Ajker Patrika

পুরোনো জ্ঞানেই লুকিয়ে আছে আধুনিক রান্না ও খাবারদাবারের রহস্য

ফিচার ডেস্ক, ঢাকা 
আপডেট : ১০ আগস্ট ২০২৫, ২২: ১৫
রান্না ও খাওয়ার জ্ঞান প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়ে। এ বিষয়ে আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের জ্ঞানের অংশীদার। ছবি: এআই দিয়ে তৈরি
রান্না ও খাওয়ার জ্ঞান প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়ে। এ বিষয়ে আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের জ্ঞানের অংশীদার। ছবি: এআই দিয়ে তৈরি

রান্নার কিছু টিপস যুগের পর যুগ চলছে তো চলছেই। হয়তো কেউ সেগুলো শিখেছিলেন দাদির কাছে, কেউ নানি কিংবা মায়ের কাছে। তাঁরাও সেগুলো শিখেছিলেন দাদি-নানি কিংবা মায়ের কাছে। তাঁদের কাছ থেকে সেগুলো যাচ্ছে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে। আমাদের রান্নার দুনিয়ায় এগুলো পর্দার আড়ালে ঘটে চলা বিষয়। এসব পরম্পরাগত জ্ঞান বা টিপসের মধ্যে লুকিয়ে আছে আধুনিক রান্নার রহস্য। এগুলো সাহায্য করে খাবারের অপচয় এড়িয়ে চলতে, কিংবা স্বল্প খরচে অনেকজনকে খাওয়ানোর মতো বিষয়গুলোকেও।

কী আছে সেসব পরম্পরাগত জ্ঞানে, যেগুলো আমরা এখনো মেনে চলি?

কাঠের চামচ ব্যবহার

ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকদের মাধ্যমে কাঠের চামচের ব্যবহার ছড়িয়ে পড়ে এশিয়া, আফ্রিকা ও আমেরিকায়। ছবি: পেক্সেলস
ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকদের মাধ্যমে কাঠের চামচের ব্যবহার ছড়িয়ে পড়ে এশিয়া, আফ্রিকা ও আমেরিকায়। ছবি: পেক্সেলস

রান্নায় কাঠের চামচের ব্যবহার নতুন কোনো ঘটনা নয়। এর ইতিহাস বহু পুরোনো। ‘চামচ’ শব্দটি এসেছে একটি প্রাচীন শব্দ থেকে, যার অর্থ কাঠের টুকরা বা শিংয়ের অংশ থেকে খোদাই করা যন্ত্র। মিসরীয় সভ্যতায় কাঠ, হাতির দাঁত ও পাথর দিয়ে তৈরি হাতলযুক্ত চামচের ব্যবহার দেখা যায়। প্রাচীন গ্রিক ও রোমান যুগেও কাঠের তৈরি রান্নার যন্ত্রপাতির উল্লেখ পাওয়া যায়। তখন ধাতব চামচ ছিল অভিজাতদের জন্য সংরক্ষিত। ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকদের মাধ্যমে কাঠের চামচের ব্যবহার ছড়িয়ে পড়ে এশিয়া, আফ্রিকা ও আমেরিকায়। বিশ শতকে ধাতু, প্লাস্টিক ও সিলিকনের তৈরি চামচ আসার পর কাঠের চামচ কিছুটা পেছনে পড়ে যায়। তবে এখন টেকসই ও পরিবেশবান্ধব উপকরণ হিসেবে কাঠের চামচ আবার জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এটি ব্যবহারের অন্যতম কারণ হলো, এটি ধাতব চামচের তুলনায় বাসনের ক্ষতি কম করে। এ ছাড়া অ্যাসিডিক খাবারের সঙ্গে প্রতিক্রিয়া করে না এবং বহু বছর টিকে থাকে।

আবার ফিরে এসেছে কাঠের চামচের ব্যবহার। এটি যখনই ব্যবহার করবেন, ভাববেন, সেই সুদূর অতীতে আমাদের কোনো পূর্বপুরুষ এটি উদ্ভাবন করেছিলেন।

ফুটিয়ে খাওয়ার কিছু উপায়

প্রাচীন চীনে, ৩ থেকে ৪ হাজার বছর আগে চীনামাটির পাত্রে ধীরে ধীরে খাবার সেদ্ধ করার প্রচলন ছিল। ছবি: পেক্সেলস
প্রাচীন চীনে, ৩ থেকে ৪ হাজার বছর আগে চীনামাটির পাত্রে ধীরে ধীরে খাবার সেদ্ধ করার প্রচলন ছিল। ছবি: পেক্সেলস

রান্নার ক্ষেত্রে অনেকে ধনেপাতা কিংবা পুদিনাপাতার মতো মসলাজাতীয় উদ্ভিদ রান্না করেন না। এগুলো তাজা অবস্থায় রান্নার শেষে তরকারিতে বা খাবারে ছিটিয়ে দেওয়া হয়। রান্নার মধ্যে দিলে এগুলোর ঘ্রাণ হারিয়ে যায়। আবার স্যুপ, স্টু বা স্টক অনেক বেশি আগুনে সেদ্ধ করতে নিষেধ করা হয়। বলা হয়, এগুলো ধীরে ধীরে সেদ্ধ করে রান্না করতে হয়। এর অন্যতম কারণ হলো, বুদ্‌বুদ স্টুর স্বাদ নষ্ট করে এবং নিচে পুড়ে যেতে পারে। স্যুপ কিংবা সবজি রান্না করার আগে অনেকে শক্ত সবজিগুলো সেদ্ধ করে নেন। সে ক্ষেত্রে টিপস থাকে, সবজিগুলো যেন গলে না যায় এমনভাবে সেদ্ধ করতে হবে। এসব কেন করা হয়?

প্রাচীন চীনে, ৩ থেকে ৪ হাজার বছর আগে চীনামাটির পাত্রে ধীরে ধীরে খাবার সেদ্ধ করার প্রচলন ছিল। প্রাচীন ভারতে চর্চা হওয়া ‘আয়ুর্বেদে’ও ধীরে ধীরে সেদ্ধ করা খাবারের বিভিন্ন উপকারিতা বর্ণনা আছে। প্রাচীন নথি থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়, মিসরীয় সভ্যতায় বিভিন্ন জুস, দুধ ও মসলা একত্রে ফুটিয়ে পানীয় তৈরি করা হতো। সেসবের ধারাবাহিকতাই আমরা এখনো রক্ষা করে চলেছি।

চিনি সংরক্ষণের উপায়

চিনি কীভাবে ভালো রাখা যায়? ঢাকনা লাগানো কাচের বয়ামে রাখলে চিনি শক্ত হয়ে দলা বেঁধে যায় না। কারণটা খুবই সহজ, এতে বাতাস ভেতরে প্রবেশ করতে পারে না। কাচের পাত্র ব্যবহারের ইতিহাস প্রাচীন মিসরে খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ অব্দ থেকে পাওয়া যায়। পরে রোমান ও পারস্য সভ্যতায় কাচের বয়াম অনেক জনপ্রিয় হয়। চিনির বয়ামে একটি ছোট পাউরুটির টুকরা রাখলে তা চিনি ভালো রাখে। এই পাউরুটি প্রতি দুই সপ্তাহে একবার বদলে দিতে হয়। এটি একেবারে আধুনিক বিজ্ঞান বলে মনে হলেও আদতে এটি ঘরোয়া সংরক্ষণ কৌশলের একটি অংশ, যা ইউরোপ ও আমেরিকার ঘরে ঘরে উনিশ ও বিশ শতকে ব্যবহার করা হতো। এ ছাড়া চিনির কৌটায় অনেকে লং বা লবঙ্গ দিয়ে রাখেন। এতে চিনিতে গন্ধ হয় না, আবার চিনি খেতে পিঁপড়াও আসে না। দক্ষিণ এশিয়ার ঘরোয়া রান্নায় লবঙ্গের ব্যবহার অন্তত হাজার বছরের পুরোনো। চিনির পাত্রে লবঙ্গ রাখার প্রথা সম্ভবত সেই সময় থেকেই চলে আসছে।

ওভেন উপায়

ইলেকট্রিক ওভেন ব্যবহারের ক্ষেত্রে আস্ত বই-ই থাকে তার বাক্সের ভেতর। এরপরেও ওভেনে রান্না করার ক্ষেত্রে বিশেষ কিছু বিষয় মেনে চলেন অনেকে। একাধিক পদ রান্না করলে সেগুলো হালকা গরম ওভেনে রেখে একসঙ্গে গরম খাবার পরিবেশন করা যায়। বর্তমানে অনেকে বাড়িতে চিজ কেক তৈরি করেন। তাঁদের জন্য জেনে রাখা ভালো, কেক বেকিং হয়ে গেলে ওভেন বন্ধ করে তার দরজাটা সামান্য খুলে ওভেনেই রেখে দিন কিছুক্ষণ। ঠান্ডা হলে বের করুন।

ইলেকট্রিক ওভেন আবিষ্কারের বহু বহু আগেও ছিল মাটি বা অন্য উপাদানে তৈরি ওভেন। ছবি: পেক্সেলস
ইলেকট্রিক ওভেন আবিষ্কারের বহু বহু আগেও ছিল মাটি বা অন্য উপাদানে তৈরি ওভেন। ছবি: পেক্সেলস

এই নিয়মকানুন বা টিপসগুলো কিন্তু আজকের নয়; কয়েক শ বা তারও বেশি পুরোনো। ইলেকট্রিক ওভেন আবিষ্কারের বহু বহু আগেও ওভেন ছিল। সেগুলো ছিল মাটি বা অন্য উপাদানে। সেগুলোতে আগুন জ্বেলে বিশেষভাবে রান্নাবান্না করা হতো এবং খাবার গরম রাখা হতো। গুগল ঘাঁটলেই পেয়ে যাবেন, ক্রোয়েশিয়ায় প্রায় সাড়ে ছয় হাজার আগের প্রাচীন ওভেনের সন্ধান পাওয়া গেছে। মিসরের রুটির খামিরের ইতিহাস প্রায় আড়াই হাজার বছর বা তারও বেশি সময়কার। আর রোমান সাম্রাজ্যের বেকারস গিল্ড প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৬৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে। ফলে মনে করার কোনো কারণ নেই, বেকিং একুশ শতকে এসে আপনিই করছেন।

অত পুরোনো ইতিহাসে না গিয়েও বলা যায়, এখনকার অনেক বেকিং টিপসের আসলে ইউরোপ ও আমেরিকান বেকিং ঐতিহ্যের শ দেড়েক বছরের আধুনিক সংস্করণ। আর বেকিংয়ের ক্ষেত্রে একটি ভালো টিপস হলো বেকিংয়ের আগে ডিম ও মাখন ঘরের তাপমাত্রায় আনুন। রুম টেম্পারেচারের উপকরণ কেকের ব্যাটারে ভালোভাবে মিশে যায়, ফলে কেক হয় হালকা ও মোলায়েম। আবার বেকিং শুরুর আগেই শুকনা উপকরণ ছেঁকে নিতে হয়। এতে বাতাস ঢুকে কেক হয় হালকা। এই টিপসগুলো প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো বেকিং ঐতিহ্য থেকে পাওয়া। ময়দা বা অন্য শুকনো উপাদান ছাঁকলে তাতে বাতাস ঢুকে এবং দলা ভেঙে যায়। এটি বেকিংয়ের অন্যতম প্রাচীন কৌশল। এটি আগে হাত দিয়ে করা হতো, পরে ছাঁকনির ব্যবহার শুরু হয়।

মুরগি রান্নার আগে পানি ঝরিয়ে নিন

চিকেন ফ্রাই বর্তমানে সবখানেই পাওয়া যায়। খেতে খেতে এখন মানুষ বাড়িতেই তৈরি করছে মজাদার সব চিকেন ফ্রাই আইটেম। এই চিকেনও ফ্রাই করার ক্ষেত্রে একটি টিপস হলো, মুরগি ধোয়ার পর ভালোভাবে পানি ঝরিয়ে নিতে হবে। এর গায়ে পানি থাকলে তা ভাজলে সেদ্ধ হয় কিন্তু বাদামি হয় না। শুকিয়ে নিলে চামড়াটা সুন্দর ক্রিস্পি হয়। মধ্যযুগে রান্নার বইয়ে উল্লেখ পাওয়া যায়, মাংস রোস্ট করার আগে তা ভালো করে মুছে নিতে হবে। এই পদ্ধতির ব্যবহার বিজ্ঞানভিত্তিক দিক থেকে প্রায় ১১০ বছরের পুরোনো, বিশেষত ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার রান্নার ঐতিহ্যে।

গরম প্লেটে খাবার পরিবেশন

যারা গরম-গরম খাবার খেতে ভালোবাসে, তাদের খেতে দেওয়ার আগে গরম প্লেট দিয়ে দিন। কারণ, গরম প্লেটে পরিবেশন করলে খাবার দ্রুত ঠান্ডা হয় না। ভাবছেন, প্লেট গরম করবেন কীভাবে? খুব সহজ। প্লেটগুলো হালকা গরম পানিতে ভিজিয়ে রাখুন বা ওভেনে দিন, ব্যস। আবার হয়তো এটাও ভাবছেন, এটা তো দেখেছি তারকা হোটেলে। হ্যাঁ, বিশ থেকে ত্রিশের দশকে ইউরোপ ও আমেরিকায় ফাইন ডাইনিং সংস্কৃতি শুরু হয়। সে সময় থেকে হোটেল ও রেস্তোরাঁগুলোতে গরম খাবার পরিবেশনের জন্য হট প্লেট অথবা প্লেট ওয়ার্মার ব্যবহার শুরু হয়। কিন্তু এই জ্ঞান পেল কোথায় মানুষ?

রোমান ভোজে গরম খাবার পরিবেশনের জন্য গরম ধাতব থালা বা পাত্র ব্যবহার করা হতো। মধ্যযুগ থেকে ভিক্টোরিয়ান যুগ পর্যন্ত ইউরোপে রাজকীয় ও অভিজাত পরিবারগুলোতে রোমান পদ্ধতিতে প্লেট ব্যবহার করা হতো। আর আজ থেকে এক শ বছর কিছু বেশি সময় আগে ইউরোপ, আমেরিকার হোটেল ও রেস্তোরাঁ কালচারে এ পদ্ধতি ঢুকে যায় সেই প্রাচীন জ্ঞানের সম্প্রসারিত রূপ হিসেবে।

সূত্র: লাভ ফুড

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

খালার সঙ্গে শত্রুতা মুহাম্মদ ইউনূসের, আমি ‘কোল্যাটারাল ড্যামেজ’: টিউলিপ সিদ্দিক

এনসিপি নেতার বাড়িতে কাফনের কাপড়, চিরকুটে লেখা—‘প্রস্তুত হ রাজাকার’

৪০ পুলিশ কর্মকর্তার পদক প্রত্যাহার, অর্থ ফেরতের নির্দেশ

গণশুনানিতে দুদক চেয়ারম্যানের প্রতি ক্ষোভ দেখালেন মৎস্যচাষি

যাচ্ছিলেন বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক করতে, গণপিটুনিতে প্রাণ হারালেন জামাই-শ্বশুর

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত