Ajker Patrika
সাক্ষাৎকার

গ্রোজনি ও পিটার—দুজনেই সম্মান পাওয়ার যোগ্য

গ্রোজনি ও পিটার—দুজনেই সম্মান পাওয়ার যোগ্য

কদিন আগে রুশ পত্রিকা ‘আর্গুমেন্তি ই ফাক্তি’ রই মেদভেদেভের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছে। শতবর্ষী এই ইতিহাসবিদ রাশিয়া ও সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতিহাস নিয়ে বেশ কিছু তীক্ষ্ণ মন্তব্য করেছেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন পত্রিকার সাংবাদিক ভিতালি চেপলিয়েভ। গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় সাক্ষাৎকারটি আজকের পত্রিকার পাঠকদের জন্য অনুবাদ করে দেওয়া হলো।

সম্পাদকীয়

রই আলেক্সান্দ্রোভিচ, একবার আপনি বলেছিলেন যে রাশিয়াকে এক মহান রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ইভান গ্রোজনি নয়, বরং জার পিটার। কিন্তু পিটার তো ইউরোপীয় ধাঁচে রাষ্ট্র গড়ে তুলেছিলেন, আর আজ ইউরোপ অনেক রাশিয়ানের কাছে প্রায় মন্দের প্রতিশব্দ। ইভান গ্রোজনিকে রুশ দেশের মানুষেরা বরং অনেক বেশি ‘মূল্যবোধসংলগ্ন’ শাসক বলে মনে করে থাকেন। জনগণের ঐক্য দিবসে ভোলগদায় তাঁর ৯ মিটার উঁচু একটি মূর্তি উন্মোচন করা হয়েছে এবং এটি মোটেই প্রথম স্মৃতিস্তম্ভ নয়। এই দুই ব্যক্তিত্বকে একে অপরের বিপরীতে দাঁড় করানো কি ঠিক?

আমি মনে করি, ইভান গ্রোজনি এবং জার পিটার—দুজনই সম্মান ও শ্রদ্ধা পাওয়ার যোগ্য, উভয়েই মহান ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব। এবং সত্যিই তাঁদের একে অপরের বিপরীতে দাঁড় করানোর প্রয়োজন নেই। গ্রোজনি রুশ জারতন্ত্র তৈরি করেছিলেন, তাঁর আমলেই সাইবেরিয়া দখল শুরু হয়, তিনি রাশিয়ার সঙ্গে কাজান ও আস্ত্রাখান যোগ করেন। পিটারের কীর্তিও মহান—তিনি ইউরোপের দিকে রাস্তা খুলে দেন, বাল্টিক সাগরের তীরে নতুন রাজধানী সেন্ট পিটার্সবার্গ নির্মাণ করেন, রুশ নৌবাহিনী গড়ে তোলেন, আমাদের সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ও শিক্ষার বিকাশের জন্য অনেক কাজ করেন। শেষে, রাশিয়াকে সাম্রাজ্য হিসেবে ঘোষণাও করেন পিটারই।

বর্তমান প্রেসিডেন্ট পুতিন অতীতের কোন শাসকের অনুসরণ করেন বলে আপনার মনে হয়? তাঁকে তো কারও সঙ্গে তুলনা করা হয়নি—ভ্লাদিমির স্ভিতোই অথবা তৃতীয় আলেকসান্দরের সঙ্গেও তুলনা করা হয়নি...

আমার মতে, পুতিন সবচেয়ে বেশি সম্মান করেন জার পিটারকে। স্তালিন সম্মান করতেন ইভান গ্রোজনিকে। কিন্তু এর মানে এই নয় যে প্রেসিডেন্ট পুতিন কারও অনুসরণ করছেন। পুতিনের পথ সম্পূর্ণ স্বাধীন, তিনি কারও ঐতিহ্যের উত্তরসূরি নন। যা কিছু তিনি করেন, তা করেন নিজের বোঝাপড়া অনুযায়ী, নিজের বুদ্ধি, জ্ঞান এবং ইচ্ছাশক্তির ওপর নির্ভর করে। তিনি বুঝতে পারেন যে বর্তমানে বিশ্বে তিনটি মহান শক্তি রয়েছে—রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। রাশিয়া ও চীন—এই দুই দেশ মিত্র, আর যুক্তরাষ্ট্র এর বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারে না।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনকে প্রেসিডেন্ট পুতিন বলেছেন ‘বিশ শতকের সবচেয়ে বড় ভূরাজনৈতিক বিপর্যয়’। আর আপনি একসময় বলেছিলেন, ইউনিয়নকে ‘কৃত্রিমভাবে ও উদ্দেশ্যমূলকভাবে ধ্বংস করা হয়েছিল’। অর্থাৎ, আপনার মতে দেশটি ভেঙে পড়েছিল সোভিয়েত নেতৃত্বের ভুল হিসাবের কারণে নয়, ‘ফ্রিজ টেলিভিশনকে হারিয়েছে’ (বাস্তবতার কাছে নান্দনিকতা পরাজিত হয়েছে) বলেই নয়, বরং কারও দুষ্ট ইচ্ছায়?

অবশ্যই। সোভিয়েত ইউনিয়নকে ধ্বংস করেছিল পশ্চিমা দেশগুলো। এটি ছিল একটি ষড়যন্ত্র, যা গরবাচেভ ক্ষমতায় আসার আগেই জন্ম নিয়েছিল। আন্দ্রোপভের শাসন পশ্চিমে প্রচণ্ড ভয় ধরিয়েছিল, কারণ তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নকে শক্তিশালী করতে চেয়েছিলেন। পশ্চিমাদের সৌভাগ্য, আন্দ্রোপভ দেশটির নেতৃত্বে মাত্র এক বছরের একটু বেশি সময় কাটিয়ে মারা যান। এরপর তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাগ্য নিজেদের হাতে তুলে নেবে।

তারা মিখাইল সেরগিয়েভিচ এবং রাইসা মাকসিমোভনাকে লন্ডনে আমন্ত্রণ জানায়, তখনো গরবাচেভ আমাদের দেশের প্রধান নেতা হননি। মার্গারেট থ্যাচার, যিনি তখন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী, গরবাচেভের সঙ্গে পাঁচ ঘণ্টা কথা বলেন। তারপর তিনি তাঁর সব মিত্রকে জানান যে–এই সেই নেতা যাঁকে পশ্চিমের প্রয়োজন। সোভিয়েত জনগণের নয়, বরং পশ্চিমের প্রয়োজন! এরপর তারা তাঁকে সমর্থন করতে শুরু করে এবং কার্যত তাঁকে পরিচালনা করতে থাকে—খোলাখুলি নয় অবশ্য, গোপনে।

গরবাচেভের সব প্রাথমিক সংস্কারই বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া ছিল, এমনকি মদবিরোধী প্রচারণাটিও। এমন ক্যাম্পেইন আগে আমেরিকায় চালানো হয়েছিল, কিন্তু তা শুধু মাফিয়া তৈরি করেছিল এবং শেষে ব্যর্থ হয়েছিল। এটি যে ব্যর্থ হবে, তা পশ্চিমারা জানত। গরবাচেভ সোভিয়েত ইউনিয়ন ধ্বংসের জন্য যা যা করা প্রয়োজন ছিল, সবই করেছিলেন। এমনকি রাইসা মাকসিমোভনাকেও তারা ঘুষ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তাঁকে একটি হীরার ক্রেডিট কার্ড দেওয়া হয় এবং বলা হয় যে পাঁচ বছরের মধ্যে তিনি পশ্চিমা দেশের দোকানে ইচ্ছেমতো যেকোনো পণ্য কিনতে পারবেন এবং এই ঋণ পরিশোধ করতে হবে না।

যতদূর আমি জানি, গরবাচেভ নিজে এই কার্ডের গল্পটি অস্বীকার করেছিলেন। আপনার কাছে এই তথ্য এল কোথা থেকে?

এটা আমি আপনাকে বলব না, তবে আমি এই তথ্যের যথার্থতা সম্পর্কে নিশ্চিত। আমি নিশ্চিত যে পশ্চিম ঘুষ দিয়ে কাজ করছিল...। যদিও সেই সময়ে আমিও গরবাচেভকে বিশ্বাস করেছিলাম, আর সেটাই ছিল আমার ভুল। আমি তাঁকে নিয়ে দুটি প্রশংসামূলক বই লিখেছিলাম। এখন অবশ্য সে ব্যাপারে আফসোস করি। যেমন আফসোস করি যে আমি সোভিয়েত সর্বোচ্চ পরিষদে (ভেরখোভনি সোভিয়েত) যোগ দিয়েছিলাম এবং আইন প্রণয়নের কাজে লেগে পড়েছিলাম। এটি ইতিহাসবিদের কাজ নয়—ইতিহাসবিদের তো এর জন্য প্রয়োজনীয় আইনি জ্ঞান, দক্ষতা থাকে না। কিন্তু ‘না’ বলা কঠিন ছিল। গরবাচেভ আমাকেও সামান্য ক্ষমতা দিয়েছিলেন। আমাকে সেই কমিশনের প্রধান করা হয়েছিল, যা দুর্নীতির সমস্যা বিবেচনা করত। এবং আমি যেকোনো ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারতাম, গরবাচেভকে ছাড়া। উদাহরণস্বরূপ, আমি ইয়েলৎসিনকে দুই ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলাম। তখনকার কেজিবি চেয়ারম্যান চেব্রিকভও আমার কাছে এসেছিলেন এবং তিনিও দুই ঘণ্টা ধরে জবাবদিহি করেছিলেন।

কিছুদিন পরই চেব্রিকভের উত্তরসূরি ক্রিউচকভ গেকেচেপেতে (চরম পরিস্থিতিসংক্রান্ত রাষ্ট্রীয় কমিশন) যোগ দেন, যারা গরবাচেভকে ক্রিমিয়ায় বিচ্ছিন্ন করে রেখে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঠেকানোর চেষ্টা করেছিল। গেকেচেপের নিয়ন্ত্রণে তখন বিশেষ সংস্থাগুলো, সেনাবাহিনী, এমনকি পুলিশও ছিল। তাহলে তারা কেন হেরে গেল এবং জেলে গেল? আর কেন জনগণ রাস্তায় নামেনি ইউনিয়নকে বাঁচাতে—না আগস্টে, না ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে?

কারণ অনেক ছিল। প্রথমত, সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল—ক্ষুধা, দোকানের ফাঁকা তাক আর নানান সমস্যায়। সেনাবাহিনী ভীষণ অসন্তুষ্ট ছিল। কারণ সামরিক কর্মীদের বেতন দেওয়া বিলম্বিত হচ্ছিল। শেষে, কোনো নেতা ছিল না। সেই ক্রিউচকভকেই আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম—তিনি ছিলেন দুর্বল মানসিকতার মানুষ। তিনি এক গেকেচেপে সদস্য থেকে আরেক সদস্যের কাছে দৌড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করতেন যে কী করতে হবে? এ ধরনের লোক দিয়ে বিপ্লব হয় না। দেশের পতন থামাতে নেপোলিয়নের মতো ব্যক্তিত্ব প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সেই সময়ে আমাদের কাছে দুর্ভাগ্যবশত কোনো নেপোলিয়ন ছিল না। তাই জনগণ রাস্তায় নামেনি—কারও অনুসরণ করার মতো নেতা ছিল না।

আপনি কি মনে করেন যে রাশিয়া ‘শক্তিশালী হাত’ ছাড়া বাঁচতে পারে না? না হলে এটিকে সব সময় অরাজকতা ও বিভাজনের মুখোমুখি হতে হবে?

হ্যাঁ, রাশিয়ার জন্য শক্তিশালী শাসন প্রয়োজন। কিন্তু নিপীড়কতন্ত্র নয়, কারণ নিপীড়কতন্ত্র হলো এমন একটি শাসনব্যবস্থা, যা আইন মানে না। আমাদের শক্তিশালী শাসন প্রয়োজন, কারণ দেশটি অনেক বড় এবং দেশটির সামনে থাকা চ্যালেঞ্জগুলোও অনেক বড়। উদাহরণস্বরূপ, রাশিয়ান জনগণকে রক্ষা করার দায়িত্ব সরকারের। আমাদের জনগণ বিভক্ত এবং বিভাজন শুরু হয়েছিল লেনিনের আমলে, যিনি প্রায় ১২ মিলিয়ন রাশিয়ান মানুষকে ইউক্রেনে দিয়েছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন যে কমিউনিস্ট পার্টি চিরকাল রাষ্ট্রকে পরিচালনা করবে এবং এই রাষ্ট্রও শতাব্দী ধরে টিকবে। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ৭০ বছরও টিকে থাকতে পারেনি এবং ধ্বংস হয়ে গেল।

ওদেসা, নিকোলায়েভ, খারকিভ এবং অন্যান্য শহরে বসবাসকারী লাখ লাখ রাশিয়ান রাশিয়ার সীমার বাইরে পড়ে থাকলেন। ২০০৮ সালে আমি ইউক্রেনে গিয়েছিলাম, কিয়েভেও গিয়েছিলাম। প্রতিটি জায়গায় আমার সঙ্গে শুধু রুশ ভাষায়ই কথা বলা হয়েছিল—হোটেল, ক্যাফে, দোকানগুলোতে...তারপর ইউক্রেনে রুশ ভাষা ও রুশ সংবাদপত্রের ওপর ভয়ংকর দমন শুরু হয়। ২০১৪ সালে জাতীয়তাবাদীরা সরকার পরিবর্তনও ঘটায়। সুতরাং আমাদের বিশেষ সামরিক অভিযান কেবল সময়ের ব্যাপার ছিল।

আপনাকে ধন্যবাদ।

আপনাকেও ধন্যবাদ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ফটিকছড়িতে আওয়ামী লীগের ঝটিকা মিছিল, আটক দুই

লিটনদের ‘ফাইনাল’ ম্যাচ দিনের আলোয়

আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপিতে যোগ দিলেন রেজা কিবরিয়া, প্রার্থী হচ্ছেন কোন আসনে

আজকের রাশিফল: প্রাক্তনের মেসেজ পেয়ে আবেগে ভেসে যাবেন, কর্মক্ষেত্রে প্রশংসিত হবেন

লবণাক্ত সুন্দরবনে মাটির গভীরে আছে দুটি বিশাল মিঠাপানির ভান্ডার: গবেষণা

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ