Ajker Patrika

চীনে পড়াশোনা ও চাকরিতে অভিজাতদের লবিং দৌরাত্ম্য, ইন্টারনেটে ঝড়

অনলাইন ডেস্ক
চীনের প্রভাবশালী অভিনেত্রী নাশির শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ ভুয়া। ছবি: ইনস্টাগ্রাম
চীনের প্রভাবশালী অভিনেত্রী নাশির শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ ভুয়া। ছবি: ইনস্টাগ্রাম

চীনের বিনোদন জগৎ থেকে শুরু করে চিকিৎসা ক্ষেত্র পর্যন্ত বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিশেষাধিকার অপব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে জনরোষ ক্রমেই বাড়ছে। সম্প্রতি একাধিক ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র সমালোচনার ঝড় উঠেছে এবং কর্তৃপক্ষ জনমতের চাপের মুখে তদন্ত শুরু করতে বাধ্য হয়েছে। ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব এবং মন্থর অর্থনীতির কারণে চীনা তরুণদের মধ্যে এই ক্ষোভ আরও তীব্র হচ্ছে বলে বিশ্লেষকেরা মনে করছেন।

চলতি বছরটা ছিল চীনা অভিনেত্রী নাশির জন্য এক যুগান্তকারী বছর। দুটি ব্লকবাস্টার চলচ্চিত্র এবং একটি বহু প্রতীক্ষিত টিভি নাটকে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি।

কিন্তু জুনে, ৩৫ বছর বয়সী এই তারকার এক দশকেরও বেশি আগেকার পরীক্ষার ফল নিয়ে বিতর্ক শুরু হলে অনলাইনে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। শেষ পর্যন্ত তাঁর শিক্ষাগত রেকর্ড নিয়ে একটি সরকারি তদন্ত শুরু হয়। এর ফলস্বরূপ, ‘লাইচিস ইন চাং’আন’ নাটকে অভিনয়ের সুযোগ হারান। বিভিন্ন ব্র্যান্ড চুক্তি বাতিল করেছে।

নাশির বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো, তিনি তাঁর অভিনেত্রী মায়ের প্রভাব খাটিয়ে একটি মর্যাদাপূর্ণ নাট্যস্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। যদিও কর্মকর্তারা পরে স্পষ্ট করেন যে তাঁর পরীক্ষার স্কোর অনেক বেশি ছিল। তবুও জনমনে অসন্তোষ প্রশমিত হয়নি।

এই ধারাবাহিক কেলেঙ্কারির শুরু হয়েছিল গত এপ্রিলে, যখন বেইজিংয়ের একটি শীর্ষস্থানীয় হাসপাতালের দুই চিকিৎসক জিয়াও এবং ডং, কথিত প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে জাতীয় বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন।

জিয়াও-এর স্ত্রী তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন যে তিনি কর্মক্ষেত্রে ডংকে অন্যায়ভাবে সুবিধা দিচ্ছেন। এর মধ্যে একটি গুরুতর অভিযোগ হলো, এক নার্সের সঙ্গে ডং-এর ঝগড়া মেটাতে তিনি রোগীকে অপারেশন টেবিলে অচেতন অবস্থায় ৪০ মিনিট ফেলে রেখেছিলেন। এই অভিযোগের জেরে জিয়াওর চাকরি চলে যায়।

এরপর ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের নজর যায় ডং-এর দিকে। ডং মাত্র চার বছরে ডাক্তারি পড়া শেষ করেছেন, যেখানে সাধারণত ন্যূনতম আট বছর লাগে। চীনের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ মেডিকেল স্কুল, পিকিং ইউনিয়ন মেডিকেল কলেজে প্রতারণা করে অভিজাত কোটায় তিনি ভর্তির সুযোগ পান এবং তিনি স্নাতক থিসিস নকল করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন এই অভিযোগগুলো তদন্ত করে এবং সত্যতা পায়। কর্তৃপক্ষ ডং-এর ডাক্তারি করার লাইসেন্স এবং ডিগ্রি বাতিল করেছে।

ছিংদাও শহরের একজন তরুণী চিকিৎসক বলেন, এমন ঘটনা অস্বাভাবিক নয়, তবে ‘গভীরভাবে গেঁড়ে বসা অন্যায়’ দেখে তিনি বিরক্ত। তিনি বলেন, ডং যে প্রোগ্রাম থেকে স্নাতক হয়েছেন, তাঁর বা তাঁর সহকর্মীদের কাছে এটা ছিল সম্পূর্ণ অজানা। আমাদের মতো সাধারণ মানুষের জন্য এসব জানার কথা না।

এই কেলেঙ্কারি চীনের অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে থাকা চিকিৎসকদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে।

গত জুনে যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ইউরং লুয়ানা জিয়াং-এর বিরুদ্ধেও একই ধরনের ক্ষোভ দেখা যায়। তাঁর স্নাতক সমাবর্তন বক্তৃতার ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর তিনি বিতর্কের মুখে পড়েন। যদিও প্রাথমিকভাবে তাঁর বৈশ্বিক ঐক্যের ডাক প্রশংসিত হয়েছিল, কিন্তু তাঁর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পোস্টগুলো চীনা ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের বিরক্তির কারণ হয়। তারা লুয়ানার জীবনবৃত্তান্ত পরীক্ষা করে এবং ‘কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে সাফল্য’ অর্জনের গল্পকে তারা চ্যালেঞ্জ করে। সমালোচকেরা তাঁর দাবিগুলোতে অসংগতি খুঁজে পান এবং এটি চীনের অনেক তরুণদের জন্য সুযোগের সংকীর্ণতার আরও একটি অনুস্মারক হিসেবে দেখা হয়।

কোভিড-পরবর্তী মন্থর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছাঁটাই, বেতন হ্রাস এবং নিয়োগ বন্ধের কারণ হয়েছে। লাখ লাখ স্নাতক চাকরি পেতে হিমশিম খাচ্ছেন, কম বেতনের কাজ বেছে নিচ্ছেন বা সম্পূর্ণভাবে প্রতিযোগিতা থেকে সরে আসছেন। রেডনোটের একজন ব্যবহারকারী তাঁর হতাশা প্রকাশ করে লিখেছেন, ‘নিশ্চিতভাবে, যে জিনিসগুলো আপনি জন্মগতভাবে পাননি, এই জীবনে আপনি সেগুলো কখনোই পাবেন না।’

এই ক্ষোভ নতুন নয়। চীন সরকার দীর্ঘদিন ধরে সেলিব্রিটি এবং প্রভাবশালীদের সম্পদ প্রদর্শনে অতিরিক্ত নজরদারি করছে। তবে কিছু বিষয় তাদের নজর এড়িয়ে যায়। অভিনেত্রী হুয়াং ইয়াং তিয়ান তিয়ান-এর কানের দুল নিয়েও একই ধরনের বিতর্ক তৈরি হয়েছিল, যেখানে তাঁর পরিবারের সম্পদ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। যদিও কর্তৃপক্ষ তা অস্বীকার করেছে। তবুও জনমনে সন্দেহ রয়ে গেছে।

চীনা কমিউনিস্ট পার্টি তদন্ত শুরু করার মতো যথেষ্ট উদ্বিগ্ন হলেও, তাদের দ্রুত প্রতিক্রিয়া যথেষ্ট বলে মনে হচ্ছে না অনেকের কাছেই। রেডনোটের একজন ব্যবহারকারী লিখেছেন, ‘জনআস্থা রাতারাতি হারায়নি। এটি একের পর এক তদন্তের ফল যা আমাদের বুদ্ধিমত্তাকে অপমান করে, একের পর এক অমীমাংসিত ঘটনার ফল।’

জনসাধারণের হতাশা বাড়ছে কারণ কমিউনিস্ট পার্টি ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছে। তরুণদের প্রতি তাদের বার্তা হলো ‘তিক্ততা হজম’ করো। ‘জাতীয় পুনরুজ্জীবনের’ লক্ষ্যে কষ্ট সহ্য করার পরামর্শ দিচ্ছে সরকার। কিন্তু অনলাইনে, সাধারণ মানুষ ‘অভিজাতদের’ দ্বারা উপভোগ করা সুবিধাগুলো নিয়ে বিতর্ক করছে। ওয়েইবোতে একটি শীর্ষ-পছন্দের মন্তব্য হলো: ‘কেন আমরা তিন প্রজন্ম ধরে এত পরিশ্রম করেও এখনো দুর্দশায় আছি, এর কারণ তারাই।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত