Ajker Patrika

আধুনিক আরবি ক্যালিগ্রাফির পথিকৃৎ এল সাইদ

এল সাইদ একালের সবচেয়ে প্রভাবশালী আরবি ক্যালিগ্রাফি শিল্পীদের একজন। আরবি ক্যালিগ্রাফির প্রথাগত ধারা ভেঙে মুক্ত হস্তশৈলীকে বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় করতে বড় অবদান রাখছেন। তাঁর অনন্য শিল্পকর্মগুলো বিশ্বের সামনে আরবি ভাষাকে মানবিকতার ভাষ্যকার রূপে প্রতিষ্ঠিত করছে। ভাষিক গণ্ডির খোলস ছেড়ে আরবি অক্ষর বিশ্বজনীন হয়ে উঠছে তাঁরই জাদুকরি ছোঁয়ায়। তাঁর কাজের চুম্বকাংশ তুলে ধরেছেন ইজাজুল হক।

ইজাজুল হক
এল সাইদ। ছবি: সংগৃহীত
এল সাইদ। ছবি: সংগৃহীত

বেড়ে ওঠা

এল সাইদের জন্ম প্যারিসে, ১৯৮১ সালে। মা-বাবা দুজনই আরব তিউনিশিয়ান। ছোটকাল থেকেই আঁকাআঁকির প্রতি ঝোঁক ছিল। ফরাসি মাধ্যমে পড়াশোনা করেন এবং প্যারিসের বিভিন্ন আর্ট স্কুলে নিজেকে সমৃদ্ধ করেন। পারিবারিক পরিবেশে তিউনিশিয়ান আঞ্চলিক আরবিতে কথা বলা শিখলেও ১৮ বছর পর্যন্ত প্রমিত আরবির সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল না। পরে নিজের শিকড় খুঁজতে গিয়ে আরবি ক্যালিগ্রাফির দিকে ঝোঁকেন। প্রাথমিক সময়ে প্রথাগত ক্যালিগ্রাফি চর্চা করলেও পরে নিজেকে সেই বেষ্টনীতে আটকে রাখতে পারেননি। শুরু করেন প্রথা ভাঙার কাজ।

প্রথাভাঙা শৈলীর যাত্রা

আরবি ক্যালিগ্রাফির প্রথাগত ধারায় যেসব শৈলী চর্চিত হয়, সেগুলোর কিছু নির্দিষ্ট নিয়মকানুন রয়েছে। ইসলামের প্রথম যুগ থেকেই কোরআন লিপিবদ্ধ করাকে কেন্দ্র করে আরবি অক্ষরশিল্প বিকশিত হতে থাকে। বিগত ১৪০০ বছর ধরে আরব বিশ্বে অনেক খত্ব বা অক্ষরশৈলী তৈরি হয়েছে। এসব খত্বে ক্যালিগ্রাফি চর্চাকারী শিল্পীর সংখ্যাও বিপুল। তবে আধুনিক শিল্পকলা সম্পর্কে জ্ঞান রাখা এল সাইদ দীর্ঘ চর্চার মধ্য দিয়ে সেই ধরাবাঁধা নিয়ম ভেঙে নতুন শৈলী গড়ে তোলেন, যা বিশ্বজুড়ে মুক্ত হস্তশৈলী নামে পরিচিত। এতে কোনো নিয়মকানুন নেই, যে অক্ষরটি যেভাবে করলে শিল্পীর মন সন্তুষ্ট হয়, সেভাবেই শিল্পী সাজাতে পারেন। এই ধারা বর্তমানে বেশ জনপ্রিয় হচ্ছে।

তাঁর শিল্পকর্মের ধরন

এল সাইদ ক্যালিগ্রাফিকে আর্টবোর্ড ও ক্যানভাস থেকে মুক্ত পরিসরে নিয়ে গেছেন। আরবি অক্ষরকে মুক্তভাবে বিশ্বমননের কাছে নিয়ে যাওয়াই তাঁর লক্ষ্যে পরিণত হয়। ফলে প্রথম প্রথম বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে আরবি অক্ষরের গ্রাফিতি করতে শুরু করেন। পরে তা ম্যুরাল ও ভাস্কর্যেও গড়ায়। এখন এল সাইদ একজন চিত্রকলা ও ভাস্কর্যের নিবেদিত শিল্পী। তিনি আরবি অক্ষরকে ক্যালিগ্রাফির ঐতিহ্যগত ধারার অনুপ্রেরণা নিয়ে আধুনিক শিল্পকলার মধ্য দিয়ে বিকশিত করে যাচ্ছেন। স্থান নির্বাচন, রং ও কম্পোজিশনের নান্দনিকতায় এল সাইদ নিজেই নিজের উদাহরণ। এ ছাড়া তাঁর প্রতিটি শিল্পকর্ম ঐক্য, শান্তি, সহাবস্থান ও স্বাধীনতার পক্ষে জোরালো বার্তা দেয়। বিশ্বের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে আরবি ভাষাকে মানবিকতার আহ্বানে উচ্চকিত করছে এসব কাজ।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রাণকেন্দ্র দুবাই অপেরায় ক্যালিগ্রাফিক ম্যুরাল ‘ডিক্লারেশন’। ছবি: সংগৃহীত
সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রাণকেন্দ্র দুবাই অপেরায় ক্যালিগ্রাফিক ম্যুরাল ‘ডিক্লারেশন’। ছবি: সংগৃহীত

উল্লেখযোগ্য কাজ

এল সাইদ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ক্যালিগ্রাফি, ক্যালিগ্রাফিতি, ভাস্কর্য ও ম্যুরাল তৈরি করেছেন। বড় আকারে ক্যালিগ্রাফিতি করার ধারণা তিনিই প্রথম দিয়েছেন। এখন পর্যন্ত তিনি তিউনিশিয়া, কানাডা, ব্রাজিল, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, দক্ষিণ আফ্রিকা, নেপাল, দক্ষিণ কোরিয়াসহ অনেক দেশে নিজেকে প্রমাণ করেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে—

পারসেপশন: এটি সম্ভবত বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্যালিগ্রাফিতি। মিসরের কায়রোর মানশিয়াত নাসর নামক স্থানে এটি আঁকা হয়। মূলত এটি হলো শহরের আবর্জনা সংগ্রহকারী খ্রিষ্টানদের একটি সম্প্রদায়ের বসতি। জায়গাটি ভীষণ নোংরা ও অবহেলিত। ভাঙাচোরা ভবনে ঠাসা। সেখানে আলো ফেলতেই বড় বড় ৫০টি ভবনজুড়ে আঁকেন একটি রঙিন আরবি বাণী, যা কায়রোর মোকাত্তাম পর্বতের একটি পয়েন্ট থেকে পুরোপুরি দেখা যায়। তাতে লেখা আছে, ‘যে ব্যক্তি সূর্যের আলো স্পষ্ট করে দেখতে চায়, তাকে প্রথমে নিজের চোখ মুছে নিতে হবে।’

ব্রিজ: উত্তর কোরিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়ার মাঝে একটি নিরপেক্ষ অঞ্চল আছে, যাকে ডিএমজেড বলা হয়। সেখানে কাঁটাতারের পাশে স্টেইনলেস স্টিল দিয়ে দীর্ঘ এক ক্যালিগ্রাফিক ম্যুরাল তৈরি করেছেন এল সাইদ। এক অবিভক্ত কোরিয়ান কবির কয়েকটি পঙ্‌ক্তির আরবি অনুবাদের মাধ্যমে দুই কোরিয়াকে শান্তির বার্তা দেওয়া হয়েছে।

ডিক্লারেশন: এই ক্যালিগ্রাফিক ম্যুরাল সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রাণকেন্দ্র দুবাই অপেরার সৌন্দর্য বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। নিজার কাব্বানির একটি ভালোবাসার কবিতা রঙিন থ্রি-ডি ম্যুরালে এখানে জীবন্ত হয়ে ধরা দেয়।

মিরাজ আল-উলা: সৌদি আরবে গড়ে ওঠা নতুন পর্যটনকেন্দ্র আল-উলায় তৈরি হয়েছে এই ভাস্কর্য। মরুর বালুর রঙের সঙ্গে মিল রেকে প্যাঁচানো আরবি শব্দের বুননে গোল করে তৈরি এই শিল্পকর্ম আল-উলার সৌন্দর্য বাড়িয়েছে। আরব পুরাণের একটি প্রেমের পঙ্‌ক্তি দিয়ে এটি সাজানো হয়।

মিসরের কায়রোর মানশিয়াত নাসরে ৫০টি ভবনজুড়ে আঁকা ক্যালিগ্রাফিতি ‘পারসেপশন’। ছবি: সংগৃহীত
মিসরের কায়রোর মানশিয়াত নাসরে ৫০টি ভবনজুড়ে আঁকা ক্যালিগ্রাফিতি ‘পারসেপশন’। ছবি: সংগৃহীত

এ ছাড়া এল সাইদের ক্যালিগ্রাফি নিউইয়র্কের মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অব আর্ট, ভার্জিনিয়ার ক্রাইসলার মিউজিয়াম অব আর্ট, ল্যুভর মিউজিয়াম আবুধাবিসহ বিশ্বখ্যাত বহু শিল্প জাদুঘরের সংগ্রহশালায় স্থান পেয়েছে।

স্বীকৃতি ও সম্মাননা

২০১৩ সালে এল সাইদ দুবাইয়ের রাজপরিবারের আমন্ত্রণে দুবাই চলে আসেন এবং সেখানকার একাধিক প্রজেক্টে যুক্ত হন। পরে তিনি দুবাইয়ে নিজের অফিস ও স্টুডিও প্রতিষ্ঠা করে কার্যক্রম চালাতে শুরু করেন এবং সেখানেই থিতু হন। ২০১৫ সালে তিনি মার্কিন প্রভাবশালী মিডিয়া টিইডির ফেলো ও ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর মনোনীত হন। কায়রোতে করা ক্যালিগ্রাফিতি ‘পারসেপশন’-এর জন্য তিনি অসংখ্য স্বীকৃতি লাভ করেন। বিশেষ করে ২০১৬ সালে ফরেন পলিসি ম্যাগাজিন কর্তৃক বৈশ্বিক চিন্তাবিদ স্বীকৃতি পান, ২০১৭ সালে ইউনেসকো শারজাহ প্রাইস ফর আরব কালচার এবং ২০১৯ সালে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড ফর পাবলিক আর্ট লাভ করেন। সর্বশেষ ২০২১ সালে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের তরুণ বিশ্বনেতাদের একজন মনোনীত হন। এ ছাড়া বিশ্বের বহু আর্ট প্ল্যাটফর্মে তাঁকে সম্মানিত করা হয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ডিএনসিসির পদ ছাড়লেন এস্তোনিয়ার নাগরিক আমিনুল ইসলাম

ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিল নিয়ে ভারতের সঙ্গে উত্তেজনা, চ্যালেঞ্জের মুখে বাংলাদেশ

এনআইডির নাম ও জন্মতারিখ সংশোধনের দায়িত্বে জেলা নির্বাচন কর্মকর্তারা

পদত্যাগ করব না, আলোচনা করে সমাধান করব: কুয়েট উপাচার্য

কাশ্মীরে পর্যটকদের ওপর অতর্কিত গুলি, নিহত ২৬

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত