Ajker Patrika

সিরাজউদ্দৌলার বাংলা ও আজকের ব্যবসায়ী

মামুনুর রশীদ
আপডেট : ০৪ এপ্রিল ২০২৪, ০৭: ৫৮
সিরাজউদ্দৌলার বাংলা ও আজকের ব্যবসায়ী

রমজান প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। মূল্যবৃদ্ধির অত্যাচার গা সওয়া হয়ে গেছে। কিছুতেই জিনিসপত্রের দাম কমল না এবং এই দাম ঈদের পরেও বলবৎ থাকবে। এভাবেই আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। ডলারের দাম বাড়া, তেল-গ্যাসের দাম বাড়ার সঙ্গে এখানকার মূল্যবৃদ্ধির কোনো সম্পর্ক নেই। দাম কেন বাড়ে? এর কোনো কারণ কোনো অর্থনীতিবিদ ব্যাখ্যা করতে পারবেন না। শুধু অসাধু ব্যবসায়ীদের মুনাফার লোভ এবং লুণ্ঠন ছাড়া কোনো কারণ নেই।

এ দেশে ব্রিটিশরা আসার আগে দীর্ঘদিন দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল থাকত। শায়েস্তা খাঁর আমলে টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যেত। আর ১৭৫৫ সালে টাকায় তিন মণ চাল পাওয়া যেত। সেই চালের মূল্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মাত্র ১৯ বছরে এমন বাড়িয়ে দিল যে টাকায় তখন ছয় সের চাল পাওয়া যেত। এ সময়েই ছিয়াত্তরের মন্বন্তর হয় এবং বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার এক-তৃতীয়াংশ মানুষ মারা যায়। কী ভয়াবহ অবস্থা! এই ব্রিটিশ বণিকেরা এমন উন্মাদ হয়ে গেল যে গ্রামেগঞ্জে কৃষকের গোলা থেকে নামমাত্র মূল্যে ধান, চাল, গম নিয়ে যেত এবং ভারতের অন্যান্য জায়গায় বিক্রি করে বিপুল মুনাফা করত।

এরপর তারা জুলুম চালায় কাপড়ের ওপর। নামমাত্র মূল্যে ঢাকার মসলিন এবং উন্নত কাপড়গুলো নিয়ে যায়। এই কাপড়গুলো ঢাকা থেকে শুধু ভারত নয়, পৃথিবীর সব জায়গায় পাঠিয়ে একটা বিশাল বাজার তৈরি হয়েছিল। সেই বাজারগুলোতে এই সব লুণ্ঠনের সামগ্রী রপ্তানি করে তারা বিশাল ধনী হয়ে যায়। সবচেয়ে বড় চাপটা পড়ে মসলার ওপর। এ দেশে উৎপাদিত মসলার একটা বড় অংশ, কোনো ক্ষেত্রে পুরোটাই চালান করে দেয় ইউরোপীয় দেশে।

১৭০০ সালে যে ঢাকার লোকসংখ্যা ছিল ১০ লাখ, তা ১৮০২ সালে দাঁড়ায় ৫০ হাজার। দ্রব্যমূল্য আর স্থিতিশীল থাকে না। নবাব সিরাজউদ্দৌলা এটা বুঝতে পেরেছিলেন খুব অল্প বয়সেই। ফরাসি, ওলন্দাজ, আর্মেনীয়সহ অন্য ব্যবসায়ীরা রাষ্ট্রের শুল্কের নিয়ম মেনেই ব্যবসা করত। কিন্তু ব্রিটিশরা এটা মানতই না। কারণ মোগল দরবারে গিয়ে ব্যবসার অনুমতি তারা নিতে পেরেছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ব্যবসার ব্যাপারে ছিল ভীষণ নিষ্ঠুর। ফরাসিদের সঙ্গে তাদের ঝগড়া লেগেই থাকত। চর দখলের মতো প্রবণতা তাদের মজ্জাগত।

অন্যদিকে ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব হয়ে গেছে। কাঁচামাল চাই। ভারতের রেশম সুতা থেকে শুরু করে প্রচুর পরিমাণ খনিজ পদার্থও চাই। তাই ভারতকে লুণ্ঠন করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। দেশীয় নবাব, রাজা, মহারাজারা আবার ব্যবসায়ীনির্ভর। সিরাজউদ্দৌলার মন্ত্রী-আমত্তদের ব্যবসায়ীরা খুবই প্রভাবশালী। তাদের সঙ্গে ইংরেজ ব্যবসায়ীদের আঁতাত স্বাভাবিক। তাই তাদের একমাত্র পথের কাঁটা সিরাজউদ্দৌলাকে হঠাতেই হবে! ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত হলো মীরজাফর, ব্যবসায়ী জগৎ শেঠ, উমিচাঁদ এবং অন্যরা। শেষ পর্যন্ত ভারতীয় এবং ইংরেজ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে একটা সমঝোতা হলো। বাংলা দখলের পথ ধরে পুরো ভারতটাই খেয়ে ফেলল একটা ব্যবসায়ী সম্প্রদায়।

আজকের দিনে বিশ্বাস করা কঠিন যে নবাব আলিবর্দী খানের সময় বাংলা, বিহার, উড়িষ্যায় ‘তালা’ বলতে কোনো বস্তু ছিল না। তালা আবিষ্কারই হয়নি। কারণ কোথাও চুরি হলে থানার দারোগার বেতন থেকে ভুক্তভোগীকে ক্ষতিপূরণ দিতে হতো। ইংরেজরা আসার পর থেকেই তালার প্রয়োজন হয়। কারণ তাদের দেশেও চুরিচামারি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। যা-ই হোক, তারা আসার পর ধীরে ধীরে ব্যবসায়ীদের একটা সাম্রাজ্য গড়ে ওঠে ভারতে। দ্রুত তার প্রভাব পড়ে এই বাংলায়। কিন্তু বাংলার মূল্যবোধ তখনো জাগ্রত। এখানকার সমাজটা তখনো আছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর রেনেসাঁ এসে একটা ঝাপটা দেয় তাতে। মানুষ আলোকিত হতে থাকে। মানুষের জাগরণের কালে আবার ব্যবসায়ীরা তাদের সন্ত্রাসী লোভটাকে কিছুটা সংযত করে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জায়গায় যখন ব্রিটিশ সরকারের শাসন চলে, তখন বুদ্ধিমান ইংরেজ নিজেদের কিছুটা সংযত করে, কারণ এর মধ্যে ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিপ্লব হয়ে গেছে। এবারে ইংরেজরা তাদের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির মানবিক দিকটা চালান করতে শুরু করে। এ দেশেও বিংশ শতাব্দীর মূল্যবোধগুলো জাগ্রত হতে থাকে। কিন্তু ব্যবসায়ীদের লোভ কিছুতেই কমে না। এভাবেই ভারতবর্ষকে লুণ্ঠন করে একসময় ব্রিটিশরা চলে যায়।

এর মধ্যে ব্রিটিশরা অনেকগুলো দুর্ভিক্ষ-বন্যা তৈরি করে যায়। তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষ একেবারেই মজুতদারদের সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ। কারণ সে বছর সবচেয়ে বেশি ফসল ফলেছিল। প্রকৃতিতে ছিল সবুজের সমারোহ। সত্যজিৎ রায়ের ‘অশনিসংকেত’ দেখলেই তা বোঝা যাবে। এই ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য কিন্তু দেশভাগের পরও কমল না।

আমাদের পূর্ব বাংলা বন্যাপীড়িত দেশ। যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ এলে তখনই চালের দাম বেড়ে যায়। চালের দাম কমাতে পারলেই যেন শাসকের একটা বড় সাফল্য। যখন চালের দাম মাত্র ৪০ টাকা হলো, তখনই আইয়ুব খানের ‘মার্শাল ল’ এল। তিনি ব্যবসায়ীদের কিছুটা ভয় দেখিয়ে কিছুটা রাজনীতি করলেন। দাম কমে গেল। মানুষ খুশি হলো। আইয়ুবকে মানুষ জিন্দাবাদ করতে শুরু করল। তাই এ সময় থেকেই দ্রব্যমূল্যের রাজনীতিটা শুরু হলো। কিন্তু শেষ অবধি এটা আর রক্ষা করা গেল না। অবশ্য উনসত্তর সাল থেকে একাত্তর পর্যন্ত আবার দ্রব্যমূল্য মানুষের নিয়ন্ত্রণে থাকল। এখন কি বিশ্বাস করা যায় যে সত্তর-একাত্তর সালে এক কেজি গরুর মাংসের দাম ছিল এক টাকা, যা এখন ৮০০ টাকা! হ্যাঁ, জানি ডলারের মূল্য বেড়েছে, মুদ্রাস্ফীতি হয়েছে কিন্তু অনেক দেশেই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য এত বাড়েনি। অথচ এ দেশে দ্রব্যমূল্য বাড়িয়েও ব্যবসায়ীদের লোভ কমেনি। প্রতিটি খাদ্যদ্রব্যে তারা ভেজাল দিচ্ছে। ভোজ্যতেল, শিশুখাদ্য, এমনকি ওষুধেও তারা ভেজাল মেশাচ্ছে। এমন অমানবিক মুনাফালোভী কি পৃথিবীর অন্য দেশে আছে? খুঁজে পাওয়া যাবে না।

থাইল্যান্ডের কোনো একটি ভ্রমণকেন্দ্রে ছিলাম। সেটি সমুদ্রের ওপরে, শহর থেকে অনেক দূরে, পুলিশি প্রহরা নেই। একদিন সকালে দেখছি নাশতার বিলম্ব হচ্ছে। ভীষণ খিদে পেয়েছে। বিরক্ত হয়ে পায়চারি করতে করতে পৌঁছালাম সমুদ্রের ওপরে কটেজটির খাবার ঘরে। দেখলাম কয়েকজন কর্মী দ্রুত পাউরুটিগুলোকে ছিঁড়ে পানিতে ফেলে দিচ্ছে। আমি তখনো উত্তেজিত—আমাদের নাশতা কোথায়? কিছুটা থাই, কিছুটা ইংরেজিতে তারা জানাল, ‘সকালে আমরা দেখলাম আপনাদের জন্য রাখা পাউরুটিগুলো গত রাত ১২টায় এক্সপায়ার হয়ে গেছে। তাই এগুলো আপনাদের দেওয়া যাবে না। নতুন পাউরুটি আসছে। কিছুক্ষণ আপনাদের অপেক্ষা করতে হবে। আমরা দুঃখিত।’ থাই ছেলেমেয়েদের চেহারা এমনিতেই খুব মায়াবী। তাদের কথায় গলে গেলাম। যা-ই হোক, রুটি এল, নাশতা খেলাম এবং তাদের ব্যবসার ধরনের শিক্ষাটাও পেলাম।

বাংলাদেশ এখন একটা সর্বব্যাপী দোকান হয়ে গেছে। এই দোকানটার মালিকদের মধ্যে সেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মতোই মুনাফার লোভ। তা ছাড়া সেই কোম্পানির মতোই দখল করার একটা মনোবৃত্তি গড়ে উঠেছে তাদের। তাই সংসদের বৃহদাংশ তাদের দখলে। লুটপাটের জন্য তাদের আর বাধা নেই। তাদের বড় বড় সংগঠন আছে, যারা রাষ্ট্রের বড় বড় সিদ্ধান্তের সঙ্গে যুক্ত হয়। যে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের জন্য বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল, তারা আজ নিপীড়নের শেষ পর্যায়ে চলে গেছে।

নবাব সিরাজউদ্দৌলা ব্যবসায়ীদের মনোভাব বুঝতে পেরেছিলেন। কিন্তু আজকের শাসকেরা কি বুঝতে পারছেন?

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত