Ajker Patrika

ইতিহাস মুছে দেওয়া যায় না

মাসুমা হক প্রিয়াংকা 
আপডেট : ১১ অক্টোবর ২০২৪, ১৯: ৩১
ইতিহাস মুছে দেওয়া যায় না

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত আমাদের এই রাষ্ট্র বাংলাদেশ। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে স্বাধীনতার আন্দোলন পর্যন্ত সাতটি গণআন্দোলনের (১৯৫২, ৫৪, ৫৬, ৬২, ৬৬, ৬৯ ও ৭১) চেতনা সমুন্নত রেখে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের মহান জাতীয় স্মৃতিসৌধ।

বাঙালির যেকোনো আন্দোলন-সংগ্রামে ইতিহাসের এই রক্তক্ষয়ী সংগ্রামগুলো ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে। এই ভিত্তিগুলো অস্বীকার করা অথবা ভুলিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। ‘রিসেট বাটনে’ চাপ দিয়ে কেউ ইতিহাস মুছে ফেলতে চাইলে বুঝতে হবে তাঁর বা তাঁদের ‘বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য’ আছে। ছাত্ররা বাংলাদেশের ভিত্তি মুছে ফেলতে চায় কিনা— সেই প্রশ্নের উত্তরই বলে দেবে বাংলাদেশ কোন পথে এগোচ্ছে।

সম্প্রতি পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন নিয়ে তোড়জোড় দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের তরুণ একজন উপদেষ্টা বললেন, পাকিস্তানের সঙ্গে একাত্তরের বিষয় মীমাংসা করবেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে পুরোনো বিতর্ক নতুন করে চাঙা করা হচ্ছে— ৩০ লাখ শহীদ নাকি ৩ লাখ— সেই প্রশ্ন দাঁড় করিয়ে পাকিস্তানকে গণহত্যার দায় থেকে মুক্তির পাঁয়তারা চলছে না তো?

২০২৩ সালের ২৪ এপ্রিল ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব জেনোসাইড স্কলার্স ‘বাংলাদেশ রেজল্যুশনের’ মাধ্যমে ১৯৭১ সালে সংঘটিত গণহত্যাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। শতকরা ৯৫ ভাগ ভোটে রেজল্যুশন পাস হয়। জাতিসংঘ থেকে স্বীকৃতি আদায়ে চলছিল কূটনৈতিক তৎপরতা।

আমরা এখন পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করে বিষয়টা বেমালুম ভুলে যাব? পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জাতিসংঘ কর্তৃক গণহত্যার স্বীকৃতি আদায় হলে আমাদের ৩০ লাখ শহীদ, ২ লাখ মা-বোনকে নির্যাতনের বিষয়ে কিছুটা হলেও সম্মান দেওয়া হবে, জাতিসংঘের ১৯৪৭ সালের যুদ্ধ কনভেনশন অনুযায়ী বাংলাদেশ পাকিস্তানের কাছে ক্ষতিপূরণ চাইতে পারবে, গণহত্যার দায়ে পাকিস্তানকে বিচারের আওতায় নিয়ে আসা যাবে।

যে মুহূর্তে আমরা জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃতি আদায়ে এক ধাপ এগিয়েছি, সে মুহূর্তে মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক ও সাম্প্রতিক সময়ে একাত্তরকে নানাভাবে এড়িয়ে চলতে চাওয়া কি কাকতালীয়? ‘৭১ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করা হলে এবং ইতিহাস মুছে দিতে চাওয়া অব্যাহত থাকলে অদূর ভবিষ্যতে ইতিহাসে ‘২০২৪-এর বিপ্লব’ একাত্তরকে মুছে দেওয়ার ষড়যন্ত্র হিসেবে চিহ্নিত হবে, যা হবে চব্বিশের শত শত শহীদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি।

বাংলাদেশের চেতনা ও জাতীয়তাবাদে উজ্জীবিত দলগুলোকে দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য রক্ষায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হতে হবে। চুয়ান্নর ২১ দফা, ছেষট্টির ৬ দফা, ঊনসত্তুরের ১১ দফার প্রতিফলন ১৯৭২ সালের সংবিধান। তাই টালবাহানা না করে নির্বাচনকেন্দ্রিক যৌক্তিক সংস্কার করে আইনপ্রণেতাদের ভোটের মাধ্যমে সংবিধানের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবা উচিত।

বাংলাদেশের দুটি বৃহৎ দল অর্থাৎ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির উচিত তাদের দলীয় সংস্কারে মনোযোগী হওয়া।তৃণমূলে দলগুলোর একই নেতারা বারবার কমিটিতে স্থান পাচ্ছেন এবং তাঁরা স্থানীয় অদৃশ্য দানবে পরিণত হচ্ছেন। দলীয় কাউন্সিলে অবশ্যই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত। এমপি, মন্ত্রীর ছেলে-মেয়ে হলেই রাজনৈতিক জ্ঞান, দক্ষতা না থাকা সত্ত্বেও মনোনয়ন পাওয়ার রীতি থেকে বের হয়ে আসা উচিত।

তরুণ প্রজন্মকে প্রাধান্য দিয়ে নতুন নেতৃত্বের মাধ্যমে দেশের উন্নয়নে তরুণদের উদ্যমকে কাজে লাগানো উচিত হবে বলে মনে করছি। গতানুগতিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির ফলে স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন নেতা ও তাঁদের পরিবার দানবে পরিণত হয়েছে।

গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দলগুলোতে নেতৃত্ব বাছাই হলে দুর্নীতি, অন্যায় বহুলাংশে কমে যাবে। পারতপক্ষে, জনগণের উন্নয়নে কাজ করার প্রবণতা বেড়ে যাবে এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে রাজনীতি থেকে দুর্নীতির গডফাদাররা দূরে থাকবে। বৃহৎ দল দুটির মধ্যে সংস্কার সম্ভব হলে দেশ সংস্কারের কাজ বহুলাংশে সম্পন্ন হয়ে যাবে।

লেখক: সমাজকর্মী ও শিক্ষার্থী

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত