Ajker Patrika

আমিনুলের নকশি ভুবন

জাকির হোসেন তপন
আপডেট : ৩১ মার্চ ২০২২, ০৯: ৪৬
আমিনুলের নকশি ভুবন

জসীমউদ্‌দীনের নকশী কাঁথার মাঠের কথা আমরা অনেকেই শুনেছি। কেউ কেউ পড়েছিও। 

‘এই এক গাঁও, ওই এক গাঁও —   মধ্যে ধু ধু মাঠ,
ধান কাউনের লিখন লিখি করছে 
নিতুই পাঠ।...
ও-গাঁয় যেন জমাট বেঁধে বনের 
কাজল কায়া,
ঘরগুলিরে জড়িয়ে ধরে বাড়ায় 
বনের মায়া।’

পল্লিকবি তাঁর কবিতায় গ্রামবাংলার দৃশ্যকল্প এঁকেছেন শব্দের পিঠে শব্দ সাজিয়ে। আর আমাদের নকশিকাঁথার শিল্পীরা আবহমানকাল ধরে সুতো ও সুই দিয়ে কাপড়ের ওপরে এঁকে চলেছেন ভালোবাসার দৃশ্য। তাঁরা রঙিন সুতায় গ্রামীণ প্রকৃতিকে ফুটিয়ে তুলেছেন নিপুণ দক্ষতায়।

বাংলাদেশে নকশিকাঁথার ইতিহাস বেশ প্রাচীন। এখন আর আগের মতো বাংলাদেশের অধিকাংশ ঘরে নারীরা নকশিকাঁথায় নকশা ফুটিয়ে তোলেন না বটে। তবে কিছু মানুষ এখনো ধরে রেখেছেন সে ঐতিহ্য। এর মধ্যে ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপার মো. আমিনুল ইসলাম অন্যতম। তিনি নিজে যেমন শিল্পী, তেমনি গ্রামের ঘরে ঘরে কারুশিল্পীদের সংগঠিত করে কাজ করানোর ব্যাপারেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন। নিজ জেলা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলায় রয়েছে তাঁর এ রকম সংগঠিত সুচিশিল্পীর দল। সে দলের বেশির ভাগ সদস্য নারী। করোনা অতিমারি শুরু হওয়ার আগে সে দলে ছিলেন প্রায় আড়াই হাজার সদস্য। এখন হাজার দেড়েক সদস্য কাজ করছেন তাঁর সঙ্গে। সবাই যে নকশিকাঁথা সেলাই করছেন, তা নয়। পোশাকসহ বিভিন্ন হোমডেকর পণ্যে সুচিকর্ম করাই ছিল তাঁর মূল কাজ। নিজের দল নিয়ে দীর্ঘদিন সেটা তিনি করেছেন দায়িত্বের সঙ্গে।

মো. আমিনুল ইসলাম সেসব দিন 
আমিনুল ইসলামের জীবন যেন গল্পকেও হার মানায়! তাঁর জন্ম ঝিনাইদহের শৈলকুপার একটি প্রান্তিক চাষি পরিবারে। ছয় ভাই এক বোন নিয়ে তাঁর পরিবার। ভাইবোনদের মধ্যে সবার ছোট আমিনুল ইসলাম। শৈশবে মায়ের কাঁথা সেলাই দেখে দেখে তিনি নিজেও একসময় কাঁথা বোনায় আগ্রহী হয়ে ওঠেন। স্কুলে যাতায়াত শেষে কলেজের গণ্ডি পার হয়েছেন। কিন্তু মনে তাঁর সব সময় শিল্প আর সুন্দরের জন্য কিছু করার চেষ্টা ছিল। ঝিনাইদহের একটি গ্রামে বসে অন্য রকম কাজ করার সুযোগ কোথায়? আমিনুল ইসলাম নিজের চারপাশ থেকে শিখতে শুরু করেন। বিশেষ করে প্রতিবেশী পরিবারগুলোর আচার অনুষ্ঠানে যেসব আয়োজন তিনি দেখেছিলেন, সেখান থেকে তাঁর ভালো লাগার উপাদান খুঁজে নিতেন।

কোনো পত্রিকা পেলে সেখানে প্রকাশিত সুন্দর ছবি বা ডিজাইন দেখলে তা মনের আয়নায় গেঁথে নিতেন। গ্রামে বিয়ের সময় কনে সাজানোর জন্যও আমিনুল ইসলামের সুনাম ছিল একসময়। আঁকতেন আলপনা। মায়ের কাঁথা সেলাই দেখে দেখে তিনিও হয়ে উঠেছিলেন একজন সহজাত সুচিশিল্পী। গ্রামের মেয়েদের সাদামাটা সব নকশিকাঁথার ডিজাইনকে তিনি তাঁর হাতের ছোঁয়া আর শিল্পীমন দিয়ে অন্য মাত্রা দিতে লাগলেন। যদিও বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে একজন পুরুষ মানুষের এসব কাজের আগ্রহকে তাচ্ছিল্যের চোখেই দেখা হয়। কিন্তু শিল্পের প্রতি অদম্য ক্ষুধা তাঁকে দিয়ে এসবই করিয়ে নেয়। 

 ঢাকা পর্ব
একপর্যায়ে ১৯৯০ সালে তিনি আরও লাখো হতভাগ্য মানুষের মতো ভাগ্যান্বেষণে রাজধানী ঢাকায় চলে আসেন। সে এক কঠিন জীবনসংগ্রাম। একদিন আড়ংয়ের শোরুম দেখে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন অনেকক্ষণ। ভাবছিলেন, যদি কোনোভাবে কাজ করার সুযোগ হতো সেখানে! একদিন সে সুযোগও এসে যায়। তিনি আড়ংয়ের অন্যতম খ্যাতিমান ও নির্ভরযোগ্য সাপ্লাইয়ার বা প্রোডিউসার হয়ে ওঠেন। তাঁর দক্ষতা, পরিশ্রম, সততা আর অধ্যবসায় তাঁকে এ জায়গায় নিয়ে আসে। তবে বলাই বাহুল্য যে তাঁর এই পথ মোটেই মসৃণ ছিল না। শিল্প আর উন্নত রুচির প্রতি আমিনুল ইসলামের 

যে ভালোবাসা আর আস্থা, সেটা তাঁকে সব সময় ভেতর থেকে উৎসাহ জুগিয়ে গেছে। 
আমিনুল জানান, তিনি তাঁর কাজ নিয়ে কোরিয়া, ভারত, পর্তুগাল, জাপান, হংকং গিয়েছেন। সেখানে প্রদর্শনী করেছেন। সেসব জায়গায় বাংলাদেশের এই শিল্প ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে। তিনি উৎসাহ আর সাহস পেয়েছেন সেসব থেকে। ফিরে এসে নতুনভাবে আবারও কাজ শুরু করেছেন।

এবং বাংলা সেলাই
মো. আমিনুল ইসলাম দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন দেশের শীর্ষ ফ্যাশন হাউস আড়ংয়ের সঙ্গে, একজন প্রোডিউসার হিসেবে। সম্প্রতি তিনি তাঁর নিজের ব্র্যান্ড ‘বাংলা সেলাই’ তৈরি করেছেন। এখান থেকে আমিনুল ইসলামের স্বতন্ত্র সব হাতের কাজের পণ্যসামগ্রী তৈরি হবে। এটি এখনো ফেসবুককেন্দ্রিক একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। তিনি কারখানা তৈরি করেছেন ঢাকার দক্ষিণখানের ফায়দাবাদে। 
বাংলা সেলাই এখন তৈরি করছে শাড়ি, পাঞ্জাবি, ফতুয়া, বেড কভার, কুশন কভার, কাঁথা, শাল, ঘরের পর্দাসহ আরও অনেক নিত্যপ্রয়োজনীয় গৃহসামগ্রী। সেগুলোতে থাকছে সুচিকর্ম।

নিজের জেলা ঝিনাইদহ ছাড়াও টাঙ্গাইল, রংপুর, নরসিংদী প্রভৃতি অঞ্চলে রয়েছে তাঁর প্রায় দেড় হাজার কর্মীর এক বিশাল বাহিনী। তাঁরাই এখন চাহিদামতো আমিনুলকে সরবরাহ করে থাকেন সুচিকর্ম। আমিনুল প্রয়োজনমতো তাঁদের সরবরাহ করে থাকেন নকশা ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক উপকরণ। যাঁর কাছে যখন যা পাঠানো হয় তাঁরা কাজ করে আবার তা ফেরত পাঠিয়ে দেন আমিনুলের কাছে। তারপর সেগুলো চাহিদামতো পৌঁছে যায় ক্রেতার হাতে। 

লেখক: উন্নয়নকর্মী ও সংগীতশিল্পী

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত