Ajker Patrika

সুস্বাগত হে নববর্ষ

জাহীদ রেজা নূর, ঢাকা
আপডেট : ১৪ এপ্রিল ২০২২, ০৮: ৩৩
Thumbnail image

নতুন একটি বছরের শুরু আজ। যে ভূখণ্ডে থাকি আমরা, যে ভাষায় কথা বলি, সে ভূখণ্ডে, সে ভাষাভাষীর জীবনে আজ এসেছে নববর্ষ। জরা-গ্লানি মুছে দিয়ে শান্তিময় জীবনের আহ্বান জানাচ্ছে সে।

কিন্তু আমরা কি তা ‘গ্রহণে সক্ষম?’ নতুন ১৪২৯ বঙ্গাব্দ আমাদের জন্য কোন বার্তা নিয়ে উপস্থিত, সেটা আমরা জানি না। শুধু জানি, প্রতিটি নতুন বছরই শুরু হয় আশা-আকাঙ্ক্ষা আর স্বপ্নের ওপর ভর করে। তার বাস্তবরূপ দেওয়ার দায়িত্ব যাদের, তারা সে দায়িত্ব পালন না করলে বছর শেষ হয় আক্ষেপ দিয়ে।

বাংলা নববর্ষের সঙ্গে বাঙালির আত্মপরিচয়ের যোগ নিবিড়। যেকোনো ধর্মের মানুষ বাঙালি আত্মপরিচয়ে গর্ব করতে পারবেন, মুক্তিযুদ্ধের একটা আকাঙ্ক্ষা ছিল তা।

সম্রাট আকবর যে সৌরবর্ষ চালু করেছিলেন, তা ছিল ফসলি সন। সেটা গ্রহণ করেছিল বাংলার জনগণও।

শুরুতে কিন্তু বাংলা সন হিসেবে এটা পরিচিত ছিল না, ধীরে ধীরে সনের জায়গায় বাংলা যুক্ত হলো। এরপর রাজনীতি ও সংস্কৃতির নানা টানাপোড়েনে বাঙালির এই নতুন সনের প্রথম দিনটি উৎসবের রং পায়। এবং বিভিন্ন ধর্মের মানুষকে নিয়ে আসে এক ছাতার নিচে, নিজেদের অভিন্ন পরিচয়ে তারা ঋদ্ধ হয়। উৎসবটি সর্বজনীন হয়ে ওঠে এই ঘাত-প্রতিঘাতের পথ ধরেই।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘রথের রশি’তে লিখেছিলেন, ‘বাধা পেলে শক্তি নিজেকে নিজে চিনতে পারে—চিনতে পারলেই আর ঠেকানো যায় না।’ বড় করে পয়লা বৈশাখ পালনের একটা ক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল পাকিস্তানি বাধা আর শাসন-শোষণের কারণে। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার বাঙালি সংস্কৃতির ওপর হামলা চালানো শুরু করেছিল বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকের গোড়ায়। রবীন্দ্রনাথ ও বাঙালি সংস্কৃতির ওপর আক্রমণ চালালে প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। পালন হয় রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী, গঠিত হয় ছায়ানট। আইয়ুবের পান্ডারা রবীন্দ্রসংগীত, লালপেড়ে শাড়ি, কপালে টিপ, আলপনা ইত্যাদিকে হিন্দুয়ানি বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল, (ইদানীং কোনো কোনো মহলের ইন্ধনে সে ধরনের মানসিকতার দেখা পাওয়া যাচ্ছে)। এগুলোর সঙ্গে ধর্ম যে কোনোভাবে সম্পৃক্ত নয়, বরং এগুলোর সঙ্গে যোগ বাঙালি সংস্কৃতির, সে কথা তারা স্বীকার করতে চাইত না। তাই প্রতিবাদে শামিল হয়েছিল ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সব বাঙালি। নিজের পোশাক, নিজের সাজের ওপর ধর্মীয় তকমা লাগানোর বিরুদ্ধে অসাম্প্রদায়িক চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল। এবং এই প্রতিবাদের পথ ধরেই একসময়ের গ্রামীণ আয়োজন ছড়িয়ে পড়ে দেশের সর্বত্র। পয়লা বৈশাখের উৎসবে শামিল হতে সারা দেশেই মেলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ে মানুষ। নববর্ষে দেশি খাবারের আয়োজন করা হয়। লক্ষ করলেই দেখা যাবে, সামরিক শাসনামলেও নববর্ষ পালনে ভাটা পড়েনি।

বর্ষবরণের সঙ্গে আছে অর্থনীতির যোগ। নববর্ষের আয়োজনে ফুলের ভূমিকা রয়েছে, এ সময় ফুলের দাম বেড়ে যায়। মিষ্টির দোকানগুলো ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি বানায়, কেনাকাটা হয় প্রচুর। বৈশাখী ফ্যাশন এখন কোনো রূপকথা নয়। বড় আয়োজনের পাশাপাশি ছোট পরিসরে অনেক উদ্যোক্তা পয়লা বৈশাখকে কেন্দ্র করে জামাকাপড়, অলংকার তৈরি করে বিক্রি করেন। ফলে অর্থনৈতিকভাবেও এই উৎসব পেয়েছে মর্যাদা।

একই সময়, অর্থাৎ চৈত্রের শেষ দুই দিন ও বৈশাখের প্রথম দিন পাহাড়ি মানুষেরা পালন করে তাদের সবচেয়ে বড় উৎসব ‘বৈসাবি’। বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের মিলিত উৎসব এটি। বৈসুক, সাংগ্রাই আর বিজুর মিলিত নাম বৈসাবি। তাই বাঙালি ও পাহাড়ি সংস্কৃতির মিলন বার্তার প্রতীকও এই বর্ষবরণ অনুষ্ঠান।

পয়লা বৈশাখ মানুষে মানুষে মিলনের কথা বলে, মানুষের সংস্কৃতির কথা বলে, প্রকৃতির কথা বলে, সাহসের সঙ্গে নান্দনিক জীবন কাটানোর কথা বলে, দেশের আপামর মানুষকে সমীহ করার শিক্ষা দেয়। দেশের সবচেয়ে বড় অসাম্প্রদায়িক এই উৎসবটি তাই খুবই তাৎপর্যময়। নতুন বছরটিতে অসহিষ্ণুতা দূর হয়ে যাক, অসাম্প্রদায়িক মন পূর্ণ বিকশিত হয়ে উঠুক, সবার প্রতি সবার ভালোবাসা একটি ঐক্যবদ্ধ জাতির মর্যাদা দান করুক।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত