Ajker Patrika

পাহাড় জলপ্রপাতের রাজ্যে

ইশতিয়াক হাসান, ঢাকা
পাহাড় জলপ্রপাতের রাজ্যে

ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত ভারতীয় লেখক রাস্কিন বন্ডকে পছন্দ তাঁর অরণ্যবিষয়ক গল্প ও লেখার জন্য। শুনেছিলাম, পরিবারসমেত থাকেন পাহাড়ি শহর মুসৌরিতে।

শহরটির প্রতি আগ্রহের জন্ম সেই সূত্রে। পরে ঘাঁটাঘাঁটি করে জানলাম, ভারতের হিল স্টেশনগুলোর অন্যতম মুসৌরি। আসতে হয় উত্তরাখন্ডের রাজধানী দেরাদুন থেকে। দেরাদুনকে বলা যায় হিমালয়ের প্রবেশদ্বার। ওখান থেকে জিম করবেটের নৈনিতাল, জিম করবেট ন্যাশনাল পার্ক, কেদারনাথসহ হিমালয় রাজ্যের নানা অন্ধিসন্ধিতে ঢুঁ মারা যায় অনায়াসে। সেই সূত্রেই দেরাদুন ও মুসৌরি বা মুসুরি যাওয়া। তবে আরও এগোনোর আগে বলে রাখছি, গল্পটা একবারে টাটকা নয়, সময়টা ছিল শীতকাল। আশা করি, এই চৈত্রের গরমে শীতের লেখাটি পড়তে খুব একটা খারাপ লাগবে না।

সেই ভ্রমণে আমার সঙ্গী-সাথি ছিলেন পরিবারের সদস্যরা। কলকাতা থেকে প্লেনে দিল্লিতে ট্রানজিট নিয়ে এসেছি দেরাদুনে। দিল্লি থেকে দেরাদুন আসার পথে একটা কাণ্ড হয়। যখন ভাবছি উড়োজাহাজটা ল্যান্ড করবে, ঘোষণাও এসেছে বেশ কতকটা আগে, তখন হঠাৎ ওপরে উঠতে শুরু করল—উঠছে তো উঠছেই। আর আমি আশ্চর্য হয়ে দেখছি হিমালয়ের শাখা-প্রশাখা, নিচের পাহাড় আর গভীর বনানী। একটু টেনশনও কাজ করছে মনে। কারণ, বিমানটা প্রচণ্ড কাঁপছে। একপর্যায়ে উড়োজাহাজ এবং চারপাশের সবকিছু ঢেকে দিল অদ্ভুত মেঘেরা। কাঁপুনি আরও বেড়েছে বিমানের। মুখ ফ্যাকাশে যাত্রীদের। তারপরই একটু একটু করে নামতে শুরু করল। ধৈর্য ধরে আরও কিছুটা অপেক্ষার পর দৃষ্টিগোচর হলো সবুজের মাঝে বাড়িঘর...।

দেরাদুন এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলের দিকে পাহাড়ের পাশ দিয়ে যাওয়ার পথটা বেশ লম্বা ছিল। বেশ ভালো লেগেছিল দুপাশের দৃশ্য। মুসৌরি যাওয়ার জন্য ৯ সিটের এক জিপ ভাড়া করেছিলাম আমরা। চালক হাসিখুশি পঞ্চান্ন-ষাটের মাঝামাঝিতে পৌঁছানো এক লোক। দেরাদুন পৌঁছে পরের দিন সকালে গাড়ির জানালা খুলে হালকা রোদ খেতে খেতে রওনা দিলাম। যাত্রা শুরুর মিনিট পনেরোর মাথায় চালক নাশতা করার জন্য গাড়ি দাঁড় করালেন রাস্তার ধারে। বেশ কয়েকটি রেস্তোরাঁর সামনে এক চত্বরে খাবারের ব্যবস্থা। ওখানে বসে দূরের পাহাড় সারি দেখতে দেখতে আলু-পরোটা, ডিম-পরোটার সঙ্গে মাখন দিয়ে নাশতাটা হলো দুর্দান্ত।

দেরাদুন থেকে পাহাড়ি শহরটির দূরত্ব ৩৫ কিলোমিটার। পাহাড়ি রাস্তা, তাই সময়টা স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি লাগে, সোয়া ঘণ্টা। ঠিক হয়েছে আমরা আগে যাব মুসৌরি লেকে, সেখান থেকে মুসৌরি শহরকে পাশ কাটিয়ে কেম্পটি ফলস বা জলপ্রপাতে। তারপর ফিরে আসব মুসৌরিতে।

একসময় চলে এলাম মুসৌরি লেকের ধারে। জিপ রেখে গাছপালার মাঝখান দিয়ে বেশ কতকটা পথ পেরিয়েই পৌঁছে গেলাম লেকটার কিনারে। শানবাঁধানো কৃত্রিম লেক আমাকে ঠিক টানল না। তবে লেকের পাশ কাটিয়ে পাহাড় বেয়ে একটু ওপরে আধা সমতল একটা জমিতে আসতেই চোখ জুড়িয়ে গেল। দূরে দুন উপত্যকা, বিস্তৃত পাহাড়রাজ্য চলে এসেছে চোখের সামনে। কিছুক্ষণ পর আমরা পাহাড়ি পথে হেঁটে উঠে এলাম রাস্তায়। এবার যাব কেম্পটি জলপ্রপাত দেখতে। মুসৌরি থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে।

কেম্পটি জলপ্রপাতরাস্তার ধারে গাড়ি দাঁড় করিয়ে ভিউ পয়েন্টে দাঁড়াতেই চোখ চলে গেল হিমালয়ের তুষার ঢাকা কয়েকটি চূড়ার দিকে। এরপরে যাওয়ার ও ফেরার পথে এগুলো দর্শন দিয়েছে একটু পরপরই।  

আরও কিছুটা পথ পাড়ি দেওয়ার পর পাকা সড়কের এক পাশে পড়ল পাহাড় অন্য পাশে বাজার। ওখান থেকে অনেকটা নিচে যেতে হবে কেম্পটি ফলসের দর্শন পেতে। সিঁড়িপথে নিচে নামার আগেই বানরের দল অভিবাদন জানাল। ভ্রমণকারীদের কাছে ভারি প্রিয় এই জলপ্রপাত। শুনেছি, বছরে নাকি ১০ লাখ মানুষ আসেন এর দর্শনে। কেম্পটি নামটা নাকি এসেছে ‌ক্যাম্প-টি থেকে, ভারি মজার না!

জলপ্রপাতের কাছে পৌঁছার আগেই পেয়ে গেলাম একটা রোপওয়ে। খুব ভিড় ছিল না। আমরা ভাগাভাগি করে দুই বগিতে উঠে পড়লাম। তারপর নিচে নেমে হেঁটে চলে এলাম জলপ্রপাতের সামনে। পাহাড়ের ওপর থেকে নেমেছে একটা নয়, আসলে দুটো ধারা। শীতেও পানি পতনের বহর দেখে ভাবলাম, বর্ষায় কী অবস্থা হয় কে জানে! অনবরত পানি পতনে নিচে ছোট্ট এক লেকের জন্ম হয়েছে। ওখানে ছোট্ট ছোট্ট জিনিস দুটো কী! আরে, এরা তো দুজন মানুষ! ওই মানুষ দুজন বরফশীতল জলে সাঁতরে বেড়াচ্ছে কীভাবে—ভেবেই গা কাঁটা দিয়ে উঠল।

ছোট্ট আরেকটা ঝরনা দেখে ওখান থেকে চলে আসি মুসৌরি শহরে। পেটে তখন ছুঁচোরা লাফালাফি জুড়ে দিয়েছে। দার্জিলিংয়ের মতো এখানেও ম্যাল বা চৌরাস্তা আছে। ম্যালের পাশের এক রেস্তোরাঁয় বসে মোমো খেলাম। ম্যালের কিনারের ছাতা দেওয়া ছোট ব্যালকনিগুলোতে দাঁড়িয়ে দূরের পাহাড় দেখলাম। ততক্ষণে শীতল হাওয়া বইতে শুরু করেছে। শীতে এখানে রাতের তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে চলে যায়। আমাদের সঙ্গে শিশুদের কথা ভেবে আমরা সেখানে রাত না কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। ইরফান চাচা তাড়া দিলেন, দেরি হলে অন্ধকারে, কুয়াশার মধ্যে গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়ার আশঙ্কা। অতএব বিদায় দিতে হলো হিল স্টেশন মুসৌরিকে। 

কীভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে ফ্লাইটে দিল্লি। সেখান থেকে দেরাদুন। আবার কলকাতা হয়ে দিল্লি ট্রানজিট নিয়েও দেরাদুন যাওয়া যায়। দেরাদুনে মোটামুটি মানের হোটেলে ডাবল বেডের রুম পেয়ে যাবেন এক-দেড় হাজার রুপিতে। সারা দিনের জন্য জিপ ভাড়া চার থেকে পাঁচ হাজার রুপি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত