Ajker Patrika

এনবিআর বিলুপ্তির জেরে প্রায় অচল দেশের রাজস্ব কর্মকাণ্ড

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
আপডেট : ১৪ মে ২০২৫, ১৪: ১০
ভ্যাট কমিশনারেট চট্টগ্রাম কার্যালয়ে কর্মঘণ্টা চলাকালে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দেখা মেলেনি। ছবি: আজকের পত্রিকা
ভ্যাট কমিশনারেট চট্টগ্রাম কার্যালয়ে কর্মঘণ্টা চলাকালে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দেখা মেলেনি। ছবি: আজকের পত্রিকা

অংশীজনদের মতামত গ্রহণ ও আলোচনা ছাড়াই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিলুপ্তির অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে। তাই মধ্যরাতে জারি করা অধ্যাদেশ বাতিল ও নতুন করে প্রণয়নের দাবিতে সারাদেশে একযোগে কলম বিরতি পালন করছেন এনবিআরের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা।

গতকাল মঙ্গলবার এনবিআরের সব স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্মিলিত প্ল্যাটফর্ম ‘এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ’-এর পক্ষ থেকে তিন কার্যদিবসে কলম বিরতি পালনের ঘোষণা আসে। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী, আজ বুধবার সকাল ১০টা থেকে কলম বিরতি পালন করছেন তাঁরা। কলম বিরতি চলবে দুপুর ১টা পর্যন্ত।

তবে এনবিআরের তিন ধরনের কার্যক্রম চালু রাখা হয়েছে। এগুলো হলো—আন্তর্জাতিক যাত্রীসেবা, বাজেট ও রপ্তানি সংক্রান্ত কার্যক্রম।

এ বিষয়ে অতিরিক্ত কমিশনার (কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট) সাধন কুমার কুণ্ডু বলেন, ‘একযোগে দেশের সব অফিসে এনবিআর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আমরা কলম বিরতি পালন করছি। আমরা চাই, দেশের ও দশের ভালোর জন্য সবার অংশগ্রহণ ও মতামতের ভিত্তিতে যে উদ্যোগ নেওয়া হবে, সেটা আমরা এনডোর্স করব। তাই আমাদের দাবি, এই অধ্যাদেশ বাতিল করে সবাইকে নিয়ে নতুন করে প্রণয়ন করা হোক।’

কলম বিরতি পালন করছেন বলে জানান উপকর কমিশনার শাহ মোহাম্মদ ফজলে এলাহীও।

তবে এ বিষয়ে দ্বিমত করে এনবিআরের এক সদস্য আজকের পত্রিকা'কে বলেন, ‘এনবিআরের কোথাও বিরতি চলছে না। আমি তো আমার অফিসারদের সঙ্গে কাজ করছি। কোথায় বিরতি চলছে আমাকে জানান।’

কর্মকর্তাদের অন্যদিকে পরিচালনার চেষ্টা চলছে বলে দাবি করেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই এনবিআর সদস্য। তিনি বলেন, ‘কর্মকর্তাদের কেউ অন্যদিকে পরিচালনা করার চেষ্টা করছেন। তাঁদের স্বার্থের ব্যাঘাত কোথাও হয়নি। আজকের মধ্যেই দেখবেন, সব ঠিক হয়ে যাবে।’

এনবিআর প্রধান কার্যালয় প্রায় ফাঁকা। ছবি: আজকের পত্রিকা।
এনবিআর প্রধান কার্যালয় প্রায় ফাঁকা। ছবি: আজকের পত্রিকা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন কর অঞ্চল ও কাস্টমস হাউসে কলম বিরতি চলছে। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে এনবিআর ভবনে সরেজমিনে দেখা যায়, কর্মকর্তারা যথারীতি দপ্তরে এসেছেন। তবে কোনো দাপ্তরিক কাজ করছেন না তাঁরা। কেবল বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এনবিআরের কর, শুল্ক ও মূসক নীতি বিভাগের কর্মকর্তারা কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন। ফ্লোরগুলো ফাঁকা রয়েছে, লোকজনের আনাগোনা নেই বললেই চলে।

এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খানও দপ্তরে আসেননি।

গত সোমবার (১২ মে) মধ্যরাতে এনবিআর বিলুপ্ত করে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা নামে দুটি বিভাগ করার বিষয়ে অধ্যাদেশ জারি করে অন্তর্বর্তী সরকার। গত ১৭ এপ্রিল উপদেষ্টা পরিষদে খসড়া অনুমোদনের ২৫ দিন পর এই অধ্যাদেশ জারি করা হয়। পরে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সরকার এই অধ্যাদেশ কার্যকর করার তারিখ ঘোষণা করবে।

এদিকে অধ্যাদেশের খসড়াতেই আপত্তি জানিয়ে এটি বাতিলের দাবি তোলেন আয়কর ও শুল্ক ক্যাডারের সদস্যদের সমিতি। ক্যাডার সার্ভিসের বাইরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও এই দাবির পক্ষে এক জোট হন।

এনবিআর অফিসের ভেতরে কলম বিরতি পালনের নির্দেশিকা। ছবি: আজকের পত্রিকা।
এনবিআর অফিসের ভেতরে কলম বিরতি পালনের নির্দেশিকা। ছবি: আজকের পত্রিকা।

মতামত গ্রহণ ও আলোচনা ছাড়াই এনবিআর বিলুপ্তির অধ্যাদেশ জারি হতে পারে, এমনটা আঁচ করে গত সোমবার দিনভর রাজস্ব ভবনে বিক্ষোভ করেন কয়েকশ আয়কর ও কাস্টমস ক্যাডারের কর্মকর্তা এবং ঢাকার বিভিন্ন কর অঞ্চল, কাস্টমস হাউস ও ভ্যাট কমিশনারেটে কর্মরত ক্যাডার সার্ভিসের বাইরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। সেদিন সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত দফায় দফায় বৈঠক করেন তাঁরা। ‍এতে কার্যত অচল হয়ে পড়ে রাজস্ব আদায় কার্যক্রম।

আন্দোলন এগিয়ে নিতে ওই দিন আত্মপ্রকাশ ঘটে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ প্ল্যাটফর্মের। বৈঠকের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত হয়, মঙ্গলবার বিকেল ৩টা থেকে রাজস্ব ভবনের সামনে বিসিএস আয়কর ও কাস্টমস ক্যাডারের কর্মকর্তা, নন-ক্যাডার কর্মকর্তা, তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের সমন্বয়ে অবস্থান কর্মসূচি পালন করবে।

এর মধ্যেই সোমবার মধ্যরাতে অধ্যাদেশ জারি করে সরকার। এতে মুষড়ে পড়েন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তারপরও মঙ্গলবার বিকেল ৩টায় কয়েকশ কর্মকর্তা-কর্মচারী এনবিআর ভবনের সামনে জমায়েত হন। সেখানে তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। আজ বুধবার সকাল ১০টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত এবং আগামীকাল বৃহস্পতিবার ও শনিবার সকাল ১০টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত সব স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী কলম বিরতি পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়।

আয়কর ও শুল্ক ক্যাডারের কর্মকর্তারা বলছেন, পৃথিবীর সব দেশের নিজস্ব রাজস্ব আদায়কারী সংস্থা রয়েছে। অথচ কোনো ধরনের সমীক্ষা ছাড়াই এনবিআর বিলুপ্ত করতে অধ্যাদেশ চূড়ান্ত করা হচ্ছে। এ সিদ্ধান্তের ফলে অংশীজন বা ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর কী ধরনের প্রভাব পড়বে, তা নিয়ে কোনো আলোচনাই করা হয়নি। একটি বিশেষ ক্যাডার নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখতে একতরফাভাবে খসড়া অধ্যাদেশ তৈরি করেছে। এ ক্ষেত্রে কাস্টমস ও আয়কর ক্যাডারের মতামত তো দূরের কথা, অর্থনৈতিক পরিস্থিতিবিষয়ক শ্বেতপত্র কমিটি বা এনবিআর সংস্কারবিষয়ক পরামর্শক কমিটির সুপারিশ আমলে নেওয়া হয়নি। খসড়া অধ্যাদেশে নানা রকমের অসংগতি আছে। এসব ত্রুটি-বিচ্যুতি চিহ্নিত না করে এবং সমীক্ষা ছাড়া এনবিআর বিলুপ্ত করলে রাজস্ব আদায় কার্যক্রম চরমভাবে ব্যাহত হবে। এতে দেশের অর্থনীতি ধসে পড়তে পারে।

রংপুরের কর অঞ্চল কার্যালয়ে কলম বিরতির ব্যানার ঝুলছে। ছবি: আজকের পত্রিকা।
রংপুরের কর অঞ্চল কার্যালয়ে কলম বিরতির ব্যানার ঝুলছে। ছবি: আজকের পত্রিকা।

এর আগে কাস্টমস ও আয়কর ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশন থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ‘রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ’র খসড়ায় কর্মকর্তাদের মতামত প্রতিফলিত হয়নি। বিভাগ দুটিতে কাস্টমস ও আয়কর ক্যাডারের জন্য পদ সংরক্ষিত না রেখে রাজস্বের কাজে অভিজ্ঞতা নেই এমন কর্মকর্তা পদায়নের সুযোগ রাখা হয়েছে। এতে একদিকে রাজস্ব ব্যবস্থাপনা কাজে অভিজ্ঞ নয় এমন কর্মকর্তা পদায়নের মাধ্যমে রাজস্ব প্রশাসনের দক্ষতা, গতিশীলতা এবং কার্যকারিতা বিঘ্নিত হবে, অন্যদিকে এনবিআরে কর্মরত দুটি ক্যাডারের কাজের ক্ষেত্র ও পদোন্নতির সুযোগ মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম আজকের পত্রিকাকে বলেন, এটা হওয়া উচিত ছিল এবং হয়েছে। তবে সরকারি প্রতিষ্ঠানে সুযোগও তৈরি হয় আবার সংকট সৃষ্টি হয়। সে ক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের উদ্বিগ্ন হওয়া স্বাভাবিক। তবে আশা করব, এই পরিবর্তনের ক্ষেত্রে রাজস্ব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরি, পদোন্নতি ও নতুন দুটি বিভাগের শীর্ষ পদে আসীন হওয়ার ক্ষেত্রে সংকট তৈরি না হয়, সে বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।

উল্লেখ্য, ১৯৯৩ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) এনবিআরকে নীতি ও প্রশাসন বিভাগে বিভক্ত করতে পরামর্শ দিয়েছিল। ২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বিশ্বব্যাংকও চাপ দিয়েছিল। কিন্তু তখন তা বেশি দূর এগোয়নি।

এর মধ্যে গত ৫ আগস্ট অভ্যুত্থানে ক্ষমতার পালাবদলের পর দেশের হাল ধরা অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যবস্থা সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। এরই অংশ হিসেবে এনবিআর সংস্কারে পাঁচ সদস্যের একটি পরামর্শক কমিটি গঠন করে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (আইআরডি)। এতে প্রশাসন ক্যাডার থেকে আসা এনবিআরের সাবেক দুই চেয়ারম্যান, শুল্ক ও আয়কর ক্যাডার থেকে আসা রাজস্ব নীতি প্রণয়ন ও আদায় বিভাগের দুজন সাবেক সদস্যকে এ কমিটিতে রাখা হয়।

গত ডিসেম্বরে ‘রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা’ নামে আলাদা বিভাগ করার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে এ কমিটি অর্থ উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়। তবে আলোচনা রয়েছে, সেই প্রতিবেদনে উল্লিখিত সুপারিশের সিংহভাগই গ্রহণ করা হয়নি ৷

আরও খবর পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

‘তুমি ঘুমাও কীভাবে’, সৌদি যুবরাজকে নিয়ে ট্রাম্পের বিস্ময়

ফরিদপুরে পালিয়ে যাওয়া আ.লীগ নেতা গ্রেপ্তার, থানার ওসিকে বদলি

বিদায় বিশ্বের দরিদ্রতম প্রেসিডেন্ট

সৌদি আরবের সঙ্গে ১৪২ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রির চুক্তি করে নিজের রেকর্ড ভাঙল যুক্তরাষ্ট্র

বিদ্যালয়ে সময় দেন না শিক্ষক, ইউএনওর কাছে অভিযোগ করায় সহকর্মীকে মারধর

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত