মামুনুর রশীদ, নাট্যব্যক্তিত্ব
কথায় কথায় আমরা যেকোনো কল্যাণমূলক কাজের জন্য পশ্চিমা বিশ্বকে ডেকে নিয়ে আসি। কিন্তু প্রাচ্য যে অনেক ভালো কাজের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, সেসব আমরা স্মরণ করি না। আমরা জাপানের উদাহরণ দিতে পারি। একেবারে ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে এসে মাত্র উনিশ-কুড়ি বছরের মাথায় একটা দেশকে তারা দাঁড় করিয়ে ফেলল এবং তার পরের কুড়ি বছরে পৃথিবীর অন্যতম একটি শিল্পায়ন উন্নয়ন ও গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা তৈরি করে ফেলল। চীন, তাইওয়ান, ভারতেও ব্যাপক শিল্পায়ন এবং জ্ঞানভিত্তিক সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। এ সবগুলো রাষ্ট্রের মূলে রয়েছে পেশাদারত্ব এবং দেশপ্রেম।
যিনি রাজনীতি করেন, তিনি রাজনীতিতে সর্বোচ্চ পেশাদারত্ব দেওয়ার চেষ্টা করেন এবং গণমূল্যায়নকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেন। যিনি প্রযুক্তি, গবেষণা এসব নিয়ে কাজ করেন, তাঁরা আন্তর্জাতিক বাজারে একটা সর্বশ্রেষ্ঠ জায়গা করার জন্য পেশাদারত্বকে মরিয়াভাবে গ্রহণ করেন। শিক্ষাদীক্ষার ব্যাপারে স্কুল, শিক্ষক, কারিকুলাম এসব বিষয়ে যাঁরা কাজ করে থাকেন, তাঁরাও পেশাদারত্বের ক্ষেত্রে একটা উদাহরণ সৃষ্টি করেন। আর আছে জাতীয় সংস্কৃতি—অতীতে সর্বশ্রেষ্ঠ সাংস্কৃতিক উপাদানগুলোকে বর্তমানে কাজে লাগিয়ে একটা মহৎ সমাজের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করে।
চীনে বর্তমানে একদলীয় কমিউনিস্ট পার্টির শাসনব্যবস্থা থাকলেও উৎপাদনের ক্ষেত্রে ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তারা একটা উন্নত জায়গায় পৌঁছে গেছে এবং উন্নততর জায়গায় পৌঁছানোর জন্য দিন-রাত পরিশ্রম করে যাচ্ছে। ভারতে দীর্ঘদিন একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থাকায় যার যার ক্ষেত্রে পেশাদারত্ব দেখানোর একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো যদি জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার পরিপূরক না হয়, তাহলে তার জবাবদিহির একটা ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, সাতচল্লিশে দেশ বিভাগের সময় আমরা ব্রিটিশের কাছ থেকে ভৌগোলিক এবং সম্পদগত কোনো হিস্যা আদায় করতে পারিনি। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ গভর্নর জেনারেল হলেন এবং পশ্চিম পাকিস্তানের বিষয়টি যেভাবে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করলেন, তেমনি পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল নিয়ে কোনো দর-কষাকষির চেষ্টাও তিনি করেননি। দুই দেশের সাম্প্রদায়িক শক্তি দাঙ্গায় মেতে ওঠে, মাঝখান থেকে ব্রিটিশ তার ২০০ বছরের সম্পদকে সুকৌশলে লুণ্ঠন করে নিয়ে যায়। তাদের এই ‘গ্রেসফুল এক্সিট’ এই উপমহাদেশকে গভীর দারিদ্র্যে নিপতিত করে গেছে।
কিন্তু ভারতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু করার জন্য এবং সরকারের জবাবদিহির বিষয়টি অক্ষুণ্ন রাখার জন্য সে দেশের রাজনীতিবিদেরা সর্বক্ষণ একটা সংগ্রামে নিয়োজিত ছিলেন। অন্যদিকে পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাগুলো বারবার ভেঙে চুরমার করার কারণে রাজনীতিতে কোনো পেশাদারত্ব আসেনি এবং সেনাশাসনের উপাদান গ্রহণ করে রাজনীতিবিদ ও স্পষ্টভাষী মানুষের জন্য কোনো জায়গা তৈরি হয়নি। রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ফলে দেশ স্বাধীন হলেও জবাবদিহি ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে দেওয়া হয়নি।
১৮৬৫ সালে জাপান পেশিশক্তি এবং স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে শোগানদের প্রতিহত করার জন্য মেইজি ইনফরমেশন শুরু করে এবং ১৯০০ সালের মধ্যে সে দেশের পুরো জনগণকে শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হয়। তার মধ্যে প্রযুক্তিচিন্তা ও সংস্কৃতিচিন্তা দুটোই একসঙ্গে কাজ করেছে। আর আমরা ক্রমান্বয়ে মেধাবীদের ও গণতান্ত্রিক চিন্তাসম্পন্ন মানুষদের রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছি। এই পরিস্থিতিতে দেখা যায়, কিছু কিছু লোক যেমন অর্থের দিক থেকে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন, তেমনি রাজনীতিতেও আগন্তুকেরা নব্য শাসকগোষ্ঠীর অংশ হয়েছেন।
আমরা যখন ওইসব দেশে যাই তখন শুধু যে প্রযুক্তিগত বা উন্নয়নের দিকটা দেখি তা নয়, বিভিন্ন ক্ষেত্রে পেশাদারত্বেরও একটা সুস্পষ্ট চেহারা দেখতে পাই। নিজস্ব অর্থে এবং নিজস্ব প্রযুক্তিবিদদের দ্বারা বড় বড় স্থাপনা তারা নির্মাণ করছে এবং তা নিয়ে আবার জনগণের মধ্যে সরকারের পক্ষে-বিপক্ষে নানান ধরনের আলোচনা-পর্যালোচনাও হচ্ছে। তাদের কণ্ঠরোধ করার কোনো চেষ্টা দেখা যাচ্ছে না।
যদিও চীন এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। একদলীয় শাসনব্যবস্থার ফলে তারা বিরোধীদের বক্তব্যকে সামনে আসতে দেয় না। কিন্তু সেগুলোকে মূল্যায়ন করে তারা উন্নয়নের একটা পথ ঠিক খুঁজে বের করে। এসবের কারণে সেই দেশগুলোতে বড় ধরনের প্রযুক্তিবিদ, বৈজ্ঞানিক, রাজনৈতিক তাত্ত্বিক—এরা জন্ম নিয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে রাজনীতির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় থেকে মেধাবীরা সরে গিয়েছেন, চাকরিবাকরি নিয়েছেন অথবা বিদেশে পাড়ি জমিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় বা নাসার মতো বড় ধরনের সংস্থায় যোগ দিয়ে নানা কৃতিত্বের অংশীদার হয়েছেন। আমরা শ্রমের মর্যাদা একেবারেই দিই না, কায়িক শ্রম যাঁরা করেন তাঁদের শ্রদ্ধা করতেও শিখিনি। ফলে তাঁরা একটি আনন্দহীন-সংস্কৃতিহীন জীবনযাপন করেন। তাই তাঁদের কাজে কোনো আনন্দের প্রতিফলন দেখা যায় না। কোনো কিছুকে অর্জন করার কৃতিত্বও তাঁদের মধ্যে দেখা যায় না।
সবচেয়ে বড় কথা হলো বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে একটা আপসকামিতা সমগ্র জীবনবোধকে ধ্বংস করে দেয়। স্পষ্ট ভাষণে যাঁরা উদ্বুদ্ধ, তাঁদেরকে সমাজের ‘সিভিল ভয়েজ’ মানে, জনতার কণ্ঠস্বর হিসেবেও আমরা স্বীকৃতি দিই না। শিক্ষাক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর, কলেজের অধ্যক্ষ, স্কুলের প্রধান শিক্ষক, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক—তাঁরা সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে মানুষের অসম্মানের জায়গায় চলে যান। শিক্ষার্থীরাও এই প্রবণতাকে অত্যন্ত অমর্যাদাকর হিসেবে দেখে থাকে। দেশের চিকিৎসকেরা কেউ যদি ভালো চিকিৎসক হন, তখনই চট করে প্রশ্ন ওঠে—তিনি কি সরকারের মানুষ? তা না হলে সারা জীবন তাঁকে সরকারের ন্যায্য পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত করা হয়ে থাকে।
আমার একজন অত্যন্ত পরিচিত দক্ষ চিকিৎসক আছেন, যিনি কোনো এক সময় সরকারের বিরোধিতা করেছিলেন। তার জন্য তাঁকে আজীবন শুরুর পদটিতেই থাকতে হয়েছে, কোনো পদোন্নতি হয়নি। অথচ তিনি এ দেশের একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিকিৎসক। একজন চিকিৎসকের ক্ষেত্রে, একজন দক্ষ প্রকৌশলীর ক্ষেত্রে, একজন উন্নতমানের শিল্পীর ক্ষেত্রে অপেশাদার রাজনীতিবিদেরা এই কাজটি আমাদের দেশে চিরদিন করে এসেছেন। একটি বাক্য প্রায়ই উচ্চারিত হয়—‘উনি কি আমাদের লোক?’ এই রাজনীতিবিদেরা কখনো ভাবেন না—তিনি তো এই দেশেরই লোক—আমাদের শ্রেষ্ঠ চিকিৎসক, আমাদের শ্রেষ্ঠ প্রযুক্তিবিদ কিংবা আমাদের শ্রেষ্ঠ শিল্পী। জনগণের হৃদয়ে তিনি আছেন। তাহলে তাঁকে নিগৃহীত করা মানে তাঁর অধিকারকে অস্বীকার করা। এটি কি মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়?
এ ব্যাপারে আমাদের মানবাধিকারকর্মীরা কোনো কথা বলেন না! সমস্যা হচ্ছে মানবাধিকার, দারিদ্র্যবিমোচন, সিভিল সোসাইটি বা সুশীল সমাজ—এ সবই এনজিওগুলোর। এই গণবিচ্ছিন্ন এনজিওগুলো একটা সময়ের অপেক্ষায় থাকে, যখন দেশে রাজনৈতিক সংকট আসে। অনেকের ভাগ্য তখন খুলে যায়, মন্ত্রীর পদমর্যাদা পেয়ে যান তাঁরা। যেন পূর্বগগন থেকে কিছু অশ্বারোহীর মতো তাঁরা অবতীর্ণ হন। কিন্তু নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর তাঁরা মূল্যহীন হয়ে পড়েন। তবে বিদেশি ফান্ডিং এজেন্সিগুলোর কাছে তাঁদের গুরুত্বটা বেড়ে যায়।
আমাদের একটি চৌকস সেনাবাহিনী আছে। যারা পেশাগত কাজে যথেষ্ট দক্ষ বলে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় যেখানে জাতিসংঘ শান্তি স্থাপন করতে চায়, সেখানে একটা বড় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অনেক সুশিক্ষিত তরুণ জোয়ান এই সেনাবাহিনীর সঙ্গে আছেন।
তাঁদের মধ্যে অনেক ডক্টরেট এবং এমবিএ, বিবিএ ডিগ্রিধারীরাও আছেন। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারের সময়ে তারা একটি ভূমিকা পালন করেছে। এরপরে এই সুদীর্ঘ সময়ে তারা কখনো রাষ্ট্রক্ষমতায় আসেনি। তার কারণ অনেক। কিন্তু এবারে আমরা তাদের বাধ্য করেছি জনপ্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত হতে। তারা প্রথমে সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেছে, কারণ রাজনীতি, সরকার গঠন তথা রাষ্ট্র পরিচালনা তাদের কাজ নয়। আসলেই রাজনীতি তাদের কাজ নয়, তারা একধরনের পেশাজীবী। নিজেদের কাজটিকে ভালোভাবে করার জন্য তারা বিভিন্ন প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকে। কিন্তু অতীতে তারা রাষ্ট্র শাসন করেছে এবং তার ফলাফলটা সুদূরপ্রসারীভাবে যে ভালো হয়নি, এটা তারা বেশ উপলব্ধিও করতে পেরেছে।
বর্তমানে সেনাবাহিনী সিভিল প্রশাসনে বা কোনো ধরনের আন্দোলন দমানোর কাজে তেমনভাবে যুক্ত হচ্ছে না, এটা উচিতও নয়। কিন্তু জনগণ শান্তি চায়। তাদের ধারণা জন্মেছে, রাজনৈতিক দলের চেয়ে সেনাবাহিনী অনেকটাই নিরপেক্ষতা অবলম্বন করছে। কিন্তু দীর্ঘদিন মাঠপর্যায়ে বা প্রশাসনে থাকলে তারাও মিয়ানমার, চীন অথবা আফ্রিকার কোনো দেশের মতো হয়ে যেতে পারে। তবে কোনো না কোনোভাবে সরকার যেহেতু মুখ্য রাজনৈতিক শক্তি, তাই সরকারকে রক্ষা করার জন্য তাদের প্রয়োজন পড়ে। এবারে সেই জায়গা থেকে তারা নিজেদের বিযুক্ত করার জন্য প্রথম থেকে সচেষ্ট থেকেছে।
কিন্তু যেহেতু অন্তর্বর্তী সরকারগুলোর পেছনে কোনো রাজনৈতিক শক্তি থাকে না, তাই সেনাবাহিনীই তাদের একমাত্র ভরসা হয়ে ওঠে। তবে সেখানেও দ্বন্দ্ব আছে। কারণ, আন্দোলনের শক্তির সঙ্গে সেনাবাহিনীর শক্তির মতবিরোধ হওয়া খুবই স্বাভাবিক। তবে আন্দোলনের শক্তিকে ভাবতে হবে যার যার পেশাদারত্বকে সম্মান করে প্রত্যেকের ক্ষেত্রে কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া, যেন সেটা একটা বিরল উদাহরণ হয়ে থাকে। শত শত মামলা এবং নানান ধরনের শাস্তি দিয়ে দেশকে গণতান্ত্রিক করা যায় না।
কথায় কথায় আমরা যেকোনো কল্যাণমূলক কাজের জন্য পশ্চিমা বিশ্বকে ডেকে নিয়ে আসি। কিন্তু প্রাচ্য যে অনেক ভালো কাজের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, সেসব আমরা স্মরণ করি না। আমরা জাপানের উদাহরণ দিতে পারি। একেবারে ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে এসে মাত্র উনিশ-কুড়ি বছরের মাথায় একটা দেশকে তারা দাঁড় করিয়ে ফেলল এবং তার পরের কুড়ি বছরে পৃথিবীর অন্যতম একটি শিল্পায়ন উন্নয়ন ও গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা তৈরি করে ফেলল। চীন, তাইওয়ান, ভারতেও ব্যাপক শিল্পায়ন এবং জ্ঞানভিত্তিক সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। এ সবগুলো রাষ্ট্রের মূলে রয়েছে পেশাদারত্ব এবং দেশপ্রেম।
যিনি রাজনীতি করেন, তিনি রাজনীতিতে সর্বোচ্চ পেশাদারত্ব দেওয়ার চেষ্টা করেন এবং গণমূল্যায়নকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেন। যিনি প্রযুক্তি, গবেষণা এসব নিয়ে কাজ করেন, তাঁরা আন্তর্জাতিক বাজারে একটা সর্বশ্রেষ্ঠ জায়গা করার জন্য পেশাদারত্বকে মরিয়াভাবে গ্রহণ করেন। শিক্ষাদীক্ষার ব্যাপারে স্কুল, শিক্ষক, কারিকুলাম এসব বিষয়ে যাঁরা কাজ করে থাকেন, তাঁরাও পেশাদারত্বের ক্ষেত্রে একটা উদাহরণ সৃষ্টি করেন। আর আছে জাতীয় সংস্কৃতি—অতীতে সর্বশ্রেষ্ঠ সাংস্কৃতিক উপাদানগুলোকে বর্তমানে কাজে লাগিয়ে একটা মহৎ সমাজের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করে।
চীনে বর্তমানে একদলীয় কমিউনিস্ট পার্টির শাসনব্যবস্থা থাকলেও উৎপাদনের ক্ষেত্রে ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তারা একটা উন্নত জায়গায় পৌঁছে গেছে এবং উন্নততর জায়গায় পৌঁছানোর জন্য দিন-রাত পরিশ্রম করে যাচ্ছে। ভারতে দীর্ঘদিন একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থাকায় যার যার ক্ষেত্রে পেশাদারত্ব দেখানোর একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো যদি জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার পরিপূরক না হয়, তাহলে তার জবাবদিহির একটা ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, সাতচল্লিশে দেশ বিভাগের সময় আমরা ব্রিটিশের কাছ থেকে ভৌগোলিক এবং সম্পদগত কোনো হিস্যা আদায় করতে পারিনি। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ গভর্নর জেনারেল হলেন এবং পশ্চিম পাকিস্তানের বিষয়টি যেভাবে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করলেন, তেমনি পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল নিয়ে কোনো দর-কষাকষির চেষ্টাও তিনি করেননি। দুই দেশের সাম্প্রদায়িক শক্তি দাঙ্গায় মেতে ওঠে, মাঝখান থেকে ব্রিটিশ তার ২০০ বছরের সম্পদকে সুকৌশলে লুণ্ঠন করে নিয়ে যায়। তাদের এই ‘গ্রেসফুল এক্সিট’ এই উপমহাদেশকে গভীর দারিদ্র্যে নিপতিত করে গেছে।
কিন্তু ভারতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু করার জন্য এবং সরকারের জবাবদিহির বিষয়টি অক্ষুণ্ন রাখার জন্য সে দেশের রাজনীতিবিদেরা সর্বক্ষণ একটা সংগ্রামে নিয়োজিত ছিলেন। অন্যদিকে পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাগুলো বারবার ভেঙে চুরমার করার কারণে রাজনীতিতে কোনো পেশাদারত্ব আসেনি এবং সেনাশাসনের উপাদান গ্রহণ করে রাজনীতিবিদ ও স্পষ্টভাষী মানুষের জন্য কোনো জায়গা তৈরি হয়নি। রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ফলে দেশ স্বাধীন হলেও জবাবদিহি ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে দেওয়া হয়নি।
১৮৬৫ সালে জাপান পেশিশক্তি এবং স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে শোগানদের প্রতিহত করার জন্য মেইজি ইনফরমেশন শুরু করে এবং ১৯০০ সালের মধ্যে সে দেশের পুরো জনগণকে শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হয়। তার মধ্যে প্রযুক্তিচিন্তা ও সংস্কৃতিচিন্তা দুটোই একসঙ্গে কাজ করেছে। আর আমরা ক্রমান্বয়ে মেধাবীদের ও গণতান্ত্রিক চিন্তাসম্পন্ন মানুষদের রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছি। এই পরিস্থিতিতে দেখা যায়, কিছু কিছু লোক যেমন অর্থের দিক থেকে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন, তেমনি রাজনীতিতেও আগন্তুকেরা নব্য শাসকগোষ্ঠীর অংশ হয়েছেন।
আমরা যখন ওইসব দেশে যাই তখন শুধু যে প্রযুক্তিগত বা উন্নয়নের দিকটা দেখি তা নয়, বিভিন্ন ক্ষেত্রে পেশাদারত্বেরও একটা সুস্পষ্ট চেহারা দেখতে পাই। নিজস্ব অর্থে এবং নিজস্ব প্রযুক্তিবিদদের দ্বারা বড় বড় স্থাপনা তারা নির্মাণ করছে এবং তা নিয়ে আবার জনগণের মধ্যে সরকারের পক্ষে-বিপক্ষে নানান ধরনের আলোচনা-পর্যালোচনাও হচ্ছে। তাদের কণ্ঠরোধ করার কোনো চেষ্টা দেখা যাচ্ছে না।
যদিও চীন এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। একদলীয় শাসনব্যবস্থার ফলে তারা বিরোধীদের বক্তব্যকে সামনে আসতে দেয় না। কিন্তু সেগুলোকে মূল্যায়ন করে তারা উন্নয়নের একটা পথ ঠিক খুঁজে বের করে। এসবের কারণে সেই দেশগুলোতে বড় ধরনের প্রযুক্তিবিদ, বৈজ্ঞানিক, রাজনৈতিক তাত্ত্বিক—এরা জন্ম নিয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে রাজনীতির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় থেকে মেধাবীরা সরে গিয়েছেন, চাকরিবাকরি নিয়েছেন অথবা বিদেশে পাড়ি জমিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় বা নাসার মতো বড় ধরনের সংস্থায় যোগ দিয়ে নানা কৃতিত্বের অংশীদার হয়েছেন। আমরা শ্রমের মর্যাদা একেবারেই দিই না, কায়িক শ্রম যাঁরা করেন তাঁদের শ্রদ্ধা করতেও শিখিনি। ফলে তাঁরা একটি আনন্দহীন-সংস্কৃতিহীন জীবনযাপন করেন। তাই তাঁদের কাজে কোনো আনন্দের প্রতিফলন দেখা যায় না। কোনো কিছুকে অর্জন করার কৃতিত্বও তাঁদের মধ্যে দেখা যায় না।
সবচেয়ে বড় কথা হলো বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে একটা আপসকামিতা সমগ্র জীবনবোধকে ধ্বংস করে দেয়। স্পষ্ট ভাষণে যাঁরা উদ্বুদ্ধ, তাঁদেরকে সমাজের ‘সিভিল ভয়েজ’ মানে, জনতার কণ্ঠস্বর হিসেবেও আমরা স্বীকৃতি দিই না। শিক্ষাক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর, কলেজের অধ্যক্ষ, স্কুলের প্রধান শিক্ষক, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক—তাঁরা সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে মানুষের অসম্মানের জায়গায় চলে যান। শিক্ষার্থীরাও এই প্রবণতাকে অত্যন্ত অমর্যাদাকর হিসেবে দেখে থাকে। দেশের চিকিৎসকেরা কেউ যদি ভালো চিকিৎসক হন, তখনই চট করে প্রশ্ন ওঠে—তিনি কি সরকারের মানুষ? তা না হলে সারা জীবন তাঁকে সরকারের ন্যায্য পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত করা হয়ে থাকে।
আমার একজন অত্যন্ত পরিচিত দক্ষ চিকিৎসক আছেন, যিনি কোনো এক সময় সরকারের বিরোধিতা করেছিলেন। তার জন্য তাঁকে আজীবন শুরুর পদটিতেই থাকতে হয়েছে, কোনো পদোন্নতি হয়নি। অথচ তিনি এ দেশের একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিকিৎসক। একজন চিকিৎসকের ক্ষেত্রে, একজন দক্ষ প্রকৌশলীর ক্ষেত্রে, একজন উন্নতমানের শিল্পীর ক্ষেত্রে অপেশাদার রাজনীতিবিদেরা এই কাজটি আমাদের দেশে চিরদিন করে এসেছেন। একটি বাক্য প্রায়ই উচ্চারিত হয়—‘উনি কি আমাদের লোক?’ এই রাজনীতিবিদেরা কখনো ভাবেন না—তিনি তো এই দেশেরই লোক—আমাদের শ্রেষ্ঠ চিকিৎসক, আমাদের শ্রেষ্ঠ প্রযুক্তিবিদ কিংবা আমাদের শ্রেষ্ঠ শিল্পী। জনগণের হৃদয়ে তিনি আছেন। তাহলে তাঁকে নিগৃহীত করা মানে তাঁর অধিকারকে অস্বীকার করা। এটি কি মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়?
এ ব্যাপারে আমাদের মানবাধিকারকর্মীরা কোনো কথা বলেন না! সমস্যা হচ্ছে মানবাধিকার, দারিদ্র্যবিমোচন, সিভিল সোসাইটি বা সুশীল সমাজ—এ সবই এনজিওগুলোর। এই গণবিচ্ছিন্ন এনজিওগুলো একটা সময়ের অপেক্ষায় থাকে, যখন দেশে রাজনৈতিক সংকট আসে। অনেকের ভাগ্য তখন খুলে যায়, মন্ত্রীর পদমর্যাদা পেয়ে যান তাঁরা। যেন পূর্বগগন থেকে কিছু অশ্বারোহীর মতো তাঁরা অবতীর্ণ হন। কিন্তু নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর তাঁরা মূল্যহীন হয়ে পড়েন। তবে বিদেশি ফান্ডিং এজেন্সিগুলোর কাছে তাঁদের গুরুত্বটা বেড়ে যায়।
আমাদের একটি চৌকস সেনাবাহিনী আছে। যারা পেশাগত কাজে যথেষ্ট দক্ষ বলে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় যেখানে জাতিসংঘ শান্তি স্থাপন করতে চায়, সেখানে একটা বড় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অনেক সুশিক্ষিত তরুণ জোয়ান এই সেনাবাহিনীর সঙ্গে আছেন।
তাঁদের মধ্যে অনেক ডক্টরেট এবং এমবিএ, বিবিএ ডিগ্রিধারীরাও আছেন। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারের সময়ে তারা একটি ভূমিকা পালন করেছে। এরপরে এই সুদীর্ঘ সময়ে তারা কখনো রাষ্ট্রক্ষমতায় আসেনি। তার কারণ অনেক। কিন্তু এবারে আমরা তাদের বাধ্য করেছি জনপ্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত হতে। তারা প্রথমে সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেছে, কারণ রাজনীতি, সরকার গঠন তথা রাষ্ট্র পরিচালনা তাদের কাজ নয়। আসলেই রাজনীতি তাদের কাজ নয়, তারা একধরনের পেশাজীবী। নিজেদের কাজটিকে ভালোভাবে করার জন্য তারা বিভিন্ন প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকে। কিন্তু অতীতে তারা রাষ্ট্র শাসন করেছে এবং তার ফলাফলটা সুদূরপ্রসারীভাবে যে ভালো হয়নি, এটা তারা বেশ উপলব্ধিও করতে পেরেছে।
বর্তমানে সেনাবাহিনী সিভিল প্রশাসনে বা কোনো ধরনের আন্দোলন দমানোর কাজে তেমনভাবে যুক্ত হচ্ছে না, এটা উচিতও নয়। কিন্তু জনগণ শান্তি চায়। তাদের ধারণা জন্মেছে, রাজনৈতিক দলের চেয়ে সেনাবাহিনী অনেকটাই নিরপেক্ষতা অবলম্বন করছে। কিন্তু দীর্ঘদিন মাঠপর্যায়ে বা প্রশাসনে থাকলে তারাও মিয়ানমার, চীন অথবা আফ্রিকার কোনো দেশের মতো হয়ে যেতে পারে। তবে কোনো না কোনোভাবে সরকার যেহেতু মুখ্য রাজনৈতিক শক্তি, তাই সরকারকে রক্ষা করার জন্য তাদের প্রয়োজন পড়ে। এবারে সেই জায়গা থেকে তারা নিজেদের বিযুক্ত করার জন্য প্রথম থেকে সচেষ্ট থেকেছে।
কিন্তু যেহেতু অন্তর্বর্তী সরকারগুলোর পেছনে কোনো রাজনৈতিক শক্তি থাকে না, তাই সেনাবাহিনীই তাদের একমাত্র ভরসা হয়ে ওঠে। তবে সেখানেও দ্বন্দ্ব আছে। কারণ, আন্দোলনের শক্তির সঙ্গে সেনাবাহিনীর শক্তির মতবিরোধ হওয়া খুবই স্বাভাবিক। তবে আন্দোলনের শক্তিকে ভাবতে হবে যার যার পেশাদারত্বকে সম্মান করে প্রত্যেকের ক্ষেত্রে কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া, যেন সেটা একটা বিরল উদাহরণ হয়ে থাকে। শত শত মামলা এবং নানান ধরনের শাস্তি দিয়ে দেশকে গণতান্ত্রিক করা যায় না।
ভারতের স্থলবন্দর নিষেধাজ্ঞার পর সীমান্তে আটকে থাকা তৈরি পোশাক, খাদ্যসহ বিভিন্ন পণ্যের ট্রাকগুলো ফেরত আনছেন রপ্তানিকারকেরা। তবে যেসব ট্রাক বন্দরে ঢুকে গিয়েছিল, সেগুলো ভারতে প্রবেশ করানোর চেষ্টা চলছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এসব ট্রাক ঢুকতে পারবে কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে।
১৯ দিন আগেআধুনিক যুগের সবচেয়ে বিস্ময়কর প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারগুলোর একটি হচ্ছে গৌতম বুদ্ধের দেহাবশেষের সঙ্গে সম্পর্কিত ঐতিহাসিক রত্নসম্ভার। গতকাল বুধবার হংকংয়ে বিখ্যাত আর্ট নিলাম কোম্পানি সাদাবি’স-এর এক নিলামে এগুলো তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
০৮ মে ২০২৫পাকিস্তানে ভারতের হামলার সমালোচনা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। চীনও এই হামলাকে ‘দুঃখজনক’ বলে অভিহিত করেছে। উদ্বেগ জানিয়েছে জাতিসংঘও। উত্তেজনা যেন আরও না বাড়ে, সে জন্য দুই পক্ষকে সংযত থাকার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশ। এদিকে ভারতের অবস্থানকে সমর্থন করেছে...
০৮ মে ২০২৫ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলা নিয়ে দুই চিরবৈরী প্রতিবেশীর মধ্যে উত্তেজনার পারদ ক্রমেই চড়ছিল। তা তুঙ্গে উঠল এবার পাকিস্তানের ভূখণ্ডে ভারতের ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামের ক্ষেপণাস্ত্র ও বিমান হামলা দিয়ে। পাশাপাশি সীমান্তেও দুই দেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যে ব্যাপক গোলাগুলি হয়েছে...
০৮ মে ২০২৫