Ajker Patrika

‘মনে হচ্ছে দুনিয়া আমাদের ভুলে গেছে’, গাজার বাসিন্দাদের আকুতি

অনলাইন ডেস্ক
গাজা এখন এক ভয়াবহ খাদ্য সংকটের মুখোমুখি। ছবি: আনাদোলু
গাজা এখন এক ভয়াবহ খাদ্য সংকটের মুখোমুখি। ছবি: আনাদোলু

ধুলোমাখা মেঝেতে বসে চিৎকার করে কাঁদছে ছোট্ট একটি মেয়ে, বিসান কুয়াইদার। ছোট ছোট হাতে বুকে জড়িয়ে ধরা তাঁর বাবার এক জোড়া জুতো। বিসানকে কিছুতেই শান্ত করা যাচ্ছে না। বাবাকে হারিয়েছে সে। বিসান ও তার ১০ ক্ষুধার্ত ভাইবোনের জন্য খাবার জোগাড় করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন বাবা, শাদি কুয়াইদার।

বিসানের কান্নার স্থির দৃশ্য ধারণ করেছিলেন ফটোসাংবাদিক খালেদ শা’আথ। তিনি সিএনএনকে বলেন, বিসানের বাবা শাদি কুয়াইদার কয়েক দিন আগে খাবারের খোঁজে দক্ষিণ গাজার মাওয়াসিতে তাঁদের তাবু থেকে খান ইউনিসের কাছাকাছি মা’আন এলাকায় গিয়েছিলেন।

শাদি জানতেন এই যাত্রা বিপজ্জনক কারণ মা’আন এলাকাটি ইসরায়েলিদের চিহ্নিত এলাকার মধ্যে ছিল। সেখানে ক্রমাগত বোমা ফেলা হচ্ছিল। সব ঝুঁকি জেনেও শাদি বের হয়েছিলেন সন্তানদের ক্ষুধায় কষ্ট পাওয়া সহ্য করতে না পেরে। আশা করছিলেন, সেখানে গিয়ে হয়তো কিছু খাবার নিয়ে ফিরতে পারবেন।

মা’আনের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)-এর কাছে প্রশ্ন করেছিল সিএনএন। জবাবে আইডিএফ গাজার একটি মানচিত্র পাঠায়, যেখানে ‘বিপজ্জনক যুদ্ধক্ষেত্র’ হিসেবে লাল রঙে চিহ্নিত ছিল এলাকায় মা’আনও ছিল।

শা’আথ জানান, শাদি কুয়াইদার ইসরায়েলের এক বিমান হামলায় নিহত হন। গত রোববার ধ্বংসস্তূপ থেকে তাঁর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। গাজা স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের মতে, সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে খাবারের খোঁজে বেরিয়ে শাদি কুয়াইদারের মতো শত শত মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন।

গাজা এখন এক ভয়াবহ খাদ্য সংকটের মুখোমুখি। এপ্রিলের শেষদিকে প্রকাশিত জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলা হয়, গাজার প্রতি পাঁচজনের একজন চরম ক্ষুধার্ত অবস্থায় আছে এবং পুরো উপত্যকা দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে। সেই পরিস্থিতি তখন থেকে আরও খারাপ হয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ।

কিন্তু এখন ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে উত্তেজনা আরও বেড়ে যাওয়ায় গাজার মানুষ আশঙ্কা করছেন, তাদের কষ্ট নিয়ে ইসরায়েলের ওপর যে সামান্য আন্তর্জাতিক চাপ ছিল, তাও দ্রুত হারিয়ে যাবে।

গাজার বাসিন্দা মোহাম্মদ বলেন, ‘ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ শুরুর পর মানুষ যেন আমাদের পুরোপুরি ভুলে গেছে। কেউ আমাদের দিকে তাকাচ্ছে না। খাবার নেই, পানি নেই, কিছুই নেই। প্রতিদিন লোকজন খাবার আর সাহায্যের জন্য বের হয়, আর শেষমেশ তাঁদের মরদেহ ব্যাগে করে ফেরত আসে।’

ইরান-ইসরায়েল সংঘাত বাড়ার ফলে গাজার দুর্দশা এখন আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম থেকেও হারিয়ে গেছে বলে মন্তব্য করেন আরেক গাজাবাসী উম্মে মুস্তাফা।

উম্মে মুস্তাফা বলেন, ‘সব মনোযোগ চলে গেছে ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধের দিকে, অথচ গাজা তো একপ্রকার মানচিত্র থেকেই মুছে গেছে।’

গাজার আরেক বাসিন্দা আবু জুমা’আ বলেন, ‘গাজার জন্য কিছু মানুষ এখনো সমবেদনা প্রকাশ করছেন, মানবিক সহায়তা প্রবেশের আহ্বান জানাচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধের কারণে এখন আর কেউ গাজায় খাবার ও পানির সরবরাহ নিশ্চিত করার দাবি তুলছে না।’

প্রতি ৪০ জনে একজনের মৃত্যু

গাজার স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত গাজায় ৫৫ হাজার ৩০০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন ১ লাখ ২৮ হাজার ৭০০ জনেরও বেশি।

নিহতের সংখ্যা গাজার মোট জনসংখ্যার প্রায় ২ দশমিক ৫ শতাংশ। অর্থাৎ, যুদ্ধের আগে গাজায় বসবাসকারী প্রতি ৪০ জন ফিলিস্তিনির মধ্যে একজন এখন মৃত। চলতি বছরের শুরুতে ল্যানসেট জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রকৃত মৃতের সংখ্যা গাজার স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের দেওয়া সংখ্যার চেয়েও অনেক বেশি হতে পারে।

এদিকে প্রাণঘাতী খাদ্য সংকট আরও গুরুতর হয়ে উঠছে। আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কমিটি গতকাল সোমবার জানিয়েছে, ইসরায়েলের নানা নিষেধাজ্ঞার কারণে গাজায় খাবার ও ওষুধের মতো মৌলিক চাহিদার পণ্যগুলো প্রবেশ করানো কঠিন হয়ে পড়েছে। এর ফলে সাধারণ মানুষ বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসও পাচ্ছেন না।

মে মাসের শেষ দিকে, ইসরায়েল ১১ সপ্তাহ ধরে চলা সম্পূর্ণ অবরোধ কিছুটা শিথিল করলেও মানবিক সংস্থাগুলো বলছে, এখন যে সহায়তা গাজায় ঢুকছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য।

জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা সমন্বয় দপ্তর (ওসিএইচএ) গত সপ্তাহে জানায়, ইসরায়েল জাতিসংঘের কিছু সংস্থা ও আন্তর্জাতিক কিছু এনজিওকে গাজায় ত্রাণ সরবরাহের অনুমতি দিলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। তাদের সীমিত পরিমাণ খাবার, পুষ্টি সহায়তা, কিছু ওষুধ ও পানি বিশুদ্ধকরণ উপকরণ নিয়ে যেতে দেওয়া হচ্ছে। তাঁবু, স্যানিটারি সামগ্রী ও চিকিৎসা সরঞ্জামের মতো ত্রাণসামগ্রী এখনো ইসরায়েল আটকে রেখেছে।

গত সপ্তাহে জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা প্রধান টম ফ্লেচার বলেন, ‘জীবনধারণের মৌলিক চাহিদাগুলোতে অবিলম্বে এবং ব্যাপকভাবে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত না করা হলে, গাজা দুর্ভিক্ষের দিকে ধাবিত হতে পারে, নেমে আসতে পারে আরও বিশৃঙ্খলা, আর প্রাণ হারাতে হতে পারে আরও অনেককে।’

এদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল সমর্থিত বিতর্কিত ত্রাণ কার্যক্রম গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) চালিত ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রগুলোতে মে মাসের শেষ থেকে অন্তত ৩০০ জন মানুষ নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে গাজা স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ।

গাজার বাসিন্দা আবু মোহাম্মদ বলেন, ‘মানুষ খাওয়ার মতো কিছুই পাচ্ছে না। এক বস্তা ময়দার দাম এখন আগের চেয়ে ৩০০ থেকে ৫০০ গুণ বেশি...সত্যিই মনে হচ্ছে বিশ্ব আমাদের ভুলে গেছে।’

আর ছোট্ট বিসান কুয়াইদা, যার বাবা খাবার আনতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন, তার কাছে বাবার একমাত্র রেখে যাওয়া জিনিসটি ছিল এক জোড়া জুতো। জুতোজোড়া বুকে ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে গাজার ছোট্ট শিশু বিসান সৃষ্টিকর্তার কাছে বিচার দিচ্ছিল তাদের নামে, যারা তার বাবার মৃত্যুর জন্য দায়ী। বিসান কাঁদছিল আর বলছিল, ‘আল্লাহ তোমাদের বিচার করুক।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

রাস্তায় নারীকে চড় মেরে বাইকচালক বললেন, ‘নিজের দেশে ফিরে যাও!’

ইরানের জন্য ইসরায়েলকে বিসর্জন দেবে রাশিয়া?

নেতানিয়াহু বাংকারে লুকিয়ে, ট্রাম্পের একটি ফোনকলই যথেষ্ট: ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী

ইরানের ভান্ডারে কত ক্ষেপণাস্ত্র আছে—কত দিন যুদ্ধ চলবে এতে

মেয়াদের মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয় চালুর পরিকল্পনা সরকারের

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত