Ajker Patrika

লোকসংগীতের ধ্রুবতারা সাইদুর বয়াতি

আব্দুর রাজ্জাক, ঘিওর (মানিকগঞ্জ)
আপডেট : ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৯: ২৯
Thumbnail image

ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২। মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন তখন তুঙ্গে। এই আন্দোলন ধাক্কা দেয় মানিকগঞ্জের নিভৃত পল্লির কিশোর সাইদুর রহমানের মনেও। সেই কিশোর লিখে ফেলেন, ‘আমার ভাষায় বলব কথা, তোদের কেন মাথাব্যথা? এই ভাষাতে জুড়ায় প্রাণ, তোদের কি তাতে যায় রে মান?’ সেদিনের সেই কিশোর বড় হয়ে সময়ে হয়ে ওঠেন মরমি সাধক, বয়াতি।

যাত্রাপালা থেকে সিনেমা, জারি-সারি থেকে মারফতি-সংস্কৃতির এমন নানা অনুষঙ্গে বিচরণ করা সাইদুর মানিকগঞ্জে একজন জীবন্ত কিংবদন্তি। ৯০ বছর বয়সেও তাঁর চোখেমুখে এক উজ্জ্বল দ্যুতি, কণ্ঠে তারুণ্যের ছাপ। লোকসংগীতে বিশেষ অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, শিল্পকলা একাডেমি পদকসহ একাধিক সম্মাননা লাভ করেছেন এই বাউল সাধক।

১৯৩১ সালে মানিকগঞ্জের পুটাইল ইউনিয়নের হাসলি গ্রামে জন্ম সাইদুর রহমানের। বাবা জিগির আলীও ছিলেন গানপাগল মানুষ। বাবার সঙ্গে ছোটবেলা থেকেই দোতারা বাজিয়ে গান গাইতেন। কবে যে নামের পেছনে বয়াতি বিশেষণটি যোগ হয়েছে, তা নিজেও জানেন না। ১৯৫৯ সালে মেট্রিক পরীক্ষা দিয়ে অঙ্কে ফেল করার পর আর পরীক্ষা দেননি। একসময় তিনি মানিকগঞ্জের কো-অপারেটিভ ব্যাংকে চাকরি নেন। পরে ‘হিসাবের খাতায়’ শিরোনামে গান লেখার কারণে চাকরি হারান। গান গেয়ে যে সামান্য অর্থ পেতেন, তা দিয়েই কষ্টে সংসার চালাতেন। ৮০ টাকার সঞ্চয় দিয়ে একসময় মুদি দোকানও করেছিলেন এই সাধক। তবে আধ্যাত্মিক সাধনা থেকে কখনোই সরে যাননি।

সাইদুর বয়াতি জানান, অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় লজিং থাকতেন নবগ্রামের জহির বয়াতির বাড়িতে। জহির বয়াতির কাছেই গানের পাশাপাশি সারিন্দা, দোতারা, বায়া, খঞ্জনির তালিম নেন সাইদুর। ওই সময় ‘বাসুদেব অপেরা’ যাত্রাদলে নারীর ভূমিকায় অভিনয় করতেন। চরিত্রের বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াতে লম্বা চুলের সঙ্গে ‘ছবি রানী’ নামে ছদ্মনাম ব্যবহার করতেন। ১৯৬৭ সালে তিনি ঘোস্তা গ্রামের জমশের আলীর মেয়ে সালেহা বেগমকে বিয়ে করেন।

জারি, সারি, ভাটিয়ালি, বাউল, মারফতি, নবীতত্ত্ব, কবিগান, মুর্শিদি, গাজির গান, মালসি, সখী সম্পাত, দমতত্ত্ব, সৃষ্টিতত্ত্ব, জীবতত্ত্ব, পরমতত্ত্বসহ প্রায় ৫০ রকমের গান গেয়ে পরিচিতি লাভ করেন সাইদুর। ভাষা সংগ্রামী রফিক শহীদ হওয়ার পর তাঁকে নিয়েও গান রচনা করেন তিনি। ‘মারিস না মারিস না ওরে, মারিস না বাঙ্গাল/এ দেশ ছেড়ে পালাবি তোরা (পাকিস্তানিরা), পালাবে না এই বাঙ্গাল’ গানটি ভাষা আন্দোলনের পর বেশ জনপ্রিয়তা পায়।

১৯৫৪ সালে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ও পরে মওলানা ভাসানীর জনসভাতেও গান গেয়ে শোনান সাইদুর। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ভোট চেয়ে গান করেছিলেন এই সাধক। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুকে দরবার হলে দেওয়া এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে গান গেয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে একটি ঘড়িও উপহার পেয়েছিলেন। নদীর নাম মধুমতি’, ‘লালসালু’, ‘চিত্রা নদীর পাড়ে’, ‘লালন’, ‘লিলিপুটেরা বড় হবেসহ বেশ কয়েকটি সিনেমায় অভিনয় করেছেন বয়াতি সাইদুর। নদীর নাম মধুমতি ছবিতে গান গেয়ে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত