Ajker Patrika

সভায় যান না মন্ত্রী-সাংসদেরা

আজাদুল আদনান, ঢাকা
আপডেট : ১৫ ডিসেম্বর ২০২১, ১৪: ১৯
সভায় যান না মন্ত্রী-সাংসদেরা

সারা দেশে সরকারি হাসপাতালগুলোর চিকিৎসাব্যবস্থার তদারকি এবং রোগী ও কর্মীদের সুবিধাগুলো নিশ্চিত করতে প্রতিটি সরকারি হাসপাতালেই আছে একটি করে ‘হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা কমিটি’। সংশ্লিষ্ট এলাকার মন্ত্রী-সাংসদেরা এসব কমিটির প্রধান। নিয়ম অনুসারে প্রতি মাসে একটি করে সভা হওয়ার কথা। কিন্তু খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, দেশের ৮০ শতাংশ হাসপাতালে গত এক বছর কোনো সভাই হয়নি। কিছু হাসপাতালে সভা হয়েছে দু-একটা করে, আর কিছু হাসপাতালে সভা হলেও সেখানে মন্ত্রী-সাংসদেরা উপস্থিত থাকেননি। এ তালিকায় শীর্ষে আছেন মানিকগঞ্জ-৩ আসনের সাংসদ, স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। নিজের এলাকার হাসপাতালের সভাতেই তিনি উপস্থিত থাকেন না।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা, অনিয়ম, দুর্নীতি, চিকিৎসায় অবহেলা নিয়ে মন্ত্রী-সাংসদেরা বিভিন্ন সময় প্রকাশ্যে কথা বললেও নিজের এলাকার হাসপাতালের উন্নয়ন নিয়ে তাঁরা কোনো দায়িত্ব পালন করেন না। করোনার সময় সেই দুরবস্থার বিষয়টি সবার সামনে এসেছে। মন্ত্রী-সংসদেরা নিজেদের এলাকার হাসপাতাল নিয়ে সক্রিয় হলে, দেশের চিকিৎসাসেবার পরিস্থিতিই পাল্টে যেত। চিকিৎসা খাতে রাষ্ট্রের যে বিপুল পরিমাণ ব্যয়, তারও সদ্ব্যবহার হতো।

জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘আমরা স্বাস্থ্যে যে জনসম্পৃক্ততার কথা বলি, সাংসদেরা এগিয়ে এলেই তা সম্ভব। তাঁরা যুক্ত হলে স্থানীয় অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। এতে করে সেবার মান যেমন বাড়বে, তেমনি অনিয়ম রোধ হবে। স্বাস্থ্যকে ভাবতে হবে স্থানীয় জনগণের সম্পত্তি, যার নেতৃত্বে থাকবেন সাংসদেরা। এ দায়িত্ব তাঁরা কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না।’

দেশে ৩৬টি সরকারি মেডিকেল কলেজ ছাড়াও বিভাগ, জেলা ও উপজেলায় হাসপাতাল আছে ৬১০টি। এসব হাসপাতালে প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষ চিকিৎসাসেবা নিয়ে থাকে। তাদের সেবা নিশ্চিত করতে প্রতিটি হাসপাতালেই আছে একটি করে ব্যবস্থাপনা কমিটি।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রধান কাজ হলো হাসপাতাল পরিচালনা এবং রোগীদের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা। এ ছাড়া রোগীদের ওষুধ, খাদ্য, যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিরাপত্তাসহ যাবতীয় সুবিধা নিশ্চিত করা। আজকের পত্রিকার ৫০ জন প্রতিনিধি বিভাগ, জেলা ও উপজেলার ৫০টি হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে যে চিত্র পেয়েছেন তা ভয়াবহ। দেখা গেছে, করোনার সময়ে হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা উন্নতির বদলে আরও ভেঙে পড়েছে। এ জন্য কে দায়ী তা নিরূপণ করার জন্য কিছু হাসপাতাল ব্যবস্থাপনার চিত্র দেখতে পারি। শুরুতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা কমিটি গত এক বছরে একটিও সভা করেনি। এই কমিটির প্রধান স্থানীয় সাংসদ রাশেদ খান মেনন অনেক দিন দেশের বাইরে। এ ক্ষেত্রে হাসপাতালটির পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হকের সাফ জবাব, সভাপতি ফিরে এলে সভা হবে।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল  ব্যবস্থাপনা কমিটির দু-একটা সভা হলেও উপস্থিত থাকতে পারেননি ঢাকা-১৫ আসনের সাংসদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। জানতে চাইলে তিনি বলেন, কমিটির সভাপতি হলেই যে সভায় থাকতে হবে এমন কোনো কথা নেই। আর পরিচালক খলিলুর রহমান বলেছেন, মন্ত্রী না এলেও নিয়মিতই সভা হয়।

করোনার হটস্পট বলে পরিচিত ফরিদপুর। সেখানকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা কমিটির সর্বশেষ সভা হয়েছে গত বছরের মে মাসে। ফরিদপুর সদর আসনের সাংসদ খন্দকার মোশাররফ হোসেন কমিটির সভাপতি। জানতে চাইলে তিনি বলেন, সভা হবে কি হবে না, কবে হবে, সেটা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষই বলতে পারবে। অন্যদিকে হাসপাতালের পরিচালক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, সভাপতির সঙ্গে যোগাযোগ নেই। কী করে সভা হবে।

খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গত বছরের শেষের দিক থেকে এখন পর্যন্ত কোনো সভা হয়নি। কমিটির প্রধান খুলনা-২ আসনের সাংসদ শেখ সালাহউদ্দিন।

খুলনার সিভিল সার্জন নিয়াজ মোহাম্মদ বলেন, ‘করোনায় গত বছরের শেষের দিকে আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর এখনো সশরীরে কোনো সভা হয়নি, তবে ভার্চুয়াল হয়েছে।’

গত দেড় বছরে টাঙ্গাইল সদর হাসপাতালে সভা হয়েছে চারটি। আবার এসব সভার একটিতে উপস্থিত ছিলেন কমিটির সভাপতি স্থানীয় সাংসদ মো. ছানোয়ার হোসেন।

জানতে চাইলে ছানোয়ার হোসেন বলেন, ‘করোনার কারণে কিছুটা সমস্যা হয়েছিল।’

পটুয়াখালী সদর ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি পটুয়াখালী-১ আসনের সাংসদ শাহজাহান মিয়া।

হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক লোকমান হাকিম বলেন, সাংসদ বয়স্ক হওয়ায় এলাকায় তেমন আসেন না।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি সদর আসনের সাংসদ ফজলে হোসেন বাদশা। হাসপাতালের পরিচালনা পর্ষদের প্রতিটি সভায় তিনি সশরীরে উপস্থিত থাকেন।

মৌলভীবাজার ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি স্থানীয় সাংসদ নেছার আহমদ। সর্বশেষ সভা হয়েছে গত বছর।

জেলার বড়লেখা ও জুড়ী উপজেলা হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি পরিবেশ ও বনমন্ত্রী এম শাহাবুদ্দিন আহমদ। তিনিও নিয়মিত সভায় উপস্থিত থাকতে পারেন না।

রাজবাড়ী সদর হাসপাতালের সর্বশেষ সভা হয়েছিল গত বছরের ২২ নভেম্বর। এরপর স্থানীয় সাংসদ সময় না দেওয়ায় সভা আর হয়নি বলে হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে।

বগুড়া ২৫০ শয্যার মোহাম্মদ আলী হাসপাতালের কোনো ব্যবস্থাপনা কমিটি নেই। সদর আসনের সাংসদ নুরুল ইসলাম ওমর (জাপা) তৎকালীন কমিটির সভাপতি ছিলেন।

একাদশ সংসদে জি এম সিরাজ নির্বাচিত হন বগুড়া-৬ (সদর) আসনে। কিন্তু এ সময়কালে কোনো ব্যবস্থাপনা কমিটি হয়নি, সভাও হয়নি।

বাগেরহাট সদর হাসপাতালে গত এক বছরে দুটি সভা হয়েছে। এর মধ্যে কোনো সভায় বাগেরহাট-২ আসনের সাংসদ শেখ তন্ময় ছিলেন না।

সভা না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে বাগেরহাটের সিভিল সার্জন ডা. কে এম হুমায়ুন কবির বলেন, সাংসদ সময় না দেওয়ায় অনেক সময় সভা ডাকা সম্ভব হয়নি।

তবে ভিন্ন চিত্র মোংলা ও রামপাল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের। অধিকাংশ সভায় সভাপতি বাগেরহাট-৩ (রামপাল-মোংলা) আসনের সাংসদ উপমন্ত্রী তালুকদার হাবিবুন্নাহার উপস্থিত ছিলেন।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা কমিটির গত দুই বছরে মাত্র দুটি সভা হয়েছে। দুটিতেই উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় সাংসদ শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল।

নড়াইল সদর হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মুর্তজা আগের সভাগুলোতে নিয়মিত অংশ নেন। তবে করোনার কারণে এ বছর এখন পর্যন্ত দুটি সভা হয়েছে।

যশোরের কেশবপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রধান যশোর-৬ (কেশবপুর) আসনের সাংসদ শাহীন চাকলাদার। গত ৭ ফেব্রুয়ারি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সভায় তিনি উপস্থিত ছিলেন।

ভোলার মনপুরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভা ২০২০ সালের জুলাই মাসে হয়েছে। এর মধ্যে করোনার কারণে স্থানীয় সাংসদ এলাকায় আসতে পারেননি বলে বৈঠক হয়নি।

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভা কবে হয়েছে, তা জানে না স্বয়ং কর্তৃপক্ষ। এই কমিটির সভাপতি বেগম রওশন এরশাদ অসুস্থ থাকায় সভা হয়নি বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের সহকারী পরিচালক (প্রশাসক) ডা. জাকিউল ইসলাম।

দেশের সব সরকারি হাসপাতাল কমিটির সভা নিয়মিত হয় কি না, তা তদারকির দায়িত্ব স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের। তবে সরকারি হাসপাতালগুলোয় মাসে কিংবা বছরে কতটা সভা হয় তার হিসাব নেই প্রতিষ্ঠানটির কাছে। এ ব্যাপারে জানতে চেয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) এ বি এম খুরশীদ আলমের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তাঁকে পাওয়া যায়নি।

তবে অধিদপ্তরের হাসপাতাল শাখার পরিচালক ডা. ফরিদ মিঞা আজকের পত্রিকাকে বলেন, সভা না হওয়ার পেছনে কমিটির সভাপতি বড় একটা বিষয়। অনেক সময় তাঁদের সঙ্গে সমন্বয় না হওয়ায় সভা করা সম্ভব হয় না।

জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. ইকবাল আর্সলান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘সাংসদেরা ভোটের সময় ছাড়া এলাকায় তেমন যান না, বেশির ভাগ সময় তাঁরা ঢাকায় থাকেন। ফলে যে উদ্দেশ্যে কমিটি করা, সেই কাজ তো হয়ই না; বরং বেশি করে বাধা তৈরি করে। আসলে সাংসদদের বদলে মেয়র ও উপজেলা চেয়ারম্যানদের এসব কমিটির প্রধান করা উচিত। সাংসদদের তুলনায় তাঁদের দায়বদ্ধতা ও জনসম্পৃক্ততা অনেক বেশি।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ব্যাংকিংয়ের নামে কারসাজি, ফাঁসছে ফার্স্ট সিকিউরিটি

‘আমার নিরপরাধ ছেলেডারে ডাইক্যা নিয়া ওসি স্যার জেলে ডুকাইয়া দিল’

রাঙামাটির হোটেল থেকে নারীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার, ম্যানেজার আটক

চাঁদাবাজদের কথিত তালিকা নিয়ে রাজশাহীতে তোলপাড়, বিএনপি-জামায়াত নেতাদের নাম

আগামী ১১ দিন নৈরাজ্যের আশঙ্কা, ঠেকাতে এসপিদের এসবির চিঠি

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত