Ajker Patrika

ম্যানহাটনের পুরোনো বাড়িটি

জাহীদ রেজা নূর, ঢাকা
ম্যানহাটনের পুরোনো বাড়িটি

‘বাবা, শোনো। এবার ম্যানহাটনের সবচেয়ে পুরোনো বাড়ি ঘুরে এসেছি। দারুণ!’

মেসেঞ্জারে কথা হচ্ছিল শৌনকের সঙ্গে। নিউইয়র্কের হান্টার কলেজে পড়ছে ও। নিউইয়র্কের হালকা ঠান্ডা থেকে যখন গরমে তপ্ত ঢাকায় ওর রোমাঞ্চে ভরা স্বর ভেসে এল, তখন আমিও ততোধিক রোমাঞ্চিত। আমি তখন কয়েক দিনের জন্য নিউইয়র্ক সফরের অপেক্ষায় দিন গুনছি।

আমার শুধু বলার ছিল, ‘আমি আসছি কিছুদিন পরে। বাড়িটি দেখতে যাব।’

ম্যানহাটন মানে তো শুধু টাইমস স্কয়ার নয়, আরও অনেক কিছু। সেই ‘অনেক কিছুর’ সন্ধানে যাওয়ার জন্য প্লেনটা শুধু নিউইয়র্কের জেএফকে এয়ারপোর্টের ৮ নম্বর টার্মিনালে নামার অপেক্ষা। জেটল্যাগকে পিছু হটিয়ে ম্যানহাটনের প্রাচীন বাড়িটির কাছে যাওয়ার জন্য মন ঢিপঢিপ করছিল।

ক্লাস ছিল বলে শৌনক সঙ্গী হয় না। সনকা সঙ্গে যায়। ও-ই হয়ে ওঠে গাইড। শুধু সতর্ক করে দেয় আমাকে, ‘বাবা, নিউইয়র্কে ম্যাপ দেখে যেকোনো জায়গায় অনায়াসে চলে যাওয়া যায়। তাই আতঙ্কিত হয়ো না। হারিয়েও যাবে না কোথাও।’ মেয়ের কথা ধ্রুব সত্য মেনে ওর পেছন পেছন রওনা হই। এরই মধ্যে অনলাইনে যে বাড়িটিতে ঢোকার জন্য টিকিট কেনা হয়, এর নাম ‘মরিস-জুমেল ম্যানশন’।

সাবওয়ের গুহা থেকে আমরা যখন ম্যানহাটনের উত্তর দিকটায় পৌঁছাই, তখন রোদ ঝলমলে শহর। মোবাইল ফোনে থাকা ম্যাপের মেয়েটা বলছে, ‘রাস্তাটা পার হন। তারপর ডানদিক ধরে হাঁটতে থাকুন তিন মিনিট।’ আমরা দুজন যখন একটু একটু করে বাড়িটার কাছে পৌঁছাতে শুরু করি, তখন বুঝতে পারি, কোনো ছোট কুঁড়েঘর নিয়ে কথা হচ্ছে না। এ এক বিশাল প্রাসাদ! রাস্তাটা ততক্ষণে একটু একটু করে উঁচু হয়েছে। ম্যানহাটনের সবচেয়ে উঁচু জায়গাগুলোর একটিতে এই মরিস-জুমেল ম্যানশন। এখান থেকে একসময় হারলেম, হাডসন নদী, স্ট্যাটেন আইল্যান্ড, নিউ জার্সি হয়ে উঠত দৃশ্যমান।

টিকে থাকা বাড়ির মধ্যে ম্যানহাটনে এটাই সবচেয়ে পুরোনো। বাইরে থেকে দরজাটা বন্ধ। দোরঘণ্টি বাজালে বেরিয়ে আসেন নারী গাইড। ফিসফিস করে বলেন, ‘আরও দুজন এসেছেন এইমাত্র। আসুন, সবাইকে একসঙ্গে শোনাই বাড়িটির গল্প।’

এ বাড়িটি তৈরি করা হয়েছিল আনুমানিক ১৭৬৫ সালে—ব্রিটিশ কর্নেল রজার মরিস, তাঁর স্ত্রী মেরি ফিলিপস মরিস আর তাঁদের সন্তানদের জন্য গ্রীষ্মাবকাশের মহল হিসেবে। ক্রীতদাস, স্বাধীন দাসদের পরিশ্রম দিয়েই গড়ে উঠেছে এর দেয়ালগুলো। মেরি ছিলেন অ্যাংলো-হলান্ডীয় বংশের উত্তরাধিকারী। তাই সে সময়ের সেরা স্থাপত্যের ঝলক দেখা যায় বাড়ি নির্মাণে। আর টাকার জোরে তাঁরা কিনে ফেলেন ১০০ একরের বেশি জমি। সে সময় নিউইয়র্ক শহরটি ছিল এখনকার চেম্বার্স স্ট্রিট পর্যন্ত ছড়ানো। আর এ বাড়িটি ছিল সেই চেম্বার্স স্ট্রিট থেকে ১১ কিলোমিটার উত্তরে। আপার ম্যানহাটনের তখন অন্য রূপ। কৃষিজমি, বিস্তীর্ণ জঙ্গল, তাজা বাতাস আর বিশুদ্ধ সুপেয় জল এলাকাটাকে করে রেখেছিল আকর্ষণীয়। ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য যে স্বাধীনতাসংগ্রাম শুরু করেছিল মার্কিন ১৩টি উপনিবেশ, তারা ১৭৭৬ সালের ২ জুন ইংল্যান্ডের শাসন থেকে বের হওয়ার জন্য আমেরিকার কন্টিনেন্টাল কংগ্রেসে ভোট দেয়। ৪ জুলাই তা অনুমোদন হয়। রজার মরিস এই ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ সময়ে চলে যান ব্রিটেনে। তাঁর পরিবার অবশ্য নিউইয়র্কে তাঁদের অন্য বাড়িতে থেকে যান।

১৯৭৬ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর জেনারেল জর্জ ওয়াশিংটন মরিসদের ফেলে যাওয়া এই বাড়িতে এসে আশ্রয় নেন। তখন ব্রুকলিনের যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিলেন তিনি। এ বাড়িটি হয়ে উঠেছিল ওয়াশিংটনের বাহিনীর আদর্শ হেডকোয়ার্টার। ১৬ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ বাহিনীর সঙ্গে কন্টিনেন্টাল বাহিনীর যুদ্ধে ওয়াশিংটনেরা জয়ী হন। প্রায় ৫ সপ্তাহ এই বাড়িতে ছিলেন ওয়াশিংটন। এই বাড়িতে একটি অষ্টোকৌনিক ঘর আছে, সেটাকেই নিজের অফিস হিসেবে ব্যবহার করতেন তিনি। সেই ঘরটি দেখার সময় সত্যিই রোমাঞ্চিত হয়েছি। সে সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে গড়ে ওঠা সুপরিসর রান্নাঘর দেখে অবাক হয়েছি।

সংক্ষেপে বললে বলতে হয়, মরিসদের পর ১৭৮০ থেকে ১৭৯০ সাল, এ সময় বাড়িটি পরিণত হয়েছিল একটি সরাইখানায়। নব্বই সালে জর্জ ওয়াশিংটন একবার ফিরেছিলেন এই বাড়িতে, তখন তাঁর সঙ্গে ছিলেন টমাস জেফারসন, জন অ্যাডামস, অ্যাবিগেইল অ্যাডামস, আলেক্সান্ডার হ্যামিলটন প্রমুখ। দারুণ খানাপিনার আয়োজন ছিল সেদিন সেখানে।

এরপর জুমেলরা নিয়েছিলেন এই বাড়ির দায়িত্ব। স্টিফেন জুমেল আর তাঁর স্ত্রী এলিজা বাওয়েন দায়িত্ব নিয়ে বাড়িটির অনেক দৃষ্টিনন্দন সংস্কার করেছিলেন। ১৮১০ থেকে ১৮৬৫ সাল পর্যন্ত বাড়িটিকে আরও নান্দনিক করে গড়ে তুলেছিলেন তাঁরা। জুমেলরা একটা সময় ফ্রান্সে ছিলেন। সে সময় নেপোলিয়ন এবং তাঁর অনুসারীদের সঙ্গে একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তাঁদের। ওয়াটারলু যুদ্ধে পরাজিত হলে জুমেল পরিবার নেপোলিয়নকে নিউইয়র্কে আতিথ্য গ্রহণের কথা বলেছিলেন। নেপোলিয়ন তাতে রাজি না হলেও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বেশ কিছু দামি সামগ্রী পাঠিয়েছিলেন এই পরিবারের কাছে।

এর মধ্যে অলংকৃত চেয়ার আর খাটও ছিল। এখনো তার দেখা পাওয়া যাবে এই মিউজিয়ামে এলে। মিউজিয়ামের কথা বলছি কেন? তাহলে কি জুমেলরাও এই বাড়ির মালিকানা ধরে রাখতে পারেননি? একদম তাই। ১৮৬৫ থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত এ বাড়িটি বিভিন্ন জনের হাতে ঘোরে। এরপর ১৯০০ সাল থেকে এটাকে জাদুঘর করা হয়। ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে এই বাড়ির কাছাকাছি যাঁরা থাকতেন, তাঁদের মধ্যে একজন হলেন পল রোবসন। ভূপেন হাজারিকার কণ্ঠে ‘বিস্তীর্ণ দুপারের অসংখ্য মানুষের’ গানটি শুনলেই যাঁর কথা মনে পড়ে।
বাড়িটি ম্যানহাটনের অতীত ইতিহাসের কাছে নিয়ে যায়। কল্পনায় নতুন গড়ে ওঠা যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে আসে। বাড়িটি থেকে বের হলে সেই তো দ্রুত ধাবমান যান্ত্রিক জীবনের ঘেরাটোপ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত