আবু তাহের খান
১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষিত হওয়ার পরবর্তী পনেরো দিনের মধ্যে ঐ বছরেরই ১০ই এপ্রিল জারি করা হয় বাংলাদেশের ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র।’ এ ঘোষণাপত্রের ভিত্তিতেই ঐ বছরের ১৭ই এপ্রিল মুজিবনগরে (বৈদ্যনাথতলা, মেহেরপুর) বাংলাদেশের প্রথম সরকার শপথ গ্রহণ করে এবং তাৎক্ষণিকভাবে সে সরকারের আওতায় মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়। ১৯৭১ সালের ন’মাসের পুরো মুক্তিযুদ্ধ ও রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমও সম্পূর্ণত এ ঘোষণাপত্রের আলোকেই পরিচালিত হয়েছে এবং এ ধারাতেই যুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে পাক-হানাদারবাহিনীকে পরাজিত করে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশের নতুন সংবিধান কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত দেশের সকল রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমও এ ঘোষণাপত্রের বিধানমতেই পরিচালিত হয়েছে। মোটকথা, ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিলের ’স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ই বস্তুত বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান, যা প্রায় একুশ মাস কার্যকর ছিল।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম ও এর প্রাতিষ্ঠানিক বিকাশের ক্ষেত্রে স্বাধীনতার উল্লিখিত ঘোষণাপত্রের এই যে বিশাল ভূমিকা ও অবস্থান, দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, স্বাধীনতা-পরর্বর্তী কোনো সরকারই আজ পর্যন্ত সেটিকে যথেষ্ট গুরুত্ব ও মর্যাদার সাথে তুলে ধরতে আগ্রহ দেখায়নি—এমনকি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারগুলোও নয়। এবং লক্ষ্য করার মতো বিষয় এই যে, আনুষ্ঠানিক দালিলিক ধারাবাহিকতার অংশ হিসেবে ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে এটিকে তফশিলভুক্ত করা আবশ্যিক হওয়া সত্বেও অনবধানবশত বা যেকোনো কারণেই হোক, তা করা হয়নি। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধ, সংবিধান, রাষ্ট্রকাঠামোর বিকাশ ও বিন্যাস ইত্যাদি সংক্রান্ত আলোচনাতেও এ অতি উন্নতমানের ঘোষণাপত্রটি নিয়ে খুব কমই আলোচনা হতে দেখা গেছে। আর গভীরতাপূর্ণ আলোচনাতো বলতে গেলে একেবারেই হয়নি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠ্যক্রমেও এর অন্তর্ভুক্তি প্রায় নেই বললেই চলে। বিষয়টিকে দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব, রাষ্ট্র পরিচালক ও বুদ্ধিজীবীদের উপেক্ষা ও অবহেলা বললে মোটেও যথেষ্ট বলা হয় না। বরং বলা দরকার যে, এটি হচ্ছে তাদের চরম দায়িত্বহীনতাজনিত এমন এক সম্মিলিত ব্যর্থতা, যার কারণে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিভিন্ন সময়ের বহু সিদ্ধান্তই নানাবিধ হীনতা ও দুর্বলতা দ্বারা আক্রান্ত হয়ে থেকেছে।
২০২১ সালে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উদযাপনের সময় খুব স্বাভাবিকভাবেই আশা করা হয়েছিল যে, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র নিয়ে এ সময়ে ব্যাপকভিত্তিক মূল্যায়নধর্মী আলোচনা হবে, এর চুলচেরা বিশ্লেষণ হবে এবং লেখক ও বুদ্ধিজীবীগণ এর নানাবিধ তাৎপর্যের বিষয়টি ব্যাপকভাবে জনসমক্ষে তুলে ধরবেন। এবং সবচেয়ে বেশি আশা ছিল এটি যে, মাত্র দু’পৃষ্ঠার আপাত নিরীহ গোছের প্রচণ্ড শক্তিধর এ ঘোষণাপত্রটি ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ থেকে ১৯৭২ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত দীর্ঘ একুশ মাস কিভাবে কোনোপ্রকার সাংবিধানিক অভাবহীনতার অনুভব ছাড়াই অপার দক্ষতায় এ রাষ্ট্রকে দিক-নির্দেশনা দিয়ে গেছে! কিন্তু তেমনটি হওয়াতো দূরের কথা, অধিকাংশ স্তাবক বুদ্ধিজীবী তখন ব্যস্ত থেকেছেন ব্যক্তি বিশেষের স্তুতি ও ফুলানো-ফাঁপানো প্রশংসায়। ফলে স্বাধীনতার এ ঘোষণাপত্র তখন অনেকটা অপাঙতেয় হিসেবেই থেকে গেছে। অনেকে অবশ্য এমনটিও বলেন যে, স্বাধীনতার উল্লিখিত ঘোষণাপত্র নিয়ে বেশী আলোচনা করলে এর মাধ্যমে তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের গুরুত্ব বেড়ে যায়, যা কারো কারো পছন্দ নয়।
আর এখনতো চারদিকে কেবলই প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির আস্ফালন। কূপমন্ডুকতায় ঘেরা অন্ধকারাচ্ছন্ন এ প্রতিক্রিয়ার শক্তি স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র নিয়ে আলোচনা করবে দূরে থাক, ‘জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার’ (ঘোষণাপত্রের অনুচ্ছেদ-৬) ধারণাকে তারা কতটুকু সমর্থন করে, সে বিষয়েইতো যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। তারাতো বরং পারলে এটিকে বা এর আলোকে প্রণীত রাষ্ট্রের সংবিধানকে কবরস্থ করতে চায়। কিন্তু তারা কি বোঝেন যে, ১৯৭১-এ এরূপ একটি জনস্বার্থমুখী ঘোষণাপত্র সামনে ছিল বলেই মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের নেতৃবৃন্দের পক্ষে সেদিন তাদের মেধা ও বিচক্ষণতাকে যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে সফল পরিসমাপ্তির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছিল? স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে মাত্র এক বছরেরও কম সময়ের ব্যবধানে রাষ্ট্রের পক্ষে যে একটি পূর্ণাঙ্গ সংবিধান গ্রহণ করা সম্ভব হলো, সেটিও স্বাধীনতার ঐ ঘোষণাপত্র সামনে ছিল বলেই সম্ভব হয়েছিল। ১৯৭২-এর সংবিধানতো বস্তুত একাত্তরের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রেরই বর্ধিত সংস্করণ।
কি আছে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে? একবারে প্রথমেই আছে এ কথা যে, এ রাষ্ট্র হবে ‘জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার’ জন্য, যা উপরেও উল্লেখ করা হয়েছে। আর আছে ’সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার’ অঙ্গীকার। এখন কথা হচ্ছে, গত ৫৫ বছরের ব্যবধানে উল্লিখিত এ অঙ্গীকারসমূহের কতোটা এ রাষ্ট্র তার জনগণের জন্য নিশ্চিত করতে পেরেছে? এ রাষ্ট্রে জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার কি আদৌ আছে—একেবারে ছিটেফোঁটা পরিমাণে হলেও, যারমধ্যে ভোটাধিকার একটি? যে বৈষম্যের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ২৩ বছর সংগ্রাম করে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ মুক্ত হলো, সে দেশে অসাম্য বা বৈষম্যহীনতা কি আদৌ এতটুকু কমেছে? যে মানবিক মর্যাদার বোধে উদ্দীপ্ত হয়ে একাত্তরে এ দেশের কৃষক মাঠে লাঙ্গল ফেলে কিংবা শ্রমিক কারখানা ছেড়ে রাজপথের মিছিলে এসে যুক্ত হয়েছিল, তারা কি আজ স্ব স্ব ক্ষেত্রে ন্যূনতম আত্মমর্যাদাবোধ নিয়ে বাঁচতে পারছে? পোশাক কারখানার যে শ্রমিক ঈদের আগে বকেয়া বেতনভাতার দাবিতে রাস্তায় নামার ‘অপরাধে’ পুলিশের প্রহারের শিকার হন এবং অভিধা পান দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীদের অংশীদার বলে, সেখানে কোথায় থাকে তার আত্মমর্যাদা? ধূর্ত রাজনীতিকি, মুৎসুদ্দি আমলা, মুনাফাখোর ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন শ্রেণীর টাউট পরিবেষ্টিত এ সমাজে কোথায় এ দেশের সাধারণ জনগণের সামাজিক ন্যায়বিচার?
তো এ রকম একটি অবস্থায় স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র জারীর ৫৫ তম বর্ষে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত কষ্ট ও হতাশার সঙ্গে বলতে হয় যে, এ রকম একটি রাষ্ট্র ও সমাজের জন্যই কি স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে ব্যক্ত অঙ্গীকারের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে একাত্তরে এ দেশের মানুষ অকাতরে তার বুকের রক্ত ঢেলে দেশকে স্বাধীন করেছিল? কেন এমন হলো? কেন ১৯৭২ থেকে অদ্যাবধি এ দেশের শাসকেরা স্বাধীনতার এ ঘোষণাপত্রকে এড়িয়ে চলতে বা কবর দিতে চেয়েছেন? কেন একে তাদের এত ভয়? কারণ আর আর কিছুই না। এর মূল কারণ হচ্ছে, তারা রাষ্ট্রক্ষমতায় জনগণের অংশীদারিত্ব চায় না। তারা চায় ক্ষমতার একচ্ছত্র মালিকানা—বিভিন্ন নামে ও বিশেষণে। এমন পরিস্থিতিতে একাত্তরের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের অঙ্গীকারকে যদি সত্যি সত্যি বাস্তবায়ন করতে হয়, তাহলে সর্বাগ্রে জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দাবির পাশাপাশি সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের বোধ ও চেতনাকে জনগণের চিন্তা ও আকাঙ্ক্ষার মধ্যে গভীরভাবে প্রোথিত করতে হবে। প্রচলিত ধারার রাজনৈতিক দলগুলো এটি করার জন্য মোটেও প্রস্তুত নয়। আর নবোত্থিত প্রতিক্রিয়াশীলরাতো নিজেদের চরিত্রগত বৈশিষ্ট্যের জন্যই তা করবে না।
তাহলে বাকি থাকে কেবল অতি ম্রিয়মান ধারায় টিকে থাকা নীতিবান, সংস্কৃতি-সচেতন ও অগ্রসর চিন্তাসম্পন্ন প্রতিবাদী চেতনার সীমিত সংখ্যক মানুষ। তবে ইতিহাসের অভিজ্ঞতা থেকে আশার কথা যে, এই নীতিবান প্রতিবাদী মানুষেরা শুরুতে সংখ্যায় কখনোই অধিক ছিল না। নীতি ও চিন্তার বলিষ্ঠতার কারণেই একসময় শক্তিমান হয়ে ওঠেছে, যেখানে তাদের জন্য পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করেছে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের মতো দলিল, যার অন্তর্গত মূলমন্ত্রই হচ্ছে সাম্য, সমতা ও ন্যায়বিচার এবং যার প্রাকারান্তরিক লক্ষ্য হচ্ছে জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠা। আজ ১০ই এপ্রিল স্বাধীনতার এ ঘোষণাপত্র দিবসে আমরা তেমনি অধিকারভিত্তিক একটি রাষ্ট্র দেখার অপেক্ষাতেই থাকলাম।
লেখক: বিসিকের সাবেক পরিচালক
১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষিত হওয়ার পরবর্তী পনেরো দিনের মধ্যে ঐ বছরেরই ১০ই এপ্রিল জারি করা হয় বাংলাদেশের ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র।’ এ ঘোষণাপত্রের ভিত্তিতেই ঐ বছরের ১৭ই এপ্রিল মুজিবনগরে (বৈদ্যনাথতলা, মেহেরপুর) বাংলাদেশের প্রথম সরকার শপথ গ্রহণ করে এবং তাৎক্ষণিকভাবে সে সরকারের আওতায় মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়। ১৯৭১ সালের ন’মাসের পুরো মুক্তিযুদ্ধ ও রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমও সম্পূর্ণত এ ঘোষণাপত্রের আলোকেই পরিচালিত হয়েছে এবং এ ধারাতেই যুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে পাক-হানাদারবাহিনীকে পরাজিত করে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশের নতুন সংবিধান কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত দেশের সকল রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমও এ ঘোষণাপত্রের বিধানমতেই পরিচালিত হয়েছে। মোটকথা, ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিলের ’স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ই বস্তুত বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান, যা প্রায় একুশ মাস কার্যকর ছিল।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম ও এর প্রাতিষ্ঠানিক বিকাশের ক্ষেত্রে স্বাধীনতার উল্লিখিত ঘোষণাপত্রের এই যে বিশাল ভূমিকা ও অবস্থান, দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, স্বাধীনতা-পরর্বর্তী কোনো সরকারই আজ পর্যন্ত সেটিকে যথেষ্ট গুরুত্ব ও মর্যাদার সাথে তুলে ধরতে আগ্রহ দেখায়নি—এমনকি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারগুলোও নয়। এবং লক্ষ্য করার মতো বিষয় এই যে, আনুষ্ঠানিক দালিলিক ধারাবাহিকতার অংশ হিসেবে ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে এটিকে তফশিলভুক্ত করা আবশ্যিক হওয়া সত্বেও অনবধানবশত বা যেকোনো কারণেই হোক, তা করা হয়নি। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধ, সংবিধান, রাষ্ট্রকাঠামোর বিকাশ ও বিন্যাস ইত্যাদি সংক্রান্ত আলোচনাতেও এ অতি উন্নতমানের ঘোষণাপত্রটি নিয়ে খুব কমই আলোচনা হতে দেখা গেছে। আর গভীরতাপূর্ণ আলোচনাতো বলতে গেলে একেবারেই হয়নি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠ্যক্রমেও এর অন্তর্ভুক্তি প্রায় নেই বললেই চলে। বিষয়টিকে দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব, রাষ্ট্র পরিচালক ও বুদ্ধিজীবীদের উপেক্ষা ও অবহেলা বললে মোটেও যথেষ্ট বলা হয় না। বরং বলা দরকার যে, এটি হচ্ছে তাদের চরম দায়িত্বহীনতাজনিত এমন এক সম্মিলিত ব্যর্থতা, যার কারণে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিভিন্ন সময়ের বহু সিদ্ধান্তই নানাবিধ হীনতা ও দুর্বলতা দ্বারা আক্রান্ত হয়ে থেকেছে।
২০২১ সালে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উদযাপনের সময় খুব স্বাভাবিকভাবেই আশা করা হয়েছিল যে, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র নিয়ে এ সময়ে ব্যাপকভিত্তিক মূল্যায়নধর্মী আলোচনা হবে, এর চুলচেরা বিশ্লেষণ হবে এবং লেখক ও বুদ্ধিজীবীগণ এর নানাবিধ তাৎপর্যের বিষয়টি ব্যাপকভাবে জনসমক্ষে তুলে ধরবেন। এবং সবচেয়ে বেশি আশা ছিল এটি যে, মাত্র দু’পৃষ্ঠার আপাত নিরীহ গোছের প্রচণ্ড শক্তিধর এ ঘোষণাপত্রটি ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ থেকে ১৯৭২ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত দীর্ঘ একুশ মাস কিভাবে কোনোপ্রকার সাংবিধানিক অভাবহীনতার অনুভব ছাড়াই অপার দক্ষতায় এ রাষ্ট্রকে দিক-নির্দেশনা দিয়ে গেছে! কিন্তু তেমনটি হওয়াতো দূরের কথা, অধিকাংশ স্তাবক বুদ্ধিজীবী তখন ব্যস্ত থেকেছেন ব্যক্তি বিশেষের স্তুতি ও ফুলানো-ফাঁপানো প্রশংসায়। ফলে স্বাধীনতার এ ঘোষণাপত্র তখন অনেকটা অপাঙতেয় হিসেবেই থেকে গেছে। অনেকে অবশ্য এমনটিও বলেন যে, স্বাধীনতার উল্লিখিত ঘোষণাপত্র নিয়ে বেশী আলোচনা করলে এর মাধ্যমে তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের গুরুত্ব বেড়ে যায়, যা কারো কারো পছন্দ নয়।
আর এখনতো চারদিকে কেবলই প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির আস্ফালন। কূপমন্ডুকতায় ঘেরা অন্ধকারাচ্ছন্ন এ প্রতিক্রিয়ার শক্তি স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র নিয়ে আলোচনা করবে দূরে থাক, ‘জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার’ (ঘোষণাপত্রের অনুচ্ছেদ-৬) ধারণাকে তারা কতটুকু সমর্থন করে, সে বিষয়েইতো যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। তারাতো বরং পারলে এটিকে বা এর আলোকে প্রণীত রাষ্ট্রের সংবিধানকে কবরস্থ করতে চায়। কিন্তু তারা কি বোঝেন যে, ১৯৭১-এ এরূপ একটি জনস্বার্থমুখী ঘোষণাপত্র সামনে ছিল বলেই মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের নেতৃবৃন্দের পক্ষে সেদিন তাদের মেধা ও বিচক্ষণতাকে যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে সফল পরিসমাপ্তির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছিল? স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে মাত্র এক বছরেরও কম সময়ের ব্যবধানে রাষ্ট্রের পক্ষে যে একটি পূর্ণাঙ্গ সংবিধান গ্রহণ করা সম্ভব হলো, সেটিও স্বাধীনতার ঐ ঘোষণাপত্র সামনে ছিল বলেই সম্ভব হয়েছিল। ১৯৭২-এর সংবিধানতো বস্তুত একাত্তরের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রেরই বর্ধিত সংস্করণ।
কি আছে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে? একবারে প্রথমেই আছে এ কথা যে, এ রাষ্ট্র হবে ‘জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার’ জন্য, যা উপরেও উল্লেখ করা হয়েছে। আর আছে ’সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার’ অঙ্গীকার। এখন কথা হচ্ছে, গত ৫৫ বছরের ব্যবধানে উল্লিখিত এ অঙ্গীকারসমূহের কতোটা এ রাষ্ট্র তার জনগণের জন্য নিশ্চিত করতে পেরেছে? এ রাষ্ট্রে জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার কি আদৌ আছে—একেবারে ছিটেফোঁটা পরিমাণে হলেও, যারমধ্যে ভোটাধিকার একটি? যে বৈষম্যের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ২৩ বছর সংগ্রাম করে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ মুক্ত হলো, সে দেশে অসাম্য বা বৈষম্যহীনতা কি আদৌ এতটুকু কমেছে? যে মানবিক মর্যাদার বোধে উদ্দীপ্ত হয়ে একাত্তরে এ দেশের কৃষক মাঠে লাঙ্গল ফেলে কিংবা শ্রমিক কারখানা ছেড়ে রাজপথের মিছিলে এসে যুক্ত হয়েছিল, তারা কি আজ স্ব স্ব ক্ষেত্রে ন্যূনতম আত্মমর্যাদাবোধ নিয়ে বাঁচতে পারছে? পোশাক কারখানার যে শ্রমিক ঈদের আগে বকেয়া বেতনভাতার দাবিতে রাস্তায় নামার ‘অপরাধে’ পুলিশের প্রহারের শিকার হন এবং অভিধা পান দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীদের অংশীদার বলে, সেখানে কোথায় থাকে তার আত্মমর্যাদা? ধূর্ত রাজনীতিকি, মুৎসুদ্দি আমলা, মুনাফাখোর ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন শ্রেণীর টাউট পরিবেষ্টিত এ সমাজে কোথায় এ দেশের সাধারণ জনগণের সামাজিক ন্যায়বিচার?
তো এ রকম একটি অবস্থায় স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র জারীর ৫৫ তম বর্ষে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত কষ্ট ও হতাশার সঙ্গে বলতে হয় যে, এ রকম একটি রাষ্ট্র ও সমাজের জন্যই কি স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে ব্যক্ত অঙ্গীকারের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে একাত্তরে এ দেশের মানুষ অকাতরে তার বুকের রক্ত ঢেলে দেশকে স্বাধীন করেছিল? কেন এমন হলো? কেন ১৯৭২ থেকে অদ্যাবধি এ দেশের শাসকেরা স্বাধীনতার এ ঘোষণাপত্রকে এড়িয়ে চলতে বা কবর দিতে চেয়েছেন? কেন একে তাদের এত ভয়? কারণ আর আর কিছুই না। এর মূল কারণ হচ্ছে, তারা রাষ্ট্রক্ষমতায় জনগণের অংশীদারিত্ব চায় না। তারা চায় ক্ষমতার একচ্ছত্র মালিকানা—বিভিন্ন নামে ও বিশেষণে। এমন পরিস্থিতিতে একাত্তরের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের অঙ্গীকারকে যদি সত্যি সত্যি বাস্তবায়ন করতে হয়, তাহলে সর্বাগ্রে জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দাবির পাশাপাশি সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের বোধ ও চেতনাকে জনগণের চিন্তা ও আকাঙ্ক্ষার মধ্যে গভীরভাবে প্রোথিত করতে হবে। প্রচলিত ধারার রাজনৈতিক দলগুলো এটি করার জন্য মোটেও প্রস্তুত নয়। আর নবোত্থিত প্রতিক্রিয়াশীলরাতো নিজেদের চরিত্রগত বৈশিষ্ট্যের জন্যই তা করবে না।
তাহলে বাকি থাকে কেবল অতি ম্রিয়মান ধারায় টিকে থাকা নীতিবান, সংস্কৃতি-সচেতন ও অগ্রসর চিন্তাসম্পন্ন প্রতিবাদী চেতনার সীমিত সংখ্যক মানুষ। তবে ইতিহাসের অভিজ্ঞতা থেকে আশার কথা যে, এই নীতিবান প্রতিবাদী মানুষেরা শুরুতে সংখ্যায় কখনোই অধিক ছিল না। নীতি ও চিন্তার বলিষ্ঠতার কারণেই একসময় শক্তিমান হয়ে ওঠেছে, যেখানে তাদের জন্য পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করেছে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের মতো দলিল, যার অন্তর্গত মূলমন্ত্রই হচ্ছে সাম্য, সমতা ও ন্যায়বিচার এবং যার প্রাকারান্তরিক লক্ষ্য হচ্ছে জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠা। আজ ১০ই এপ্রিল স্বাধীনতার এ ঘোষণাপত্র দিবসে আমরা তেমনি অধিকারভিত্তিক একটি রাষ্ট্র দেখার অপেক্ষাতেই থাকলাম।
লেখক: বিসিকের সাবেক পরিচালক
সূর্যোদয় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এবার যে নববর্ষের আগমন, তা রাঙিয়ে দিয়ে যাক প্রত্যেক মানুষের জীবন। বাংলা নববর্ষের উজ্জীবনী সুধায় স্নান করুক মানুষ। আশা ও আকাঙ্ক্ষার স্বপ্নপূরণে সার্থক হোক পৃথিবী। গ্লানি, জ্বরা মুছে গিয়ে অগ্নিস্নানে ধরণিকে শুচি করার যে আহ্বান জানিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ...
১ দিন আগেবাংলা নববর্ষ বরণকে কেন্দ্র করে আমাদের নগরকেন্দ্রিক জীবনে উপচানো আবেগ-উচ্ছ্বাস উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই আবেগ-উচ্ছ্বাস জাতিগত পারস্পরিক সৌহার্দ্যের নয়, সমষ্টিগতও নয়, একান্তই আত্মকেন্দ্রিকতায় সীমাবদ্ধ।
১ দিন আগেনতুন বছরে প্রবেশ করলাম আমরা। পৃথিবীব্যাপী বসবাসরত নানা জনগোষ্ঠী যেমন নতুন বছরকে উৎসবের মাধ্যমে বরণ করে নেয়, তেমনি বাঙালিও নানা আনন্দ-আয়োজনের মাধ্যমে নতুন বছরকে বরণ করে নেয়। একটি নতুন আশা, উদ্দীপনা নিয়ে যাত্রা শুরু হয় বছরের প্রথম দিনটিতে।
১ দিন আগেআশেকা ইরশাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এবং সাবেক চেয়ারপারসন। তাঁর গবেষণার ক্ষেত্র জেন্ডার, ভূ-কৌশলগত ও আঞ্চলিক সম্পর্ক নিয়ে। ফিলিস্তিন পরিস্থিতিতে আরব বিশ্বের ভূমিকা...
২ দিন আগে