Ajker Patrika

বাংলার আদরে গড়া অগ্রহায়ণের পিঠাপুলি

ছন্দা ব্যানার্জি
বাংলার আদরে গড়া অগ্রহায়ণের পিঠাপুলি

এখন সারা বছর পিঠা তৈরি হলেও একটা সময় হেমন্ত ঋতু আসার সঙ্গে সঙ্গে পিঠা ও পায়েসের সময় এসে যেত। শীত পিঠার প্রধান মৌসুম। তবে তার প্রস্তুতি শুরু হয় হেমন্তে।

আমাদের স্থানীয় খাবারগুলোর মধ্যে পিঠা বেশ প্রাচীন খাবার। পিঠার বয়স কত, তা ঠিক করে বলা কঠিন। সিন্ধু সভ্যতার সময়ও পিঠাজাতীয় খাদ্য ছিল। তাই ৫ হাজার বছর বা তার বেশি পিঠার বয়স। পিঠার ইতিহাস বলে বৈদিক যুগে যবের গুঁড়া গুড় দিয়ে মেখে সেঁকা হতো। আরেকটি ছিল অপূপ। যবের গুঁড়া খামি করে চাটুতে ঘি মেখে সরু চাকলির মতো করে ভাজা।

পিঠা বাঙালির বিশেষ প্রীতি ও শ্রদ্ধার বস্তু। অগ্রহায়ণ মাসে বাড়িতে ধান আসে, তা থেকে চাল হয়। তারপর নতুন চাল, দুধ, গুড়, ফলমূল একসঙ্গে মেখে দেবতার উদ্দেশে নিবেদন করা হয়। আর পৌষের শেষ দিন অর্থাৎ পৌষসংক্রান্তিতে হয় পিঠার পর্ব।

পিঠা নানা রকম। মূল উপকরণ চালের গুঁড়া, নারকেল, তিল, ময়দা, গুড় বা চিনি। মিষ্টি উপকরণ হিসেবে চিনি অর্বাচীন বা নতুন জিনিস। আগে গুড়, নারকেল, তিল—এসব দিয়েই পিঠা বানানো হতো।

‘ঠাকুরমার ঝুলি’র ‘কাঁকনমালা-কাঞ্চনমালা’ গল্পের যা ‘আস্কে’ পিঠা অন্য জায়গায় তা গুড় পিঠা নামে বেঁচে আছে। এই আস্কে পিঠা খুব পুরোনো। দেখতে অনেকটা দক্ষিণি ইডলির মতো। বিশেষ ধরনের মাটির সরায় তৈরি হয় আস্কে পিঠা। এরই রকমফের চিতই পিঠা।

তবে আস্কে পিঠা তৈরি হয় যে চালের গুঁড়া দিয়ে, তা সেদ্ধ নাকি আতপ চালের, এ নিয়ে মতভেদ রয়েছে। সে যাই হোক, ‘উসুম আঁচে আস্কে পিঠে, কড়া আঁচে পুলি’—এই হলো এর রেসিপির মূল সূত্র। আস্কে বানানোর সময় উনুন বা গ্যাসের আঁচ খেয়াল রাখতে হবে। এ পিঠা গুড় দিয়ে খাওয়া হয়। কিন্তু চিতই পিঠা গুড়, সবজি, মাংস সবকিছু দিয়ে খাওয়া যায়।

পুলিপিঠা মূলত সেদ্ধ ও ভাপা পিঠা। এখন সেটা ভাজা পিঠাও বটে। এতে যে পুর থাকে, সেটি প্রধানত গুড় বা নারকেলের পাক, তিল ও গুড়ের পাক অথবা ক্ষীর ও চিনির পাক দিয়ে তৈরি হয়। সবজি ও আলু পোস্তর পুরও বহুল প্রচলিত।

একই পিঠার হাজার রকম নামও হয়। পুলিপিঠার শুধু পুর বদলে দিলেই নামও বদলে যেতে পারে। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতেও এ রকম পিঠার সন্ধান পাওয়া যায়। পিঠা পার্বণে ঠাকুরবাড়ির রান্নাঘরে সরু চাকলি, সেদ্ধ পিঠা, ভাপা পিঠা, বাটাসাপটা, পাটিসাপটা, চিড়ের পুলি, রাঙা আলুর পুলি, গোল আলুর পুলি, চুষি পিঠে, কড়াইশুঁটির পুলি, মুগের পুলি, আঁদোসা, রসবড়া, গুড় পিঠা, ছানার পুলি, ক্ষীরের পুলি, দুধ দিয়ে চুষি পিঠা, ময়দার সাপটা পুলি, গোল পিঠা, কচুর পিঠা, লাউয়ের পুলি হতো। প্রজ্ঞা সুন্দরী দেবীর লেখায় আমরা এসবের খোঁজ পাই।

গুড়-নারকেল, তিল, চালের গুঁড়া একসঙ্গে মেখে কলাপাতায় মুড়ে পাতুরির মতো ভাপানো পিঠাও অনেকে ছোটবেলায় খেয়েছেন। গ্রামের দিকে কাঁঠালপাতা ঠোঁয়ার মতো মুড়ে তাল মাখা ঢেলে ঠোঁয়ার মুখটা কাঁঠালপাতা দিয়ে বন্ধ করে, হাঁড়িতে পানি দিয়ে ফুটিয়ে সেই হাঁড়ির মুখে একটা কাপড় পেতে, তার ওপর পাতাগুলো রেখে ভাপানো হতো এই পিঠা।

এরই একটু রকমফেরে বিক্রমপুরের বিখ্যাত বিবিখানা পিঠা। এর সঙ্গে কেকের অনেকখানি মিল রয়েছে, তবে এটি কেক নয়। তা ছাড়া, চাল ও ময়দা মিশিয়ে বা ময়দার জায়গায় বিউলি ডাল বা মাষকলাই ব্যবহার করে শেষ পাতে পাটিসাপটা কিন্তু অসাধারণ। এর পুর হবে নারকেল, গুড়, তিল বা খোয়ার মসলা। তার সঙ্গে একটু জায়ফল গুঁড়া, কুচোনো কিশমিশ দিয়ে দিতে পারেন।

চালের গুঁড়া আর বিউলির ডাল বেটে একসঙ্গে মিশিয়ে লবণ মৌরি দিয়ে পাতলা ব্যাটার করে দোসার মতো করে ভাজা। জিনিসটা নোনতা কিন্তু অনুপানটি পাতলা গুড়। কেবল এটা নয়, বেশির ভাগ পিঠার অনুষঙ্গ গুড়। পাতলা খেজুর বা একতারের আখের গুড়।

একসময় ফ্রিজের প্রচলন ছিল না বলে লুচি, পায়েস ও পিঠা বাসি থাকত। তার ছিল ভিন্নতর স্বাদ। এখন লেফট ওভার হিসেবে সবটাই ফ্রিজে গিয়ে পিঠা তার সেই ‘বাসিত্ব’ হারিয়ে ফেলেছে। তাই হারিয়ে গেছে দুধে বা খেজুর রসে চুবানো বাসি পিঠার স্বাদ। এই শীতে একবার সেটা চেখে দেখবেন নাকি?

ছন্দা ব্যানার্জি, রন্ধনশিল্পী ও খাদ্যবিষয়ক লেখক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...