Ajker Patrika

বিজ্ঞানীদের সতর্কবার্তায় কান দেয়নি ভারত সরকার

আপডেট : ০২ মে ২০২১, ১৬: ৪৮
বিজ্ঞানীদের সতর্কবার্তায় কান দেয়নি ভারত সরকার

ঢাকা: করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে বিপর্যস্ত ভারত। দেশটিতে দৈনিক লাফিয়ে বাড়ছে শনাক্ত ও মৃতের সংখ্যা। বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলছে, করোনাভাইরাসের অতি সংক্রামক নতুন ধরন নিয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের গঠন করা একটি ফোরাম আগেই সতর্কবার্তা দিয়েছিল। কিন্তু তা কানে নেয়নি সরকার। ওই ফোরামের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পাঁচ জন্য বিজ্ঞানী রয়টার্সকে এমনটি জানিয়েছেন।

চারজন বিজ্ঞানী জানিয়েছেন, সতর্কবার্তা সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়নি। লাখ লাখ মানুষ মাস্ক ছাড়াই ধর্মীয় উৎসবে অংশ নিয়েছেন। সেই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির রাজনৈতিক সমাবেশেও স্বাস্থ্যবিধি না মেনে বিপুল মানুষ অংশ নিয়েছেন। দিল্লির চারপাশে দশ হাজারের বেশি কৃষক ক্যাম্প করে সরকারের সংশোধিত কৃষি আইন রদের দাবিতে অবস্থান করেছিলেন।

২০১৪ সালে প্রথম ক্ষমতায় আসার পর এই প্রথম বড় দুর্যোগের মধ্যে পড়েছে মোদি সরকার। ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে এ সংকটের প্রভাব পড়বে বলেও ধারণা করছেন অনেকে।

করোনা সংক্রমণের গতিবিধি চিহ্নিত করা এবং পরামর্শের জন্য গত ডিসেম্বরে কেন্দ্রীয় সরকার ইন্ডিয়ান সার্স-কোভ-২ জেনেটিকস কনসোর্টিয়াম বা আইএনএসএসিওজি নামে একটি উচ্চ পর্যায়ের ফোরাম গঠন করে। ফোরামের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বিজ্ঞানী মার্চের শুরুতেই সম্ভাব্য ভয়ংকর বিপর্যয়ের বিষয়ে কেন্দ্র সরকারের একজন কর্মকর্তাকে সতর্ক করেছিলেন। তবে সেই বার্তা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে পৌঁছেছিল কিনা, তা নিশ্চিত নয়।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির শুরুতেই বিজ্ঞানীরা প্রথম করোনার ভারতীয় ধরন (বি.১.৬১৭) শনাক্ত করতে সক্ষম হন বলে জানান আইএনএসএসিওজির সদস্য অজয় পারিদা। তিনি ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত ইনস্টিটিউট অব লাইফ সায়েন্সের পরিচালকের দায়িত্বেও রয়েছেন। 

নর্দার্ন ইন্ডিয়ান রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক রয়টার্স জানিয়েছেন, ১০ মার্চের আগেই আইএনএসএসিওজি তার অনুসন্ধানের ফল ও সুপারিশ কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ন্যাশনাল সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোলে (এনসিডিসি) পৌঁছে দিয়েছিল। পরে তা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। একই সময়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হয়ে একটি খসড়া বিজ্ঞপ্তি তৈরি করে আইএনএসএসিওজি। রয়টার্সের হাতে ওই খসড়ার একটি কপি রয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, মহারাষ্ট্র থেকে সংগ্রহ করা ১৫ থেকে ২০ শতাংশ নমুনায় করোনার নতুন শনাক্ত হওয়া ভারতীয় ধরনের দুইবার মিউটেশনের প্রমাণ মিলেছে। যা অতি সংক্রামক ও খুবই উদ্বেগজনক।

ভারতীয় বিজ্ঞানীদের ওই পর্যবেক্ষণ মোদি সরকার প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করে দুই সপ্তাহ পরে, ২৪ মার্চ। তবে সরকারি বিবৃতিতে ‘উচ্চ উদ্বেগের’ বিষয়টি বলা হয়নি। এরপর কেন্দ্র সরকার করোনার পরীক্ষা বাড়ানো ও কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করার ওপর জোর দেয়।

আইএনএসএসিওজির সায়েন্টিফিক অ্যাডভাইজরি গ্রুপের চেয়ার শহীদ জামেল বলেন, ওইসময় ভারত সরকার করোনা সংক্রমণ রোধে নীতি প্রণয়নে বৈজ্ঞানিক তথ্য-প্রমাণের ওপর কম গুরুত্ব দিয়েছিল। এটা নিয়ে আমি বেশ উদ্বিগ্ন ছিলাম। বিজ্ঞানী হিসেবে আমাদের কাজ ছিল তথ্য-প্রমাণ হাজির করে সরকারকে সুপারিশ করা। আমরা সেটা করেছি।

নর্দার্ন ইন্ডিয়া রিসার্চ সেন্টারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, মার্চের শুরুতে বিজ্ঞানীদের সংগ্রহ করা যাবতীয় তথ্য-প্রমাণ ও সুপারিশ ভারতের মন্ত্রিপরিষদ সচিব রাজিব গুবের কাছে পাঠানো হয়েছিল। সরাসরি প্রধানমন্ত্রী মোদিকে এসব জানানোর দায়িত্ব ছিল তাঁর। তবে মোদি এসব জানতেন কিনা সেটি এখনো কেউ নিশ্চিত নন ।

রয়টার্সের পক্ষ থেকে বিষয়টি জানতে যোগাযোগ করা হলেও প্রতিক্রিয়া জানায়নি রাজিব গুবে ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর।

এ নিয়ে আইএনএসএসিওজি-এর অন্তর্গত ভারতের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োমেডিকেল জেনোমিক্সের পরিচালক সৌমিত্র দাস বলছেন, করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের বিষয়ে শুধু রাজনৈতিক নেতৃত্বকে দোষারোপ করার সুযোগ নেই। কেননা, এখন সংক্রমণ যে হারে ছড়াচ্ছে, তা অনেক বিজ্ঞানীও অনুমান করতে পারেননি।

গত ১৯ এপ্রিল ভারতের সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোলের পরিচালক সুজিত কুমার সিং একটি অনলাইন আয়োজনে এপ্রিলের শুরু থেকে কঠোর লকডাউন জারি করা প্রয়োজন ছিল বলে মন্তব্য করেছেন। এর আগে ১৫ এপ্রিল বৈঠকে বসেছিল কোভিড-১৯ বিষয়ক ভারতের জাতীয় টাস্কফোর্স। এ কমিটিতে ২১ জন বিশেষজ্ঞ ও সরকারি কর্মকর্তা রয়েছেন। সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন করোনাবিষয়ক ভারতের প্রধানমন্ত্রীর জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা ভি কে পাল। বৈঠকে অংশ নেওয়া একজন বিশেষজ্ঞ রয়টার্সকে জানিয়েছেন, করোনা সংক্রমণের বর্তমান পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ বলে টাস্কফোর্স সদস্যরা একমত হয়েছেন। সংক্রমণে লাগাম টানতে দেশজুড়ে লকডাউন আরোপের মতো কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে সরকারের সময় নেওয়া উচিত হবে না বলেও মত দিয়েছে টাস্কফোর্স।

ভারতের সেন্টার ফর সেলুলার অ্যান্ড মলিকুলার বায়োলজির পরিচালক রাকেশ মিশ্র আইএনএসএসিওজির সদস্য। তিনি বলেন, আমাদের বিজ্ঞানীরা বেশ ভালো কাজ করেছিলেন। কিন্তু সময়মতো তাদের সুপারিশ মানেনি কেন্দ্র সরকার।  ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত ইনস্টিটিউট অব কলেরা অ্যান্ড এন্টেরিক ডিজিসেসের বিজ্ঞানী শান্তা দত্ত আক্ষেপ করে বলেন, মানুষ বিজ্ঞানীদের চেয়ে রাজনীতিকদের কথা বেশি শোনে। আমরা এখন খুবই মারাত্মক পরিস্থিতিতে আছি।

তবে গত ২০ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি লকডাউন আরোপের বিপক্ষে তাঁর অবস্থানের কথা জানিয়ে দেন। তিনি বলেন, করোনার বিরুদ্ধে চলমান লড়াইয়ের সর্বশেষ অস্ত্র হওয়া উচিত লকডাউন।

ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ভারতে এ পর্যন্ত  ১ কোটি ৯৫ লাখ ৫৭ হাজার ৪৫৭ জন করোনা রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে মারা গেছেন ২ লাখ ১৫ হাজার ৫৪২ জন।

রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। অক্সিজেনের অভাবে মারা যাচ্ছেন অনেকে। বিভিন্ন রাজ্যে মরদেহ সৎকার নিয়েও তৈরি হয়েছে জটিলতা।

করোনায় বিপর্যস্ত ভারতের বিপদে পাশে দাঁড়াতে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন,  নিউজিল্যান্ড, ফ্রান্সসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত