Ajker Patrika

রাধাপদ রায় ও মানুষের মন

সম্পাদকীয়
রাধাপদ রায় ও মানুষের মন

‘মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক, আমি তোমাদেরই লোক’—রবীন্দ্রনাথের ‘পরিচয়’ কবিতার এই পঙ্‌ক্তিটি মানুষকে সম্মান জানিয়ে বহু জায়গায়, বহুভাবে ব্যবহার করা যাবে।

কিন্তু কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরের মানুষেরা নিশ্চয়ই রাধাপদ রায়ের ওপর হামলার কারণে তাঁদের এলাকা খ্যাত হোক, সেটা চাইবেন না। একটা অমানবিক কাণ্ড ঘটিয়ে দুই যুবক এখন পলাতক আছেন। বলা হচ্ছে, মাস ছয়েক আগে এক সালিসি বৈঠকে কথা-কাটাকাটি এবং হাতাহাতির ঘটনার জেরে ঘটেছে এই হামলার ঘটনা।

রাধাপদ রায়কে এলাকার বাইরের মানুষ খুব একটা চিনত না। কেন চিনত না, তার একটা কারণ তিনি নিজেই বলেছেন। ফেসবুকে এখন সে কথাগুলো পাওয়া যায়। রাজধানী বা শহরকেন্দ্রিক শক্তিবলয়ের কাছে গ্রাম যে তার যথাযথ মূল্য পায় না, সে কথা বলেছেন রাধাপদ রায় এবং লিখেছেন এমন কবিতা, যেখানে সমাজের যেসব অসাম্য এবং অন্যায় রয়েছে, সেখানে সরাসরি আঘাত করেছেন। ৫ হাজার টাকা বেতনের সরকারি চাকুরে কীভাবে মাসে ৫০ হাজার টাকা খরচ করেন, সে কথা জানতে চেয়েছেন। লেখাপড়া জানা লোকেরাই যে যত নষ্টের গুরু, সে কথা বলতেও তাঁর বাধেনি।

আমাদের গ্রাম আর শহরের মধ্যে ব্যবধান খুব একটা কমেনি। তবে শহরের কলুষ গ্রামে প্রবেশ করেনি, এ কথা বললে তা সত্য হবে না। ভিলেজ পলিটিকস কতটা ভয়াবহ ব্যাপার, সেটাও আমরা সাহিত্যের বিভিন্ন মাধ্যম থেকে জেনে আসছি। কিন্তু এই সমস্ত কলুষের মধ্যেও গ্রাম বেঁচে থাকে তার কিছু অনন্য মানুষের মাধ্যমে। আমাদের এই চারণকবি যে সে রকমই একজন মানুষ, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। তাঁর ওপর হামলার তীব্র নিন্দা জানাই।

নির্দিষ্ট এ বিষয়টি নিয়ে নিশ্চয়ই তদন্ত হবে এবং পলাতক আসামিরা ধরা পড়বেন, বিচার হবে। কিন্তু সমাজে এ রকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে ৮০ বছর বয়সী এক প্রবীণ ব্যক্তিও নিরাপদ নন, সেটা সত্যিই ভাবার বিষয়। একটা সময় তরুণেরা প্রবীণদের মেনে চলত। এখন তারা যেকোনো কারণে প্রবীণদের গায়ে হাত তোলার মতো অপরাধ করতে পারছে। এ নিয়ে সামাজিক গবেষণা হওয়া প্রয়োজন।
গ্রাম হোক বা শহর, পারস্পরিক সম্পর্কের বিষয়টি যদি ঘৃণাবিদ্বেষ এবং ক্রোধের আবর্তে বিভীষিকাময় হয়ে ওঠে, তাহলে সে সমাজ ঠিক পথে বিকশিত হতে পারে না। রাধাপদ রায়ের ওপর এই হামলা বুঝিয়ে দিচ্ছে, সমাজ এখনো তার পথটি ঠিক করে উঠতে পারেনি। আর এ জন্য রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অনাচার, সাংস্কৃতিক বিভেদ, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা দায়ী বলে মনে করা হয়।

সমাজের মধ্যে সেই শৃঙ্খলা ফিরে না এলে চারণকবিরা মার খেতে থাকবেন। জ্যেষ্ঠতাও তাঁদের বাঁচাতে পারবে না।

আকাশ সংস্কৃতিই কেবল এই বিভাজনের জন্য দায়ী নয়। আমাদের শৈশবে যে শিক্ষা পাওয়া উচিত ছিল পরিবার থেকে, শিক্ষালয় থেকে, সেগুলো আমরা যথাযথভাবে পাচ্ছি না বলে বিচ্ছিন্নভাবে এমন সব আচরণ করছি, যা আমাদের সাংস্কৃতিক দীনতাকে স্পষ্ট করে তোলে।
এ অবস্থার অবসান দরকার।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত