মৃত্যুঞ্জয় রায়
বিশ বছরের ব্যবধানে দুবার হিমালয়ে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। দুবারই গিয়েছিলাম একই সময়ে, জুন মাসে। এই সামান্য সময়ের ব্যবধানেই পার্থক্যটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলাম। প্রথমবার হিমালয়ের যে পথ ধরে সকালবেলা হেঁটেছিলাম, সেই পথের চারপাশে আহা কী অনিন্দ্য সুন্দর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য! রুক্ষ পাথরের সুউচ্চ পাহাড়ের চূড়াগুলো সাদা বরফের মুকুটে ঢাকা, খাদে খাদে বরফের স্রোত যেন নদীরেখার মতো, ওপর থেকে নেমে আসা শত শত ঝরনার জল চকচকে কাচের ফিতার মতো জমাট বরফ হয়ে ঝুলছে, পথের ওপর সাদা গুঁড়ো গুঁড়ো বরফের কুচি, তীব্র ঠান্ডা পোশাকের ওপর দিয়ে যেন সুচ হয়ে ফুটছে, মাঝে মাঝে পথের ওপর বরফের চাঁই উপুড় হয়ে থাকা ডিঙি নৌকার মতো। গাছপালা খুব সামান্যই চোখে পড়ে। হাঁটতে হাঁটতে ওপরে উঠছিলাম, একটা হিমবাহ আর হিমবাহ গলে নামা জলের ধারায় সৃষ্ট একটা জলপ্রপাত দেখার আশায়। মুঠো ভরে বরফকুচি নিয়ে বল ছোড়ার মতো করে খেলছিলাম আর ছবি তুলছিলাম।
ঠিক একই জায়গায় যখন দ্বিতীয়বার গেলাম, এসব দৃশ্য উধাও হয়ে গেছে। কোথায় সেই সব বরফের কুচি আর জমাট ঝরনাগুলো? পাহাড়ের মাথায় বরফের মুকুটগুলো আছে, তবে তার বিস্তার মনে হলো কিছুটা কমেছে। শক্ত পাথুরে পাহাড়ের গা বেয়ে গজিয়েছে কিছু বুনো গোলাপের গাছ, দিব্যি সেগুলোয় ফুল ফুটছে, ফল ধরছে। দূরে কোথাও কোথাও মনে হলে পাহাড় কেটে সিঁড়ির মতো সমতল করে সেখানে বাঁধাকপি আর কাবুলি মটরের খেত করা হয়েছে। ফাঁকফোকরে পাইনগাছ মাথা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। কোথায় গেল সেই রূপবতী হিমালয়ের বরফশীতল শৈল রূপ? মাত্র ২০ বছরেই এত পরিবর্তন! আরও ২০ বছর পরে তাহলে কী হবে?
হিমালয়কে বলা হয় আমাদের জীবনরেখা বা লাইফলাইন। যে জায়গাটায় গিয়েছিলাম, সেটাকে বলা যায় হিমালয়ের মধ্যাঞ্চল, একেবারে তিব্বত সীমান্ত লাগোয়া। হিন্দুকুশ হিমালয় বলা হয় আমাদের অংশকে, যাকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে আসমুদ্র হিমাচলের জলবায়ু, পরিবেশ ও প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য। হিন্দুকুশ হিমালয় বলতে বোঝায় আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান, নেপাল, চীন, পাকিস্তান ও মিয়ানমারের পার্বত্যাঞ্চলকে। প্রায় ৩ হাজার ৫০০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে হিন্দুকুশ হিমালয় অঞ্চল বিস্তৃত। সাগর থেকে জলবাষ্প কালিদাসের মেঘদূতেরা নিয়ে যায় হিমালয়ের চূড়ায়। সেখানে সেগুলো জমাট বরফ হয়ে থাকে, উষ্ণতা বাড়লে গলতে শুরু করে, হিমবাহ থেকে বরফগলা জল নামতে থাকে নদী দিয়ে। পৃথিবীর মেরু অঞ্চল ছাড়া আর কোথাও এত বরফ নেই।
এশিয়ার ১০টি বড় নদীর জলের উৎস এই হিমালয়। গঙ্গা নদীর উৎসমুখে গিয়ে দেখেছি, সেখানে অলকানন্দা নদী যেন সরু একটা খালের মতো। কিন্তু বরফগলা জলের শত শত প্রবাহ ও গঙ্গোত্রী হিমবাহের জল মিশে কী তীব্র বেগই না সৃষ্টি করেছে তাতে। উষ্ণতা বৃদ্ধির হারটা একটু হেরফের হলেই সেই সব নদীতে বান ডাকে। ২০১৩ সালের জুনে হিমালয় থেকে নেমে আসা তীব্র ঢল ও বন্যায় ভারতের উত্তরাখন্ডে কেদারনাথের কী দুরবস্থা হয়েছিল তা আমরা দেখেছি। সেই ঘটনাকে চিরস্থায়ী করে রেখেছে হিন্দি ভাষার সিনেমা ‘কেদারনাথ’।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে যে হারে ও যত দ্রুত হিমালয়ের এসব বরফ গলছে, তা অতীতে সেভাবে হয়নি। বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বেড়ে হিমালয়ের জমাট বরফ দ্রুত গলে যাওয়ায় নদীগুলোতে জলের প্রবাহ বেড়ে যাচ্ছে। ফলে বন্যা দেখা দিচ্ছে, হচ্ছে ভূমিধস ও ভূমিক্ষয়, জীববৈচিত্র্যের বিনাশ ও ক্ষতি, মাটির জৈব উপাদানের ক্ষয়ে যাওয়া ও উর্বরতা নষ্ট, সেচের সংকট ইত্যাদি। আর এর কৃষি ও সামাজিক প্রভাব পড়ছে এই অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর ওপর। মৌসুমভেদে এর পরিমাণ ও মাত্রা কম-বেশি হলেও আগের তুলনায় এই বরফ গলে জল নামার হার বেড়েছে। মজার বিষয় হলো, হিমালয়ের বরফ গলে জল বেশি নামলেও বিপদ, আবার কম নামলে বা না নামলেও বিপদ।
হিমালয় আমাদের এই অঞ্চলের ভূপ্রকৃতি ও জনজীবনকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। বিষয়টা একটু আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে খোলসা করে দেখা যাক। শীতকালে হিমালয়ে বরফ জমে থাকে বেশি, গরমকালে তা গলে জল হয়ে নামতে থাকে। হিমালয়ের এই বরফ গলা ও জমাট বাঁধার ওপর আমাদের ঋতুবৈচিত্র্য নির্ভর করে। বায়ুমণ্ডলে তাপমাত্রা বাড়ার ফলে যদি হিমালয়ের বরফ খুব বেশি গলে যায়, তাহলে হঠাৎ করে নদীর প্রবাহ বেড়ে যাবে, বন্যায় তলিয়ে যাবে উপত্যকা ও নিম্নভূমি। আবার বরফ বেশি গলে যাওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে নদীগুলোতে জলের প্রবাহ কমে যাবে, নদীতে জল থাকবে না। ফলে নদীতীরবর্তী অঞ্চলে ও ভূগর্ভে জলের সংকট দেখা দেবে। খাওয়ার পানিও জুটবে না, খরায় পুড়ে সব ফসল শেষ হয়ে যাবে। এতে বহু মানুষ খাদ্যসংকটে পড়বে; যা আমাদের জীবন, জীবিকা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও সামাজিকতার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে।
বিভিন্ন গবেষকের গবেষণার ফল ও নাসার ভূ-উপগ্রহের চিত্র বিশ্লেষণ করে এখন বেশ পরিষ্কারভাবে বোঝা যাচ্ছে যে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন দ্রুত হারে হিমালয়ের বরফ গলছে। সম্প্রতি সংবাদপত্রে প্রকাশিত এসংক্রান্ত একটি খবর আমাদের দুশ্চিন্তা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। খবরটিতে বলা হয়েছে, হিন্দুকুশ হিমবাহ ২১০০ সালের শেষ নাগাদ ৮০ শতাংশ গলে যেতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এমনটি হতে পারে। এটা ঠেকাতে হলে বাতাসে কার্বন নিঃসারণের হার কমানোর কোনো বিকল্প নেই। প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়েছে, আগামী ৭৭ বছরের মধ্যে সমগ্র হিন্দুকুশ হিমালয়ের ৮০ শতাংশ হিমবাহ গলে গেলে প্রায় ২০০ কোটি মানুষ বিভিন্ন মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কেউ ভুগবে জলের অভাবে, কেউ ভুগবে জলের আধিক্যে। এতে বাড়বে আকস্মিক বন্যা ও পাহাড়ি ঢল, তুষারপাত, বৃষ্টি।
ফলে হিন্দুকুশ হিমালয়ের মধ্যে বিভিন্ন স্থানে বসবাসকারী ২৪ কোটি এবং হিমালয়ের পাদভূমিতে বসবাসকারী প্রায় ১৬৫ কেটি মানুষ বিভিন্ন সমস্যায় পড়বে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে ফসলের খেত, পশুচারণভূমি ও বাসস্থান। খাওয়ার জল সংগ্রহের কষ্ট বাড়বে। নেপালের কাঠমান্ডুভিত্তিক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ইন্টিগ্রেটেড মাউন্টেইন ডেভেলপমেন্টের সাম্প্রতিক প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে রয়টার্স এ খবর জানিয়েছে।
শিল্পযুগের আগের অবস্থার সঙ্গে যদি আমরা তুলনা করি, তাহলে দেখতে পাব, সেই সময় এই হিন্দুকুশ হিমালয়ের বায়ুমণ্ডলের যে তাপমাত্রা ছিল, তা এখন বেড়ে গেছে। বর্তমান শতকের শেষে যদি এই বর্ধিত তাপমাত্রার পরিমাণ আমরা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখতে না পারি, তাহলে হিমালয়ের কমপক্ষে ৩০ শতাংশ হিমবাহ গলে যাবে। আর যদি বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যায়, তাহলে প্রায় ৫০ শতাংশ হিমবাহ গলে বিপুল পরিমাণ জল এই অঞ্চলের ভূখণ্ডের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশবে। আর তাপমাত্রা যদি এই শতকের শেষে ৩ ডিগ্রি বেড়ে যায়, তাহলেই আমাদের দুর্ভোগের চূড়ান্ত হবে, প্রায় ৭৫ শতাংশ হিমবাহ গলে যাবে, এর বেশি তাপমাত্রা বাড়লে আরও বেশি বরফ গলে একসময় নিঃশেষ হয়ে যাবে হিমালয়ের হিমশীতল বরফরাজি।
তখন মরুভূমি আর মানুষের শূন্যতা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে হিমালয় ও তার পাদভূমি। কোনো জীব আর বেঁচে থাকবে কি না, সেই শঙ্কাও দেখা দিয়েছে এখন। ২০০০ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে হিমালয়ের হিমবাহ যে হারে গলেছে, এর পরের ১০ বছরে, অর্থাৎ ২০১০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে সেই গলনের হার বেড়েছে ৬৫ শতাংশ, যার প্রভাব এখন আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। বরফ কমে যাওয়ায় গরম পড়া বেড়ে যাচ্ছে, শীত কম পড়ছে। আল জাজিরা বলছে, হিমালয়ের সর্বোচ্চ চূড়া মাউন্ট এভারেস্টের হিমবাহ গত ২ হাজার বছরে যে পরিমাণে গলেছে, গত ৩০ বছরে প্রায় তার সমান গলেছে। বিষয়টি খুবই দুশ্চিন্তার।
সব সময় জলবায়ু পরিবর্তন ও তার প্রভাবের কথা উঠলেই আমাদের দৃষ্টি চলে যায় কেবল মেরু অঞ্চলের বরফের দিকে। কিন্তু হিমালয়ের বরফও যে আমাদের কৃষি পরিবেশ ও প্রকৃতির জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা আমরা চিন্তাও করি না। এখন আর অবহেলা করলে চলছে না। যদি বাঁচতে চাই, এই অঞ্চলের পরিবেশ-প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য বাঁচাতে চাই, তাহলে যেকোনোভাবেই হোক, আমাদের এখন বায়ুমণ্ডলে কার্বন নিঃসারণ কমিয়ে তাপমাত্রা স্বাভাবিক রাখতে হবে, না হলে খুব শিগ্গির হয়তো আমরা কেয়ামত দেখতে পাব।
মৃত্যুঞ্জয় রায়, কৃষিবিদ ও লেখক
বিশ বছরের ব্যবধানে দুবার হিমালয়ে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। দুবারই গিয়েছিলাম একই সময়ে, জুন মাসে। এই সামান্য সময়ের ব্যবধানেই পার্থক্যটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলাম। প্রথমবার হিমালয়ের যে পথ ধরে সকালবেলা হেঁটেছিলাম, সেই পথের চারপাশে আহা কী অনিন্দ্য সুন্দর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য! রুক্ষ পাথরের সুউচ্চ পাহাড়ের চূড়াগুলো সাদা বরফের মুকুটে ঢাকা, খাদে খাদে বরফের স্রোত যেন নদীরেখার মতো, ওপর থেকে নেমে আসা শত শত ঝরনার জল চকচকে কাচের ফিতার মতো জমাট বরফ হয়ে ঝুলছে, পথের ওপর সাদা গুঁড়ো গুঁড়ো বরফের কুচি, তীব্র ঠান্ডা পোশাকের ওপর দিয়ে যেন সুচ হয়ে ফুটছে, মাঝে মাঝে পথের ওপর বরফের চাঁই উপুড় হয়ে থাকা ডিঙি নৌকার মতো। গাছপালা খুব সামান্যই চোখে পড়ে। হাঁটতে হাঁটতে ওপরে উঠছিলাম, একটা হিমবাহ আর হিমবাহ গলে নামা জলের ধারায় সৃষ্ট একটা জলপ্রপাত দেখার আশায়। মুঠো ভরে বরফকুচি নিয়ে বল ছোড়ার মতো করে খেলছিলাম আর ছবি তুলছিলাম।
ঠিক একই জায়গায় যখন দ্বিতীয়বার গেলাম, এসব দৃশ্য উধাও হয়ে গেছে। কোথায় সেই সব বরফের কুচি আর জমাট ঝরনাগুলো? পাহাড়ের মাথায় বরফের মুকুটগুলো আছে, তবে তার বিস্তার মনে হলো কিছুটা কমেছে। শক্ত পাথুরে পাহাড়ের গা বেয়ে গজিয়েছে কিছু বুনো গোলাপের গাছ, দিব্যি সেগুলোয় ফুল ফুটছে, ফল ধরছে। দূরে কোথাও কোথাও মনে হলে পাহাড় কেটে সিঁড়ির মতো সমতল করে সেখানে বাঁধাকপি আর কাবুলি মটরের খেত করা হয়েছে। ফাঁকফোকরে পাইনগাছ মাথা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। কোথায় গেল সেই রূপবতী হিমালয়ের বরফশীতল শৈল রূপ? মাত্র ২০ বছরেই এত পরিবর্তন! আরও ২০ বছর পরে তাহলে কী হবে?
হিমালয়কে বলা হয় আমাদের জীবনরেখা বা লাইফলাইন। যে জায়গাটায় গিয়েছিলাম, সেটাকে বলা যায় হিমালয়ের মধ্যাঞ্চল, একেবারে তিব্বত সীমান্ত লাগোয়া। হিন্দুকুশ হিমালয় বলা হয় আমাদের অংশকে, যাকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে আসমুদ্র হিমাচলের জলবায়ু, পরিবেশ ও প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য। হিন্দুকুশ হিমালয় বলতে বোঝায় আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান, নেপাল, চীন, পাকিস্তান ও মিয়ানমারের পার্বত্যাঞ্চলকে। প্রায় ৩ হাজার ৫০০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে হিন্দুকুশ হিমালয় অঞ্চল বিস্তৃত। সাগর থেকে জলবাষ্প কালিদাসের মেঘদূতেরা নিয়ে যায় হিমালয়ের চূড়ায়। সেখানে সেগুলো জমাট বরফ হয়ে থাকে, উষ্ণতা বাড়লে গলতে শুরু করে, হিমবাহ থেকে বরফগলা জল নামতে থাকে নদী দিয়ে। পৃথিবীর মেরু অঞ্চল ছাড়া আর কোথাও এত বরফ নেই।
এশিয়ার ১০টি বড় নদীর জলের উৎস এই হিমালয়। গঙ্গা নদীর উৎসমুখে গিয়ে দেখেছি, সেখানে অলকানন্দা নদী যেন সরু একটা খালের মতো। কিন্তু বরফগলা জলের শত শত প্রবাহ ও গঙ্গোত্রী হিমবাহের জল মিশে কী তীব্র বেগই না সৃষ্টি করেছে তাতে। উষ্ণতা বৃদ্ধির হারটা একটু হেরফের হলেই সেই সব নদীতে বান ডাকে। ২০১৩ সালের জুনে হিমালয় থেকে নেমে আসা তীব্র ঢল ও বন্যায় ভারতের উত্তরাখন্ডে কেদারনাথের কী দুরবস্থা হয়েছিল তা আমরা দেখেছি। সেই ঘটনাকে চিরস্থায়ী করে রেখেছে হিন্দি ভাষার সিনেমা ‘কেদারনাথ’।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে যে হারে ও যত দ্রুত হিমালয়ের এসব বরফ গলছে, তা অতীতে সেভাবে হয়নি। বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বেড়ে হিমালয়ের জমাট বরফ দ্রুত গলে যাওয়ায় নদীগুলোতে জলের প্রবাহ বেড়ে যাচ্ছে। ফলে বন্যা দেখা দিচ্ছে, হচ্ছে ভূমিধস ও ভূমিক্ষয়, জীববৈচিত্র্যের বিনাশ ও ক্ষতি, মাটির জৈব উপাদানের ক্ষয়ে যাওয়া ও উর্বরতা নষ্ট, সেচের সংকট ইত্যাদি। আর এর কৃষি ও সামাজিক প্রভাব পড়ছে এই অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর ওপর। মৌসুমভেদে এর পরিমাণ ও মাত্রা কম-বেশি হলেও আগের তুলনায় এই বরফ গলে জল নামার হার বেড়েছে। মজার বিষয় হলো, হিমালয়ের বরফ গলে জল বেশি নামলেও বিপদ, আবার কম নামলে বা না নামলেও বিপদ।
হিমালয় আমাদের এই অঞ্চলের ভূপ্রকৃতি ও জনজীবনকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। বিষয়টা একটু আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে খোলসা করে দেখা যাক। শীতকালে হিমালয়ে বরফ জমে থাকে বেশি, গরমকালে তা গলে জল হয়ে নামতে থাকে। হিমালয়ের এই বরফ গলা ও জমাট বাঁধার ওপর আমাদের ঋতুবৈচিত্র্য নির্ভর করে। বায়ুমণ্ডলে তাপমাত্রা বাড়ার ফলে যদি হিমালয়ের বরফ খুব বেশি গলে যায়, তাহলে হঠাৎ করে নদীর প্রবাহ বেড়ে যাবে, বন্যায় তলিয়ে যাবে উপত্যকা ও নিম্নভূমি। আবার বরফ বেশি গলে যাওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে নদীগুলোতে জলের প্রবাহ কমে যাবে, নদীতে জল থাকবে না। ফলে নদীতীরবর্তী অঞ্চলে ও ভূগর্ভে জলের সংকট দেখা দেবে। খাওয়ার পানিও জুটবে না, খরায় পুড়ে সব ফসল শেষ হয়ে যাবে। এতে বহু মানুষ খাদ্যসংকটে পড়বে; যা আমাদের জীবন, জীবিকা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও সামাজিকতার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে।
বিভিন্ন গবেষকের গবেষণার ফল ও নাসার ভূ-উপগ্রহের চিত্র বিশ্লেষণ করে এখন বেশ পরিষ্কারভাবে বোঝা যাচ্ছে যে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন দ্রুত হারে হিমালয়ের বরফ গলছে। সম্প্রতি সংবাদপত্রে প্রকাশিত এসংক্রান্ত একটি খবর আমাদের দুশ্চিন্তা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। খবরটিতে বলা হয়েছে, হিন্দুকুশ হিমবাহ ২১০০ সালের শেষ নাগাদ ৮০ শতাংশ গলে যেতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এমনটি হতে পারে। এটা ঠেকাতে হলে বাতাসে কার্বন নিঃসারণের হার কমানোর কোনো বিকল্প নেই। প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়েছে, আগামী ৭৭ বছরের মধ্যে সমগ্র হিন্দুকুশ হিমালয়ের ৮০ শতাংশ হিমবাহ গলে গেলে প্রায় ২০০ কোটি মানুষ বিভিন্ন মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কেউ ভুগবে জলের অভাবে, কেউ ভুগবে জলের আধিক্যে। এতে বাড়বে আকস্মিক বন্যা ও পাহাড়ি ঢল, তুষারপাত, বৃষ্টি।
ফলে হিন্দুকুশ হিমালয়ের মধ্যে বিভিন্ন স্থানে বসবাসকারী ২৪ কোটি এবং হিমালয়ের পাদভূমিতে বসবাসকারী প্রায় ১৬৫ কেটি মানুষ বিভিন্ন সমস্যায় পড়বে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে ফসলের খেত, পশুচারণভূমি ও বাসস্থান। খাওয়ার জল সংগ্রহের কষ্ট বাড়বে। নেপালের কাঠমান্ডুভিত্তিক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ইন্টিগ্রেটেড মাউন্টেইন ডেভেলপমেন্টের সাম্প্রতিক প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে রয়টার্স এ খবর জানিয়েছে।
শিল্পযুগের আগের অবস্থার সঙ্গে যদি আমরা তুলনা করি, তাহলে দেখতে পাব, সেই সময় এই হিন্দুকুশ হিমালয়ের বায়ুমণ্ডলের যে তাপমাত্রা ছিল, তা এখন বেড়ে গেছে। বর্তমান শতকের শেষে যদি এই বর্ধিত তাপমাত্রার পরিমাণ আমরা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখতে না পারি, তাহলে হিমালয়ের কমপক্ষে ৩০ শতাংশ হিমবাহ গলে যাবে। আর যদি বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যায়, তাহলে প্রায় ৫০ শতাংশ হিমবাহ গলে বিপুল পরিমাণ জল এই অঞ্চলের ভূখণ্ডের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশবে। আর তাপমাত্রা যদি এই শতকের শেষে ৩ ডিগ্রি বেড়ে যায়, তাহলেই আমাদের দুর্ভোগের চূড়ান্ত হবে, প্রায় ৭৫ শতাংশ হিমবাহ গলে যাবে, এর বেশি তাপমাত্রা বাড়লে আরও বেশি বরফ গলে একসময় নিঃশেষ হয়ে যাবে হিমালয়ের হিমশীতল বরফরাজি।
তখন মরুভূমি আর মানুষের শূন্যতা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে হিমালয় ও তার পাদভূমি। কোনো জীব আর বেঁচে থাকবে কি না, সেই শঙ্কাও দেখা দিয়েছে এখন। ২০০০ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে হিমালয়ের হিমবাহ যে হারে গলেছে, এর পরের ১০ বছরে, অর্থাৎ ২০১০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে সেই গলনের হার বেড়েছে ৬৫ শতাংশ, যার প্রভাব এখন আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। বরফ কমে যাওয়ায় গরম পড়া বেড়ে যাচ্ছে, শীত কম পড়ছে। আল জাজিরা বলছে, হিমালয়ের সর্বোচ্চ চূড়া মাউন্ট এভারেস্টের হিমবাহ গত ২ হাজার বছরে যে পরিমাণে গলেছে, গত ৩০ বছরে প্রায় তার সমান গলেছে। বিষয়টি খুবই দুশ্চিন্তার।
সব সময় জলবায়ু পরিবর্তন ও তার প্রভাবের কথা উঠলেই আমাদের দৃষ্টি চলে যায় কেবল মেরু অঞ্চলের বরফের দিকে। কিন্তু হিমালয়ের বরফও যে আমাদের কৃষি পরিবেশ ও প্রকৃতির জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা আমরা চিন্তাও করি না। এখন আর অবহেলা করলে চলছে না। যদি বাঁচতে চাই, এই অঞ্চলের পরিবেশ-প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য বাঁচাতে চাই, তাহলে যেকোনোভাবেই হোক, আমাদের এখন বায়ুমণ্ডলে কার্বন নিঃসারণ কমিয়ে তাপমাত্রা স্বাভাবিক রাখতে হবে, না হলে খুব শিগ্গির হয়তো আমরা কেয়ামত দেখতে পাব।
মৃত্যুঞ্জয় রায়, কৃষিবিদ ও লেখক
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা এলাকায় যাত্রীবাহী বাসে ডাকাতি বেড়েই চলছে। এ কারণে চালক ও যাত্রীদের কাছে আতঙ্কের নাম হয়ে উঠছে এই সড়ক। ডাকাতির শিকার বেশি হচ্ছেন প্রবাসফেরত লোকজন। ডাকাতেরা অস্ত্র ঠেকিয়ে লুট করে নিচ্ছে সর্বস্ব। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়েও ঘটছে ডাকাতির ঘটনা।
০২ মার্চ ২০২৫বিআরটিসির বাস দিয়ে চালু করা বিশেষায়িত বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) লেনে অনুমতি না নিয়েই চলছে বেসরকারি কোম্পানির কিছু বাস। ঢুকে পড়ছে সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। উল্টো পথে চলছে মোটরসাইকেল। অন্যদিকে বিআরটিসির মাত্র ১০টি বাস চলাচল করায় সোয়া চার হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্প থেকে...
১৬ জানুয়ারি ২০২৫গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
২৪ নভেম্বর ২০২৪ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
২০ নভেম্বর ২০২৪