Ajker Patrika

এসক্রো কি ই–কমার্স ক্রেতাদের সুরক্ষা দিতে পারবে

জাহাঙ্গীর আলম শোভন
আপডেট : ০৪ নভেম্বর ২০২৩, ১৮: ৫৫
এসক্রো কি ই–কমার্স ক্রেতাদের সুরক্ষা দিতে পারবে

আজকের লেখাটা একটা কৌতুক দিয়ে শুরু করা যাক: আদালতে বিচারক জেরার একপর্যায়ে জনৈক চৌর্যবিদকে জিজ্ঞেস করলেন, ওহে মূর্খ তুমি বলছো তুমি চুরি করোনি, তবে তুমি কেন কৃষকের গবাদিপশুটি রাতের অন্ধকারে হস্তগত করে পলায়ন করেছিলে? চৌর্যবিদ বিনয়াবনত হয়ে জবাব দিলেন, মান্যবর, আমিতো কেবল একটি রশি হাতিয়ে নিয়েছিলাম। এটার শেষ মাথায় যে একটি গবাদিপশু ছিল, সে ব্যাপারেতো রাতের অন্ধকারে আমি বেখেয়াল ছিলাম, হুজুর। 

বুঝতেই পারছেন আস্ত একটা গরু চুরি করে মহাশয় নিজেকে বাঁচাতে চাচ্ছেন। 

ব্যাপারটা উল্টো হতে পারত। ধরে নিলাম, এক কুতুব তার পিরের দরবারে একটি আস্ত মহিষ দান করবেন। কিন্তু তিনি একটা রশি দিয়ে চলে এলেন। তারপর তাকে যখন লোকেরা শুধালো, ওহে তোমার মস্ত বড় মহিষ কোথায়? তখন সে বলল, আমিতো সব সময় সব লোকের মতো রশিখানা বেঁধে আসলাম। এর শেষ মাথায় নিশ্চয়ই সেটি বাঁধা থাকবে। লোকেরা দেখল এই রশি এত বড় যে, এর শেষ মাথা নদীর ধারে তৃণভূমি পর্যন্ত বিস্তৃত। এখন এই তৃণভূমিতে রশির মাথায় যদি আস্ত মহিষটি থাকেও তাতে সেটি কবে নাগাদ জবাই করে স্বাদ নেওয়া যাবে, তা ‘দূর কি বাত’! 
 
 ই–কমার্স খাতে অভিযোগ, অস্থিরতা প্রতারণার শোরগোলের মাঝে ২০২১ সালের ৩০ জুন বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে একটি প্রজ্ঞাপন সূত্রে ই–কমার্স গ্রাহকের পরিশোধ করা অগ্রিম অর্থ গেটওয়েতে ধরে রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়। শর্ত থাকে যে, পণ্য ডেলিভারির প্রমাণ সাপেক্ষে মার্চেন্ট বা শপার ওই অর্থ গেটওয়ে থেকে প্রাপ্য হবেন। এর একটা বড় সুফল পেয়েছেন তখনকার বিতর্কিত কিছু প্ল্যাটফর্মের ক্রেতারা। এই প্রক্রিয়ায় টাকা আটকে রাখা গেছে এবং পরে কারিগরি কমিটি গঠন করে প্রায় ৩৯৭ কোটি টাকা থেকে প্রায় ৩৭৮ কোটি টাকা গ্রাহককে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় ফেরত দেওয়া সম্ভব হয়েছে। 

এসক্রো বিশ্বব্যাপী একটি বহুল প্রচলিত প্রক্রিয়া। এটা ই–কমার্সের জন্য ব্যবহৃত হয়। যাতে ক্রেতা ও বিক্রেতার মাঝখানে আর্থিক নিরাপত্তা বিঘ্নিত না হয়। এসক্রোর কাজ হলো, ক্রেতার প্রেরিত অর্থের নিশ্চয়তা দেওয়া। কোনো কারণে যদি ক্রেতা কাঙ্ক্ষিত সেবা না পান, তাহলে এসক্রো থেকে তিনি অর্থ ফেরত পাবেন। এসক্রো তার অর্থ মজুত রেখেও ফেরত দিতে পারে বা অন্য কোনো ভাবেও দিতে পারে। 

এসক্রো একটি তৃতীয় পক্ষ হতে পারে, অথবা মার্কেটপ্লেসের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায়ও হতে পারে। আমাজন কিংবা দারাজের মতো মার্কেটপ্লেসগুলো থেকে ক্রেতা পণ্য ক্রয় করে পণ্য পাওয়ার পরই প্ল্যাটফর্ম কর্তৃপক্ষ বিক্রেতাকে মূল্য পরিশোধ করে থাকে। নচেৎ নয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে এসক্রো দৃশ্যমান নয়। এসক্রো দৃশ্যমান হয় তৃতীয় পক্ষ বা রেগুলেটরি পক্ষের দ্বারা পরিচালিত হলে। 

 ২০২১ সালের ৩০ জুন প্রজ্ঞাপন দিয়ে গেটওয়েতে অর্থ আটকে রাখার নির্দেশনা এক ধরনের ম্যানুয়েল এসক্রো ছিল। যা দৃশ্যমান ছিল না। কিন্তু এটিকে এসক্রো বলার কারণে কিছু বিভ্রান্তি তৈরি হয়, একদিকে এটি দৃশ্যমান ছিল না, অন্যদিকে এর কার্যকর কোনো সুফল ছিল না। 

ডিজিটাল সেবাগুলোরও একটি দৃশ্যমান রূপ রয়েছে। যেমন, সরকার ই–কমার্স নিবন্ধনের জন্য ডিবিআইডি চালু করেছে। এটি পুরোটাই ভার্চুয়াল সেবা। ভৌত সেবা না হলেও এর একটি লোগো ও পোর্টাল রয়েছে। কিন্তু ৩০ জুনের প্রজ্ঞাপনকে এসক্রো বলা হলেও সেটি আসলে এসক্রো ছিল না। দুনিয়ার কোনো দেশে এভাবে এসক্রো করা হয় না। এসক্রো সম্পূর্ণ রূপে ডিজিটাল ও ভার্চুয়ালে। এখানে ফোনে কথা বলে ডেলিভারি নিশ্চিত করা হয় না। ডেলিভারি নিশ্চিত করার জন্য সিস্টেমের ওপর নির্ভরশীল এবং চেকের মাধ্যমে পেমেন্ট হয় না। পেমেন্ট হয় অনলাইনে। 

তাই আমাদের গল্পের মতো রশি দান করলেই মহিষ দান করা হয় না এবং গেটওয়েতে টাকা আটকে রাখলেই সেটি পূর্ণ এসক্রো হয় না। গত ২৬ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংক এসক্রো সেবা নীতিমালা প্রকাশ করে। এর মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত এসক্রো সেবা আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এই সার্কুলার প্রমাণ করে যে,২০২১ সালের ৩০ জুন প্রজ্ঞাপন দিয়ে গেটওয়েতে টাকা আটকে রাখা একটা জরুরি নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা ছিল বৈকি। সেটি আসলে এসক্রো ছিল না। 
 
এসক্রো বাস্তবায়নের এই যাত্রাপথ আসলে বঙ্কিমই বটে। ২০১৭ সালে ডিজিটাল কমার্স নীতিমালা প্রণয়নের সময় ই–কমার্স খাতের উন্নয়ন ও শৃঙ্খলা বিধানে এসক্রো, টেকনিক্যাল কমিটিসহ বেশ কিছু প্রস্তাব দেওয়া হয় ই–কমার্স অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে। ২০১৮ সালে এসক্রো ও অন্যান্য বিষয় ‘ডিজিটাল কমার্স নীতিমালা ২০১৮ ’–এ সংযুক্ত হয়। 

পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে প্রাইভেট সেক্টর ডেভেলপমেন্ট কমিটির ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ১৩ তম সভায় প্রাইভেট সেক্টর থেকে উত্থাপিত ই–কমার্স উন্নয়ন দাবির সঙ্গে এ বিষয়গুলো বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত হয়। 

 ২০২০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে লিখিত রূপে আবারও প্রস্তাবগুলো তুলে ধরে ই–ক্যাব। এখানে উল্লেখ্য যে, ‘ডিজিটাল কমার্স নীতিমালা ২০১৮ ’–এর কর্ম পরিকল্পনার উদ্দেশ্য ২ এর ০৬ নং ক্রমতে টেকনিক্যাল কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে। সৌভাগ্যবশত, ২০২১ সালে টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করা হয়েছিল। 

 ২০২১ সালের ৩০ জুন ই–ক্যাবের পক্ষ থেকে এসওপি পর্যালোচনা করে মতামত প্রদান করা হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে ২০২১ সালের ৪ জুলাই ‘ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা নির্দেশিকা ২০২১’ ঘোষণা করা হয়। ২০২১ সালের ২২ সেপ্টেম্বর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত একটি আন্তমন্ত্রণালয় সভায় ই–ক্যাব এই খাতকে সমৃদ্ধ ও সংগঠিত করতে নতুন করে কিছু প্রস্তাবও পেশ করে। এরপর বিভিন্ন সময় আরও কিছু পরামর্শ লিখিত আকারে দেওয়া হয়। সেগুলোর মধ্যে ডিবিআইডি ও কেন্দ্রীয় অভিযোগ পদ্ধতি চালু হয়। বলাবাহুল্য এই দুটি প্ল্যাটফর্ম গ্রাহক ও উদ্যোক্তা কারও প্রত্যাশা পূরণ করেনি। যেভাবে খাত সংশ্লিষ্টরা পরামর্শ দিয়েছিল, ঠিক সেভাবে সেগুলো ডিজাইন করা হয়নি। 

 ২০২০ ও ২১ সালে এসেও ডিজিটাল কমার্স নীতিমালা ২০১৮–এর কর্মপরিকল্পনা ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন প্রাইভেট সেক্টর ডেভেলপমেন্ট কমিটির বেশ কিছু সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়নি। তথাপি ২০২১ সালের ২২ সেপ্টেম্বর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত একটি আন্তমন্ত্রণালয় সভায় ই–ক্যাব এই খাতকে সমৃদ্ধ ও সংগঠিত করতে নতুন করে কিছু প্রস্তাবও পেশ করে। পরে বিভিন্ন সময়ে আরও কিছু পরামর্শ লিখিত আকারে দেওয়া হয়। সেগুলোর মধ্যে ডিবিআইডি ও কমপ্লেইন সিস্টেম চালু হয়। 

এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক এসক্রো নীতিমালা প্রকাশ করেছে। এসক্রো নিয়ে কতিপয় বিতর্কিত ই–কমার্স প্রতিষ্ঠান ভুল ধারণা ছড়িয়ে দিয়েছিল যে, এর মাধ্যমে টাকা হারিয়ে যায়। কিন্তু কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর গ্রাহকেরা বুঝতে পারে যে, এসক্রো মূলত গ্রাহকদের সুরক্ষা দেয়। এখন গ্রাহকেরা অপেক্ষা করছেন, বাংলাদেশে ব্যাংকের এই এসক্রোতে ব্যাংকের দায়িত্ব কতটা থাকবে এবং গ্রাহকের সুরক্ষার মাত্রা কতটুকু। এর উপকার ভোগ করার আগে পর্যন্ত গ্রাহকেরা আত্মতুষ্টিতে ভুগবে বলে মনে হয় না। কারণ অতীতে খারাপ অভিজ্ঞতাও আছে। 

এসক্রো যদি গ্রাহককে সুরক্ষা দেয় তাহলে কি বিক্রেতাকে নানা রকম প্রতিবন্ধকতার মধ্যে ফেলে দেয়? একটু ফেলে বৈকি। তবে সব বিক্রেতাকে নয়। বিশেষ করে সে বিক্রেতাকে ঝামেলায় ফেলে দেবে যে বিক্রেতা নিজে কোনো বিনিয়োগ না করে গ্রাহকের টাকায় পকেট ভারী করার তালে থাকে। তবে প্রকৃত ‍ও সঠিক বিক্রেতার জন্য এটা তাঁর হয়ে গ্রাহককে আস্থা দেয়। 

এসক্রো নীতিমালায় কয়েকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ: প্রথমত, এটি ঐচ্ছিক থাকতে পারে—বিক্রেতা সেবাটি নেবেন কি নেবে না না; বিক্রেতার সেই সুযোগ না থাকলেও ক্রেতার ক্ষেত্রে থাকতে পারে। এ ছাড়া ছোট ছোট লেনদেন, তাৎক্ষণিক সেবা—এসব ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ না করলেও ক্ষতি নেই। বিশেষ করে ক্রস বর্ডার ই–কমার্সের ক্ষেত্রে এসক্রোর ব্যবহার প্রচলিত অনলাইন শপ ও মার্কেটপ্লেসের মতো করে হবে না। সে ক্ষেত্রে ক্রেতার নিরাপত্তার জন্য ক্রস বর্ডারে বিশেষ লাইসেন্স ও অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যপদ বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। যেভাবে আমাদের স্থানীয় ব্যবসা আমরা শুধু ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে করলেও আমদানি ও রপ্তানির জন্য ট্রেড লাইসেন্সের সঙ্গে বাড়তি একটা লাইসেন্স দরকার হয়। 

এসক্রো সেবা নিয়ে ক্রেতা বিক্রেতার দুটো নির্দিষ্ট প্রত্যাশা আছে। প্রথমত, এটি অন্য কিছু সেবার মতো নামকাওয়াস্তে হবে না। এটি সঠিক ক্ষেত্রে সঠিকভাবে প্রয়োগ হবে। দ্বিতীয়ত, এতে ক্রেতাকে সুরক্ষা দেবে এবং বিক্রেতাকেও আস্থা দেবে এবং এটি নতুন কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে না। 

নীতিমালায় ঠিক কী ধরনের প্রবিধান থাকলে শঙ্কা দূর করা যায়, সেটির এখানে উল্লেখ করার মতো সুযোগ নেই। তবে কর্তাব্যক্তিরা হয়তো সেটা জানেন অথবা বেসরকারি ও ই–কমার্স খাত থেকে এ সংক্রান্ত পরামর্শ নিয়ে তাঁরা পথ চলবেন—আপাতত এটুকু প্রত্যাশা। 

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, ই–কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই–ক্যাব)

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত