Ajker Patrika

ভালোবাসামাখা আলীপুর

আশিস রহমান, দোয়ারাবাজার (সুনামগঞ্জ)
আপডেট : ০৩ ডিসেম্বর ২০২১, ১০: ৫১
ভালোবাসামাখা আলীপুর

যত দূর চোখ যায় সবুজে বিস্তৃত ফসলের মাঠ। দক্ষিণ-পশ্চিমের কানলার হাওর সূর্যের আলোর রুপালি রোদ মাখে যেন। পূর্বে নিয়ত বয়ে চলা পাহাড়ি খরস্রোতা খাসিয়ামারা নদী। আর উত্তরে দূরবর্তী মেঘালয়ের খাসিয়া পাহাড়ের সুনীল হাতছানি।

এরই মাঝখানে ভালোবাসা মাখা ছোট্ট গ্রাম আলীপুর।

সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজারের সুরমা ইউনিয়নের এ গ্রামেই আমার বেড়ে ওঠা। এখানকার ধূলিকণা, বালি আর ধূসর মাটিতে শৈশবে কত জানা-অজানা খেলায় মেতে থাকতাম। গ্রীষ্মের দুপুরের তপ্ত রোদে খাসিয়ামারা নদীর স্বচ্ছ জলরাশিতে দল বেঁধে জলকেলি করতাম। স্রোত কাটিয়ে সাঁতরে বেড়াতাম নদীর এপার থেকে ওপারে। সারা দুপুর খেলতাম ‘লাই খেলা’। নদীতে না যেতে পারলেও ছিল পুকুর। বড় জারুলগাছ থেকে পুকুরে লাফ দিয়ে দল বেঁধে গোসল করতাম।

মোবাইল গেমে আসক্ত আজকের প্রজন্ম লাই খেলার নাম হয়তো কখনো শোনেনি!

আরে! স্মৃতিকাতর হয়ে ভুলেই গেলাম আমাদের গ্রামের চমৎকার ইতিহাসও আছে। প্রবীণদের কাছে শুনতে পাই, এককালে আলীপুর গ্রাম কালাপানি নামে পরিচিত ছিল। ব্রিটিশ শাসনামলের শুরুর দিকে জমিদারেরা অপরাধীদের এই কালাপানিতে নির্বাসন দিতেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। পাঁচের দশকে এখানে গড়ে ওঠে জনবসতি। হিংস্র প্রাণীর বাসস্থান শ্বাপদসংকুল ঘন জঙ্গল আবাদ করে ঘর ওঠে এই গ্রামে। জনৈক হাফিজ আলী আহমদের নাম অনুসারে কালাপানি থেকে এই গ্রামের নামকরণ করা হয় আলীপুর।

আলীপুরের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করেছে কৃষি ও মাছ চাষ। বাণিজ্যিকভাবে এখানে প্রতিবছর প্রচুর মাছের উৎপাদন করা হয়। গ্রামে উৎপাদিত এসব মাছ সারা বছর স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে জেলা শহর ও বাইরে বিক্রি করা হয়। ঘরে ঘরে এখন শিক্ষার আলো ছড়িয়ে পড়েছে। রয়েছে আলীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মুহিবুর রহমান মানিক সোনালি নূর উচ্চবিদ্যালয়, আলীপুর নুরানিয়া হাফিজিয়া ইবতেদায়ি মাদ্রাসা, আলীপুর নুরানি কিন্ডার গার্টেন। আলীপুর বাজার নামে একটি বাজারও গড়ে উঠেছে। আরও রয়েছে আলীপুর জামে মসজিদ (হজরত আলী রা. জামে মসজিদ) ও আলীপুর পশ্চিমপাড়া জামে মসজিদ।

ঘরে ঘরে বিদ্যুৎসুবিধা থাকায় প্রযুক্তিতে আগের চেয়ে অনেক এগিয়ে গেছে আলীপুর। তবে স্মৃতির পাতায় বড় ক্ষত। একসময়কার খড়ের কুঁড়েঘর এখন বিলুপ্ত। নগরায়ণের প্রভাবে পাকা রাস্তাঘাট, টিনশেড আর ইট-সিমেন্টের দালান সর্বত্র।

মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় এখানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বাংকার ছিল। মুক্তিযুদ্ধকালীন স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য মরহুম আমজাদ হোসেন মাস্টার, বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম শাহজাহান হোসেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম হেলাল উদ্দিন, বীর মুক্তিযোদ্ধা হ‌ুমায়ূন আহমেদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা সফিউদ্দীন, বীর মুক্তিযোদ্ধা সিদ্দিক মিয়া এই গ্রামেরই সূর্যসন্তান।

যেখানেই যাই আবেগ ও ভালোবাসার গ্রাম আলীপুরের মাটি ও মানুষের কথা মনে পড়ে। প্রায়ই গ্রামের স্মৃতি রোমন্থন করে আবেগাপ্লুত হই। গ্রামের কবরস্থানে মৃত আত্মীয়স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীকে দাফন করার শেষ বিদায়ের করুণ হৃদয়বিদারক দৃশ্যও চোখে ভাসে। পূর্বসূরিদের মতো এক সময় আমিও এখানে চিরনিদ্রায় শায়িত হব।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত