Ajker Patrika

রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘শ্রমিক দিনে সত্তরবার অপরাধ করলেও ক্ষমা করে দাও’

ড. মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন
আপডেট : ০২ মে ২০২৩, ০০: ৪৩
Thumbnail image

পৃথিবীর উন্নয়নে সবচেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক উপকরণটি হলো শ্রম। আর নিরলস শ্রমের পরাকাষ্ঠা যারা বহন করেন তাঁরাই শ্রমিক। ইসলামে শ্রমিকের অধিকার ও মর্যাদা যথাযথভাবে স্বীকৃত। ইবনে মাজাহর হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা.) ওফাতকালীন যে উপদেশ দিয়েছেন তা হলো, তোমরা নামাজ এবং অধীনস্থদের ব্যাপারে সাবধান থেকো। এখানে অধীনস্থ বলতে কাজের লোক বা শ্রমিক—যারা কারও অধীনে শ্রমের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আঞ্জাম দিয়ে থাকেন তাঁদের বোঝানো হয়েছে। 

শ্রমের গুরুত্ব সম্পর্কে একটি ঐতিহাসিক তথ্য খুবই প্রাসঙ্গিক। তা হলো, নবী-রাসুলগণের প্রায় সকলেই প্রত্যক্ষভাবে শ্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। মুসনাদে আহমদের হাদিস মতে, সব নবী-রাসুলই মেষ চড়িয়েছেন; এমনকি শ্রেষ্ঠ নবী ও রাসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.) নিজেও মেষ চড়াতেন। শ্রমের অনেক ফজিলতের কথাও হাদিসে এসেছে। বুখারির হাদিস মতে, কারও কাছে হাত পাতার চেয়ে কারও বোঝা বহন করে রোজগার করা উত্তম। কেউ কিছু দিক আর না দিক, কারও কাছে কিছু চাওয়ার চেয়ে নিজ পিঠে করে কাঠের বোঝা নিয়ে বাজারে বিক্রি করা অনেক ভালো। এখানেও সেই শ্রমেরই গুরুত্ব ফুটে ওঠে। বিখ্যাত বুজুর্গ ও ইসলামি পণ্ডিতেরা নিজেদের নামের সঙ্গে আত্তার বা আতর ব্যবসায়ী, খাব্বাজ বা রুটি ব্যবসায়ী, কাত্তান বা তুলা উৎপাদনকারী প্রভৃতি পেশাভিত্তিক উপাধি ধারণ করতে দ্বিধাবোধ করেননি। 

আবু দাউদের হাদিস মতে, যে ব্যক্তি আয়-রোজগারের জন্য শ্রম ব্যয় করবে সে যেন আল্লাহর পথে জিহাদে রত রয়েছে। কেউ যদি তার সন্তান বা স্ত্রী অথবা বাবা-মায়ের জীবিকা নির্বাহের জন্য কোনো কাজে লিপ্ত থাকে তবে সে নিঃসন্দেহে আল্লাহর পথেই বিচরণ করছে। তাবরানির হাদিস মতে, ক্লান্ত-শ্রান্ত অবস্থায় যে শ্রমিক সন্ধ্যাযাপন করল, সে নিঃসন্দেহে যাবতীয় অপরাধ থেকে ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়ে সন্ধ্যা অতিক্রম করল। একজন শ্রমিকের জন্য এটি সর্বোত্তম এক প্রণোদনা—যা ইসলাম তাকে দিয়েছে। 

হজরত মুহাম্মদ (সা.) নিজেকে শ্রমিক শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত করে পৃথিবীর সকল শ্রমিককে ধন্য ও মর্যাদাশীল করেছেন। তিনি তাঁর প্রিয়তমা কন্যা ফাতেমাকে একজন উত্তম শ্রমিকের কাছে পাত্রস্থ করেছিলেন; যিনি শিক্ষা ও বীরত্বের দিক থেকেও ছিলেন সমান পারদর্শী। হজরত আলি (রা.) নিজে জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম হিসেবে শ্রমিকের জীবন বেছে নিয়েছিলেন। রাসুল (সা.)-এর সবচেয়ে প্রিয় সাহাবি হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) ছিলেন কাপড়ের ব্যবসায়ী, আল্লাহর নবী দাউদ (আ.) নিজেই শ্রমের বিনিময়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। রাসুলের (সা.) ঘোষণা—সর্বোত্তম খাবার সেটিই, যা নিজের হাতে উপার্জিত। বুখারির ভাষ্যমতে, রাসুল (সা.) কিয়ামতের দিন যাদের প্রতিপক্ষ হবেন তাদের মধ্যে এক শ্রেণি হলো—যারা শ্রমিক নিয়োগ করবে এবং শ্রমিকের মাধ্যমে ষোলো আনা কার্যসিদ্ধি করে নেবে কিন্তু শ্রমিককে তার প্রাপ্য মজুরি দেবে না। রাসুল (সা.) যার বা যাদের প্রতিপক্ষ হিসেবে নিজেকে সাব্যস্ত করবেন তাদের অবস্থা বা পরিণতি কতটা ভয়াবহ হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। 

এখানে সাহাবি হজরত আবু মাসউদ (রা.)-এর জীবনের একটি ঘটনার অবতারণা করতে পারি। মুসলিম শরিফে বিবৃত আছে, আবু মাসউদ একদিন তাঁর এক ক্রীতদাসের গায়ে হাত তোলেন, তাকে মারধর করেন। এরই মধ্যে তিনি শুনতে পান, ‘হে আবু মাসউদ, তোমার ক্রীতদাসের ওপর তোমার যতটা ক্ষমতা আর প্রভাব রয়েছে, তোমার ওপরে তোমার প্রভুর তার চেয়েও বেশি ক্ষমতা ও প্রভাব রয়েছে।’ মাসউদ (রা.) পেছন ফিরে দেখেন তিনি আর কেউ নন; তিনি হচ্ছেন মানবতার পরম সুহৃদ দয়ার নবী মুহাম্মদ (সা.)। মাসউদ (রা.) খুবই লজ্জিত হলেন এবং অধীনস্থ শ্রমিককে মুক্ত করে দিলেন। দয়াল নবী (সা.) বললেন, ‘তুমি যদি একে মুক্ত না করতে, তবে তুমি নিশ্চিতভাবে জাহান্নামের আগুনে জ্বলতে।’ 

আবু দাউদ শরিফের হাদিস মতে, শ্রমিকের কোনো অপরাধ হলে তা ক্ষমা করে দিতে হবে। এক সাহাবি জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘হে রাসুল, শ্রমিকের অপরাধ কয়বার ক্ষমা করব?’ রাসুল (সা.) চুপ থাকলেন। আবারও তাঁকে প্রশ্ন করা হলো, রাসুল (সা.) আবারও চুপ থাকলেন। তৃতীয়বার যখন জিজ্ঞেস করা হলো যে, ‘শ্রমিককে কয়বার মাফ করব?’ রাসুল (সা.) তখন গাম্ভীর্যের সঙ্গে ঘোষণা করলেন, ‘শ্রমিক যদি দিনে সত্তরবারও অপরাধ করে তবে প্রতিবারই তাকে ক্ষমা করে দাও।’ 

পাশাপাশি রাসুল (সা.) শ্রমিকের ব্যাপারেও সতর্কবার্তা দিয়েছেন যে, শ্রমিক যেন তার মালিকের কাজে কোনো ফাঁকি না দেয়। বরং রাসুল (সা.) বলেন, ‘সেই শ্রমিক উত্তম, যে তার মালিকের কাজটি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করে থাকে।’ তিনি আরও বলেন, ‘যে শ্রমিক তার মালিকের হক আদায় করবে এবং আল্লাহর হকও আদায় করবে, মহান আল্লাহ তাকে দ্বিগুণ পুরস্কার দেবেন। কাজে ফাঁকি দিয়ে অথবা শুধু হাজিরা দিয়ে কাজ না করে যে শ্রমিক মজুরি গ্রহণ করবে, সে নিঃসন্দেহে গর্হিত কাজ করল; এ জন্য তার জবাবদিহি করতে হবে এবং কিয়ামতের দিন তাকে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে।’ 

শ্রম এবং শ্রমিকের ব্যাপারে মহানবী (সা.)-এর সবচেয়ে তাৎপর্যমণ্ডিত ঘোষণাটি হলো, ‘শ্রমিক মহান আল্লাহর বন্ধু।’ আমরা রাসুল (সা.)-কে জানি আল্লাহর বন্ধু হিসেবে। অথচ মহানবী (সা.) একজন শ্রমিককে তার শ্রমের মর্যাদা ও গুরুত্ব প্রদান করতে গিয়ে তাকে আল্লাহর বন্ধু হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। রাসুল (সা.)-এর অপর তাগিদটি হলো শ্রমিকের প্রাপ্য নিয়ে। তিনি বলেন, ‘শ্রমিকের গায়ের ঘাম শুকানোর আগেই তার প্রাপ্য মজুরি পরিশোধ করে দাও।’ 

মহানবী (সা.)-এর উল্লিখিত দুটি বাণীতে শ্রম ও শ্রমিকের অধিকার ও মর্যাদার বিষয়টি অভূতপূর্ব স্বীকৃতি পেয়েছে। পবিত্র কোরআনের বাণী অনুযায়ী ইসলামের অন্যতম মূলনীতি হচ্ছে, মহান আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যাতীত দায়িত্ব চাপিয়ে দেন না। সুতরাং শ্রম-ঘণ্টা তথা শ্রমিকের কাজের সময়সীমার ব্যাপারেও সংশ্লিষ্টদের সচেতন থাকার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কোনোমতেই অধিক পরিশ্রম বা অধিক সময়ের শ্রম কারও ওপরে চাপিয়ে দেওয়া ইসলামসম্মত নয়। 

কোরআনে কারিমে শ্রমকে মানুষের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। সুরা বালাদের ৪ নম্বর আয়াতে এরশাদ হচ্ছে—‘সুনিশ্চিতভাবে আমি মানুষকে শ্রম নির্ভররূপে সৃষ্টি করেছি।’ এই শ্রম নির্ভরতা বা শ্রমিকের বৈশিষ্ট্য পৃথিবীর সব মানুষের মধ্যেই রয়েছে। সুতরাং শ্রম এবং শ্রমিকের পেশাটি একটি সর্বজনীন রূপ নেয়। এ কারণে যেকোনো শ্রমকেই আমাদের গুরুত্ব দেওয়া উচিত এবং শ্রমিকের মর্যাদা ও অধিকার সুরক্ষায় সম্ভাব্য সকল প্রচেষ্টাই একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ জাতি-রাষ্ট্রের এক অনিবার্য অনুষঙ্গ হওয়া চাই। 

লেখক: অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত