Ajker Patrika

যুদ্ধাপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা আজহারকে খালাস দিলেন সুপ্রিম কোর্ট

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
আপডেট : ২৭ মে ২০২৫, ২০: ৫৩
মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ডের রায়প্রাপ্ত জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলাম। ফাইল ছবি
মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ডের রায়প্রাপ্ত জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলাম। ফাইল ছবি

একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা এ টি এম আজহারুল ইসলামকে খালাস দিয়েছে আপিল বিভাগ। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া রায় বাতিল করে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে সাত বিচারপতির আপিল বেঞ্চ সর্বসম্মতিক্রমে এ রায় দেন। সেই সঙ্গে অন্য কোনো মামলা না থাকলে তাঁকে অবিলম্বে মুক্তিরও নির্দেশ দিয়েছেন সর্বোচ্চ আদালত।

মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ডের রায় বাতিল করে আজহারের পক্ষে আপিলের শুনানি শেষে গত ৮ মে রায়ের জন্য আজ মঙ্গলবার দিন রাখা হয়। আপিল বিভাগে আজহারের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার এহসান এ সিদ্দিক ও মোহাম্মদ শিশির মনির।

মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর এ টি এম আজহারুল ইসলামকে মৃত্যুদণ্ড দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ২০১৯ সালের ৩১ অক্টোবর আপিল বিভাগ ট্রাইব্যুনালের রায় বহাল রাখেন। এ টি এম আজহারুল ইসলামের পক্ষে ওই রায়ের রিভিউ বা পর্যালোচনা চেয়ে ২০২০ সালের ১৯ জুলাই আপিল বিভাগে আবেদন করা হয়।

গতবছর ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পর চলতি বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ মৃত্যুদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে এ টি এম আজহারুল ইসলামকে রিভিউ আবেদনের অনুমতি দেন। সেই সঙ্গে দুই সপ্তাহের মধ্যে আপিলের সারসংক্ষেপ জমা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। পরে সারসংক্ষেপ জমা দিলে আপিল শুনানি হয়।

আজহারের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের যত অভিযোগ

মুক্তিযুদ্ধকালে রংপুরে আলবদর বাহিনীর যুদ্ধাপরাধে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ২০১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলামকে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেন বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। তাঁর বিরুদ্ধে আলবদর বাহিনীর নেতা হিসেবে রংপুর অঞ্চলে গণহত্যা চালিয়ে অন্তত ১৪০০ লোককে হত্যা ও ১৪ জনকে খুনের অভিযোগ আনা হয়েছিল।

জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আজহারের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, অপহরণ, ধর্ষণ, নির্যাতনের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের ছয়টি ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ ছিল। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন জামায়াতের সেই সময়ের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের জেলা কমিটির সভাপতি। পদাধিকার বলেই আলবদর বাহিনীর রংপুর শাখার কমান্ডারও ছিলেন তিনি। বাঙালির মুক্তির সংগ্রাম দমনে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতা করার জন্য এই বাহিনী গড়ে তোলা হয়েছিল।

আজহারের বিরুদ্ধে ছয় অভিযোগের মধ্যে দুটি গণহত্যা, একটি ধর্ষণ, চারটি হত্যা এবং অপহরণ, আটক, নির্যাতনের তিন ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ ছিল। এসব ঘটনায় অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে ২০১৩ সালের ১২ নভেম্বর আজহারের বিচার শুরু করে ট্রাইব্যুনাল। দুই পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে ২০১৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখা হয়।

  • অভিযোগ ১

১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ থেকে ২৭ মার্চের মধ্যে ইসলামী ছাত্র সংঘের রংপুর শাখার সভাপতি এটিএম আজহারুল ইসলাম জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রসংঘের সশস্ত্র সদস্য এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, ভাসানী (ন্যাপ) নেতা ও রংপুর শহরের আয়কর আইনজীবী এ ওয়াই মাহফুজ আলী ওরফে জররেজ মিয়াসহ ১১ জনকে অপহরণ করে রংপুর ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়। সেখানে তাঁদের সাতদিন আটকে রেখে নির্যাতন চালানো হয়। এরপর ৩ এপ্রিল তাদের রংপুর শহরের দখিগঞ্জ শ্মশানে নিয়ে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে আজহারের লোকজন। এ সময় দীনেশ চন্দ্র ভৌমিক ওরফে মন্টু ডাক্তার আহত হলেও বেঁচে যান। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার শরীরে সেই গুলির জখম ছিল।

এসব ঘটনায় এটিএম আজহারের বিরুদ্ধে ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের ৩(২)(এ)(জি)(এইচ), ৪(১), ৪(২) এবং ২০(২) ধারায় অপহরণ, আটক, নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগ আনা হয়।

  • অভিযোগ ২

১৯৭১ সালের ১৬ এপ্রিল দুপুর ১টার দিকে জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রসংঘের সশস্ত্র সদস্য এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে ট্রেনে করে নিজ এলাকা রংপুরের বদরগঞ্জ থানার ট্যাক্সেরহাট রেলগুমটিতে যান আজহার। সেখান থেকে ধাপপাড়া যাওয়ার পথে দুই পাশের একাধিক গ্রামে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ চালান তাঁরা। ধাপপাড়ায় পৌঁছে মোকসেদপুর গ্রামে গুলি চালিয়ে ১৪ জন নিরীহ, নিরস্ত্র বাঙালিকে হত্যা করেন তাঁরা।

এ ঘটনায় আসামির বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩(২)(এ)(জি)(এইচ), ৪(১), ৪(২) এবং ২০(২) ধারায় লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।

  • অভিযোগ ৩

১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল দুপুর ১২টা থেকে ৫টার মধ্যে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রসংঘের সশস্ত্র সদস্য এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে রংপুরের বদরগঞ্জের ঝাড়ুয়ারবিলের আশেপাশের গ্রামে হামলা চালিয়ে এক হাজার দুইশর বেশি নিরীহ হিন্দু গ্রামবাসীকে গুলি চালিয়ে হত্যা করে আজহারুল ইসলাম। এছাড়া আরো অন্তত ২০০ লোককে ধরে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে। এছাড়া গ্রামগুলোর বাড়িঘরে লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করে তাঁরা।

এই ঘটনায় আসামির বিরুদ্ধে আন্তুর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩(২)(এ)(জি)(এইচ), ৪(১), ৪(২) এবং ২০(২) ধারায় লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, হত্যা ও গণহত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।

  • অভিযোগ ৪

১৯৭১ সালের ৩০ এপ্রিল রাত ৯টা থেকে ১২টার মধ্যে আলবদর বাহিনীর সদস্য ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে কারমাইকেল কলেজের চারজন অধ্যাপক ও একজন অধ্যাপকের স্ত্রীকে কলেজ ক্যাম্পাস থেকে অপহরণ করে দমদম ব্রিজের কাছে নিয়ে গুলি করে হত্যা করেন আজহার।

এই ঘটনায় আসামির বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩(২)(এ), ৩(২)(সি), ৩(২)(জি), ৩(২)(এইচ), ৪(১), ৪(২) এবং ২০(২) ধারায় হত্যা ও গণহত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।

  • অভিযোগ ৫

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে ইসলামী ছাত্র সংঘের রংপুর শাখার সভাপতি এটিএম আজহারুল ইসলামের নেতৃত্বে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রসংঘের সদস্যরা এবং স্থানীয় বিহারীরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজনের তথ্য সংগ্রহ করে রংপুর ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সরবরাহ করত। এর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে থাকা অনেক পরিবারের সদস্যদের অপহরণ, আটক ও নির্যাতন চালানো হয়। ওই সময়ের মধ্যে রংপুর শহর এবং আশেপাশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মনসুরা খাতুনসহ অসংখ্য নারীকে ধরে এনে টাউন হলে আটকে রেখে ধর্ষণসহ শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়।

এই ঘটনায় আসামির বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩(২)(এ), ৩(২)(জি), ৩(২)(এইচ), ৪(১), ৪(২) এবং ২০(২) ধারায় অপহরণ, আটক, নির্যাতন ও ধর্ষণের অভিযোগ আনা হয়েছে।

  • অভিযোগ ৬

একাত্তরের নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে রংপুর শহরের গুপ্তপাড়ায় ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেওয়ায় শওকত হোসেন রাঙাকে নির্যাতন করেন অভিযুক্ত এটিএম আজহার। এরপর রাঙার ভাই ও ছাত্রলীগের কারমাইকেল কলেজ শাখার ছাত্রলীগ কর্মী রফিকুল হাসান নান্নুকে রংপুর শহরের বেতপট্টি থেকে অপহরণ করে রংপুর কলেজের শহীদ মুসলিম ছাত্রাবাসে নিয়ে আটক রেখে নির্যাতন ও জখম করা হয়। পরে নাসিম ওসমান নামের এক অবাঙালির সহায়তায় নান্নুকে ছাড়িয়ে আনেন তার বড়ভাই সাজ্জাদ জহির।

এ ঘটনায় আসামির বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩(২)(এ), ৩(২)(জি), ৩(২)(এইচ), ৪(১), ৪(২) এবং ২০(২) ধারায় অপহরণ, আটক ও নির্যাতনের অভিযোগ আনা হয়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

আজহারুলের আপিলে তাজুলের প্রসিকিউশন টিম, স্বার্থের সংঘাত দেখছেন ডেভিড বার্গম্যানও

ডিসেম্বরে নির্বাচন চায় শুধু একটি দল—প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যের যে ব্যাখ্যা দিল প্রেস উইং

মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র হাতে লড়েছিলেন বলেই কি জামিন পেলেন না অধ্যাপক আনোয়ারা

হঠাৎ ব্যাংকের ভেতরে সবাই অচেতন

সৌদি আরবে পুরুষের ‘অবাধ্য’ হলে নারীর যে পরিণতি হয়

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত