Ajker Patrika

পঞ্চান্নয় পাহাড় জয়

রজত কান্তি রায়, ঢাকা
আপডেট : ০৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ১১: ৪৫
পঞ্চান্নয় পাহাড় জয়

নারীর বয়স আর পুরুষের বেতন— এ দুই তথ্য নাকি জিজ্ঞেস করতে নেই। প্রবাদে থাকলেও বাঙালি অবশ্য সেটা বিশ্বাস করে না বলে যেখানে-সেখানে বয়স আর বেতনের কথা জিজ্ঞেস করে বিব্রত করে ফেলে। কিন্তু ফওজিয়া তৌহিদ বয়সটাকেই জয় করতে চেয়েছেন। সে জন্য বয়স জানানো নিয়ে তাঁর কোনো ছুতমার্গ নেই। জানালেন, তাঁর বয়স ৫৪ প্লাস। কিন্তু ৫৫ এখনো হয়নি। আর হলেই বা কী? আগামী বছর তিনি উঠতে চান এভারেস্টের চূড়ায়!

পরিবারসহ একবার নেপাল গিয়েছিলেন ঘুরতে। খুব অল্প সময়ের জন্য দেখেছিলেন, ফিশ টেইল তথা মাচুপুচুর ধবধবে সাদা শরীরে ভোরের সূর্যকণা আগুন লাগিয়ে দিয়েছে! তারপরই একরাশ কুয়াশা এসে ঢেকে দিয়েছিল মাচুপুচু, ফলে আক্ষেপ থেকে গিয়েছিল। তখনই মনে মনে সংকল্প করেছিলেন, আবার ফিরবেন। দেখতে তো বটেই, জয় করতেও। তারপর খোঁজখবর শুরু করেন, দেশে কোন কোন প্রতিষ্ঠান পর্যটকদের পাহাড়ে নিয়ে যায়। পেয়ে যান রোপ ফোর নামের প্রতিষ্ঠানটিকে। সেখানেই চলে প্রাথমিক ট্রেনিং, পাহাড়ে ওঠার। তারপর সুযোগ-সময়মতো দলেবলে তিনি গিয়েছিলেন অন্নপূর্ণা বেসক্যাম্পে। যেতে যেতে ট্রেকিং করেছেন বেশ দুর্গম পথে।

কিন্তু পাহাড় কেন? পাহাড় খুব রহস্যময়। রহস্য-রোমাঞ্চের ডাক এড়ানো তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। ফওজিয়া তৌহিদের কখনো প্রচলিত ও সাধারণ কাজ ভালো লাগেনি। ছোটবেলায় তিনি স্নাইপার হতে চেয়েছিলেন। ভালোবাসেন সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী বিষয়—শার্প শুটিং ও আর্চারি, ফটোগ্রাফি আর বাগান করা। পছন্দের বিষয় ফ্যাশন ডিজাইন ও ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন। এখন শিখছেন মার্শাল আর্ট। তবে কি তিনি অসাধারণ হতে চেয়েছিলেন? তা-ও নয়। তিনি জানালেন, জীবন তাঁর কাছে উদ্‌যাপনের বিষয়। যখনই সুযোগ পান, কোনো না কোনো ছুতোয় তাকে আনন্দময় করে তোলেন ফওজিয়া।

অন্নপূর্ণা বেসক্যাম্পে ফওজিয়া তৌহিদ।	ছবি: সংগৃহীত

সরকারি চাকুরে বাবা ফরিদুল আলম আর স্কুলশিক্ষক মা চৌধুরী খালিদা ফরিদের ঘরে জন্মেছিলেন জামালপুরে। তারপর বাবার চাকরির সূত্রে ঢাকায় আসেন। কিন্তু বেড়ে উঠেছিলেন ময়মনসিংহে। পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্য বিষয়ে। পড়তে পড়তেই নেভাল অফিসার মো. তৌহিদুল ইসলামের সঙ্গে বিয়ে হয় মাত্র ১৯ বছর বয়সে, ১৯৮৯ সালে। তারপর সংসার, পড়াশোনা, সন্তান, চাকরি সামলে নিজের শখ আর পছন্দের কাজগুলো করার সময় হয়নি। তাই প্রায় ৫৫ বছর বয়সে এসে যখন দেখলেন, সন্তানেরা বড় হয়ে গেছে, চাকরিতে বেশ ভালো অবস্থায় আছেন, ভাবলেন, বয়স যা-ই হোক, জীবন উদ্‌যাপনের সময় এসেছে। দুই সন্তান অদ্রিকা এষণা পূর্বাশা ও নুমায়ের আরসালান। দুজনই প্রকৌশলী। তাঁদের খুলে বললেন নিজের ইচ্ছার কথা। তাঁরা উৎসাহ জোগালেন। ব্যস, আর পায় কে! একে একে নিজের ভালো লাগার কাজগুলো করতে শুরু করলেন ফওজিয়া। তিনি মনে করেন, মেয়েদের অবজেক্ট ভাবা যাবে না। এত বাধানিষেধ শুনে তারা বড় হয়, একপর্যায়ে জীবনের প্রতি আর তেমন মায়া থাকে না। নারীরা যে শুধু কারও মেয়ে, বোন, স্ত্রী বা কারও মা নয়, তারা যে নিজেরাই একটা সত্তা, তাদেরও যে নিজস্ব স্বপ্ন থাকে, সাধ-আহ্লাদ থাকে, সেটা ভুলে গেলে চলবে না। যেভাবেই হোক না কেন, জীবনের এই বাধাটা অতিক্রম করতে হবে। সেটা অতিক্রমের জন্য অন্নপূর্ণা কেন, এভারেস্টেও চড়া যায়।

সময় যত বাড়তে থাকে, আমাদের কথা বিভিন্ন ট্রেইলে ছুটতে শুরু করে। জীবনের বিপুল অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করে নেন ফওজিয়া। এর বড় অংশ নিয়ে থাকে ভ্রমণ, ট্রেকিং আর জীবনের আনন্দঘন মুহূর্তগুলো। ফওজিয়া কখনো বিহ্বল হয়ে পড়েন হিমালয়ের সৌন্দর্যের কথা বলতে গিয়ে, কখনো কিছুটা আবেগতাড়িত। ফিশ টেইলের ওপর সূর্যের আলো পড়ে তৈরি হওয়া যে অপার্থিব সৌন্দর্যের বিচ্চুরণ তিনি দেখেছেন, পাথুরে পথে হাঁটতে হাঁটতে পায়ের ব্যথা ভুলে যাওয়ার যে অভিজ্ঞতা তিনি অর্জন করেছেন, তার বর্ণনা দিতে গিয়ে খানিক বিহ্বলতা আসা স্বাভাবিক।

অন্নপূর্ণা বেসক্যাম্প জয়ের পর ফওজিয়া তৌহিদের লক্ষ্য এখন এভারেস্ট বেসক্যাম্প। 	ছবি: সংগৃহীত

জানতে চাইলাম, শরীর কি পুরোপুরি ঠিক ছিল? চিকিৎসকেরা নিষেধ করেননি? ফওজিয়া হাসলেন। বললেন, তাঁদের বলেছিলেন, তিনি পাহাড়ে যাচ্ছেন। চিকিৎসকেরাও তাঁকে উৎসাহ দিয়েছিলেন। তারপর প্রায় ছয় মাসের প্রাথমিক ট্রেনিং নেন রোপ ফোর থেকে। তাঁদের সঙ্গেই গেছেন অন্নপূর্ণা বেসক্যাম্পে।

ফওজিয়া তৌহিদ। ছবি: সংগৃহীত

‘ইমপসিবল মানে হলো আই অ্যাম পসিবল। আমার মনে হয়েছে যাব, গিয়েছি। সাত দিনের ক্যাম্পে সেই সকাল থেকে শুরু করে সন্ধ্যা পর্যন্ত হাঁটতে হয়েছে। সেটা খুব সহজ কিছু ছিল না।’ সেই কঠিন বিষয়টাই জয় করেছেন ফওজিয়া তৌহিদ, যার পরের লক্ষ্য এভারেস্ট বেসক্যাম্পে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত