Ajker Patrika

শেখ হাসিনাকে ফেরত আনা: ভারত এখন চাপে পড়বে

  • মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হওয়ায় জোর বাড়বে হাসিনাকে ফেরত চাওয়ায়।
  • সহায়ক হবে দুই দেশের মধ্যে হওয়া বন্দী প্রত্যর্পণ চুক্তি।
  • বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারত চুক্তির ফাঁকফোকর বের করার চেষ্টা করবে।
  • ইন্টারপোলে নোটিশ জারির প্রক্রিয়া শুরু: প্রসিকিউটর

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
শেখ হাসিনা। ফাইল ছবি
শেখ হাসিনা। ফাইল ছবি

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মুখে দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তখন থেকে তাঁকে ফেরত দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে। তবে বিষয়টি খুব বেশি আমল দেয়নি ভারত। কিন্তু শেখ হাসিনা এখন মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত। ফলে বাংলাদেশ এখন তাঁকে আরও জোর দিয়ে চাইতে পারবে। তার ওপর দুই দেশের মধ্যে বন্দিবিনিময় চুক্তি থাকায় শেখ হাসিনাকে ফেরত দেওয়া নিয়ে চাপে পড়বে ভারত।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে গত সোমবার শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। রায়ের পরপরই অন্তর্বর্তী সরকার তাঁকে হস্তান্তরের জন্য ভারতকে অনুরোধ জানিয়েছে। যদিও ওই দিন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়, ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী হিসেবে ভারত বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থ বিবেচনায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ভারত সর্বদা সেই লক্ষ্যে সকল অংশীদারের সঙ্গে গঠনমূলকভাবে সম্পৃক্ত থাকবে। কিন্তু শেখ হাসিনাকে ফেরত দেওয়ার ব্যাপারে ওই বিবৃতিতে কিছুই বলেনি দিল্লি।

শেখ হাসিনাকে ফেরাতে দুই দেশের মধ্যে নতুন করে চিঠি চালাচালি শুরু হবে বলে মনে করেন সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ আহমদ। গতকাল মঙ্গলবার তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এখন তো পরিস্থিতির কিছু পরিবর্তন হয়েছে। আগে ছিল অভিযুক্ত (শেখ হাসিনা), এখন তাঁর বিরুদ্ধে রায় হয়েছে। তিনি দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। এখন নতুন করে আবার চাইতে হবে। বন্দী প্রত্যর্পণ চুক্তির মাধ্যমে চাইতে পারি। তবে আমাদের হাতে এমন কোনো অস্ত্র নেই যে ভারতকে বাধ্য করতে পারি।’

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হন বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই দিন তিনি দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেন। শেখ হাসিনা ছাড়াও কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামালসহ দলটির অনেক নেতা-কর্মী দেশটিতে আশ্রয়ে আছেন। মানবতা-বিরোধী অপরাধের মামলার বিচারকাজ শুরু হলে শেখ হাসিনাকে ফেরত চেয়ে ভারতকে আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দেয় বাংলাদেশ সরকার। তবে তাতে সাড়া মেলেনি। তা নিয়ে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে। শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায়ের পর দেশে তাঁকে ফিরিয়ে আনতে আরও বেশি দাবি উঠেছে।

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ২০১৩ সালে একটি প্রত্যর্পণ চুক্তি সই হয়, যা ২০১৬ সালে সংশোধিত হয়েছে। এ চুক্তি দুই দেশের মধ্যে পলাতক আসামিদের দ্রুত এবং সহজে বিনিময়ের জন্য করা হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী, প্রত্যর্পণযোগ্য অপরাধের মামলায় অভিযুক্ত বা ফেরার আসামি এবং বন্দীদের একে অপরের কাছে হস্তান্তর করবে ভারত ও বাংলাদেশ।

এই চুক্তির কথা উল্লেখ করে সাবেক রাষ্ট্রদূত মাহফুজুর রহমান বলেন, যেকোনো দ্বিপক্ষীয় চুক্তি কতটা কার্যকর হবে, সেটা নির্ভর করে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক কী রকম, তার ওপর। কোনো চুক্তিই চূড়ান্ত হয় না, এটাই বাস্তবতা। যেহেতু আমাদের দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের কারণে। গত বছর থেকে শেখ হাসিনাকে প্রত্যর্পণের জন্য অনুরোধ করা হলেও ভারতের দিক থেকে কোনো সাড়া দেওয়া হয়নি। অনুমান করা যায়, এবারও সাড়া দেবে না।

ভারতীয় বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, দেশটি থেকে শেখ হাসিনাকে ফেরত নেওয়া সহজ হবে না। দেশটির ওপি জিন্দাল বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত সোমবার দিল্লিতে জার্মানির গণমাধ্যম ডয়চে ভেলেকে বলেন, শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশ অনেক দিন ধরে ফেরত চাইছে। ভারত দিচ্ছে না। এখন রায়ের পর সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর বিষয়ে ভারত তার অবস্থান বদলাবে, এটা মনে হয় না।

ভারতের দিক থেকে ‘না’ বলার অনেক উপায় আছে মন্তব্য করে শ্রীরাধা দত্ত বলেন, সাজাপ্রাপ্ত বন্দী প্রত্যর্পণের জন্য দুই দেশের মধ্যে চুক্তি থাকলেও তাতে অনেক ফাঁকফোকর আছে। ভারত সরকারের আইন বিশেষজ্ঞরা তা নিশ্চয় খতিয়ে দেখবেন।

ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের আমন্ত্রণে কলম্বো সিকিউরিটি কনক্লেভের (সিএসসি) জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের সম্মেলনে যোগ দিতে গতকাল ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে গেছেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান। সেখানে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার সঙ্গে খলিলুর রহমানের বৈঠক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানা গেছে। যেখানে শেখ হাসিনাকে প্রত্যর্পণের বিষয় নিয়ে আলোচনা হতে পারে বলে সূত্র বলছে।

সাবেক রাষ্ট্রদূত মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তিনি (খলিলুর রহমান) ভারতের সঙ্গে কথা বলতে পারেন বা বিষয়টি উপস্থাপন করতে পারেন। সেখান থেকে হয়তো আলোচনার সূত্রপাত হতে পারে। কিন্তু বিষয়টি কঠিন। সহজে সমাধান হবে বলে মনে করি না।’

আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক বিশ্লেষকেরা বলছেন, এখন বাংলাদেশের দিক থেকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে যে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায়ে সুবিচার হয়েছে। তাহলে শেখ হাসিনাকে ফেরানোর দাবিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে পাশে পাওয়া যেতে পারে। সাবেক রাষ্ট্রদূত মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘রায়ে সুবিচার হয়েছে, এটি প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। তা হলে ভারত একটা চাপের মধ্যে পড়তে পারে।’

ইন্টারপোলে নোটিশ জারির প্রক্রিয়া শুরু: প্রসিকিউটর

সাজা পরোয়ানা মূলে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলে নোটিশ জারির জন্য আবেদনের কাজ শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামিম। গতকাল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ের পক্ষ থেকে এটা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে এটা ইন্টারপোলে যাবে।

গাজী তামিম বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামাল ৩০ দিনের মধ্যে আপিল না করলে আপিলের সুযোগ থাকবে না। যদি তাঁরা ৩০ দিনের মধ্যে আপিল না করেন, তাহলে তাঁরা গ্রেপ্তার হলে রায় কার্যকর হবে। যেসব আইনে আপিলের সময়সীমা বর্ণনা করা নেই, সেসব আইনের আপিলের সময়সীমা নির্ধারণ হয় তামাদি আইন অনুযায়ী। তামাদি আইন অনুযায়ী আপিলের সময়সীমা নির্ধারণ হলে সময় পার হলেও বিলম্ব মার্জনার সুযোগ আছে। কিন্তু বিশেষ আইনগুলোতে যেখানে তামাদির সময় বলা আছে, ওই সময় পার হলে বিলম্ব মার্জনার কোনো সুযোগ নেই।

প্রসিকিউটর তামিম বলেন, এই রায়ের একটি সার্টিফায়েড কপি ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন পাবে এবং একটি সার্টিফায়েড কপি এই মামলায় যে আসামি উপস্থিত ছিলেন তিনি পাবেন। যে আসামিরা পলাতক আছেন, তাঁরা যদি ৩০ দিনের মধ্যে আত্মসমর্পণ করেন অথবা গ্রেপ্তার হন, তাহলে তাঁরাও পাবেন। এ ছাড়া রায়ের আরেকটি কপি ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে মানে ঢাকার জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠানো হবে কার্যকর করার জন্য।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ