্রণয়নের জন্য গঠিত কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের মতে, বিগত সরকারের শেষের দিকে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ১৬ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়ে গেছে। এর মানে, পূর্বের যেকোনো সময়ের তুলনায় বাংলাদেশ এখন ডলার-সাম্রাজ্যবাদের অনেক বড় শিকারে পরিণত হয়েছে, যেটাকে সাবেক সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে লাই দিয়েছে। ডলারের এহেন দ্বৈত বাজার এ দেশের অর্থনীতিতে ব্ল্যাক-ইকোনমির প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দখল করে ফেলেছে। পতিত স্বৈরশাসক হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশ ব্রিকসের সদস্য হওয়ার জন্য আগ্রহী হলেও সফল হয়নি। এখন ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার যেহেতু মার্কিনপন্থী সরকার, তাই এখন বাংলাদেশ ব্রিকসের ব্যাপারে হয়তো কোনো আগ্রহ দেখাবে না। তবে এটুকু বলতেই হবে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিশ্ব আধিপত্য খর্ব করে ভবিষ্যতে যদি ব্রিকস একটি ‘মাল্টি-পোলার ওয়ার্ল্ড’ গড়ে তুলতে পারে, তাহলে একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশও ‘ডলার সাম্রাজ্যবাদের’ একটি বিকল্প খুঁজে পাবে।
ড. মইনুল ইসলাম

ব্রিকস হচ্ছে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার ইংরেজি আদ্যাক্ষর নিয়ে গঠিত সংস্থার নাম। সম্প্রতি রাশিয়ার কাজানে ব্রিকসের সম্মেলন সমাপ্ত হয়েছে। ব্রিকসের ১০ সদস্যদেশসহ মোট ৩৫টি দেশের প্রতিনিধিরা সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। সম্মেলনে ব্রিকসের সদস্যদেশগুলোর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ডলারের পরিবর্তে ব্রিকসের নিজস্ব মুদ্রা ব্যবহারের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে, যা বিশ্ববাণিজ্যে ডলারের আধিপত্য অনেকখানি খর্ব করবে। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর অর্থনীতির মালিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সাম্রাজ্যবাদী হাতিয়ার হলো মার্কিন ডলার। তৃতীয় বিশ্বের কোনো দেশের ডলারের নাগপাশ থেকে নিজেদের মুক্ত রাখার সুযোগ নেই। ১৯৪৭ সালে সৃষ্ট ইন্টারন্যাশনাল মনিটরি ফান্ডের (আইএমএফ) মাধ্যমে এই হাতিয়ারের জাল বিস্তার শুরু হয়েছিল এর পূর্ববর্তী ব্রিটিশ পাউন্ড-স্টার্লিংয়ের পরিবর্তে মার্কিন ডলারকে বিশ্বের যাবতীয় আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, বিনিয়োগ, মুদ্রা বিনিময় ও অর্থ লেনদেনের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ও বহুল ব্যবহৃত মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে। আইএমএফের সিস্টেমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একক গ্যারান্টির ভিত্তিতে ৩৫ ডলারে এক আউন্স সোনার দাম নির্ধারণ ও স্থিতিশীল রাখার মাধ্যমে এই ‘ফিক্সড এক্সচেঞ্জ রেট সিস্টেম’ চালু হয়েছিল। ১৯৭২ সাল পর্যন্ত আইএমএফের ফিক্সড এক্সচেঞ্জ রেট সিস্টেম কাজ করলেও বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকের শেষের দিকে ‘ডলার ক্রাইসিস বা গোল্ড ক্রাইসিস’-এর সময় সিস্টেমটা ভেঙে পড়ে।
স্বর্ণের দাম ওই সময় হু হু করে বাড়তে বাড়তে ১ আউন্স ৩০০ ডলার ছাড়িয়ে গেলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ডলারের দাম স্থিতিশীল রাখার দায়িত্ব পালনে অক্ষমতা প্রকাশ করে, যার ফলে আইএমএফের ‘ফিক্সড এক্সচেঞ্জ রেট সিস্টেম’ ভেস্তে যায়। এর পরিবর্তে চালু করা হয় ‘ফ্লোটিং এক্সচেঞ্জ রেট সিস্টেম’, যেখানে স্বর্ণের দাম এবং বিভিন্ন দেশের মুদ্রার বৈদেশিক দাম নির্ধারণ আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়। (২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ১ আউন্স স্বর্ণের দাম ২৬০০ ডলার ছাড়িয়ে গেছে)। গত ৫২ বছরে এই ‘কারেন্সি কেনাবেচার বাজারে’ মুদ্রা লেনদেন প্রতিদিন ৪ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাচ্ছে, যেখানে এক বছরে ‘ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট’ (এফডিআই) হয় ৮০০ বিলিয়ন ডলারের মতো। চলমান তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লবের কারণে আন্তর্জাতিক মুদ্রাবাজারের দক্ষতা আকাশচুম্বী হয়ে পড়ছে ক্রমেই। বিশ্ব মুদ্রাবাজারের সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য ১৯৭২ সাল থেকে ৫২ বছর ধরে বহাল রেখেছে মার্কিন ডলার।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিশ্বের জনগণ প্রায় পাঁচ কোটি মানুষের প্রাণহানিসহ যে ভয়াবহ ধ্বংসলীলার সম্মুখীন হয়েছিল, তার ফলে ঔপনিবেশিক কাঠামো পরিত্যাগ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়েছিল মনে করা হলেও প্রকৃতপক্ষে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে সাম্রাজ্যবাদ শুধু রূপ ও কৌশল পরিবর্তন করেছে, সাম্রাজ্যবাদ এখনো বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতির প্রধান নিয়ামক হিসেবে অটুট রয়ে গেছে। তৃতীয় বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ ১৯৪৫-৭৫ পর্বে সরাসরি ঔপনিবেশিক দখলদারি থেকে ভৌগোলিক স্বাধীনতা অর্জন করলেও সাম্রাজ্যবাদী-রাজনৈতিক আধিপত্য ও অর্থনৈতিক পরনির্ভরতার এক অবিচ্ছেদ্য জালে প্রায় সব দেশ ৭৯ বছর ধরে আটকা রয়েছে। বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের এই ‘আধিপত্য-পরনির্ভরতার’ জটাজালে সবচেয়ে ক্ষমতাধর অধিপতির ভূমিকা পালন করে চলেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যাদের বিশ্ব আধিপত্য (হেজিমনি) এখনো বহাল রয়েছে।
মার্কিনদের রপ্তানি আয় আমদানি ব্যয়ের চেয়ে প্রতিবছর অনেক কম হওয়ায় তাদের ব্যালেন্স অব পেমেন্টসের কারেন্ট অ্যাকাউন্টে নিয়মিতভাবে ঘাটতি সৃষ্টি হচ্ছে। অন্য কোনো দেশ এ রকম ঘাটতিতে পড়লে ওই দেশের মুদ্রার বৈদেশিক মানে ধস নামত, কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে একেবারেই ব্যতিক্রম। তাদের মুদ্রা ডলার যেহেতু বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের প্রধান অংশ, তাই কোনো দেশই চায় না ডলারের বৈদেশিক মানে ধস নামুক। উদাহরণ হিসেবে চীনের ব্যাপারটা উল্লেখ করা যেতে পারে: চীন এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের মালিক হওয়া সত্ত্বেও তারা নিজেদের মুদ্রাকে ডলারের সঙ্গে একটা স্থিতিশীল সম্পর্কে বহাল রাখতে চায়। নয়তো একদিকে তাদের কাছে ডলারের যে বিশাল মজুত রয়েছে, তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, অন্যদিকে তাদের রপ্তানি পণ্যের প্রতিযোগিতা-সক্ষমতা ক্ষুণ্ন হবে। বিশ্বের সবচেয়ে ঋণগ্রস্ত দেশ হয়েও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনো বিশ্বের অর্থনৈতিক আধিপত্য অক্ষুণ্ন রাখতে সমর্থ হচ্ছে মার্কিন ডলারের এই ‘আনচ্যালেঞ্জড হেজিমনি’র কারণে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের মুদ্রা টাকার বৈদেশিক মান ডলার-প্রতি অফিশিয়ালি ৪.৭৬ টাকা হলেও আনঅফিশিয়ালি ছিল ১৫ টাকা। এখন ১ ডলারের বাজার দাম বাংলাদেশ ব্যাংক-নির্ধারিত বাজারে ১২০ টাকা, আর কার্ব মার্কেটে প্রতি ডলার বিক্রি হয় ১২৩ টাকায়।
গত তিন বছরে ডলারের তুলনায় টাকার বৈদেশিক মান ৪২ শতাংশের বেশি অবচয়ন হয়েছে। এর ফলে আমাদের অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি বিপজ্জনকভাবে বেড়ে গেছে এবং আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও বড়সড় ধস নেমেছে। অথচ আমরা এখনো ‘ফ্রিলি-ফ্লোটিং এক্সচেঞ্জ রেট সিস্টেম’ চালু করিনি, ক্যাপিটাল অ্যাকাউন্টে টাকা এখনো অবাধে বিনিময়যোগ্য করা হয়নি। আমরা ‘ক্রলিং পেগ’ নীতি অনুসরণ করছি ডলারের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে। তবু এ ক্ষেত্রে ডলারের দাম টাকার অঙ্কে ক্রমে আরও বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা বিদ্যমান। ডলারের দামকে স্থিতিশীল রাখার জন্য সব দেশের সরকার সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে প্রয়াস জারি রাখা সত্ত্বেও দিন দিন ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার এই প্রক্রিয়াকে থামাতে অসমর্থ হচ্ছে প্রায় সব দেশ। (পাকিস্তানে ১ ডলারের দাম এখন ২৮০ রুপির আশপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে, যার ফলে পাকিস্তানের মূল্যস্ফীতির হার এখন ৩০ শতাংশে পৌঁছে গেছে)।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ এজেন্ট আইএমএফ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর ওপর সার্বক্ষণিক চাপ অব্যাহত রেখে চলেছে ক্রমেই ডলারের দাম দেশীয় মুদ্রায় বাড়ানোর ব্যাপারে। তাদের মতে সব তৃতীয় বিশ্বের দেশে ডলারের তুলনায় মুদ্রাগুলো ‘অতিমূল্যায়িত’ রয়ে যাচ্ছে, তাই মুদ্রার অবচয়ন (ডেপ্রিসিয়েশন) আইএমএফের প্রধান দাবিগুলোর মধ্যে সব সময় অন্তর্ভুক্ত থাকে। আইএমএফের এই দাবি মার্কিন ডলারকে মদদ দেওয়ার জন্য। ব্রিকস সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে মার্কিন ডলারের বিশ্ব আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করার প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করেছে। ব্রিকস দেশগুলোর সম্মিলিত জিডিপি এখন বিশ্বের মোট জিডিপির ৪৭ শতাংশে পৌঁছে গেছে এবং এই অনুপাত ক্রমবর্ধমান। বিশ্বের জনসংখ্যার ৫৭ শতাংশ ব্রিকসের সদস্যদেশগুলোর অধিবাসী। এবারের কাজান সম্মেলনে আরও ১৩টি দেশকে ব্রিকসের ‘পার্টনার কান্ট্রি’ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। মনে হচ্ছে, আগামী এক দশকে ডলারের বিশ্ব আধিপত্য খর্ব হয়ে যাবে।
আমরা অনেকেই খেয়াল করি না যে বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি পুঁজি পাচার হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। বিশ্বের সব দেশের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের কাছে অভিবাসনের স্বর্গরাজ্য বিবেচিত হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর যে ১৪-১৫ বিলিয়ন ডলার চারটি প্রধান প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে বলে ধারণা করা হয়, সেগুলোরও প্রধান গন্তব্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এই চারটি প্রক্রিয়া হলো: ১) আমদানিতে ওভারইনভয়েসিং, ২) রপ্তানিতে আন্ডারইনভয়েসিং, ৩) রপ্তানি আয় দেশে ফেরত না আনা এবং ৪) হুন্ডি পদ্ধতিতে প্রবাসীদের রেমিট্যান্সের বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে রেখে দিয়ে তার বিনিময়ে দেশের পুঁজি পাচারকারীরা হুন্ডিওয়ালাদের কাছে সমপরিমাণ টাকা পরিশোধ করে সহজেই অর্থ পাচার সম্পন্ন করা।
সাবেক হাসিনা সরকারের আমলে এই হুন্ডি প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বেশি ব্যাংকের ঋণ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছিল এবং প্রথমোক্ত তিনটি প্রক্রিয়ার তুলনায় ওই সময় হুন্ডি পদ্ধতিতে অর্থ পাচার সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত প্রক্রিয়ায় পরিণত হয়েছিল। গত ২ নভেম্বর টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান দাবি করেছেন যে গত ১০ বছরের প্রত্যেক বছর বিভিন্ন পন্থায় বিদেশে ১২ বিলিয়ন ডলার থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়ে গেছে। অর্থনীতির ওপর শ্বেতপত্র প্রণয়নের জন্য গঠিত কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের মতে, বিগত সরকারের শেষের দিকে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ১৬ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়ে গেছে। এর মানে, পূর্বের যেকোনো সময়ের তুলনায় বাংলাদেশ এখন ডলার-সাম্রাজ্যবাদের অনেক বড় শিকারে পরিণত হয়েছে, যেটাকে সাবেক সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে লাই দিয়েছে। ডলারের এহেন দ্বৈত বাজার এ দেশের অর্থনীতিতে ব্ল্যাক-ইকোনমির প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দখল করে ফেলেছে। পতিত স্বৈরশাসক হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশ ব্রিকসের সদস্য হওয়ার জন্য আগ্রহী হলেও সফল হয়নি। এখন ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার যেহেতু মার্কিনপন্থী সরকার, তাই এখন বাংলাদেশ ব্রিকসের ব্যাপারে হয়তো কোনো আগ্রহ দেখাবে না। তবে এটুকু বলতেই হবে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিশ্ব আধিপত্য খর্ব করে ভবিষ্যতে যদি ব্রিকস একটি ‘মাল্টি-পোলার ওয়ার্ল্ড’ গড়ে তুলতে পারে, তাহলে একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশও ‘ডলার সাম্রাজ্যবাদের’ একটি বিকল্প খুঁজে পাবে।

ব্রিকস হচ্ছে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার ইংরেজি আদ্যাক্ষর নিয়ে গঠিত সংস্থার নাম। সম্প্রতি রাশিয়ার কাজানে ব্রিকসের সম্মেলন সমাপ্ত হয়েছে। ব্রিকসের ১০ সদস্যদেশসহ মোট ৩৫টি দেশের প্রতিনিধিরা সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। সম্মেলনে ব্রিকসের সদস্যদেশগুলোর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ডলারের পরিবর্তে ব্রিকসের নিজস্ব মুদ্রা ব্যবহারের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে, যা বিশ্ববাণিজ্যে ডলারের আধিপত্য অনেকখানি খর্ব করবে। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর অর্থনীতির মালিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সাম্রাজ্যবাদী হাতিয়ার হলো মার্কিন ডলার। তৃতীয় বিশ্বের কোনো দেশের ডলারের নাগপাশ থেকে নিজেদের মুক্ত রাখার সুযোগ নেই। ১৯৪৭ সালে সৃষ্ট ইন্টারন্যাশনাল মনিটরি ফান্ডের (আইএমএফ) মাধ্যমে এই হাতিয়ারের জাল বিস্তার শুরু হয়েছিল এর পূর্ববর্তী ব্রিটিশ পাউন্ড-স্টার্লিংয়ের পরিবর্তে মার্কিন ডলারকে বিশ্বের যাবতীয় আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, বিনিয়োগ, মুদ্রা বিনিময় ও অর্থ লেনদেনের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ও বহুল ব্যবহৃত মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে। আইএমএফের সিস্টেমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একক গ্যারান্টির ভিত্তিতে ৩৫ ডলারে এক আউন্স সোনার দাম নির্ধারণ ও স্থিতিশীল রাখার মাধ্যমে এই ‘ফিক্সড এক্সচেঞ্জ রেট সিস্টেম’ চালু হয়েছিল। ১৯৭২ সাল পর্যন্ত আইএমএফের ফিক্সড এক্সচেঞ্জ রেট সিস্টেম কাজ করলেও বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকের শেষের দিকে ‘ডলার ক্রাইসিস বা গোল্ড ক্রাইসিস’-এর সময় সিস্টেমটা ভেঙে পড়ে।
স্বর্ণের দাম ওই সময় হু হু করে বাড়তে বাড়তে ১ আউন্স ৩০০ ডলার ছাড়িয়ে গেলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ডলারের দাম স্থিতিশীল রাখার দায়িত্ব পালনে অক্ষমতা প্রকাশ করে, যার ফলে আইএমএফের ‘ফিক্সড এক্সচেঞ্জ রেট সিস্টেম’ ভেস্তে যায়। এর পরিবর্তে চালু করা হয় ‘ফ্লোটিং এক্সচেঞ্জ রেট সিস্টেম’, যেখানে স্বর্ণের দাম এবং বিভিন্ন দেশের মুদ্রার বৈদেশিক দাম নির্ধারণ আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়। (২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ১ আউন্স স্বর্ণের দাম ২৬০০ ডলার ছাড়িয়ে গেছে)। গত ৫২ বছরে এই ‘কারেন্সি কেনাবেচার বাজারে’ মুদ্রা লেনদেন প্রতিদিন ৪ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাচ্ছে, যেখানে এক বছরে ‘ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট’ (এফডিআই) হয় ৮০০ বিলিয়ন ডলারের মতো। চলমান তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লবের কারণে আন্তর্জাতিক মুদ্রাবাজারের দক্ষতা আকাশচুম্বী হয়ে পড়ছে ক্রমেই। বিশ্ব মুদ্রাবাজারের সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য ১৯৭২ সাল থেকে ৫২ বছর ধরে বহাল রেখেছে মার্কিন ডলার।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিশ্বের জনগণ প্রায় পাঁচ কোটি মানুষের প্রাণহানিসহ যে ভয়াবহ ধ্বংসলীলার সম্মুখীন হয়েছিল, তার ফলে ঔপনিবেশিক কাঠামো পরিত্যাগ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়েছিল মনে করা হলেও প্রকৃতপক্ষে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে সাম্রাজ্যবাদ শুধু রূপ ও কৌশল পরিবর্তন করেছে, সাম্রাজ্যবাদ এখনো বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতির প্রধান নিয়ামক হিসেবে অটুট রয়ে গেছে। তৃতীয় বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ ১৯৪৫-৭৫ পর্বে সরাসরি ঔপনিবেশিক দখলদারি থেকে ভৌগোলিক স্বাধীনতা অর্জন করলেও সাম্রাজ্যবাদী-রাজনৈতিক আধিপত্য ও অর্থনৈতিক পরনির্ভরতার এক অবিচ্ছেদ্য জালে প্রায় সব দেশ ৭৯ বছর ধরে আটকা রয়েছে। বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের এই ‘আধিপত্য-পরনির্ভরতার’ জটাজালে সবচেয়ে ক্ষমতাধর অধিপতির ভূমিকা পালন করে চলেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যাদের বিশ্ব আধিপত্য (হেজিমনি) এখনো বহাল রয়েছে।
মার্কিনদের রপ্তানি আয় আমদানি ব্যয়ের চেয়ে প্রতিবছর অনেক কম হওয়ায় তাদের ব্যালেন্স অব পেমেন্টসের কারেন্ট অ্যাকাউন্টে নিয়মিতভাবে ঘাটতি সৃষ্টি হচ্ছে। অন্য কোনো দেশ এ রকম ঘাটতিতে পড়লে ওই দেশের মুদ্রার বৈদেশিক মানে ধস নামত, কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে একেবারেই ব্যতিক্রম। তাদের মুদ্রা ডলার যেহেতু বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের প্রধান অংশ, তাই কোনো দেশই চায় না ডলারের বৈদেশিক মানে ধস নামুক। উদাহরণ হিসেবে চীনের ব্যাপারটা উল্লেখ করা যেতে পারে: চীন এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের মালিক হওয়া সত্ত্বেও তারা নিজেদের মুদ্রাকে ডলারের সঙ্গে একটা স্থিতিশীল সম্পর্কে বহাল রাখতে চায়। নয়তো একদিকে তাদের কাছে ডলারের যে বিশাল মজুত রয়েছে, তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, অন্যদিকে তাদের রপ্তানি পণ্যের প্রতিযোগিতা-সক্ষমতা ক্ষুণ্ন হবে। বিশ্বের সবচেয়ে ঋণগ্রস্ত দেশ হয়েও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনো বিশ্বের অর্থনৈতিক আধিপত্য অক্ষুণ্ন রাখতে সমর্থ হচ্ছে মার্কিন ডলারের এই ‘আনচ্যালেঞ্জড হেজিমনি’র কারণে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের মুদ্রা টাকার বৈদেশিক মান ডলার-প্রতি অফিশিয়ালি ৪.৭৬ টাকা হলেও আনঅফিশিয়ালি ছিল ১৫ টাকা। এখন ১ ডলারের বাজার দাম বাংলাদেশ ব্যাংক-নির্ধারিত বাজারে ১২০ টাকা, আর কার্ব মার্কেটে প্রতি ডলার বিক্রি হয় ১২৩ টাকায়।
গত তিন বছরে ডলারের তুলনায় টাকার বৈদেশিক মান ৪২ শতাংশের বেশি অবচয়ন হয়েছে। এর ফলে আমাদের অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি বিপজ্জনকভাবে বেড়ে গেছে এবং আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও বড়সড় ধস নেমেছে। অথচ আমরা এখনো ‘ফ্রিলি-ফ্লোটিং এক্সচেঞ্জ রেট সিস্টেম’ চালু করিনি, ক্যাপিটাল অ্যাকাউন্টে টাকা এখনো অবাধে বিনিময়যোগ্য করা হয়নি। আমরা ‘ক্রলিং পেগ’ নীতি অনুসরণ করছি ডলারের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে। তবু এ ক্ষেত্রে ডলারের দাম টাকার অঙ্কে ক্রমে আরও বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা বিদ্যমান। ডলারের দামকে স্থিতিশীল রাখার জন্য সব দেশের সরকার সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে প্রয়াস জারি রাখা সত্ত্বেও দিন দিন ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার এই প্রক্রিয়াকে থামাতে অসমর্থ হচ্ছে প্রায় সব দেশ। (পাকিস্তানে ১ ডলারের দাম এখন ২৮০ রুপির আশপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে, যার ফলে পাকিস্তানের মূল্যস্ফীতির হার এখন ৩০ শতাংশে পৌঁছে গেছে)।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ এজেন্ট আইএমএফ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর ওপর সার্বক্ষণিক চাপ অব্যাহত রেখে চলেছে ক্রমেই ডলারের দাম দেশীয় মুদ্রায় বাড়ানোর ব্যাপারে। তাদের মতে সব তৃতীয় বিশ্বের দেশে ডলারের তুলনায় মুদ্রাগুলো ‘অতিমূল্যায়িত’ রয়ে যাচ্ছে, তাই মুদ্রার অবচয়ন (ডেপ্রিসিয়েশন) আইএমএফের প্রধান দাবিগুলোর মধ্যে সব সময় অন্তর্ভুক্ত থাকে। আইএমএফের এই দাবি মার্কিন ডলারকে মদদ দেওয়ার জন্য। ব্রিকস সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে মার্কিন ডলারের বিশ্ব আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করার প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করেছে। ব্রিকস দেশগুলোর সম্মিলিত জিডিপি এখন বিশ্বের মোট জিডিপির ৪৭ শতাংশে পৌঁছে গেছে এবং এই অনুপাত ক্রমবর্ধমান। বিশ্বের জনসংখ্যার ৫৭ শতাংশ ব্রিকসের সদস্যদেশগুলোর অধিবাসী। এবারের কাজান সম্মেলনে আরও ১৩টি দেশকে ব্রিকসের ‘পার্টনার কান্ট্রি’ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। মনে হচ্ছে, আগামী এক দশকে ডলারের বিশ্ব আধিপত্য খর্ব হয়ে যাবে।
আমরা অনেকেই খেয়াল করি না যে বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি পুঁজি পাচার হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। বিশ্বের সব দেশের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের কাছে অভিবাসনের স্বর্গরাজ্য বিবেচিত হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর যে ১৪-১৫ বিলিয়ন ডলার চারটি প্রধান প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে বলে ধারণা করা হয়, সেগুলোরও প্রধান গন্তব্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এই চারটি প্রক্রিয়া হলো: ১) আমদানিতে ওভারইনভয়েসিং, ২) রপ্তানিতে আন্ডারইনভয়েসিং, ৩) রপ্তানি আয় দেশে ফেরত না আনা এবং ৪) হুন্ডি পদ্ধতিতে প্রবাসীদের রেমিট্যান্সের বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে রেখে দিয়ে তার বিনিময়ে দেশের পুঁজি পাচারকারীরা হুন্ডিওয়ালাদের কাছে সমপরিমাণ টাকা পরিশোধ করে সহজেই অর্থ পাচার সম্পন্ন করা।
সাবেক হাসিনা সরকারের আমলে এই হুন্ডি প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বেশি ব্যাংকের ঋণ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছিল এবং প্রথমোক্ত তিনটি প্রক্রিয়ার তুলনায় ওই সময় হুন্ডি পদ্ধতিতে অর্থ পাচার সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত প্রক্রিয়ায় পরিণত হয়েছিল। গত ২ নভেম্বর টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান দাবি করেছেন যে গত ১০ বছরের প্রত্যেক বছর বিভিন্ন পন্থায় বিদেশে ১২ বিলিয়ন ডলার থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়ে গেছে। অর্থনীতির ওপর শ্বেতপত্র প্রণয়নের জন্য গঠিত কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের মতে, বিগত সরকারের শেষের দিকে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ১৬ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়ে গেছে। এর মানে, পূর্বের যেকোনো সময়ের তুলনায় বাংলাদেশ এখন ডলার-সাম্রাজ্যবাদের অনেক বড় শিকারে পরিণত হয়েছে, যেটাকে সাবেক সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে লাই দিয়েছে। ডলারের এহেন দ্বৈত বাজার এ দেশের অর্থনীতিতে ব্ল্যাক-ইকোনমির প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দখল করে ফেলেছে। পতিত স্বৈরশাসক হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশ ব্রিকসের সদস্য হওয়ার জন্য আগ্রহী হলেও সফল হয়নি। এখন ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার যেহেতু মার্কিনপন্থী সরকার, তাই এখন বাংলাদেশ ব্রিকসের ব্যাপারে হয়তো কোনো আগ্রহ দেখাবে না। তবে এটুকু বলতেই হবে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিশ্ব আধিপত্য খর্ব করে ভবিষ্যতে যদি ব্রিকস একটি ‘মাল্টি-পোলার ওয়ার্ল্ড’ গড়ে তুলতে পারে, তাহলে একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশও ‘ডলার সাম্রাজ্যবাদের’ একটি বিকল্প খুঁজে পাবে।

রাজনীতি কোন পথে যাত্রা করেছে, তা কি সাধারণ মানুষ বুঝতে পারছে? যে রাজনৈতিক দলগুলো রাজনীতির মাঠে সক্রিয়, তারা নির্বাচনের জন্য কতটা তৈরি হয়ে আছে, তা নিয়ে সংশয় এখনো কাটছে না। বলা হচ্ছে, ডিসেম্বরের মাঝামাঝি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে। রমজানের আগেই নির্বাচন সুসম্পন্ন হবে বলে অনেকেই আশা প্রকাশ করছেন।
৯ ঘণ্টা আগে
চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে দেশে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন স্মারক ছাড়াও মাজার, সাধু-সন্ন্যাসী, বাউল-ফকিরসহ সংখ্যালঘু ও ভিন্ন মতাদর্শের মানুষের ওপর হামলা যেন থামছেই না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসব হামলায় ধর্মতন্ত্রী একটি গোষ্ঠীকে নেতৃত্ব দিতে দেখা যাচ্ছে। হামলাকারীরা নিজেদের ‘তৌহিদি জনতা’...
৯ ঘণ্টা আগে
কদিন আগে রুশ পত্রিকা ‘আর্গুমেন্তি ই ফাক্তি’ রই মেদভেদেভের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছে। শতবর্ষী এই ইতিহাসবিদ রাশিয়া ও সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতিহাস নিয়ে বেশ কিছু তীক্ষ্ণ মন্তব্য করেছেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন পত্রিকার সাংবাদিক ভিতালি চেপলিয়েভ। গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় সাক্ষাৎকারটি আজকের পত্রিকার পাঠকদের...
৯ ঘণ্টা আগে
বাংলাদেশে গত পাঁচ দশকের বেশি সময়ের মধ্যে সংঘটিত পরিবর্তনে দেশের জনগণের ও নেতৃত্বের ভূমিকা কী, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল, জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা কী, অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা গ্রহণের প্রয়োজনে তা বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখা একান্ত দরকার।
১ দিন আগেসম্পাদকীয়

রাজনীতি কোন পথে যাত্রা করেছে, তা কি সাধারণ মানুষ বুঝতে পারছে? যে রাজনৈতিক দলগুলো রাজনীতির মাঠে সক্রিয়, তারা নির্বাচনের জন্য কতটা তৈরি হয়ে আছে, তা নিয়ে সংশয় এখনো কাটছে না। বলা হচ্ছে, ডিসেম্বরের মাঝামাঝি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে। রমজানের আগেই নির্বাচন সুসম্পন্ন হবে বলে অনেকেই আশা প্রকাশ করছেন। সবকিছু স্বাভাবিক থাকলে দেশের মানুষ ভোটকেন্দ্রে হাজির হয়ে নিজের পছন্দমতো ভোট দেবেন।
রাজনীতি নিয়ে দেশের জনগণ বেশ দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে রয়েছে। একই দিনে সংসদ নির্বাচন এবং গণভোটের কারণে কিছুটা সমস্যা দেখা দিতে পারে। সাধারণ মানুষকে দুই রকম ভোট একই সঙ্গে দেওয়ার বিষয়টি ঠিকঠাকভাবে বোঝানো যাবে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। বিগত সময়ে নির্বাচন নিয়ে নানা ধরনের দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে, তাই এবার যেন ভোটার নিজের ভোটটি ইচ্ছেমতো দিতে পারেন, সে রকম একটি পরিবেশ সৃষ্টি করে দেওয়া প্রয়োজন। গণভোটের প্রসঙ্গ নিয়েও অনেক ধরনের তর্কবিতর্ক হচ্ছে। গণভোটে চারটি প্রশ্ন থাকায় কেউ যদি তিনটির পক্ষে থাকে এবং একটির বিপক্ষে থাকে, কিংবা দুটির পক্ষে থাকে এবং দুটির বিপক্ষে থাকে, তাহলে ভোটার ‘হ্যাঁ’ নাকি ‘না’ ভোট দেবেন, তা নিয়েও অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হতে পারে। নির্বাচন কমিশন নিশ্চয়ই এ বিষয়টির দিকে খেয়াল রাখবে।
নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার আগেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে হানাহানি বেড়ে গেছে। কোনো কোনো দলের কোনো কোনো নেতা যে ভাষায় কথা বলছেন, তাকে কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক প্রকাশভঙ্গি বলা যাবে না। এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের নানা ধরনের চেষ্টা দেখা যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ অবস্থায় ঠিক কাজটি করতে পারছে কি না, তা নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন। এলাকার রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ হারিয়ে ফেললে নির্বাচনে তার প্রভাব পড়তে পারে।
দেশের সাধারণ জনগণ নিজের ইচ্ছায় নিরাপদে নিজের ভোটটি দিতে চাইছে। জনগণের মনে সত্যিকার সাহস জোগানোর কাজটি এখন খুবই জরুরি কাজে পরিণত হয়েছে। নির্বাচন উৎসবমুখর পরিবেশে করা যাবে কি না, তা নির্ভর করছে এ সময়টিতে সেভাবে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হওয়া যাচ্ছে কি না, তার ওপর। প্রস্তুতিতে সমস্যা যেন না থাকে, তার দায়িত্ব নিতে হবে নির্বাচন কমিশনকে।
নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এলে বিনিয়োগ, বিশেষ করে বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে যে অস্থিরতা রয়েছে, তা কেটে যাবে বলে মনে করে অভিজ্ঞ মহল। অনেক ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদের মতে, রাজনৈতিক অস্থিরতা, নীতি-অস্পষ্টতা এবং ব্যাংকিং বা মনিটারি সমস্যার কারণে বিনিয়োগকারীদের আত্মবিশ্বাস কমেছে। সেই আত্মবিশ্বাস পুনরুদ্ধার করা একান্ত জরুরি। দেশের অর্থনৈতিক স্বাস্থ্য যেন পূর্ণ নিরাময়ের গ্যারান্টি পায়, তা নিশ্চিত করা দরকার। তবে এ কথাও ঠিক, রপ্তানি, রেমিট্যান্স প্রবাহে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেছে, যা দেশের অর্থনীতিকে কিছুটা সুসংবাদ দেয়।
সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ দুর্নীতি করে না। তারা দুবেলা দুমুঠো খেতে পেলেই শান্তি পায়। নির্বাচনের মাধ্যমে সে শান্তির পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারলে রাজনৈতিক বিজয় অর্জিত হবে।

রাজনীতি কোন পথে যাত্রা করেছে, তা কি সাধারণ মানুষ বুঝতে পারছে? যে রাজনৈতিক দলগুলো রাজনীতির মাঠে সক্রিয়, তারা নির্বাচনের জন্য কতটা তৈরি হয়ে আছে, তা নিয়ে সংশয় এখনো কাটছে না। বলা হচ্ছে, ডিসেম্বরের মাঝামাঝি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে। রমজানের আগেই নির্বাচন সুসম্পন্ন হবে বলে অনেকেই আশা প্রকাশ করছেন। সবকিছু স্বাভাবিক থাকলে দেশের মানুষ ভোটকেন্দ্রে হাজির হয়ে নিজের পছন্দমতো ভোট দেবেন।
রাজনীতি নিয়ে দেশের জনগণ বেশ দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে রয়েছে। একই দিনে সংসদ নির্বাচন এবং গণভোটের কারণে কিছুটা সমস্যা দেখা দিতে পারে। সাধারণ মানুষকে দুই রকম ভোট একই সঙ্গে দেওয়ার বিষয়টি ঠিকঠাকভাবে বোঝানো যাবে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। বিগত সময়ে নির্বাচন নিয়ে নানা ধরনের দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে, তাই এবার যেন ভোটার নিজের ভোটটি ইচ্ছেমতো দিতে পারেন, সে রকম একটি পরিবেশ সৃষ্টি করে দেওয়া প্রয়োজন। গণভোটের প্রসঙ্গ নিয়েও অনেক ধরনের তর্কবিতর্ক হচ্ছে। গণভোটে চারটি প্রশ্ন থাকায় কেউ যদি তিনটির পক্ষে থাকে এবং একটির বিপক্ষে থাকে, কিংবা দুটির পক্ষে থাকে এবং দুটির বিপক্ষে থাকে, তাহলে ভোটার ‘হ্যাঁ’ নাকি ‘না’ ভোট দেবেন, তা নিয়েও অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হতে পারে। নির্বাচন কমিশন নিশ্চয়ই এ বিষয়টির দিকে খেয়াল রাখবে।
নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার আগেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে হানাহানি বেড়ে গেছে। কোনো কোনো দলের কোনো কোনো নেতা যে ভাষায় কথা বলছেন, তাকে কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক প্রকাশভঙ্গি বলা যাবে না। এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের নানা ধরনের চেষ্টা দেখা যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ অবস্থায় ঠিক কাজটি করতে পারছে কি না, তা নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন। এলাকার রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ হারিয়ে ফেললে নির্বাচনে তার প্রভাব পড়তে পারে।
দেশের সাধারণ জনগণ নিজের ইচ্ছায় নিরাপদে নিজের ভোটটি দিতে চাইছে। জনগণের মনে সত্যিকার সাহস জোগানোর কাজটি এখন খুবই জরুরি কাজে পরিণত হয়েছে। নির্বাচন উৎসবমুখর পরিবেশে করা যাবে কি না, তা নির্ভর করছে এ সময়টিতে সেভাবে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হওয়া যাচ্ছে কি না, তার ওপর। প্রস্তুতিতে সমস্যা যেন না থাকে, তার দায়িত্ব নিতে হবে নির্বাচন কমিশনকে।
নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এলে বিনিয়োগ, বিশেষ করে বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে যে অস্থিরতা রয়েছে, তা কেটে যাবে বলে মনে করে অভিজ্ঞ মহল। অনেক ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদের মতে, রাজনৈতিক অস্থিরতা, নীতি-অস্পষ্টতা এবং ব্যাংকিং বা মনিটারি সমস্যার কারণে বিনিয়োগকারীদের আত্মবিশ্বাস কমেছে। সেই আত্মবিশ্বাস পুনরুদ্ধার করা একান্ত জরুরি। দেশের অর্থনৈতিক স্বাস্থ্য যেন পূর্ণ নিরাময়ের গ্যারান্টি পায়, তা নিশ্চিত করা দরকার। তবে এ কথাও ঠিক, রপ্তানি, রেমিট্যান্স প্রবাহে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেছে, যা দেশের অর্থনীতিকে কিছুটা সুসংবাদ দেয়।
সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ দুর্নীতি করে না। তারা দুবেলা দুমুঠো খেতে পেলেই শান্তি পায়। নির্বাচনের মাধ্যমে সে শান্তির পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারলে রাজনৈতিক বিজয় অর্জিত হবে।

ব্রিকস হচ্ছে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার ইংরেজি আদ্যাক্ষর নিয়ে গঠিত সংস্থার নাম। সম্প্রতি রাশিয়ার কাজানে ব্রিকসের সম্মেলন সমাপ্ত হয়েছে। ব্রিকসের ১০ সদস্যদেশসহ মোট ৩৫টি দেশের প্রতিনিধিরা সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। সম্মেলনে ব্রিকসের সদস্যদেশগুলোর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ডলারের পরিবর্তে ব্রি
২৮ ডিসেম্বর ২০২৪
চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে দেশে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন স্মারক ছাড়াও মাজার, সাধু-সন্ন্যাসী, বাউল-ফকিরসহ সংখ্যালঘু ও ভিন্ন মতাদর্শের মানুষের ওপর হামলা যেন থামছেই না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসব হামলায় ধর্মতন্ত্রী একটি গোষ্ঠীকে নেতৃত্ব দিতে দেখা যাচ্ছে। হামলাকারীরা নিজেদের ‘তৌহিদি জনতা’...
৯ ঘণ্টা আগে
কদিন আগে রুশ পত্রিকা ‘আর্গুমেন্তি ই ফাক্তি’ রই মেদভেদেভের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছে। শতবর্ষী এই ইতিহাসবিদ রাশিয়া ও সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতিহাস নিয়ে বেশ কিছু তীক্ষ্ণ মন্তব্য করেছেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন পত্রিকার সাংবাদিক ভিতালি চেপলিয়েভ। গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় সাক্ষাৎকারটি আজকের পত্রিকার পাঠকদের...
৯ ঘণ্টা আগে
বাংলাদেশে গত পাঁচ দশকের বেশি সময়ের মধ্যে সংঘটিত পরিবর্তনে দেশের জনগণের ও নেতৃত্বের ভূমিকা কী, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল, জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা কী, অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা গ্রহণের প্রয়োজনে তা বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখা একান্ত দরকার।
১ দিন আগেআজাদুর রহমান চন্দন

চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে দেশে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন স্মারক ছাড়াও মাজার, সাধু-সন্ন্যাসী, বাউল-ফকিরসহ সংখ্যালঘু ও ভিন্ন মতাদর্শের মানুষের ওপর হামলা যেন থামছেই না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসব হামলায় ধর্মতন্ত্রী একটি গোষ্ঠীকে নেতৃত্ব দিতে দেখা যাচ্ছে। হামলাকারীরা নিজেদের ‘তৌহিদি জনতা’ হিসেবে পরিচয় দিচ্ছে। এসব হামলা বন্ধ করতে সরকারকেও তেমন তৎপর হতে দেখা যায়নি।
সবশেষ ঘটনায়ও সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। শেষ ঘটনাটির সূত্রপাত গত ৪ নভেম্বর মানিকগঞ্জের ঘিওরে একটি পালাগানের আসরে আবুল সরকার মহারাজের পরিবেশনা ঘিরে। সেদিন জীব ও পরম—এই দুই পক্ষে লড়াই করছিলেন আবুল সরকার মহারাজ, প্রতিপক্ষের নামও ছিল আবুল সরকার, যিনি ফরিদপুর থেকে এসেছিলেন। মানিকগঞ্জের আবুল সরকার মহারাজ ছিলেন জীবের পক্ষে, পরমের বিপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন তিনি। সেদিন দুই বাউলের দার্শনিক বাহাস চলে চার ঘণ্টা ধরে। সেই চার ঘণ্টা থেকে কয়েক সেকেন্ডের ভিডিও কেটে অনলাইনে ছড়িয়ে দেওয়া হয় এবং ধর্মের বিরুদ্ধে কটূক্তি হিসেবে প্রচার করা হয়। পরে মামলা করা হলে আবুল সরকার মহারাজকে দ্রুত গ্রেপ্তার করে কারাগারেও পাঠানো হয়েছে। এর পর থেকেই এই বাউলশিল্পীর নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানিয়ে আসছেন তাঁর ভক্ত-অনুরাগীরা। দেশের অনেক বিশিষ্টজন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদসহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন নিন্দা ও উদ্বেগ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে। এরই মধ্যে ২৩ নভেম্বর মানিকগঞ্জে বাউলশিল্পী আবুল সরকার মহারাজের ভক্ত-অনুরাগীদের ওপর প্রথমে হামলা হয়। ২৬ নভেম্বর হামলা হয়েছে ঠাকুরগাঁও ও খুলনায়।
সমালোচনার মুখ বন্ধ করতেই হোক আর যে কারণেই হোক, শেষ পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়। কিন্তু বাউল আবুল সরকারের মুক্তি এখনো মেলেনি। এ ছাড়া কোনো কোনো উপদেষ্টার বক্তব্য জনসমালোচনাকে আরও উসকে দেয়। এ অবস্থার মধ্যেই সারা দেশে বাউলদের ওপর হামলা ও কারাবন্দী বাউল আবুল সরকারের মুক্তির দাবিতে ২৮ নভেম্বর বিকেলে রাজধানীর শাহবাগে আয়োজন করা হয় প্রতিবাদী গানের অনুষ্ঠানের।
জাতীয় জাদুঘরের সামনে ‘গানের আর্তনাদ’ নামের ওই কর্মসূচির আয়োজন করে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম ‘সম্প্রীতি যাত্রা’। মূলত বামপন্থীদের একটি অংশ ছিল এই আয়োজনের পুরোভাগে। সেই অনুষ্ঠানেও হামলা করা হয় ‘জুলাই মঞ্চ’ ব্যানারে। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে অনুষ্ঠানস্থলে গিয়ে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে জুলাই মঞ্চের একদল কর্মী। পরে উভয় পক্ষ মুখোমুখি হলে সেখানে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ‘গানের আর্তনাদ’ কর্মসূচির আয়োজকদের অভিযোগ, কর্মসূচি চলা অবস্থায় হঠাৎ করে জুলাই মঞ্চের ২০-২৫ জন সেখানে গিয়ে অতর্কিত হামলা করে। হামলাকারীরা মঞ্চ ভাঙচুর করে এবং নারীসহ কয়েকজনের গায়ে হাত তোলে। তারা মাইকে বলতে থাকে যে বাউল আবুল সরকারের মুক্তি দাবি করা যাবে না। প্রতিরোধের মুখে হামলাকারীরা চলে গেলে অনুষ্ঠান আবার শুরু হয়। পরে করা হয়েছে প্রতিবাদী মশাল মিছিল।
সর্বস্তরের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে বৈষম্যের প্রাচীর ভাঙার জুলাই আন্দোলন গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নিলে এবং কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান ঘটলে সংস্কারের এক প্রবল আবহ ছড়িয়ে পড়ে। সমাজবিপ্লবের লক্ষ্য সত্ত্বেও দেশের বেশ কিছু বামপন্থী দল বছরের পর বছর নির্বাচনী ব্যবস্থাসহ রাষ্ট্রের নানা ক্ষেত্রে আমূল সংস্কারের দাবি জানিয়ে আসছে। ওসব দলের অনেক নেতা-কর্মীও মনে করলেন, এবার বুঝি তাঁদের কাঙ্ক্ষিত সেই সংস্কার হবে! কিন্তু ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট থেকেই একটি বিশেষ মহল ভাস্কর্য-জাদুঘরসহ শিল্প-সংস্কৃতি ও মুক্তিযুদ্ধের সব স্মারক ধ্বংস করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। জুলাই আন্দোলনের কিছুদিন আগেও ছাত্রলীগের হেলমেটে মাথা-মুখ আড়াল করে রাখা এমনকি সংগঠনটির বিভিন্ন পদপদবি নিয়ে সুবিধা ভোগ করা কেউ কেউ হঠাৎ হিরো সেজে সংস্কারের নামে কখনো জাতীয় সংগীত, কখনো সংবিধানসহ রাষ্ট্রের মৌল চেতনায় আঘাত হানতে শুরু করায় বামপন্থীদের কারও কারও মোহ কাটলেও অনেকে এখনো মুক্তিযুদ্ধবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর সঙ্গে মিলে রাষ্ট্রের নতুন বন্দোবস্ত বাস্তবায়নের স্বপ্নে বিভোর।
ধর্মকে শিখণ্ডি করেও এবার যে জুলাই মঞ্চ তেমন একটা সুবিধা করতে পারল না, এর প্রধান কারণ, বাম ও সেক্যুলারপন্থীদের সম্মিলিত প্রতিরোধ। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন স্মারকের ওপর দেড় বছর ধরে চলা হামলাগুলো সফল হওয়ার পেছনে একটি কারণ ছিল বামপন্থীদের একাংশের মৌন সমর্থন। শুধু তা-ই নয়, বামপন্থীদের যে অংশটি জাতীয় সংগীত ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কথা বলেছে, তাদের ‘মুজিববাদী বাম’ বলতেও দ্বিধা করেনি মৌলবাদী ও স্বাধীনতাবিরোধীদের নিয়ে ইনক্লুসিভ বন্দোবস্ত বাস্তবায়নকামী অপর বামেরা। জুলাই মঞ্চ যে বামপন্থীদের আয়োজনে হামলা করেছে, গত বছরের জুলাইয়ে তারাও কিন্তু কারফিউ অমান্য করে ঢোল-করতাল নিয়ে রাজপথে নেমেছিল। জুলাইয়ে তাদের দুটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচির নাম ছিল ‘কারফিউ ব্রেক’ ও ‘গানের মিছিল’। এ ছাড়া চব্বিশের ২ আগস্টের ‘দ্রোহযাত্রা’ কর্মসূচি ছিল বাম-প্রগতিশীল রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর সবচেয়ে বড় ও তাৎপর্যপূর্ণ মিছিল-সমাবেশ। জুলাইয়ে ‘কারফিউ ব্রেক’ ও ‘গানের মিছিল’-এর সেই দিনগুলোতে এখনকার হামলাকারীদের কাউকে রাজপথে দেখা যায়নি। ‘গানের আর্তনাদ’ কর্মসূচিতে হামলাকারী সংগঠন জুলাই মঞ্চের আহ্বায়ক হলেন আরিফুল ইসলাম তালুকদার, যিনি জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কেন্দ্রীয় নেতা। শাহবাগে হামলার পরও মার্কিন সহায়তায় মৌলবাদীদের নিয়ে ‘ইনক্লুসিভ’ বাংলাদেশ বাস্তবায়নের স্বপ্নে ভাটা পড়বে বলে মনে হয় না। দেড় বছর ধরে সংস্কার, নয়া বন্দোবস্ত, বাংলাদেশপন্থা—এমন নানা মুখরোচক বুলি এমনভাবে আওড়ানো হচ্ছে, যেন তাদের প্রস্তাবগুলো ছাড়া সংস্কার বা নয়া বন্দোবস্ত বলে আর কিছু নেই। যাঁরা ওসব বুলি আওড়ে গলা ফাটাচ্ছেন, তাঁদের কথাবার্তায় মনে হয়, তাঁরা ছাড়া আর কেউ বাংলাদেশপন্থী নন, এমনকি যাঁরা রণাঙ্গনে লড়াই করে দেশটি স্বাধীন করেছিলেন, তাঁরাও নন। কিন্তু গোপনীয় চুক্তির মাধ্যমে তড়িঘড়ি দেশের প্রধান বন্দর-টার্মিনাল পরিচালনার ভার বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া হলেও সেই বাংলাদেশপন্থী দাবিদারদের মুখে রা নেই। সংস্কারের নামেও দেশকে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ধারায় ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা দৃশ্যমান। সুফিবাদী, বাউল, শিল্পী, সংস্কৃতিকর্মীসহ প্রগতিমনা ব্যক্তি-সংগঠনের ওপর হামলার ক্ষেত্রে ধর্মকে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিরোধী মতাদর্শের ব্যক্তি-গোষ্ঠীকে কাফের-ইসলামবিরোধী আখ্যা দিয়ে কোণঠাসা করার অপচেষ্টা মাথাচাড়া দিচ্ছে। রাজনীতিতে ধর্মের এমন অপব্যবহার এক আত্মবিনাশী পথ ছাড়া আর কিছুই নয়।
আত্মবিনাশী পথ বলার কারণ, ধর্ম নিয়ে রাজনীতির খেলায় কেউই নিরাপদ নন, এমনকি যিনি খেলাটা শুরু করছেন, তিনিও। আপনি হয়তো প্র্যাকটিসিং মুসলিম—পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেন, রোজা রাখেন, তাই বলে নিজেকে নিরাপদ ভাবার কারণ নেই। আপনি সুন্নি হলে শিয়া সম্প্রদায়ের কাছে বাতিল, শিয়া হলে সুন্নিদের চোখে রীতিমতো অমুসলিম আর আহমদিয়া বা কাদিয়ানি হলে তো রক্ষাই নেই। মুসলিম দেশগুলোর ইতিহাসের দিকে চোখ বুলালে দেখা যায়, ভিন্ন ধর্মের জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সংঘাতে মুসলমানদের যত না ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তার চেয়ে বহুগুণ বেশি হয়েছে ইসলাম ধর্মেরই বিভিন্ন ফিরকার মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে।//// চার খলিফার অন্যতম হজরত আলী (রা.)-কে কাফের ঘোষণা দিয়ে হত্যা করেছিল খারিজিরা। শিয়াপ্রধান ইরান ও সুন্নিপ্রধান ইরাকের মধ্যে ছয় বছরে যুদ্ধ-সংঘাতে উভয় পক্ষের ১০ লাখের বেশি মানুষ হতাহত হয়। ১৯৭৯ সালে ইরানে বিপ্লবের পর কয়েক লাখ বামপন্থী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে হত্যা করা হয়েছিল, যাঁরা সবাই মুসলমান। পাকিস্তানে ইসলাম ধর্মেরই বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ এমন পর্যায়ে যে তারা এক ছাদের নিচে বাস করা তো দূরের কথা, এক মসজিদে নামাজও আদায় করতে পারেন না। প্রায়ই খবরে দেখা যায়, জুমার জামাতে সশস্ত্র হামলা চালাচ্ছে স্বধর্মীয় ভিন্ন কোনো গোষ্ঠী। পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনী একসময় মাদ্রাসাশিক্ষার্থীদের ‘সামরিক প্রশিক্ষণ’ দিয়ে ‘তালেবান’ বানিয়েছিল আফগানিস্তানে সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য। সেই তালেবান এখন দ্বিতীয়বারের মতো আফগানিস্তানে ক্ষমতায়। আফগান তালেবানের ঘনিষ্ঠ তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) এখন পাকিস্তান সরকার ও সামরিক বাহিনীর গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব দেখেও আমরা শিখব না কিছুই!

চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে দেশে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন স্মারক ছাড়াও মাজার, সাধু-সন্ন্যাসী, বাউল-ফকিরসহ সংখ্যালঘু ও ভিন্ন মতাদর্শের মানুষের ওপর হামলা যেন থামছেই না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসব হামলায় ধর্মতন্ত্রী একটি গোষ্ঠীকে নেতৃত্ব দিতে দেখা যাচ্ছে। হামলাকারীরা নিজেদের ‘তৌহিদি জনতা’ হিসেবে পরিচয় দিচ্ছে। এসব হামলা বন্ধ করতে সরকারকেও তেমন তৎপর হতে দেখা যায়নি।
সবশেষ ঘটনায়ও সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। শেষ ঘটনাটির সূত্রপাত গত ৪ নভেম্বর মানিকগঞ্জের ঘিওরে একটি পালাগানের আসরে আবুল সরকার মহারাজের পরিবেশনা ঘিরে। সেদিন জীব ও পরম—এই দুই পক্ষে লড়াই করছিলেন আবুল সরকার মহারাজ, প্রতিপক্ষের নামও ছিল আবুল সরকার, যিনি ফরিদপুর থেকে এসেছিলেন। মানিকগঞ্জের আবুল সরকার মহারাজ ছিলেন জীবের পক্ষে, পরমের বিপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন তিনি। সেদিন দুই বাউলের দার্শনিক বাহাস চলে চার ঘণ্টা ধরে। সেই চার ঘণ্টা থেকে কয়েক সেকেন্ডের ভিডিও কেটে অনলাইনে ছড়িয়ে দেওয়া হয় এবং ধর্মের বিরুদ্ধে কটূক্তি হিসেবে প্রচার করা হয়। পরে মামলা করা হলে আবুল সরকার মহারাজকে দ্রুত গ্রেপ্তার করে কারাগারেও পাঠানো হয়েছে। এর পর থেকেই এই বাউলশিল্পীর নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানিয়ে আসছেন তাঁর ভক্ত-অনুরাগীরা। দেশের অনেক বিশিষ্টজন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদসহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন নিন্দা ও উদ্বেগ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে। এরই মধ্যে ২৩ নভেম্বর মানিকগঞ্জে বাউলশিল্পী আবুল সরকার মহারাজের ভক্ত-অনুরাগীদের ওপর প্রথমে হামলা হয়। ২৬ নভেম্বর হামলা হয়েছে ঠাকুরগাঁও ও খুলনায়।
সমালোচনার মুখ বন্ধ করতেই হোক আর যে কারণেই হোক, শেষ পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়। কিন্তু বাউল আবুল সরকারের মুক্তি এখনো মেলেনি। এ ছাড়া কোনো কোনো উপদেষ্টার বক্তব্য জনসমালোচনাকে আরও উসকে দেয়। এ অবস্থার মধ্যেই সারা দেশে বাউলদের ওপর হামলা ও কারাবন্দী বাউল আবুল সরকারের মুক্তির দাবিতে ২৮ নভেম্বর বিকেলে রাজধানীর শাহবাগে আয়োজন করা হয় প্রতিবাদী গানের অনুষ্ঠানের।
জাতীয় জাদুঘরের সামনে ‘গানের আর্তনাদ’ নামের ওই কর্মসূচির আয়োজন করে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম ‘সম্প্রীতি যাত্রা’। মূলত বামপন্থীদের একটি অংশ ছিল এই আয়োজনের পুরোভাগে। সেই অনুষ্ঠানেও হামলা করা হয় ‘জুলাই মঞ্চ’ ব্যানারে। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে অনুষ্ঠানস্থলে গিয়ে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে জুলাই মঞ্চের একদল কর্মী। পরে উভয় পক্ষ মুখোমুখি হলে সেখানে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ‘গানের আর্তনাদ’ কর্মসূচির আয়োজকদের অভিযোগ, কর্মসূচি চলা অবস্থায় হঠাৎ করে জুলাই মঞ্চের ২০-২৫ জন সেখানে গিয়ে অতর্কিত হামলা করে। হামলাকারীরা মঞ্চ ভাঙচুর করে এবং নারীসহ কয়েকজনের গায়ে হাত তোলে। তারা মাইকে বলতে থাকে যে বাউল আবুল সরকারের মুক্তি দাবি করা যাবে না। প্রতিরোধের মুখে হামলাকারীরা চলে গেলে অনুষ্ঠান আবার শুরু হয়। পরে করা হয়েছে প্রতিবাদী মশাল মিছিল।
সর্বস্তরের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে বৈষম্যের প্রাচীর ভাঙার জুলাই আন্দোলন গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নিলে এবং কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান ঘটলে সংস্কারের এক প্রবল আবহ ছড়িয়ে পড়ে। সমাজবিপ্লবের লক্ষ্য সত্ত্বেও দেশের বেশ কিছু বামপন্থী দল বছরের পর বছর নির্বাচনী ব্যবস্থাসহ রাষ্ট্রের নানা ক্ষেত্রে আমূল সংস্কারের দাবি জানিয়ে আসছে। ওসব দলের অনেক নেতা-কর্মীও মনে করলেন, এবার বুঝি তাঁদের কাঙ্ক্ষিত সেই সংস্কার হবে! কিন্তু ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট থেকেই একটি বিশেষ মহল ভাস্কর্য-জাদুঘরসহ শিল্প-সংস্কৃতি ও মুক্তিযুদ্ধের সব স্মারক ধ্বংস করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। জুলাই আন্দোলনের কিছুদিন আগেও ছাত্রলীগের হেলমেটে মাথা-মুখ আড়াল করে রাখা এমনকি সংগঠনটির বিভিন্ন পদপদবি নিয়ে সুবিধা ভোগ করা কেউ কেউ হঠাৎ হিরো সেজে সংস্কারের নামে কখনো জাতীয় সংগীত, কখনো সংবিধানসহ রাষ্ট্রের মৌল চেতনায় আঘাত হানতে শুরু করায় বামপন্থীদের কারও কারও মোহ কাটলেও অনেকে এখনো মুক্তিযুদ্ধবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর সঙ্গে মিলে রাষ্ট্রের নতুন বন্দোবস্ত বাস্তবায়নের স্বপ্নে বিভোর।
ধর্মকে শিখণ্ডি করেও এবার যে জুলাই মঞ্চ তেমন একটা সুবিধা করতে পারল না, এর প্রধান কারণ, বাম ও সেক্যুলারপন্থীদের সম্মিলিত প্রতিরোধ। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন স্মারকের ওপর দেড় বছর ধরে চলা হামলাগুলো সফল হওয়ার পেছনে একটি কারণ ছিল বামপন্থীদের একাংশের মৌন সমর্থন। শুধু তা-ই নয়, বামপন্থীদের যে অংশটি জাতীয় সংগীত ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কথা বলেছে, তাদের ‘মুজিববাদী বাম’ বলতেও দ্বিধা করেনি মৌলবাদী ও স্বাধীনতাবিরোধীদের নিয়ে ইনক্লুসিভ বন্দোবস্ত বাস্তবায়নকামী অপর বামেরা। জুলাই মঞ্চ যে বামপন্থীদের আয়োজনে হামলা করেছে, গত বছরের জুলাইয়ে তারাও কিন্তু কারফিউ অমান্য করে ঢোল-করতাল নিয়ে রাজপথে নেমেছিল। জুলাইয়ে তাদের দুটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচির নাম ছিল ‘কারফিউ ব্রেক’ ও ‘গানের মিছিল’। এ ছাড়া চব্বিশের ২ আগস্টের ‘দ্রোহযাত্রা’ কর্মসূচি ছিল বাম-প্রগতিশীল রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর সবচেয়ে বড় ও তাৎপর্যপূর্ণ মিছিল-সমাবেশ। জুলাইয়ে ‘কারফিউ ব্রেক’ ও ‘গানের মিছিল’-এর সেই দিনগুলোতে এখনকার হামলাকারীদের কাউকে রাজপথে দেখা যায়নি। ‘গানের আর্তনাদ’ কর্মসূচিতে হামলাকারী সংগঠন জুলাই মঞ্চের আহ্বায়ক হলেন আরিফুল ইসলাম তালুকদার, যিনি জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কেন্দ্রীয় নেতা। শাহবাগে হামলার পরও মার্কিন সহায়তায় মৌলবাদীদের নিয়ে ‘ইনক্লুসিভ’ বাংলাদেশ বাস্তবায়নের স্বপ্নে ভাটা পড়বে বলে মনে হয় না। দেড় বছর ধরে সংস্কার, নয়া বন্দোবস্ত, বাংলাদেশপন্থা—এমন নানা মুখরোচক বুলি এমনভাবে আওড়ানো হচ্ছে, যেন তাদের প্রস্তাবগুলো ছাড়া সংস্কার বা নয়া বন্দোবস্ত বলে আর কিছু নেই। যাঁরা ওসব বুলি আওড়ে গলা ফাটাচ্ছেন, তাঁদের কথাবার্তায় মনে হয়, তাঁরা ছাড়া আর কেউ বাংলাদেশপন্থী নন, এমনকি যাঁরা রণাঙ্গনে লড়াই করে দেশটি স্বাধীন করেছিলেন, তাঁরাও নন। কিন্তু গোপনীয় চুক্তির মাধ্যমে তড়িঘড়ি দেশের প্রধান বন্দর-টার্মিনাল পরিচালনার ভার বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া হলেও সেই বাংলাদেশপন্থী দাবিদারদের মুখে রা নেই। সংস্কারের নামেও দেশকে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ধারায় ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা দৃশ্যমান। সুফিবাদী, বাউল, শিল্পী, সংস্কৃতিকর্মীসহ প্রগতিমনা ব্যক্তি-সংগঠনের ওপর হামলার ক্ষেত্রে ধর্মকে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিরোধী মতাদর্শের ব্যক্তি-গোষ্ঠীকে কাফের-ইসলামবিরোধী আখ্যা দিয়ে কোণঠাসা করার অপচেষ্টা মাথাচাড়া দিচ্ছে। রাজনীতিতে ধর্মের এমন অপব্যবহার এক আত্মবিনাশী পথ ছাড়া আর কিছুই নয়।
আত্মবিনাশী পথ বলার কারণ, ধর্ম নিয়ে রাজনীতির খেলায় কেউই নিরাপদ নন, এমনকি যিনি খেলাটা শুরু করছেন, তিনিও। আপনি হয়তো প্র্যাকটিসিং মুসলিম—পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেন, রোজা রাখেন, তাই বলে নিজেকে নিরাপদ ভাবার কারণ নেই। আপনি সুন্নি হলে শিয়া সম্প্রদায়ের কাছে বাতিল, শিয়া হলে সুন্নিদের চোখে রীতিমতো অমুসলিম আর আহমদিয়া বা কাদিয়ানি হলে তো রক্ষাই নেই। মুসলিম দেশগুলোর ইতিহাসের দিকে চোখ বুলালে দেখা যায়, ভিন্ন ধর্মের জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সংঘাতে মুসলমানদের যত না ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তার চেয়ে বহুগুণ বেশি হয়েছে ইসলাম ধর্মেরই বিভিন্ন ফিরকার মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে।//// চার খলিফার অন্যতম হজরত আলী (রা.)-কে কাফের ঘোষণা দিয়ে হত্যা করেছিল খারিজিরা। শিয়াপ্রধান ইরান ও সুন্নিপ্রধান ইরাকের মধ্যে ছয় বছরে যুদ্ধ-সংঘাতে উভয় পক্ষের ১০ লাখের বেশি মানুষ হতাহত হয়। ১৯৭৯ সালে ইরানে বিপ্লবের পর কয়েক লাখ বামপন্থী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে হত্যা করা হয়েছিল, যাঁরা সবাই মুসলমান। পাকিস্তানে ইসলাম ধর্মেরই বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ এমন পর্যায়ে যে তারা এক ছাদের নিচে বাস করা তো দূরের কথা, এক মসজিদে নামাজও আদায় করতে পারেন না। প্রায়ই খবরে দেখা যায়, জুমার জামাতে সশস্ত্র হামলা চালাচ্ছে স্বধর্মীয় ভিন্ন কোনো গোষ্ঠী। পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনী একসময় মাদ্রাসাশিক্ষার্থীদের ‘সামরিক প্রশিক্ষণ’ দিয়ে ‘তালেবান’ বানিয়েছিল আফগানিস্তানে সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য। সেই তালেবান এখন দ্বিতীয়বারের মতো আফগানিস্তানে ক্ষমতায়। আফগান তালেবানের ঘনিষ্ঠ তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) এখন পাকিস্তান সরকার ও সামরিক বাহিনীর গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব দেখেও আমরা শিখব না কিছুই!

ব্রিকস হচ্ছে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার ইংরেজি আদ্যাক্ষর নিয়ে গঠিত সংস্থার নাম। সম্প্রতি রাশিয়ার কাজানে ব্রিকসের সম্মেলন সমাপ্ত হয়েছে। ব্রিকসের ১০ সদস্যদেশসহ মোট ৩৫টি দেশের প্রতিনিধিরা সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। সম্মেলনে ব্রিকসের সদস্যদেশগুলোর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ডলারের পরিবর্তে ব্রি
২৮ ডিসেম্বর ২০২৪
রাজনীতি কোন পথে যাত্রা করেছে, তা কি সাধারণ মানুষ বুঝতে পারছে? যে রাজনৈতিক দলগুলো রাজনীতির মাঠে সক্রিয়, তারা নির্বাচনের জন্য কতটা তৈরি হয়ে আছে, তা নিয়ে সংশয় এখনো কাটছে না। বলা হচ্ছে, ডিসেম্বরের মাঝামাঝি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে। রমজানের আগেই নির্বাচন সুসম্পন্ন হবে বলে অনেকেই আশা প্রকাশ করছেন।
৯ ঘণ্টা আগে
কদিন আগে রুশ পত্রিকা ‘আর্গুমেন্তি ই ফাক্তি’ রই মেদভেদেভের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছে। শতবর্ষী এই ইতিহাসবিদ রাশিয়া ও সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতিহাস নিয়ে বেশ কিছু তীক্ষ্ণ মন্তব্য করেছেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন পত্রিকার সাংবাদিক ভিতালি চেপলিয়েভ। গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় সাক্ষাৎকারটি আজকের পত্রিকার পাঠকদের...
৯ ঘণ্টা আগে
বাংলাদেশে গত পাঁচ দশকের বেশি সময়ের মধ্যে সংঘটিত পরিবর্তনে দেশের জনগণের ও নেতৃত্বের ভূমিকা কী, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল, জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা কী, অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা গ্রহণের প্রয়োজনে তা বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখা একান্ত দরকার।
১ দিন আগে
কদিন আগে রুশ পত্রিকা ‘আর্গুমেন্তি ই ফাক্তি’ রই মেদভেদেভের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছে। শতবর্ষী এই ইতিহাসবিদ রাশিয়া ও সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতিহাস নিয়ে বেশ কিছু তীক্ষ্ণ মন্তব্য করেছেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন পত্রিকার সাংবাদিক ভিতালি চেপলিয়েভ। গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় সাক্ষাৎকারটি আজকের পত্রিকার পাঠকদের জন্য অনুবাদ করে দেওয়া হলো।
সম্পাদকীয়

রই আলেক্সান্দ্রোভিচ, একবার আপনি বলেছিলেন যে রাশিয়াকে এক মহান রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ইভান গ্রোজনি নয়, বরং জার পিটার। কিন্তু পিটার তো ইউরোপীয় ধাঁচে রাষ্ট্র গড়ে তুলেছিলেন, আর আজ ইউরোপ অনেক রাশিয়ানের কাছে প্রায় মন্দের প্রতিশব্দ। ইভান গ্রোজনিকে রুশ দেশের মানুষেরা বরং অনেক বেশি ‘মূল্যবোধসংলগ্ন’ শাসক বলে মনে করে থাকেন। জনগণের ঐক্য দিবসে ভোলগদায় তাঁর ৯ মিটার উঁচু একটি মূর্তি উন্মোচন করা হয়েছে এবং এটি মোটেই প্রথম স্মৃতিস্তম্ভ নয়। এই দুই ব্যক্তিত্বকে একে অপরের বিপরীতে দাঁড় করানো কি ঠিক?
আমি মনে করি, ইভান গ্রোজনি এবং জার পিটার—দুজনই সম্মান ও শ্রদ্ধা পাওয়ার যোগ্য, উভয়েই মহান ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব। এবং সত্যিই তাঁদের একে অপরের বিপরীতে দাঁড় করানোর প্রয়োজন নেই। গ্রোজনি রুশ জারতন্ত্র তৈরি করেছিলেন, তাঁর আমলেই সাইবেরিয়া দখল শুরু হয়, তিনি রাশিয়ার সঙ্গে কাজান ও আস্ত্রাখান যোগ করেন। পিটারের কীর্তিও মহান—তিনি ইউরোপের দিকে রাস্তা খুলে দেন, বাল্টিক সাগরের তীরে নতুন রাজধানী সেন্ট পিটার্সবার্গ নির্মাণ করেন, রুশ নৌবাহিনী গড়ে তোলেন, আমাদের সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ও শিক্ষার বিকাশের জন্য অনেক কাজ করেন। শেষে, রাশিয়াকে সাম্রাজ্য হিসেবে ঘোষণাও করেন পিটারই।
বর্তমান প্রেসিডেন্ট পুতিন অতীতের কোন শাসকের অনুসরণ করেন বলে আপনার মনে হয়? তাঁকে তো কারও সঙ্গে তুলনা করা হয়নি—ভ্লাদিমির স্ভিতোই অথবা তৃতীয় আলেকসান্দরের সঙ্গেও তুলনা করা হয়নি...
আমার মতে, পুতিন সবচেয়ে বেশি সম্মান করেন জার পিটারকে। স্তালিন সম্মান করতেন ইভান গ্রোজনিকে। কিন্তু এর মানে এই নয় যে প্রেসিডেন্ট পুতিন কারও অনুসরণ করছেন। পুতিনের পথ সম্পূর্ণ স্বাধীন, তিনি কারও ঐতিহ্যের উত্তরসূরি নন। যা কিছু তিনি করেন, তা করেন নিজের বোঝাপড়া অনুযায়ী, নিজের বুদ্ধি, জ্ঞান এবং ইচ্ছাশক্তির ওপর নির্ভর করে। তিনি বুঝতে পারেন যে বর্তমানে বিশ্বে তিনটি মহান শক্তি রয়েছে—রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। রাশিয়া ও চীন—এই দুই দেশ মিত্র, আর যুক্তরাষ্ট্র এর বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারে না।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনকে প্রেসিডেন্ট পুতিন বলেছেন ‘বিশ শতকের সবচেয়ে বড় ভূরাজনৈতিক বিপর্যয়’। আর আপনি একসময় বলেছিলেন, ইউনিয়নকে ‘কৃত্রিমভাবে ও উদ্দেশ্যমূলকভাবে ধ্বংস করা হয়েছিল’। অর্থাৎ, আপনার মতে দেশটি ভেঙে পড়েছিল সোভিয়েত নেতৃত্বের ভুল হিসাবের কারণে নয়, ‘ফ্রিজ টেলিভিশনকে হারিয়েছে’ (বাস্তবতার কাছে নান্দনিকতা পরাজিত হয়েছে) বলেই নয়, বরং কারও দুষ্ট ইচ্ছায়?
অবশ্যই। সোভিয়েত ইউনিয়নকে ধ্বংস করেছিল পশ্চিমা দেশগুলো। এটি ছিল একটি ষড়যন্ত্র, যা গরবাচেভ ক্ষমতায় আসার আগেই জন্ম নিয়েছিল। আন্দ্রোপভের শাসন পশ্চিমে প্রচণ্ড ভয় ধরিয়েছিল, কারণ তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নকে শক্তিশালী করতে চেয়েছিলেন। পশ্চিমাদের সৌভাগ্য, আন্দ্রোপভ দেশটির নেতৃত্বে মাত্র এক বছরের একটু বেশি সময় কাটিয়ে মারা যান। এরপর তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাগ্য নিজেদের হাতে তুলে নেবে।
তারা মিখাইল সেরগিয়েভিচ এবং রাইসা মাকসিমোভনাকে লন্ডনে আমন্ত্রণ জানায়, তখনো গরবাচেভ আমাদের দেশের প্রধান নেতা হননি। মার্গারেট থ্যাচার, যিনি তখন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী, গরবাচেভের সঙ্গে পাঁচ ঘণ্টা কথা বলেন। তারপর তিনি তাঁর সব মিত্রকে জানান যে–এই সেই নেতা যাঁকে পশ্চিমের প্রয়োজন। সোভিয়েত জনগণের নয়, বরং পশ্চিমের প্রয়োজন! এরপর তারা তাঁকে সমর্থন করতে শুরু করে এবং কার্যত তাঁকে পরিচালনা করতে থাকে—খোলাখুলি নয় অবশ্য, গোপনে।
গরবাচেভের সব প্রাথমিক সংস্কারই বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া ছিল, এমনকি মদবিরোধী প্রচারণাটিও। এমন ক্যাম্পেইন আগে আমেরিকায় চালানো হয়েছিল, কিন্তু তা শুধু মাফিয়া তৈরি করেছিল এবং শেষে ব্যর্থ হয়েছিল। এটি যে ব্যর্থ হবে, তা পশ্চিমারা জানত। গরবাচেভ সোভিয়েত ইউনিয়ন ধ্বংসের জন্য যা যা করা প্রয়োজন ছিল, সবই করেছিলেন। এমনকি রাইসা মাকসিমোভনাকেও তারা ঘুষ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তাঁকে একটি হীরার ক্রেডিট কার্ড দেওয়া হয় এবং বলা হয় যে পাঁচ বছরের মধ্যে তিনি পশ্চিমা দেশের দোকানে ইচ্ছেমতো যেকোনো পণ্য কিনতে পারবেন এবং এই ঋণ পরিশোধ করতে হবে না।
যতদূর আমি জানি, গরবাচেভ নিজে এই কার্ডের গল্পটি অস্বীকার করেছিলেন। আপনার কাছে এই তথ্য এল কোথা থেকে?
এটা আমি আপনাকে বলব না, তবে আমি এই তথ্যের যথার্থতা সম্পর্কে নিশ্চিত। আমি নিশ্চিত যে পশ্চিম ঘুষ দিয়ে কাজ করছিল...। যদিও সেই সময়ে আমিও গরবাচেভকে বিশ্বাস করেছিলাম, আর সেটাই ছিল আমার ভুল। আমি তাঁকে নিয়ে দুটি প্রশংসামূলক বই লিখেছিলাম। এখন অবশ্য সে ব্যাপারে আফসোস করি। যেমন আফসোস করি যে আমি সোভিয়েত সর্বোচ্চ পরিষদে (ভেরখোভনি সোভিয়েত) যোগ দিয়েছিলাম এবং আইন প্রণয়নের কাজে লেগে পড়েছিলাম। এটি ইতিহাসবিদের কাজ নয়—ইতিহাসবিদের তো এর জন্য প্রয়োজনীয় আইনি জ্ঞান, দক্ষতা থাকে না। কিন্তু ‘না’ বলা কঠিন ছিল। গরবাচেভ আমাকেও সামান্য ক্ষমতা দিয়েছিলেন। আমাকে সেই কমিশনের প্রধান করা হয়েছিল, যা দুর্নীতির সমস্যা বিবেচনা করত। এবং আমি যেকোনো ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারতাম, গরবাচেভকে ছাড়া। উদাহরণস্বরূপ, আমি ইয়েলৎসিনকে দুই ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলাম। তখনকার কেজিবি চেয়ারম্যান চেব্রিকভও আমার কাছে এসেছিলেন এবং তিনিও দুই ঘণ্টা ধরে জবাবদিহি করেছিলেন।
কিছুদিন পরই চেব্রিকভের উত্তরসূরি ক্রিউচকভ গেকেচেপেতে (চরম পরিস্থিতিসংক্রান্ত রাষ্ট্রীয় কমিশন) যোগ দেন, যারা গরবাচেভকে ক্রিমিয়ায় বিচ্ছিন্ন করে রেখে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঠেকানোর চেষ্টা করেছিল। গেকেচেপের নিয়ন্ত্রণে তখন বিশেষ সংস্থাগুলো, সেনাবাহিনী, এমনকি পুলিশও ছিল। তাহলে তারা কেন হেরে গেল এবং জেলে গেল? আর কেন জনগণ রাস্তায় নামেনি ইউনিয়নকে বাঁচাতে—না আগস্টে, না ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে?
কারণ অনেক ছিল। প্রথমত, সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল—ক্ষুধা, দোকানের ফাঁকা তাক আর নানান সমস্যায়। সেনাবাহিনী ভীষণ অসন্তুষ্ট ছিল। কারণ সামরিক কর্মীদের বেতন দেওয়া বিলম্বিত হচ্ছিল। শেষে, কোনো নেতা ছিল না। সেই ক্রিউচকভকেই আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম—তিনি ছিলেন দুর্বল মানসিকতার মানুষ। তিনি এক গেকেচেপে সদস্য থেকে আরেক সদস্যের কাছে দৌড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করতেন যে কী করতে হবে? এ ধরনের লোক দিয়ে বিপ্লব হয় না। দেশের পতন থামাতে নেপোলিয়নের মতো ব্যক্তিত্ব প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সেই সময়ে আমাদের কাছে দুর্ভাগ্যবশত কোনো নেপোলিয়ন ছিল না। তাই জনগণ রাস্তায় নামেনি—কারও অনুসরণ করার মতো নেতা ছিল না।
আপনি কি মনে করেন যে রাশিয়া ‘শক্তিশালী হাত’ ছাড়া বাঁচতে পারে না? না হলে এটিকে সব সময় অরাজকতা ও বিভাজনের মুখোমুখি হতে হবে?
হ্যাঁ, রাশিয়ার জন্য শক্তিশালী শাসন প্রয়োজন। কিন্তু নিপীড়কতন্ত্র নয়, কারণ নিপীড়কতন্ত্র হলো এমন একটি শাসনব্যবস্থা, যা আইন মানে না। আমাদের শক্তিশালী শাসন প্রয়োজন, কারণ দেশটি অনেক বড় এবং দেশটির সামনে থাকা চ্যালেঞ্জগুলোও অনেক বড়। উদাহরণস্বরূপ, রাশিয়ান জনগণকে রক্ষা করার দায়িত্ব সরকারের। আমাদের জনগণ বিভক্ত এবং বিভাজন শুরু হয়েছিল লেনিনের আমলে, যিনি প্রায় ১২ মিলিয়ন রাশিয়ান মানুষকে ইউক্রেনে দিয়েছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন যে কমিউনিস্ট পার্টি চিরকাল রাষ্ট্রকে পরিচালনা করবে এবং এই রাষ্ট্রও শতাব্দী ধরে টিকবে। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ৭০ বছরও টিকে থাকতে পারেনি এবং ধ্বংস হয়ে গেল।
ওদেসা, নিকোলায়েভ, খারকিভ এবং অন্যান্য শহরে বসবাসকারী লাখ লাখ রাশিয়ান রাশিয়ার সীমার বাইরে পড়ে থাকলেন। ২০০৮ সালে আমি ইউক্রেনে গিয়েছিলাম, কিয়েভেও গিয়েছিলাম। প্রতিটি জায়গায় আমার সঙ্গে শুধু রুশ ভাষায়ই কথা বলা হয়েছিল—হোটেল, ক্যাফে, দোকানগুলোতে...তারপর ইউক্রেনে রুশ ভাষা ও রুশ সংবাদপত্রের ওপর ভয়ংকর দমন শুরু হয়। ২০১৪ সালে জাতীয়তাবাদীরা সরকার পরিবর্তনও ঘটায়। সুতরাং আমাদের বিশেষ সামরিক অভিযান কেবল সময়ের ব্যাপার ছিল।
আপনাকে ধন্যবাদ।
আপনাকেও ধন্যবাদ।
রই আলেক্সান্দ্রোভিচ, একবার আপনি বলেছিলেন যে রাশিয়াকে এক মহান রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ইভান গ্রোজনি নয়, বরং জার পিটার। কিন্তু পিটার তো ইউরোপীয় ধাঁচে রাষ্ট্র গড়ে তুলেছিলেন, আর আজ ইউরোপ অনেক রাশিয়ানের কাছে প্রায় মন্দের প্রতিশব্দ। ইভান গ্রোজনিকে রুশ দেশের মানুষেরা বরং অনেক বেশি ‘মূল্যবোধসংলগ্ন’ শাসক বলে মনে করে থাকেন। জনগণের ঐক্য দিবসে ভোলগদায় তাঁর ৯ মিটার উঁচু একটি মূর্তি উন্মোচন করা হয়েছে এবং এটি মোটেই প্রথম স্মৃতিস্তম্ভ নয়। এই দুই ব্যক্তিত্বকে একে অপরের বিপরীতে দাঁড় করানো কি ঠিক?
আমি মনে করি, ইভান গ্রোজনি এবং জার পিটার—দুজনই সম্মান ও শ্রদ্ধা পাওয়ার যোগ্য, উভয়েই মহান ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব। এবং সত্যিই তাঁদের একে অপরের বিপরীতে দাঁড় করানোর প্রয়োজন নেই। গ্রোজনি রুশ জারতন্ত্র তৈরি করেছিলেন, তাঁর আমলেই সাইবেরিয়া দখল শুরু হয়, তিনি রাশিয়ার সঙ্গে কাজান ও আস্ত্রাখান যোগ করেন। পিটারের কীর্তিও মহান—তিনি ইউরোপের দিকে রাস্তা খুলে দেন, বাল্টিক সাগরের তীরে নতুন রাজধানী সেন্ট পিটার্সবার্গ নির্মাণ করেন, রুশ নৌবাহিনী গড়ে তোলেন, আমাদের সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ও শিক্ষার বিকাশের জন্য অনেক কাজ করেন। শেষে, রাশিয়াকে সাম্রাজ্য হিসেবে ঘোষণাও করেন পিটারই।
বর্তমান প্রেসিডেন্ট পুতিন অতীতের কোন শাসকের অনুসরণ করেন বলে আপনার মনে হয়? তাঁকে তো কারও সঙ্গে তুলনা করা হয়নি—ভ্লাদিমির স্ভিতোই অথবা তৃতীয় আলেকসান্দরের সঙ্গেও তুলনা করা হয়নি...
আমার মতে, পুতিন সবচেয়ে বেশি সম্মান করেন জার পিটারকে। স্তালিন সম্মান করতেন ইভান গ্রোজনিকে। কিন্তু এর মানে এই নয় যে প্রেসিডেন্ট পুতিন কারও অনুসরণ করছেন। পুতিনের পথ সম্পূর্ণ স্বাধীন, তিনি কারও ঐতিহ্যের উত্তরসূরি নন। যা কিছু তিনি করেন, তা করেন নিজের বোঝাপড়া অনুযায়ী, নিজের বুদ্ধি, জ্ঞান এবং ইচ্ছাশক্তির ওপর নির্ভর করে। তিনি বুঝতে পারেন যে বর্তমানে বিশ্বে তিনটি মহান শক্তি রয়েছে—রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। রাশিয়া ও চীন—এই দুই দেশ মিত্র, আর যুক্তরাষ্ট্র এর বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারে না।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনকে প্রেসিডেন্ট পুতিন বলেছেন ‘বিশ শতকের সবচেয়ে বড় ভূরাজনৈতিক বিপর্যয়’। আর আপনি একসময় বলেছিলেন, ইউনিয়নকে ‘কৃত্রিমভাবে ও উদ্দেশ্যমূলকভাবে ধ্বংস করা হয়েছিল’। অর্থাৎ, আপনার মতে দেশটি ভেঙে পড়েছিল সোভিয়েত নেতৃত্বের ভুল হিসাবের কারণে নয়, ‘ফ্রিজ টেলিভিশনকে হারিয়েছে’ (বাস্তবতার কাছে নান্দনিকতা পরাজিত হয়েছে) বলেই নয়, বরং কারও দুষ্ট ইচ্ছায়?
অবশ্যই। সোভিয়েত ইউনিয়নকে ধ্বংস করেছিল পশ্চিমা দেশগুলো। এটি ছিল একটি ষড়যন্ত্র, যা গরবাচেভ ক্ষমতায় আসার আগেই জন্ম নিয়েছিল। আন্দ্রোপভের শাসন পশ্চিমে প্রচণ্ড ভয় ধরিয়েছিল, কারণ তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নকে শক্তিশালী করতে চেয়েছিলেন। পশ্চিমাদের সৌভাগ্য, আন্দ্রোপভ দেশটির নেতৃত্বে মাত্র এক বছরের একটু বেশি সময় কাটিয়ে মারা যান। এরপর তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাগ্য নিজেদের হাতে তুলে নেবে।
তারা মিখাইল সেরগিয়েভিচ এবং রাইসা মাকসিমোভনাকে লন্ডনে আমন্ত্রণ জানায়, তখনো গরবাচেভ আমাদের দেশের প্রধান নেতা হননি। মার্গারেট থ্যাচার, যিনি তখন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী, গরবাচেভের সঙ্গে পাঁচ ঘণ্টা কথা বলেন। তারপর তিনি তাঁর সব মিত্রকে জানান যে–এই সেই নেতা যাঁকে পশ্চিমের প্রয়োজন। সোভিয়েত জনগণের নয়, বরং পশ্চিমের প্রয়োজন! এরপর তারা তাঁকে সমর্থন করতে শুরু করে এবং কার্যত তাঁকে পরিচালনা করতে থাকে—খোলাখুলি নয় অবশ্য, গোপনে।
গরবাচেভের সব প্রাথমিক সংস্কারই বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া ছিল, এমনকি মদবিরোধী প্রচারণাটিও। এমন ক্যাম্পেইন আগে আমেরিকায় চালানো হয়েছিল, কিন্তু তা শুধু মাফিয়া তৈরি করেছিল এবং শেষে ব্যর্থ হয়েছিল। এটি যে ব্যর্থ হবে, তা পশ্চিমারা জানত। গরবাচেভ সোভিয়েত ইউনিয়ন ধ্বংসের জন্য যা যা করা প্রয়োজন ছিল, সবই করেছিলেন। এমনকি রাইসা মাকসিমোভনাকেও তারা ঘুষ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তাঁকে একটি হীরার ক্রেডিট কার্ড দেওয়া হয় এবং বলা হয় যে পাঁচ বছরের মধ্যে তিনি পশ্চিমা দেশের দোকানে ইচ্ছেমতো যেকোনো পণ্য কিনতে পারবেন এবং এই ঋণ পরিশোধ করতে হবে না।
যতদূর আমি জানি, গরবাচেভ নিজে এই কার্ডের গল্পটি অস্বীকার করেছিলেন। আপনার কাছে এই তথ্য এল কোথা থেকে?
এটা আমি আপনাকে বলব না, তবে আমি এই তথ্যের যথার্থতা সম্পর্কে নিশ্চিত। আমি নিশ্চিত যে পশ্চিম ঘুষ দিয়ে কাজ করছিল...। যদিও সেই সময়ে আমিও গরবাচেভকে বিশ্বাস করেছিলাম, আর সেটাই ছিল আমার ভুল। আমি তাঁকে নিয়ে দুটি প্রশংসামূলক বই লিখেছিলাম। এখন অবশ্য সে ব্যাপারে আফসোস করি। যেমন আফসোস করি যে আমি সোভিয়েত সর্বোচ্চ পরিষদে (ভেরখোভনি সোভিয়েত) যোগ দিয়েছিলাম এবং আইন প্রণয়নের কাজে লেগে পড়েছিলাম। এটি ইতিহাসবিদের কাজ নয়—ইতিহাসবিদের তো এর জন্য প্রয়োজনীয় আইনি জ্ঞান, দক্ষতা থাকে না। কিন্তু ‘না’ বলা কঠিন ছিল। গরবাচেভ আমাকেও সামান্য ক্ষমতা দিয়েছিলেন। আমাকে সেই কমিশনের প্রধান করা হয়েছিল, যা দুর্নীতির সমস্যা বিবেচনা করত। এবং আমি যেকোনো ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারতাম, গরবাচেভকে ছাড়া। উদাহরণস্বরূপ, আমি ইয়েলৎসিনকে দুই ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলাম। তখনকার কেজিবি চেয়ারম্যান চেব্রিকভও আমার কাছে এসেছিলেন এবং তিনিও দুই ঘণ্টা ধরে জবাবদিহি করেছিলেন।
কিছুদিন পরই চেব্রিকভের উত্তরসূরি ক্রিউচকভ গেকেচেপেতে (চরম পরিস্থিতিসংক্রান্ত রাষ্ট্রীয় কমিশন) যোগ দেন, যারা গরবাচেভকে ক্রিমিয়ায় বিচ্ছিন্ন করে রেখে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঠেকানোর চেষ্টা করেছিল। গেকেচেপের নিয়ন্ত্রণে তখন বিশেষ সংস্থাগুলো, সেনাবাহিনী, এমনকি পুলিশও ছিল। তাহলে তারা কেন হেরে গেল এবং জেলে গেল? আর কেন জনগণ রাস্তায় নামেনি ইউনিয়নকে বাঁচাতে—না আগস্টে, না ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে?
কারণ অনেক ছিল। প্রথমত, সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল—ক্ষুধা, দোকানের ফাঁকা তাক আর নানান সমস্যায়। সেনাবাহিনী ভীষণ অসন্তুষ্ট ছিল। কারণ সামরিক কর্মীদের বেতন দেওয়া বিলম্বিত হচ্ছিল। শেষে, কোনো নেতা ছিল না। সেই ক্রিউচকভকেই আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম—তিনি ছিলেন দুর্বল মানসিকতার মানুষ। তিনি এক গেকেচেপে সদস্য থেকে আরেক সদস্যের কাছে দৌড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করতেন যে কী করতে হবে? এ ধরনের লোক দিয়ে বিপ্লব হয় না। দেশের পতন থামাতে নেপোলিয়নের মতো ব্যক্তিত্ব প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সেই সময়ে আমাদের কাছে দুর্ভাগ্যবশত কোনো নেপোলিয়ন ছিল না। তাই জনগণ রাস্তায় নামেনি—কারও অনুসরণ করার মতো নেতা ছিল না।
আপনি কি মনে করেন যে রাশিয়া ‘শক্তিশালী হাত’ ছাড়া বাঁচতে পারে না? না হলে এটিকে সব সময় অরাজকতা ও বিভাজনের মুখোমুখি হতে হবে?
হ্যাঁ, রাশিয়ার জন্য শক্তিশালী শাসন প্রয়োজন। কিন্তু নিপীড়কতন্ত্র নয়, কারণ নিপীড়কতন্ত্র হলো এমন একটি শাসনব্যবস্থা, যা আইন মানে না। আমাদের শক্তিশালী শাসন প্রয়োজন, কারণ দেশটি অনেক বড় এবং দেশটির সামনে থাকা চ্যালেঞ্জগুলোও অনেক বড়। উদাহরণস্বরূপ, রাশিয়ান জনগণকে রক্ষা করার দায়িত্ব সরকারের। আমাদের জনগণ বিভক্ত এবং বিভাজন শুরু হয়েছিল লেনিনের আমলে, যিনি প্রায় ১২ মিলিয়ন রাশিয়ান মানুষকে ইউক্রেনে দিয়েছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন যে কমিউনিস্ট পার্টি চিরকাল রাষ্ট্রকে পরিচালনা করবে এবং এই রাষ্ট্রও শতাব্দী ধরে টিকবে। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ৭০ বছরও টিকে থাকতে পারেনি এবং ধ্বংস হয়ে গেল।
ওদেসা, নিকোলায়েভ, খারকিভ এবং অন্যান্য শহরে বসবাসকারী লাখ লাখ রাশিয়ান রাশিয়ার সীমার বাইরে পড়ে থাকলেন। ২০০৮ সালে আমি ইউক্রেনে গিয়েছিলাম, কিয়েভেও গিয়েছিলাম। প্রতিটি জায়গায় আমার সঙ্গে শুধু রুশ ভাষায়ই কথা বলা হয়েছিল—হোটেল, ক্যাফে, দোকানগুলোতে...তারপর ইউক্রেনে রুশ ভাষা ও রুশ সংবাদপত্রের ওপর ভয়ংকর দমন শুরু হয়। ২০১৪ সালে জাতীয়তাবাদীরা সরকার পরিবর্তনও ঘটায়। সুতরাং আমাদের বিশেষ সামরিক অভিযান কেবল সময়ের ব্যাপার ছিল।
আপনাকে ধন্যবাদ।
আপনাকেও ধন্যবাদ।

ব্রিকস হচ্ছে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার ইংরেজি আদ্যাক্ষর নিয়ে গঠিত সংস্থার নাম। সম্প্রতি রাশিয়ার কাজানে ব্রিকসের সম্মেলন সমাপ্ত হয়েছে। ব্রিকসের ১০ সদস্যদেশসহ মোট ৩৫টি দেশের প্রতিনিধিরা সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। সম্মেলনে ব্রিকসের সদস্যদেশগুলোর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ডলারের পরিবর্তে ব্রি
২৮ ডিসেম্বর ২০২৪
রাজনীতি কোন পথে যাত্রা করেছে, তা কি সাধারণ মানুষ বুঝতে পারছে? যে রাজনৈতিক দলগুলো রাজনীতির মাঠে সক্রিয়, তারা নির্বাচনের জন্য কতটা তৈরি হয়ে আছে, তা নিয়ে সংশয় এখনো কাটছে না। বলা হচ্ছে, ডিসেম্বরের মাঝামাঝি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে। রমজানের আগেই নির্বাচন সুসম্পন্ন হবে বলে অনেকেই আশা প্রকাশ করছেন।
৯ ঘণ্টা আগে
চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে দেশে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন স্মারক ছাড়াও মাজার, সাধু-সন্ন্যাসী, বাউল-ফকিরসহ সংখ্যালঘু ও ভিন্ন মতাদর্শের মানুষের ওপর হামলা যেন থামছেই না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসব হামলায় ধর্মতন্ত্রী একটি গোষ্ঠীকে নেতৃত্ব দিতে দেখা যাচ্ছে। হামলাকারীরা নিজেদের ‘তৌহিদি জনতা’...
৯ ঘণ্টা আগে
বাংলাদেশে গত পাঁচ দশকের বেশি সময়ের মধ্যে সংঘটিত পরিবর্তনে দেশের জনগণের ও নেতৃত্বের ভূমিকা কী, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল, জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা কী, অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা গ্রহণের প্রয়োজনে তা বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখা একান্ত দরকার।
১ দিন আগেবাংলাদেশে শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থার আমূল সংস্কার দরকার। এর জন্য প্রথম পর্যায়ে দরকার সর্বজনীন কল্যাণে বিবেকবান চিন্তাশীল ব্যক্তিদের দূরদর্শী চিন্তাভাবনা, আলোচনা-সমালোচনা ও বিচার-বিবেচনা। শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থা কেমন হওয়া উচিত, সে সম্পর্কে ধারণা যদি ঠিক হয়, তাহলে সেই লক্ষ্যে পর্যায়ক্রমে চেষ্টা চালালে সমাধানযোগ্য সব সমস্যারই সমাধান করা যাবে।
আবুল কাসেম ফজলুল হক

বাংলাদেশে গত পাঁচ দশকের বেশি সময়ের মধ্যে সংঘটিত পরিবর্তনে দেশের জনগণের ও নেতৃত্বের ভূমিকা কী, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল, জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা কী, অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা গ্রহণের প্রয়োজনে তা বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখা একান্ত দরকার। দেখা দরকার, কী হতে পারত আর কী হয়েছে, কী আমরা করতে পারতাম আর কী করেছি। স্বাধীন বাংলাদেশে জাতীয় চরিত্রের কী পরিচয় আমরা দিয়েছি? রাজনীতিতে, অর্থনীতিতে, শিক্ষাব্যবস্থায়, প্রশাসনব্যবস্থায়, বিচারব্যবস্থায় গত ৫৪ বছরে আমাদের সংস্কৃতির চেহারাটা কী? সংগীতে, চারুশিল্পে, সাহিত্যে, জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চায় আমাদের জাতির সৃষ্টিশীলতার স্বরূপ কী? আমরা কোন গন্তব্যের দিকে চলছি? সবকিছুই কি অনিবার্য ছিল? আমাদের স্বাধীনতা বলে কি কিছুই ছিল না? স্বাধীনতার সদ্ব্যবহার আমরা কতটা করেছি? এখন আমাদের লক্ষ্য কী? আমাদের আত্মজিজ্ঞাসা, আত্মসমালোচনা ও আত্মোৎকর্ষ দরকার।
আমাদের শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থা তো রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিশ্বব্যবস্থারই অংশ। তবু সরকার চাইলে এরই মধ্যে ভালো অনেক কিছু করতে পারত বা করতে পারে। শিক্ষাব্যবস্থা নানা ধারা-উপধারায় এমনভাবে বিভক্ত যে তা জাতিগঠন ও রাষ্ট্রগঠনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এ ব্যাপারে শিক্ষক, অভিভাবক, সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী—কারও মধ্যেই খুব একটা সচেতনতা নেই। সবাই চলমান ব্যবস্থাকে মেনে নিয়ে চলছেন, পরিবর্তন সাধনের চিন্তা ও চেষ্টা নেই। বাংলাদেশে ব্রিটিশ সরকার ব্রিটিশ কাউন্সিলের মাধ্যমে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়কৃত পাঠ্যসূচি ও পাঠ্যক্রম অনুযায়ী ইংরেজি মাধ্যমে চালাচ্ছে ও লেভেল, এ লেভেল, যা ব্রিটিশ স্বার্থে ব্রিটেনের বাস্তবতা অনুযায়ী পরিকল্পিত। তা ছাড়া, বাইরে থেকে বাংলাদেশে ইংরেজি মাধ্যমে অন্য ধারার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ও চালানো হচ্ছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশের মূলধারার শিক্ষাকে দুই ভাগে বিভক্ত করে বাংলা মাধ্যমের পাশাপাশি চালাচ্ছে ‘ইংলিশ ভার্সন’। এনজিও মহল থেকে চালানো হচ্ছে নানা ধরনের বিদ্যালয়। পাশাপাশি আছে আলিয়া মাদ্রাসা ও কওমি মাদ্রাসার ধারা। তা ছাড়া আছে সরকারি ও বেসরকারি কয়েক ধারার মাদ্রাসা। মূলধারার পাঠ্যসূচি, পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক মোটেই সন্তোষজনক নয়। এখন মূলধারার পাঠ্যপুস্তকের হেফাজতীকরণ নিয়ে প্রচারমাধ্যমে বাদ-প্রতিবাদ চলছে। আগে বিতর্ক ছিল জামায়াতীকরণ নিয়ে। সরকার কর্তৃক মাদ্রাসা ধারার আধুনিকীকরণের চেষ্টার প্রতিক্রিয়ায় চলছে মূলধারার ইসলামীকরণের জন্য এই চাপ।
কথিত সৃজনশীল পরীক্ষাপদ্ধতি শিক্ষার্থীদের শিক্ষাবিমুখ, জ্ঞানবিমুখ, অনুসন্ধিৎসাবিমুখ ও পরীক্ষামুখী করেছে। শিক্ষা আর পরীক্ষার ফলকে সমার্থক করে ফেলা হয়েছে। শিক্ষার অর্থ করা হচ্ছে কথিত সৃজনশীল পদ্ধতিতে জিপিএ ফাইভ পাওয়ার প্রস্তুতি। যারা সব পরীক্ষায় জিপিএ ফাইভ পাচ্ছে, তারা সৃজনশীল। ইউনিয়ন পর্যায় থেকে রাজধানী পর্যন্ত জিপিএ ফাইভ পাওয়া ছাত্র-ছাত্রীদের যেভাবে সংবর্ধনা দেওয়া হয়, তাতে জ্ঞানের প্রতি, শিক্ষার প্রতি তাদের আগ্রহের কোনো কারণ থাকে না। এসব পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসকে এখন সবাই মেনে নিচ্ছেন। জিপিএ ফাইভ পাওয়া ছাত্র-ছাত্রীদের ভালো বই উপহার না দিয়ে দেওয়া হয় ক্রেস্ট। শিক্ষার্থীদের উপহার দেওয়ার মতো ভালো বই কি বাংলাদেশে পাওয়া যায় না? শিক্ষার্থীদের মনে ধারণা দেওয়া হচ্ছে যে ইন্টারনেটের যুগে বইয়ের দিন শেষ।
রাষ্ট্রের সংবিধান ও জাতীয় শিক্ষানীতির আওতায় পাঠ্যসূচি, পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন এবং পরীক্ষা গ্রহণে প্রতিটি শিক্ষা বোর্ড হওয়া উচিত স্বায়ত্তশাসিত। আর প্রতিটি শিক্ষা বোর্ডের আওতায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন ও প্রকাশ করার জন্য আলাদা আলাদা পাঠ্যপুস্তক শাখা প্রতিষ্ঠা করা উচিত। তাতে বিভিন্ন বোর্ডের প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে পাঠ্যপুস্তকের ও শিক্ষার উন্নতি হবে। শিক্ষার পরীক্ষাসর্বস্ব ধারণা পরিহার্য। সর্বত্র বহুত্ববাদ, কেবল শিক্ষাক্ষেত্রে নিরঙ্কুশ কেন্দ্রিকতাবাদ কেন?
আমাদের ধারণা, মূলধারার বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার সার্বিক উন্নতি সাধন করা গেলে, তা দেখে অন্য সব ধারাও উন্নতিতে আগ্রহী হবে। তীব্র বিরোধমূলক বাস্তবতায় সুফলপ্রদ কিছুই করা যাবে না। মাদ্রাসা ধারার আধুনিকীকরণের চেষ্টার ফলে যে প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে, তাতে মূলধারার বাংলা মাধ্যম এখন ভীষণ চাপে আছে। ২০১০ সালের শিক্ষানীতি থেকে আজ পর্যন্ত শিক্ষক্ষেত্রে কী কী প্রচেষ্টা, প্রতিক্রিয়া ও প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তা বিবেচনা করে নতুন পরিকল্পনা ও কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। মূলধারার বাংলা মাধ্যমকে অবশ্যই অগ্রাধিকার দিতে হবে, বাংলাদেশের ঐতিহ্যকে ও বাংলা ভাষাকেও অগ্রাধিকার দিতে হবে।
আর্থসামাজিক-রাষ্ট্রিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতার সঙ্গে সংগতি রেখে ডিজিটাল পদ্ধতি প্রবর্তন করতে হবে। ব্লগে, অনলাইনে যাঁরা সক্রিয় আছেন, তাঁদের কেবল উপরিতলে তাকিয়ে চিন্তা করা ঠিক নয়, গভীরে ও ব্যাপ্তিতে দৃষ্টিকে প্রসারিত করতে হবে। সারা দেশে পেশামূলক শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটাতে হবে।
বিশ্বমান অর্জনের নামে জাতীয় স্বাধীনতা ও জাতীয় ঐতিহ্যকে বিসর্জন দেওয়া মারাত্মক ভুল। পাশ্চাত্যের প্রগতিশীল ভাবধারাকে গ্রহণ করতে হবে এবং উপনিবেশবাদী, সাম্রাজ্যবাদী ও ফ্যাসিবাদী ভাবধারা পরিহার করে চলতে হবে। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে উচ্চশিক্ষার অবস্থাও ভালো নয়। অন্ধভাবে সাম্রাজ্যবাদী নীতি গ্রহণ করে চলার ফলে কোনোটাই স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। যেভাবে সেমিস্টার পদ্ধতি চালু করা হয়েছে, তাতে উচ্চশিক্ষাকেও পরীক্ষামুখী করে ফেলা হয়েছে। পরীক্ষা আর শিক্ষা যে এক নয়, কেবল পরীক্ষার ফল ভালো করলেই যে কেউ শিক্ষিত হয় না, গোটা জাতিকে এটা বুঝতে হবে। বাংলাদেশে চিকিৎসা, কৃষি, প্রকৌশল ও প্রযুক্তিবিষয়ক শিক্ষা সেগুলোতে গৌণ ব্যাপার!
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষা নেই। পরীক্ষাসর্বস্ব এই শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষা নিয়ে ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবক—কারও আনন্দ নেই। এ অবস্থায় ১৯৮০-এর দশক থেকেই ব্যাপক প্রসার ঘটেছে কোচিং সেন্টার, গাইড বুক ইত্যাদির। এগুলোতে শিক্ষার কোনো আয়োজনই নেই, আছে কেবল পরীক্ষার ফল ভালো করানোর আয়োজন। শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে, পরীক্ষার ফল খুব ভালো করছে—দ্রুত সৃজনশীল হচ্ছে। যারা উদ্যোগী ও পরিশ্রমী, তারা বাংলাদেশকে ভবিষ্যৎহীন ভেবে ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া—নানা রাষ্ট্রে নাগরিকত্ব নিচ্ছে। ব্রেন ড্রেন সম্পূর্ণ নতুন রূপ নিয়েছে। দেশপ্রেম, স্বাজাত্যবোধ, সুনাগরিকের গুণাবলি ও জ্ঞান অর্জন হচ্ছে না।
দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে যত আলোচনা করা হবে, ততই এর ত্রুটিবিচ্যুতি ও বিকৃতির দিকগুলো সামনে আসবে। জনগণের জন্য অনভিপ্রেত অবাঞ্ছিত অনেক কিছুকে কায়েমি-স্বার্থবাদীরা ক্রমাগত বলে প্রচার করছে।
বাংলাদেশে শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থার আমূল সংস্কার দরকার। এর জন্য প্রথম পর্যায়ে দরকার সর্বজনীন কল্যাণে বিবেকবান চিন্তাশীল ব্যক্তিদের দূরদর্শী চিন্তাভাবনা, আলোচনা-সমালোচনা ও বিচার-বিবেচনা। শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থা কেমন হওয়া উচিত, সে সম্পর্কে ধারণা যদি ঠিক হয়, তাহলে সেই লক্ষ্যে পর্যায়ক্রমে চেষ্টা চালালে সমাধানযোগ্য সব সমস্যারই সমাধান করা যাবে। লক্ষ্য ও যাত্রাপথ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নিয়ে এগোতে হবে।
এ অবস্থায় বাংলাদেশকে সর্বজনীন গণতন্ত্র অবলম্বন করে জনগণের স্বাধীন প্রগতিশীল গণরাষ্ট্র রূপে গড়ে তোলা আমাদের কেন্দ্রীয় কর্তব্য। জাতীয়তাবাদ ও তার সম্পূরক আন্তর্জাতিকতাবাদ অবলম্বন করে বিশ্বব্যবস্থাকে পুনর্গঠিত করতে হবে। সেই লক্ষ্যে পৃথিবীর সব রাষ্ট্রে, জনজীবনের আরম্ভ করা দরকার। সব রাষ্ট্রেই শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার দরকার।
লেখক: আবুল কাসেম ফজলুল হক, রাষ্ট্রচিন্তক ও সাবেক অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলাদেশে গত পাঁচ দশকের বেশি সময়ের মধ্যে সংঘটিত পরিবর্তনে দেশের জনগণের ও নেতৃত্বের ভূমিকা কী, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল, জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা কী, অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা গ্রহণের প্রয়োজনে তা বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখা একান্ত দরকার। দেখা দরকার, কী হতে পারত আর কী হয়েছে, কী আমরা করতে পারতাম আর কী করেছি। স্বাধীন বাংলাদেশে জাতীয় চরিত্রের কী পরিচয় আমরা দিয়েছি? রাজনীতিতে, অর্থনীতিতে, শিক্ষাব্যবস্থায়, প্রশাসনব্যবস্থায়, বিচারব্যবস্থায় গত ৫৪ বছরে আমাদের সংস্কৃতির চেহারাটা কী? সংগীতে, চারুশিল্পে, সাহিত্যে, জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চায় আমাদের জাতির সৃষ্টিশীলতার স্বরূপ কী? আমরা কোন গন্তব্যের দিকে চলছি? সবকিছুই কি অনিবার্য ছিল? আমাদের স্বাধীনতা বলে কি কিছুই ছিল না? স্বাধীনতার সদ্ব্যবহার আমরা কতটা করেছি? এখন আমাদের লক্ষ্য কী? আমাদের আত্মজিজ্ঞাসা, আত্মসমালোচনা ও আত্মোৎকর্ষ দরকার।
আমাদের শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থা তো রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিশ্বব্যবস্থারই অংশ। তবু সরকার চাইলে এরই মধ্যে ভালো অনেক কিছু করতে পারত বা করতে পারে। শিক্ষাব্যবস্থা নানা ধারা-উপধারায় এমনভাবে বিভক্ত যে তা জাতিগঠন ও রাষ্ট্রগঠনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এ ব্যাপারে শিক্ষক, অভিভাবক, সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী—কারও মধ্যেই খুব একটা সচেতনতা নেই। সবাই চলমান ব্যবস্থাকে মেনে নিয়ে চলছেন, পরিবর্তন সাধনের চিন্তা ও চেষ্টা নেই। বাংলাদেশে ব্রিটিশ সরকার ব্রিটিশ কাউন্সিলের মাধ্যমে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়কৃত পাঠ্যসূচি ও পাঠ্যক্রম অনুযায়ী ইংরেজি মাধ্যমে চালাচ্ছে ও লেভেল, এ লেভেল, যা ব্রিটিশ স্বার্থে ব্রিটেনের বাস্তবতা অনুযায়ী পরিকল্পিত। তা ছাড়া, বাইরে থেকে বাংলাদেশে ইংরেজি মাধ্যমে অন্য ধারার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ও চালানো হচ্ছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশের মূলধারার শিক্ষাকে দুই ভাগে বিভক্ত করে বাংলা মাধ্যমের পাশাপাশি চালাচ্ছে ‘ইংলিশ ভার্সন’। এনজিও মহল থেকে চালানো হচ্ছে নানা ধরনের বিদ্যালয়। পাশাপাশি আছে আলিয়া মাদ্রাসা ও কওমি মাদ্রাসার ধারা। তা ছাড়া আছে সরকারি ও বেসরকারি কয়েক ধারার মাদ্রাসা। মূলধারার পাঠ্যসূচি, পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক মোটেই সন্তোষজনক নয়। এখন মূলধারার পাঠ্যপুস্তকের হেফাজতীকরণ নিয়ে প্রচারমাধ্যমে বাদ-প্রতিবাদ চলছে। আগে বিতর্ক ছিল জামায়াতীকরণ নিয়ে। সরকার কর্তৃক মাদ্রাসা ধারার আধুনিকীকরণের চেষ্টার প্রতিক্রিয়ায় চলছে মূলধারার ইসলামীকরণের জন্য এই চাপ।
কথিত সৃজনশীল পরীক্ষাপদ্ধতি শিক্ষার্থীদের শিক্ষাবিমুখ, জ্ঞানবিমুখ, অনুসন্ধিৎসাবিমুখ ও পরীক্ষামুখী করেছে। শিক্ষা আর পরীক্ষার ফলকে সমার্থক করে ফেলা হয়েছে। শিক্ষার অর্থ করা হচ্ছে কথিত সৃজনশীল পদ্ধতিতে জিপিএ ফাইভ পাওয়ার প্রস্তুতি। যারা সব পরীক্ষায় জিপিএ ফাইভ পাচ্ছে, তারা সৃজনশীল। ইউনিয়ন পর্যায় থেকে রাজধানী পর্যন্ত জিপিএ ফাইভ পাওয়া ছাত্র-ছাত্রীদের যেভাবে সংবর্ধনা দেওয়া হয়, তাতে জ্ঞানের প্রতি, শিক্ষার প্রতি তাদের আগ্রহের কোনো কারণ থাকে না। এসব পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসকে এখন সবাই মেনে নিচ্ছেন। জিপিএ ফাইভ পাওয়া ছাত্র-ছাত্রীদের ভালো বই উপহার না দিয়ে দেওয়া হয় ক্রেস্ট। শিক্ষার্থীদের উপহার দেওয়ার মতো ভালো বই কি বাংলাদেশে পাওয়া যায় না? শিক্ষার্থীদের মনে ধারণা দেওয়া হচ্ছে যে ইন্টারনেটের যুগে বইয়ের দিন শেষ।
রাষ্ট্রের সংবিধান ও জাতীয় শিক্ষানীতির আওতায় পাঠ্যসূচি, পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন এবং পরীক্ষা গ্রহণে প্রতিটি শিক্ষা বোর্ড হওয়া উচিত স্বায়ত্তশাসিত। আর প্রতিটি শিক্ষা বোর্ডের আওতায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন ও প্রকাশ করার জন্য আলাদা আলাদা পাঠ্যপুস্তক শাখা প্রতিষ্ঠা করা উচিত। তাতে বিভিন্ন বোর্ডের প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে পাঠ্যপুস্তকের ও শিক্ষার উন্নতি হবে। শিক্ষার পরীক্ষাসর্বস্ব ধারণা পরিহার্য। সর্বত্র বহুত্ববাদ, কেবল শিক্ষাক্ষেত্রে নিরঙ্কুশ কেন্দ্রিকতাবাদ কেন?
আমাদের ধারণা, মূলধারার বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার সার্বিক উন্নতি সাধন করা গেলে, তা দেখে অন্য সব ধারাও উন্নতিতে আগ্রহী হবে। তীব্র বিরোধমূলক বাস্তবতায় সুফলপ্রদ কিছুই করা যাবে না। মাদ্রাসা ধারার আধুনিকীকরণের চেষ্টার ফলে যে প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে, তাতে মূলধারার বাংলা মাধ্যম এখন ভীষণ চাপে আছে। ২০১০ সালের শিক্ষানীতি থেকে আজ পর্যন্ত শিক্ষক্ষেত্রে কী কী প্রচেষ্টা, প্রতিক্রিয়া ও প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তা বিবেচনা করে নতুন পরিকল্পনা ও কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। মূলধারার বাংলা মাধ্যমকে অবশ্যই অগ্রাধিকার দিতে হবে, বাংলাদেশের ঐতিহ্যকে ও বাংলা ভাষাকেও অগ্রাধিকার দিতে হবে।
আর্থসামাজিক-রাষ্ট্রিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতার সঙ্গে সংগতি রেখে ডিজিটাল পদ্ধতি প্রবর্তন করতে হবে। ব্লগে, অনলাইনে যাঁরা সক্রিয় আছেন, তাঁদের কেবল উপরিতলে তাকিয়ে চিন্তা করা ঠিক নয়, গভীরে ও ব্যাপ্তিতে দৃষ্টিকে প্রসারিত করতে হবে। সারা দেশে পেশামূলক শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটাতে হবে।
বিশ্বমান অর্জনের নামে জাতীয় স্বাধীনতা ও জাতীয় ঐতিহ্যকে বিসর্জন দেওয়া মারাত্মক ভুল। পাশ্চাত্যের প্রগতিশীল ভাবধারাকে গ্রহণ করতে হবে এবং উপনিবেশবাদী, সাম্রাজ্যবাদী ও ফ্যাসিবাদী ভাবধারা পরিহার করে চলতে হবে। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে উচ্চশিক্ষার অবস্থাও ভালো নয়। অন্ধভাবে সাম্রাজ্যবাদী নীতি গ্রহণ করে চলার ফলে কোনোটাই স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। যেভাবে সেমিস্টার পদ্ধতি চালু করা হয়েছে, তাতে উচ্চশিক্ষাকেও পরীক্ষামুখী করে ফেলা হয়েছে। পরীক্ষা আর শিক্ষা যে এক নয়, কেবল পরীক্ষার ফল ভালো করলেই যে কেউ শিক্ষিত হয় না, গোটা জাতিকে এটা বুঝতে হবে। বাংলাদেশে চিকিৎসা, কৃষি, প্রকৌশল ও প্রযুক্তিবিষয়ক শিক্ষা সেগুলোতে গৌণ ব্যাপার!
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষা নেই। পরীক্ষাসর্বস্ব এই শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষা নিয়ে ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবক—কারও আনন্দ নেই। এ অবস্থায় ১৯৮০-এর দশক থেকেই ব্যাপক প্রসার ঘটেছে কোচিং সেন্টার, গাইড বুক ইত্যাদির। এগুলোতে শিক্ষার কোনো আয়োজনই নেই, আছে কেবল পরীক্ষার ফল ভালো করানোর আয়োজন। শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে, পরীক্ষার ফল খুব ভালো করছে—দ্রুত সৃজনশীল হচ্ছে। যারা উদ্যোগী ও পরিশ্রমী, তারা বাংলাদেশকে ভবিষ্যৎহীন ভেবে ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া—নানা রাষ্ট্রে নাগরিকত্ব নিচ্ছে। ব্রেন ড্রেন সম্পূর্ণ নতুন রূপ নিয়েছে। দেশপ্রেম, স্বাজাত্যবোধ, সুনাগরিকের গুণাবলি ও জ্ঞান অর্জন হচ্ছে না।
দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে যত আলোচনা করা হবে, ততই এর ত্রুটিবিচ্যুতি ও বিকৃতির দিকগুলো সামনে আসবে। জনগণের জন্য অনভিপ্রেত অবাঞ্ছিত অনেক কিছুকে কায়েমি-স্বার্থবাদীরা ক্রমাগত বলে প্রচার করছে।
বাংলাদেশে শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থার আমূল সংস্কার দরকার। এর জন্য প্রথম পর্যায়ে দরকার সর্বজনীন কল্যাণে বিবেকবান চিন্তাশীল ব্যক্তিদের দূরদর্শী চিন্তাভাবনা, আলোচনা-সমালোচনা ও বিচার-বিবেচনা। শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থা কেমন হওয়া উচিত, সে সম্পর্কে ধারণা যদি ঠিক হয়, তাহলে সেই লক্ষ্যে পর্যায়ক্রমে চেষ্টা চালালে সমাধানযোগ্য সব সমস্যারই সমাধান করা যাবে। লক্ষ্য ও যাত্রাপথ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নিয়ে এগোতে হবে।
এ অবস্থায় বাংলাদেশকে সর্বজনীন গণতন্ত্র অবলম্বন করে জনগণের স্বাধীন প্রগতিশীল গণরাষ্ট্র রূপে গড়ে তোলা আমাদের কেন্দ্রীয় কর্তব্য। জাতীয়তাবাদ ও তার সম্পূরক আন্তর্জাতিকতাবাদ অবলম্বন করে বিশ্বব্যবস্থাকে পুনর্গঠিত করতে হবে। সেই লক্ষ্যে পৃথিবীর সব রাষ্ট্রে, জনজীবনের আরম্ভ করা দরকার। সব রাষ্ট্রেই শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার দরকার।
লেখক: আবুল কাসেম ফজলুল হক, রাষ্ট্রচিন্তক ও সাবেক অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ব্রিকস হচ্ছে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার ইংরেজি আদ্যাক্ষর নিয়ে গঠিত সংস্থার নাম। সম্প্রতি রাশিয়ার কাজানে ব্রিকসের সম্মেলন সমাপ্ত হয়েছে। ব্রিকসের ১০ সদস্যদেশসহ মোট ৩৫টি দেশের প্রতিনিধিরা সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। সম্মেলনে ব্রিকসের সদস্যদেশগুলোর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ডলারের পরিবর্তে ব্রি
২৮ ডিসেম্বর ২০২৪
রাজনীতি কোন পথে যাত্রা করেছে, তা কি সাধারণ মানুষ বুঝতে পারছে? যে রাজনৈতিক দলগুলো রাজনীতির মাঠে সক্রিয়, তারা নির্বাচনের জন্য কতটা তৈরি হয়ে আছে, তা নিয়ে সংশয় এখনো কাটছে না। বলা হচ্ছে, ডিসেম্বরের মাঝামাঝি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে। রমজানের আগেই নির্বাচন সুসম্পন্ন হবে বলে অনেকেই আশা প্রকাশ করছেন।
৯ ঘণ্টা আগে
চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে দেশে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন স্মারক ছাড়াও মাজার, সাধু-সন্ন্যাসী, বাউল-ফকিরসহ সংখ্যালঘু ও ভিন্ন মতাদর্শের মানুষের ওপর হামলা যেন থামছেই না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসব হামলায় ধর্মতন্ত্রী একটি গোষ্ঠীকে নেতৃত্ব দিতে দেখা যাচ্ছে। হামলাকারীরা নিজেদের ‘তৌহিদি জনতা’...
৯ ঘণ্টা আগে
কদিন আগে রুশ পত্রিকা ‘আর্গুমেন্তি ই ফাক্তি’ রই মেদভেদেভের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছে। শতবর্ষী এই ইতিহাসবিদ রাশিয়া ও সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতিহাস নিয়ে বেশ কিছু তীক্ষ্ণ মন্তব্য করেছেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন পত্রিকার সাংবাদিক ভিতালি চেপলিয়েভ। গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় সাক্ষাৎকারটি আজকের পত্রিকার পাঠকদের...
৯ ঘণ্টা আগে