Ajker Patrika

মাত্র এক সপ্তাহে রাশিয়াকে যেভাবে চমকে দিল ইউক্রেন

অনলাইন ডেস্ক
একটি রুশ বিমানঘাঁটিতে ইউক্রেনের ড্রোন হামলার চিত্র। ছবি: দ্য ইনডিপেনডেন্ট
একটি রুশ বিমানঘাঁটিতে ইউক্রেনের ড্রোন হামলার চিত্র। ছবি: দ্য ইনডিপেনডেন্ট

ইউক্রেনের নিরাপত্তা সংস্থার প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল ভাসিল মালিউক যখন প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির কাছে ‘অপারেশন স্পাইডারস ওয়েব’-এর পরিকল্পনা পেশ করেন, তখন অনেকের কাছেই তা রূপকথার মতোই মনে হয়েছিল। এই অপারেশনের লক্ষ্য ছিল, রাশিয়ার পাঁচটি বিমানঘাঁটিতে একযোগে আঘাত হানা। হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এসব ঘাঁটিগুলোর নিরাপত্তা বেষ্টনী আবার খুব কঠোর। এ ছাড়া রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের গর্বের কের্চ সেতু ও কিছু গুরুত্বপূর্ণ রেলপথ ছিল ইউক্রেনের সপ্তাহব্যাপী হামলার গৌণ লক্ষ্যবস্তু।

যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক দ্য টাইমস জানিয়েছে, ইউক্রেনের পরিকল্পনার পরিসর ছিল বিপুল। এই পরিকল্পনার অংশ ছিল ১১৭টি আত্মঘাতী ড্রোন, যেগুলো দূরবর্তী বিমানঘাঁটিগুলোতে আঘাত হানবে এবং এর নিয়ন্ত্রণে থাকবে এআই প্রযুক্তি ও হাতেকলমে কমান্ডের সমন্বয়। এ ক্ষেত্রে শনাক্ত না হয়ে ড্রোনগুলোকে লক্ষ্যবস্তুতে পৌঁছানোই ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

পরিকল্পনার সূক্ষ্মতা ও সাহস

রাশিয়ার সীমান্ত পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে এই অপারেশনের বাস্তবায়ন ছিল খুবই বিপজ্জনক। তবে ইউক্রেনের গুপ্তচরেরা কাঠের নকল কেবিন তৈরি করে সেগুলোর ভেতরে ড্রোন ও বিস্ফোরক লুকিয়ে পাঠাতে সক্ষম হন। ট্রাকের সঙ্গে যুক্ত কেবিনগুলোর ছাদে ছিল সৌর প্যানেলের। তবে এই সৌর প্যানেলের নিচেই রাখা ছিল ড্রোনগুলো। একটি রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্যে ছাদটি সরে গেলেই ড্রোনগুলো উন্মুক্ত হয়ে যায়।

রাশিয়ার বিশাল লজিস্টিকস ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে ইউক্রেনের এসবিইউ (সিকিউরিটি সার্ভিস অব ইউক্রেন) কিছু রুশ ট্রাকচালককে ব্যবহার করে কেবিনগুলো দেশটির ভেতরে পৌঁছে দেয়। পরে চেলিয়াবিনস্ক শহরের একটি গুদামে ড্রোনগুলো জোড়া লাগানো হয় এবং হামলার জন্য এগুলোকে প্রস্তুত করা হয়।

ড্রোন, এআই এবং যুদ্ধের নতুন বাস্তবতা

‘ফার্স্ট কনটাক্ট’ ও ‘নর্ডা ডায়নামিকস’-এর মতো ইউক্রেনের প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো মিলে নতুন ধরনের এআই চালিত ড্রোন তৈরি করেছে। এগুলো নিজেরাই টার্গেট শনাক্ত করে হামলা চালাতে পারে। এই এআইকে ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে সোভিয়েত যুগের বিমানের মডেল দিয়ে, যাতে এগুলো রাশিয়ার কৌশলগত বোমারু বিমান শনাক্ত করতে পারে।

এসব ড্রোনের বিস্ফোরক শক্তি স্বল্প হলেও নির্ভুলভাবে আঘাত হানার ক্ষমতা ছিল। ইন্টারনেটের মাধ্যমে রাশিয়ান মোবাইল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে ড্রোনগুলো পরিচালিত হয়েছে।

আঘাত ও প্রভাব

অপারেশনের সময় ড্রোনগুলো বোমারু বিমানগুলোর দুর্বল অংশ—যেমন ফুয়েল ট্যাংক বা রাডার ডোম—লক্ষ্য করে আঘাত হানে। ইভানোভো ঘাঁটিতে রাশিয়ার এ-৫০ ‘মেইনস্টে’ রাডার বিমানে আঘাত হানা হয়, যার মূল্য প্রায় ৩৫০ মিলিয়ন ডলার। এই বিমানগুলো রাশিয়ার আকাশসীমা নজরদারিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

ইউক্রেনের দাবি, তারা ৩৯টি রুশ বিমান ধ্বংস করেছে, যার মধ্যে রয়েছে টু-৯৫, টু-১৬০, টু-২২ এম ৩ এবং কিছু পরিবহন বিমান। তবে যুক্তরাষ্ট্র বলছে, প্রকৃত সংখ্যা ২০ টির মতো, যার মধ্যে সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে প্রায় ১০ টি।

সাহসী চর এবং অপারেশনের ‘ডিজে’ নায়ক

দুর্ধর্ষ এই হামলার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে উঠে এসেছে ৩৭ বছর বয়সী ইউক্রেনীয় নাগরিক আর্তেম টিমোফেইভের নাম। একসময় তিনি কিয়েভে ডিজে হিসেবে কাজ করতেন। চেলিয়াবিনস্কে তিনিই একটি কার্গো কোম্পানি খোলেন, যেখানে ট্রাক ব্যবহার করে ড্রোনবাহী কেবিন হামলার স্থানগুলোতে পাঠানো হয়। অভিযোগ রয়েছে, হামলার পর তিনি কাজাখস্তানে পালিয়ে গেছেন।

আক্রমণের ধারা অব্যাহত

বিমানঘাঁটিতে হামলার কয়েক দিনের মধ্যেই ইউক্রেন সমুদ্রপথে মাইন বসিয়ে কের্চ সেতুতে আরও একবার বিস্ফোরণ ঘটায়। এ ছাড়া রাশিয়ার দুটি রেলসেতুও ধ্বংস হয়, যেখানে সাতজন রুশ নাগরিক নিহত হন।

এমন পরিপ্রেক্ষিতে ঘটনাগুলোকে ‘সন্ত্রাসবাদ’ বলে অভিহিত করেন পুতিন।

ফলাফল ও ভবিষ্যৎ বার্তা

‘অপারেশন স্পাইডারস ওয়েব’ শুধু রাশিয়ার বিমান সক্ষমতায় আঘাতই করেনি, বরং ইউক্রেনের মনোবলে নতুন প্রাণ সঞ্চার করেছে। যুদ্ধ যখন অনিশ্চিত মোড় নিচ্ছিল, তখন এই সাফল্য যুদ্ধবিধ্বস্ত জাতিকে আবার জাগিয়ে তুলেছে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, এই অপারেশন প্রমাণ করেছে—উন্নত প্রযুক্তি, কৌশলী পরিকল্পনা আর অদম্য সাহস দিয়ে ছোট একটি দেশও একটি পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রের কৌশলগত শক্তিকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত