Ajker Patrika

তাজউদ্দীন আহমদের নাম মুছে দেওয়া যাবে না

আপডেট : ২৪ জুলাই ২০২৫, ০০: ৩৪
তাজউদ্দীন আহমদ। ছবি: সংগৃহীত
তাজউদ্দীন আহমদ। ছবি: সংগৃহীত

১৯২৫ সালের ২৩ জুলাই, গাজীপুর জেলার অন্তর্গত কাপাসিয়ার দরদরিয়ায় জন্মগ্রহণ করা শিশুটি যে বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখে যাবেন, সেটা হয়তো সেদিনই বোঝা যায়নি। কিন্তু সেদিনের ক্ষীণকায় শিশুটি ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠেন। আজীবন সঙ্গী হয় শান্ত, সংযমী, আত্মমগ্ন স্বভাব। তিনি তাজউদ্দীন আহমদ—স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধুর অকৃত্রিম সাথি, বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্র নির্মাণের অন্যতম কারিগর। এক অসম্ভব প্রতিকূল সময়ে রাজনৈতিক স্থিতি রক্ষাকারী রূপকার। আজ তাঁর জন্মের শততম বছর পূর্ণ হলো। কিন্তু এ জন্মশতবর্ষ যেন ইতিহাসের পাতায় নয়, বরং রাষ্ট্রের ভ্রান্ত স্মৃতিতে আড়াল হয়ে রয়েছে। অথচ স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ যে ভেঙে না পড়ে দাঁড়িয়েছিল, তা অনেকটাই সম্ভব হয়েছিল এই মানুষের ধৈর্য, প্রজ্ঞা, সততা ও আত্মত্যাগের কারণে।

তাজউদ্দীন আহমদকে বোঝার জন্য তাঁর রাজনৈতিক জীবনের ঘটনাপ্রবাহ যতটা গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ তাঁর চারিত্রিক কাঠামো। তিনি ছিলেন সততার প্রতিমূর্তি, আত্মমর্যাদায় অচঞ্চল এবং নেতৃত্বে ছিলেন অসাধারণ বুদ্ধিদীপ্ত ও দূরদর্শী। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তিনি পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রেখে যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন, রাষ্ট্র গঠনের রূপরেখা তৈরি করেছিলেন, প্রবাসী সরকারের স্থপতি ও বাস্তবায়ক ছিলেন এবং সবচেয়ে বড় কথা, তিনি নিজেকে কখনো রাষ্ট্রের ওপরে দাঁড় করাননি। এসব গুণ আজকের রাজনীতিতে প্রায় অবলুপ্ত।

গত শতকের ৪০/৫০-এর দশকে যখন বঙ্গভঙ্গ, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা ও ভাষা আন্দোলনের উত্তাল সময় চলছিল, তাজউদ্দীন আহমদের রাজনৈতিক মানস গঠনের সেটাই সময়কাল। ঢাকা কলেজে পড়াকালে ছাত্ররাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন। মুসলিম ছাত্রলীগের মাধ্যমে তাঁর সক্রিয়তা শুরু হয়, কিন্তু দ্রুতই তিনি তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট করেন—ধর্মের ভিত্তিতে নয়, বরং বাঙালি জাতিসত্তার ভিত্তিতে রাজনীতি করতে হবে। তিনি সশরীরে যুক্ত হন আওয়ামী মুসলিম লীগের কার্যক্রমে। পরে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দ বাদ দিয়ে অসাম্প্রদায়িক রূপ দেওয়ার পেছনেও তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।

তাজউদ্দীন আহমদ ষাটের দশকে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে পরিচিত হলেও তাঁদের সম্পর্ক শুধু রাজনৈতিক ছিল না; বরং ছিল হৃদয়ের সম্পর্ক, আদর্শের সম্পর্ক। বঙ্গবন্ধু ছিলেন গণজোয়ার সৃষ্টিকারী নেতা, জনতার হৃদয় জয় করা নেতা; তাজউদ্দীন ছিলেন শৃঙ্খলার প্রতীক, কৌশলের রূপকার ও নীরব সংগঠক। ছয় দফা আন্দোলনের সময় বঙ্গবন্ধু কারাগারে ছিলেন, তখন তাজউদ্দীনই ছিলেন কার্যত দলের কান্ডারি। ১৯৬৬ থেকে ১৯৭১—এই পাঁচ বছর আওয়ামী লীগের ভেতরে যে বিপুল সাংগঠনিক প্রস্তুতি, নীতিনির্ধারণ ও রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণ হয়েছে, তার অন্যতম পরিকল্পক ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। জাতির ভাগ্যনির্ধারক সেই সময়ের প্রতিটি সভা, পলিসি পেপার, রোডম্যাপ এবং বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে যোগাযোগে তিনি ছিলেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। অথচ প্রচারের আলোতে কখনো আসেননি।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে বঙ্গবন্ধু যখন গ্রেপ্তার হলেন এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনী দেশের বুকে অপারেশন সার্চলাইট চালিয়ে গণহত্যা শুরু করল, তখন গোটা দেশ বিপর্যস্ত। ২৬ মার্চ সকালে তাজউদ্দীন হেঁটে সীমান্তের উদ্দেশে রওনা হন। পথে পথে মিলিটারি পোস্ট, বাংকার, শত্রুপ্রহরী; কিন্তু তাজউদ্দীন অনড়। তিনি জানতেন, এ মুহূর্তে দেশের বাইরে একটি কার্যকর রাজনৈতিক কেন্দ্র না গড়লে মুক্তিযুদ্ধ ব্যর্থ হয়ে যাবে। তাঁর মেধা, দৃষ্টিভঙ্গি ও সিদ্ধান্তের ক্ষমতা তখনই প্রথম জাতীয়ভাবে সত্যিকার মূল্য লাভ করে। কলকাতায় পৌঁছে তিনি ভারত সরকারের সঙ্গে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক করেন, সহযোগিতা নেন এবং আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে সংহত করে যুদ্ধের প্রথম সামরিক কাঠামো দাঁড় করান।

এত বড় একটি যুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো কোনো প্রতিষ্ঠান, বাজেট বা পরিকল্পনা ছিল না। কেবল ছিল একটি প্রজ্বলিত আত্মা—তাজউদ্দীন আহমদ। তিনি বঙ্গবন্ধুর পক্ষে দায়িত্ব নিয়ে ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠন করেন এবং ১৭ এপ্রিল তা শপথ নেয়। কলকাতার একটি অতিসাধারণ বাড়িতে ছিল বাংলাদেশের ‘প্রধানমন্ত্রী’র কার্যালয়। সেখান থেকেই যুদ্ধ পরিকল্পনা, আন্তর্জাতিক লবিং, প্রশাসনিক কাঠামো, রেডিও সম্প্রচার, কূটনৈতিক স্বীকৃতি অর্জনের জন্য বৈঠক—সবকিছু তিনি হাতে-কলমে পরিচালনা করেছেন।

অসাধারণ বিষয় হলো, মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি বারবার চেষ্টা করেছেন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই দেশ পরিচালিত হবে—এই নীতি বজায় রাখতে। অথচ তিনি নিজে নির্বিঘ্নে ‘প্রেসিডেন্ট’ বা ‘স্বাধীন বাংলাদেশের নেতা’ হতে পারতেন। কিন্তু তাজউদ্দীন সেই রাজনীতিক ছিলেন, যিনি ব্যক্তিগত চাওয়া না-চাওয়াকে জাতীয় প্রয়োজনের নিচে রাখতেন। এটা এমন এক চরিত্রের সাক্ষ্য দেয়, যা আজকের রাজনীতিতে দুর্লভ।

১৯৭২ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে এলে তাজউদ্দীন তাঁর সরকারকে বিলুপ্ত ঘোষণা করেন এবং বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আবার সরকার গঠন করা হয়। তিনি অর্থমন্ত্রী হন এবং দায়িত্ব নেন একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত রাষ্ট্রের ভিত্তি প্রতিষ্ঠার। মাত্র তিন বছরের মধ্যে একটিও বিদেশি ঋণ ছাড়া দুর্নীতিমুক্ত অর্থনৈতিক কাঠামো দাঁড় করান। কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পল্লি উন্নয়নসহ সবখানে পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের যেসব সূচনা হয়েছিল, তা প্রধানত ছিল তাঁরই কর্মফল। তিনি পরিকল্পনা কমিশনকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত রেখেছিলেন, দেশের বাজেট প্রণয়ন করেছিলেন এক অভূতপূর্ব স্বচ্ছতায়। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ ছিল তাঁর রাজনৈতিক বিপর্যয়ের সূচনা; যদিও তাঁর নীতির ব্যর্থতা নয়, বরং প্রাকৃতিক ও প্রশাসনিক জটিলতা এবং কিছু আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র এতে ভূমিকা রেখেছিল।

তবে এর পর থেকে তাঁর রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা শুরু হয়। ১৯৭৪ সালের শেষ দিকে তিনি মন্ত্রিত্ব থেকে সরে দাঁড়ান। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর একদলীয় শাসনব্যবস্থা ‘বাকশাল’ চালুর পর তিনি কার্যত নীরব হয়ে যান। বাকশাল গঠনের সমালোচক না হলেও দলের গণতান্ত্রিক চেতনার বিচ্যুতি তাঁকে আঘাত করেছিল। বঙ্গবন্ধু তাঁর ওপর খুশি ছিলেন না, দূরত্ব তৈরি হয়, ভুল-বোঝাবুঝি বাড়ে। কিন্তু ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের পর ইতিহাস নির্মমভাবে সেই দূরত্বের মূল্য দেয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার কয়েক দিন পর তাঁকেও গ্রেপ্তার করা হয়। আর ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে তাঁর রক্তাক্ত দেহ পড়ে থাকল। অন্যদের সঙ্গে তিনিও শহীদ হলেন—এ যেন দ্বিতীয়বার দেশ হারাল তাঁকে।

তাঁর মৃত্যু শুধু একজন নেতার মৃত্যু ছিল না, বরং একটি সম্ভাব্য রাষ্ট্রনৈতিক বিকল্পধারার মৃত্যু। তিনি যদি জীবিত থাকতেন, হয়তো বাংলাদেশের প্রথম দশক হতো অনেক স্থিতিশীল, অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী ও রাজনৈতিকভাবে ভারসাম্যপূর্ণ। তিনি ছিলেন এমন এক রাষ্ট্রনায়ক, যিনি নীতির প্রশ্নে কখনো আপস করেননি, কিন্তু নিজের ভূমিকা কখনো জাহিরও করেননি। এই আত্মনিমগ্নতা, আত্মত্যাগ ও নেতৃত্বের নৈতিক উচ্চতা—তাঁকে ইতিহাসের এক অনন্য চরিত্রে পরিণত করেছে।

আজ তাঁর জন্মশতবর্ষে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নেই কোনো আনুষ্ঠানিকতা। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতেও তাঁকে নিয়ে ছিল না কোনো উচ্ছ্বাস-আয়োজন। শুধু বঙ্গবন্ধুর ওপর আলো ফেলতে গিয়ে ইতিহাসে আমরা যে কালো অধ্যায় সংযোজন করেছি, তার খেসারতই কি আজ দিতে হচ্ছে না?

আজ মুক্তিযুদ্ধের ধারায় বিশ্বাসীদের জন্য সময় খারাপ। অতীতকে অস্বীকার করার, ইতিহাসকে বিকৃত করার অপচেষ্টা করা হচ্ছে উন্মাদের উন্মাদনায়। কিন্তু এই ধারা স্থায়ী হবে না। ইতিহাস বদলের কিংবা দখলের চেষ্টা হয়, কিন্তু তা সফল হয় না। ইতিহাসে কার জায়গা হবে, আর কে ফুটনোটেও স্থান পাবে না, সেটা শেষ পর্যন্ত ইতিহাসই ঠিক করে। তাজউদ্দীন অবশ্যই স্মরিত ও বরিত হবেন। তাঁর রাজনৈতিক নীতির চর্চা ও তাঁর নীরব নেতৃত্বের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এখন যে কার্পণ্য, সেটাও থাকবে না। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে যেসব নায়কের নাম লেখা থাকবে, তাঁদের কাতারে তাজউদ্দীন আহমদ থাকবেন এক ব্যতিক্রমী উজ্জ্বলতার প্রতীক হয়ে। তাঁর অবদান এখন উচ্চারণহীন থাকলেও একসময় আলোকচ্ছটা হয়ে বিরাজ করবেই।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

জমকালো দোতলা বাড়িতে দূতাবাস, সামনে সারি সারি কূটনৈতিক গাড়ি—৭ বছর পর জানা গেল ভুয়া

অবশেষে রাজি ভারত, ‘জিতেছে বাংলাদেশ’

বেনজীরের এক ফ্ল্যাটেই ১৯ ফ্রিজ, আরও বিপুল ব্যবহার সামগ্রী উঠছে নিলামে

ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতাকে শুভেচ্ছা জানাতে বিমানবন্দরে পলাতক আসামি

বাংলাদেশ ব্যাংকে নারীদের শর্ট স্লিভ ড্রেস ও লেগিংস নিষেধ, পরতে হবে ‘শালীন’ পোশাক-হিজাব

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত