Ajker Patrika

ঘুম নিয়ে সংকটে বিশ্ব

কোন দেশের মানুষ কত ঘণ্টা ঘুমায় জেনে নিন, সুস্বাস্থ্যের জন্য আপনার কত ঘণ্টা ঘুম জরুরি

ফিচার ডেস্ক, ঢাকা 
আপডেট : ০৯ আগস্ট ২০২৫, ২৩: ৫৮
সঠিক মাত্রার ঘুম স্বাস্থ্য, মানসিক সুস্থতা ও আবেগীয় স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য অপরিহার্য। ছবি: এআই দিয়ে তৈরি
সঠিক মাত্রার ঘুম স্বাস্থ্য, মানসিক সুস্থতা ও আবেগীয় স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য অপরিহার্য। ছবি: এআই দিয়ে তৈরি

কারও রাতে ঘুম হচ্ছে না, আবার কেউ দুপুরের আগে ঘুমে ঢলে পড়ছে। কেউ ঘুমের কারণে ক্লাস মিস করছে, আবার কেউ রাতে ঘুম না হওয়ায় অফিসে ঘুমিয়ে পড়ছে। ঘুম মানুষের দৈনন্দিন জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলেও এটা সব সময় অবহেলিত। আচ্ছা, একটু ঘুমিয়ে নিলেই চলবে—সবার মাঝে এমন একটা ভাব। কিন্তু সঠিক মাত্রার ঘুম স্বাস্থ্য, মানসিক সুস্থতা এবং আবেগীয় স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য অপরিহার্য। তবু কাজের চাপে, সামাজিক দায়িত্বে বা ডিজিটাল জগতে নিমগ্ন থাকায় প্রায়ই ঘুম বিসর্জন দিতে হয়। ঘুমের ঘাটতি যেন একটি নীরব মহামারি হয়ে উঠছে।

বিশ্বজুড়ে ঘুম নিয়ে সংকট তৈরি হচ্ছে। কোটি কোটি মানুষ দীর্ঘমেয়াদি ঘুমের ঘাটতিতে ভুগছে, যার পেছনে রয়েছে মানসিক চাপ, অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম এবং অনিয়মিত রুটিন। তবে আশার কথা হলো, কিছু দেশ এখন ঘুমের গুরুত্ব উপলব্ধি করছে। ফলে সেসব দেশ তাদের স্বাস্থ্যনীতি, সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রায় ঘুমকে সুনির্দিষ্টভাবে স্থান দিচ্ছে। ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউ ও স্ট্যাটিস্টার তথ্য অনুযায়ী কোন দেশের মানুষ ঠিক কতটা ঘুমায়, এই বিষয়ে ধারণা পাওয়া যায়। এসব তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, কোন দেশে ঘুমকে কতটা বেশি আর কতটা কম গুরুত্ব দিয়েছে।

যেসব দেশের মানুষ কম ঘুমায়

গবেষণা অনুসারে, পৃথিবীতে গড়ে সবচেয়ে কম ঘুমায় জাপানের মানুষ। ছবি: পেক্সেলস
গবেষণা অনুসারে, পৃথিবীতে গড়ে সবচেয়ে কম ঘুমায় জাপানের মানুষ। ছবি: পেক্সেলস

কম ঘুমানো দেশের তালিকায় প্রথমে আছে জাপানের নাম। দেশটিতে দীর্ঘ কর্মঘণ্টা ও কর্মসংস্কৃতির চাপের কারণে মানুষ কম ঘুমায়। জাপানি নাগরিকেরা গড়ে ৫ ঘণ্টা ৫২ মিনিট ঘুমায়। তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে আছে দক্ষিণ কোরিয়া। দেশটিতে মানুষের ঘুমের গড় সময় ৬ ঘণ্টা ২ মিনিট। আর এটাই মূলত দক্ষিণ কোরিয়ার মানুষদের মানসিক চাপের প্রধান কারণ। কুয়েতের মানুষের ঘুমের গড় সময় ৬ ঘণ্টা ১৫ মিনিট। সেখানে অভিবাসী শ্রমিকদের কাজের চাপে ঘুম কম হয়। এদিকে প্রযুক্তি ও কর্মব্যস্ততার কারণে তাইওয়ানে মানুষের ঘুমের গড় সময় ৬ ঘণ্টা ২১ মিনিট। যাতায়াত, স্ক্রিন টাইম—সব মিলিয়ে তাইওয়ানের পরেই আছে ইন্দোনেশিয়া। পর্যটকপ্রবণ এই দেশে মানুষের ঘুম হয় গড়ে ৬ ঘণ্টা ২৫ মিনিট। এরপরেই আসে সিঙ্গাপুর। ইন্দোনেশিয়ার তুলনায় সিঙ্গাপুরের মানুষ মাত্র ৯ মিনিট বেশি ঘুমায়। শহুরে চাপ ও প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রভাবে দেশটিতে ঘুমের গড় সময় ৬ ঘণ্টা ৩৪ মিনিট।

সিঙ্গাপুরের চেয়ে গড়ে ১ মিনিট বেশি ঘুমায় ভারতের মানুষ। পড়াশোনা ও কাজের চাপে সেখানে মানুষের ঘুমের গড় সময় ৬ ঘণ্টা ৩৫ মিনিট। প্রযুক্তির পাশাপাশি অস্থির রাজনৈতিক কারণে ইসরায়েলে মানুষের ঘুমের সময় গড়ে ৬ ঘণ্টা ৩৬ মিনিট। অন্যান্য দেশের মতো মেক্সিকোতেও ঘুমের ব্যাঘাতের মূল কারণ কাজ, স্ক্রিন টাইম ও মানসিক চাপ। দেশটিতে ঘুমের গড় সময় ৬ ঘণ্টা ৩৭ মিনিট। শহুরে জীবন ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের প্রভাবে চিলিতে মানুষের ঘুমের গড় সময় ৬ ঘণ্টা ৩৯ মিনিট। প্রযুক্তি ব্যবহারের পাশাপাশি অগোছালো জীবনযাপনের ফলে ব্রাজিলের মানুষের ঘুমের গড় সময় ৬ ঘণ্টা ৪০ মিনিট। জনবহুল দেশ চীন। পড়াশোনার চাপ ও ট্রাফিকের প্রভাবে সেখানে মানুষের ঘুমের গড় সময় ৬ ঘণ্টা ৪৩ মিনিট। মূলত অর্থনৈতিক চাপ ও একাধিক কাজের প্রয়োজনে রাশিয়ায় মানুষের ঘুমের গড় সময় ৬ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট। অন্যদিকে ক্যাফেইন, গরম আবহাওয়া ও সামাজিক জীবনযাপনের প্যাটার্নের প্রভাবে ইতালিতে মানুষের ঘুমের গড় সময় ৬ ঘণ্টা ৫৪ মিনিট। দেরি করে খাওয়া এবং নাইট লাইফের প্রভাবে স্পেনের মানুষের ঘুমের গড় সময় ৬ ঘণ্টা ৫৬ মিনিট।

ঘুম প্রাধান্য দিচ্ছে যে দেশগুলো

ভালো ঘুম শুধু বিশ্রামের জন্য নয়, এটি সুস্থ, কর্মক্ষম ও মানসিকভাবে স্থিতিশীল জীবনের জন্য অপরিহার্য। বিশ্বজুড়ে ঘুম সংকটের এমন সময়ে কিছু দেশ তাদের নাগরিকদের মানসিক ও শারীরিক সুস্থতার কথা ভেবে তাদের কাজের গঠন নিয়ে ভাবছে। দেশটি ঘুমকে কেবল বিলাসিতা নয়, বরং সুস্বাস্থ্যের একটি অপরিহার্য অংশ হিসেবে গ্রহণ করেছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, নেদারল্যান্ডস ও নিউজিল্যান্ড। দেশগুলোর নাগরিকেরা বিশ্বে গড়ে বেশি সময় ঘুমায়।

প্রযুক্তি ব্যবহার ভালো ঘুমের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলছে। ছবি: এআই দিয়ে তৈরি
প্রযুক্তি ব্যবহার ভালো ঘুমের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলছে। ছবি: এআই দিয়ে তৈরি

অস্ট্রেলিয়া

প্রাকৃতিক জীবনের ছোঁয়া অস্ট্রেলিয়ায় ভালো ঘুমে সহায়ক হিসেবে ভূমিকা পালন করে। তাদের ঘুম ভালো হওয়ার অন্যতম কারণ হলো জীবনধারায় প্রকৃতি ও ভারসাম্যের উপস্থিতি। বাইরের জীবনের প্রতি ভালোবাসা, নমনীয় কর্মসংস্কৃতি, সহজলভ্য স্বাস্থ্যসেবা ও উন্নত জীবনযাত্রা মানের ফলে অস্ট্রেলিয়ানরা গড়ে প্রতি রাতে ৭ ঘণ্টা ২০ মিনিট ঘুমায়। দেশটিতে ঘুম শুধু বিশ্রাম নয়, সুস্থতার অংশ।

যুক্তরাজ্য

ঘুমের স্বাস্থ্যগত গুরুত্বের প্রতি জাতীয় মনোযোগ দেওয়া হয়েছে যুক্তরাজ্যে। ঘুম সেখানে স্বাস্থ্যনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। দেশটির ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের ক্যাম্পেইন, গণমাধ্যম ও স্কুলগুলো নিয়মিত প্রচারণা চালায় ঘুমের গুরুত্ব, স্ক্রিন টাইম কমানো এবং মানসিক চাপ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশটিতে স্বাস্থ্য ও সুস্থতাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। এরই ফল হিসেবে ব্রিটিশরা গড়ে প্রতিরাতে ৭ ঘণ্টা ২২ মিনিট ঘুমায়।

নেদারল্যান্ডস

বিশ্রাম ও জীবনের ভারসাম্যে বিশ্বসেরা বলা যেতে পারে নেদারল্যান্ডসকে। সেখানে কাজের চাপ তুলনামূলক কম। সক্রিয় জীবনযাত্রা ও ঘুমবান্ধব সংস্কৃতি রয়েছে দেশটিতে। সেখানে মানুষ বিশ্রাম ও অবসরকে জীবনের স্বাভাবিক অংশ হিসেবে বিবেচনা করে। উন্নত জীবনমান ও কর্মস্থলে কম চাপের কারণে ডাচরা গড়ে ৭ ঘণ্টা ২৪ মিনিট ঘুমায়।

গবেষণা অনুসারে, পৃথিবীতে গড়ে বেশি সময় ঘুমায় নিউজিল্যান্ডের মানুষ। তারা গড়ে প্রতি রাতে ৭ ঘণ্টা ২৭ মিনিট ঘুমায়। ছবি: পেক্সেলস
গবেষণা অনুসারে, পৃথিবীতে গড়ে বেশি সময় ঘুমায় নিউজিল্যান্ডের মানুষ। তারা গড়ে প্রতি রাতে ৭ ঘণ্টা ২৭ মিনিট ঘুমায়। ছবি: পেক্সেলস

নিউজিল্যান্ড

বিশ্বে সর্বোচ্চ সময় ঘুমায় নিউজিল্যান্ডের মানুষ। দেশটিতে ঘুম ঘিরে ইতিবাচক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। পরিবার, ব্যক্তিগত সময় ও প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগের বিষয় নিউজিল্যান্ডে অনেক গুরুত্ব দেওয়া হয়। এই মানসিক ও শারীরিক প্রশান্তি সরাসরি ঘুমের ওপর প্রভাব ফেলে। উন্নত জীবনযাত্রা, কাজ ও জীবনের ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক এবং স্বাস্থ্যসেবার সহজলভ্যতা—সব মিলিয়ে নিউজিল্যান্ডবাসী গড়ে প্রতি রাতে ৭ ঘণ্টা ২৭ মিনিট ঘুমায়।

কত ঘণ্টা ঘুম জরুরি

প্রতিদিন কত ঘণ্টা ঘুম জরুরি বা সুস্থ থাকতে প্রতিদিন কত ঘণ্টা ঘুমানো দরকার—এর উত্তর ভিন্ন ভিন্ন হয়। বয়স, মানুষের শারীরিক অবস্থা ও পরিশ্রমের পরিমাণভেদে ঘুমের সময় আলাদা। তারপর শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের সাধারণভাবে ঘুমের চাহিদা আলাদা। ন্যাশনাল স্লিপ ফাউন্ডেশন (এনএসএফ) এবং আমেরিকান একাডেমি অব স্লিপ মেডিসিনের (এএএসএম) মতো স্বাস্থ্য সংস্থাগুলো বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে ঘুমের তালিকা তৈরি করেছে।

শিশুদের ঘুমের সময়

নবজাতক (শূন্য থেকে ৩ মাস): ১৪ থেকে ১৭ ঘণ্টা (দিন ও রাতের ঘুম মিলিয়ে)।

শিশু (৪ থেকে ১১ মাস): ১২ থেকে ১৫ ঘণ্টা।

টডলার (১ থেকে ২ বছর): ১১ থেকে ১৪ ঘণ্টা।

প্রি-স্কুলার (৩ থেকে ৫ বছর): ১০ থেকে ১৩ ঘণ্টা।

স্কুলপড়ুয়া শিশু (৬ থেকে ১৩ বছর): ৯ থেকে ১১ ঘণ্টা।

কিশোর ও প্রাপ্তবয়স্কদের ঘুমের সময়

কিশোর (১৪ থেকে ১৭ বছর): ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা।

তরুণ প্রাপ্তবয়স্ক (১৮ থেকে ২৫ বছর): ৭ থেকে ৯ ঘণ্টা।

প্রাপ্তবয়স্ক (২৬ থেকে ৬৪ বছর): ৭ থেকে ৯ ঘণ্টা

বয়স্ক (৬৫ বছর ও বেশি): ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা

ঘুমের সময়সূচির এই সুপারিশগুলো স্বাস্থ্য, মানসিক বিকাশ ও শারীরিক সুস্থতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তবে ব্যক্তি, শারীরিক অবস্থা, পরিবেশ ইত্যাদি ভেদে সময়ের কিছুটা তারতম্য হতে পারে।

সূত্র

১. স্লিপ ডিউরেশন রেকমেন্ডেশন, ন্যাশনাল স্লিপ ফাউন্ডেশন, ২০১৫

২. সেনসাস স্টেটমেন্ট অন রেকমেন্ডেড স্লিপ ডিউরেশন, আমেরিকান একাডেমি অব স্লিপ মেডিসিন, ২০১৬

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

লুটপাটে শেষ ৫ কোটির প্রকল্প: ইউএনও-উপজেলা প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে শুনানি কাল

চীন–রাশিয়া থেকে ভারতকে দূরে রাখতে কয়েক দশকের মার্কিন প্রচেষ্টা ভেস্তে দিচ্ছেন ট্রাম্প: জন বোল্টন

‘হানি ট্র্যাপের’ ঘটনা ভিডিও করায় খুন হন সাংবাদিক তুহিন: পুলিশ

আটজন উপদেষ্টার ‘সীমাহীন’ দুর্নীতির প্রমাণ আছে: সাবেক সচিব

স্ত্রীকে মেরে ফেলেছি, আমাকে নিয়ে যান— ৯৯৯–এ স্বামীর ফোন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত