Ajker Patrika

উড়িয়ে দিন সম্পর্কের বিষবাষ্প

অধ্যাপক ডা. সানজিদা শাহ্‌রিয়া
আপডেট : ২০ এপ্রিল ২০২২, ১২: ০১
উড়িয়ে দিন সম্পর্কের বিষবাষ্প

আমাদের সম্পর্কগুলো মাঝে মাঝেই বিষাক্ত হয়ে ওঠে। বিভিন্ন কারণে যখন দুজনের মনে বিষবাষ্প জমে, তখন তৈরি হয় সম্পর্কের টানাপোড়েন। এই টানাপোড়েনে সম্পর্কের ইলাস্টিসিটি নষ্ট হতে থাকে। পুঞ্জীভূত বাষ্প উত্তপ্ত হলে সম্পর্ক দূষিত হয়ে যায়। কিন্তু কেন সম্পর্কে জমে বিষবাষ্প, তার কিছু কারণ খুঁজে পেয়েছেন গবেষকেরা। কারণগুলো হলো:

  • একজন অন্যজনকে গুরুত্ব দেয় না
  • সিদ্ধান্ত নেওয়ায় অংশীদারত্ব দেয় না
  • অতি নির্ভরশীলতা
  • অতি নিয়ন্ত্রণপ্রবণতা
  • ব্যক্তিত্বের সংঘাত

আমরা প্রত্যেকেই বিভিন্ন ধরনের সম্পর্কে যুক্ত আছি। কিন্তু ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতম সম্পর্কে যখন আমরা জড়াই, তখন একটা কথা ভুলে যাই যে আমরা প্রত্যেকে আলাদা আলাদা পরিবেশ থেকে এসেছি। আমাদের প্রত্যেকের বেড়ে ওঠার ধরন আলাদা। কাজেই এসব ব্যাপারে আমাদের মতের মিল হবে না, সেটাই স্বাভাবিক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষের কবিতায় চমৎকার বলেছেন, ‘ভালোবাসায় ট্র্যাজেডি সেখানেই ঘটে, যেখানে পরস্পরকে স্বতন্ত্র জেনে মানুষ সন্তুষ্ট থাকতে পারেনি–নিজের ইচ্ছা অন্যের ইচ্ছে করবার জন্য যেখানে জুলুম–যেখানে মনের কবি, আপন মনের মত করে বদলিয়ে অন্যকে সৃষ্টি করে।’

দুই.
এবার কথা এগোই, আসলেই সম্পর্কে যে পলি জমেছে, সেটা দূর করে ভালোবাসার নাব্যতা আমরা আনতে চাই কি না? যদি চাই, তাহলে খেয়াল করতে হবে, আমি কি একাই চাই? নাকি দুজনেই চাই? কারণ সম্পর্ক তৈরি হয় দুজন মানুষের যোগসূত্রে। একজন যদি তাঁর সর্বস্ব দিয়ে দেন, তাহলে তিনি মাত্র ৫০ শতাংশ অবদান রাখবেন সম্পর্কে। এই সম্পর্ক ডিটক্স বা বিষমুক্ত করতে চাইলে বিবেচনায় রাখতে হবে, আমি একা যতই চাই, তাতে মাত্র ৫০ শতাংশ পরিশোধন হবে। আবার নিজের চোখে আয়না ধরাটা এ ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই সম্পর্কের আয়নায় আমার চেহারাটা কী? আমি কি নিজেকেও ডিটক্স করব? নাকি শুধু প্রত্যাশা করব জীবনসঙ্গী ডিটক্স হবেন কিন্তু আমি বদলাব না? অধিকাংশ সময় আমরা আত্মকেন্দ্রিক থাকি অবচেতনভাবে। কাজেই এসব ক্ষেত্রে একজন নিরপেক্ষ পেশাদার কাউন্সেলর বা সাইকোথেরাপিস্টের কাছে গেলে আন্তসম্পর্ক কোথায় কোথায় জট পাকিয়েছে, সেগুলো বোঝা সহজ হয়ে যায়।

তিন.
প্রত্যেক মানুষের একটি নির্দিষ্ট লাইফ পজিশন থাকে। এটাকে চারটা ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ভাগ আমি ঠিক, তুমিও ঠিক। যেখান থেকে পরস্পরের সীমাবদ্ধতাকে মেনে নিয়ে শ্রদ্ধায় পরস্পরকে ছাড় দেওয়া হয়। এই অন্যজনের মর্যাদা রেখে তার সীমাবদ্ধতাকে গ্রহণ করা, মতের অমিল হওয়া সত্ত্বেও যেকোনো আন্তসম্পর্ক ডিটক্স করার পূর্বশর্ত।

যতক্ষণ পর্যন্ত না আপনি সেটা গ্রহণে রাজি, ততক্ষণ পর্যন্ত বিষাক্ত বাষ্প আপনাকে নীলকণ্ঠ করবে। লাইভ পজিশনের বাকি তিনটি অংশ, যেমন–

  • আমি ঠিক, তুমি ভুল। এ পর্যায়ে শুধু জীবনসঙ্গীর দোষ ধরবে, সমালোচনা করবে, অসম্মান করবে।
  • তুমি ঠিক, আমি ভুল। এ পর্যায়ে এক পক্ষ সাংঘাতিকভাবে নির্ভরশীল হবে, তার আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদা নষ্ট হয়ে যাবে।
  • আমি, তুমি দুজনই ভুল। এ পর্যায়ে এক পক্ষ যেকোনো কিছু করতে পারে, খুন করতে পারে আবার আত্মহত্যাও করতে পারে জীবনসঙ্গীকে।

অবচেতনে মানুষ এভাবেও নিজেদের পরিচালিত করতে পারে। আবার আন্তসম্পর্কে তৃতীয় পক্ষ ক্ষেত্রবিশেষে ঢুকে যেতে পারে। তখন ডিটক্স প্রক্রিয়া আরও কঠিন হয়ে যায়।

যা করতে হবে

  • প্রথমে প্রয়োজন একে অন্যকে যে যেমন আছেন, সেভাবেই গ্রহণ করা।
  • আমরা বলি বেশি, শুনি কম। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সে বলাও হয় বলার জন্য বলা, যা মুখে আসে। কিন্তু জীবনসঙ্গীর কথা শুনতে হবে। তিনি কী বলতে চাচ্ছেন, সেটা অনুধাবন করতে হবে আগে, পরে মুখ খুলতে হবে। একে অ্যাকটিভ লিসনিং বলে। এককথায় মনোযোগী শ্রোতা হতে হবে।
  • অতিনির্ভরশীল হওয়া যাবে না। প্রতিটি আন্তসম্পর্কে একটি নিশ্বাস নেওয়ার জায়গা রাখতে হবে। যেখানে সম্পর্কে আবদ্ধ দুজন দুজনের পছন্দের কাজ করতে পারবে। কখনো একটু একা ঘুরতে যাওয়া, সিনেমা দেখা, কফিশপে ঢুঁ মারা, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া ভীষণ স্বাস্থ্যকর।
  • যৌথ সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় উভয়ের মতামতকে বিবেচনায় রেখে পরিকল্পনা করতে হবে।
  • আন্তসম্পর্কে একটু ভালোবাসা কম থাকলেও চলে কিন্তু শ্রদ্ধার কলসটি অবশ্যই ভরা থাকতে হবে। না হলে বিষাক্ত ক্লেদ জমে যাবে ধীরে ধীরে।
  • পরস্পরকে সম্মান করতে হবে।
  • জীবনসঙ্গীকে নির্ভর করার মতো ভরসা দেওয়ার আচরণ এবং সদিচ্ছা রাখতে হবে।
  • যে সম্পর্কের সত্যতা নেই, স্বচ্ছতা নেই, সেই সম্পর্কের কোনো মূল্য নেই।
  • দুজন দুজনের কাছে স্বচ্ছ থাকতে হবে।

লেখক: চিকিৎসক ও সাইকোথেরাপি প্র‍্যাকটিশনার, ফিনিক্স ওয়েলনেস সেন্টার, ঢাকা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত