Ajker Patrika

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গুলি, নিহত ৬

শাহরিয়ার হাসান, ঢাকা ও মাইনউদ্দিন শাহেদ, কক্সবাজার
আপডেট : ২৩ অক্টোবর ২০২১, ১৭: ৩২
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গুলি, নিহত ৬

বাইরের দিক থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্প শান্ত মনে হলেও ভেতরে-ভেতরে অস্থিরতা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মুহিবুল্লাহকে হত্যার ২৩ দিনের মাথায় আবারও সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছে। এতে ঘটনাস্থলেই ৪ জনসহ মোট ৬ জন নিহত ও অন্তত ১০ জন আহত হয়েছেন। গতকাল শুক্রবার ভোররাতে উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্প-১৮-এর ‘দারুল উলুম নাদওয়াতুল ওলামা আল-ইসলামিয়াহ’ মাদ্রাসায় এ ঘটনা ঘটে।

স্থানীয় মুসল্লিরা বলছেন, ঘুম থেকে উঠে মসজিদের দিকে যাচ্ছিলেন তাঁরা। যেতে যেতে কানে আসছিল গুলির শব্দ। একপর্যায়ে সবাই ছোটাছুটি শুরু করেন। গুলি থামার পর দেখেন রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছেন অনেকে।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্র বলছে, হামলাকারীরা ক্যাম্পের ভেতরে তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সম্প্রতি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়ার পর এ গোষ্ঠীই অনেক রোহিঙ্গাকে ভয়ভীতি দেখিয়েছে, যাতে তারা ফিরে যেতে রাজি না হয়। অভিযোগের আঙুল উঠেছে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) দিকে।

রোহিঙ্গা শিবিরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অধিনায়ক ও পুলিশ সুপার শিহাব কায়সার আজকের পত্রিকাকে বলেন, নিহত ব্যক্তিরা ক্যাম্পের ভেতরে থাকা একটি মাদ্রাসার শিক্ষক ও ছাত্র। গুলির পর তাঁদের কুপিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। তবে কারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে, তা এখনো স্পষ্ট নয়।

এ ঘটনায় নিহত ব্যক্তিরা হলেন উখিয়ার বালুখালী-২-এর ইদ্রিস (৩২), বালুখালী-১-এর ইব্রাহীম হোসেন (২২), ১৮ নম্বর ক্যাম্পের এইচ ব্লকের বাসিন্দা নুরুল ইসলামের ছেলে আজিজুল হক (২৬), আবুল হোসেনের ছেলে মো. আমীন (৩২,) মোহাম্মদ নবীর ছেলে নুরুল আলম ওরফে হালিম (৪৫) ও রহিম উল্লার ছেলে হামিদ উল্লাহ (৫৫)। মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য কক্সবাজার সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। আহত ব্যক্তিদের স্থানীয় কক্সবাজার সদর হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) রফিকুল ইসলাম বলেন, চারদিক থেকে গুলিবর্ষণ হওয়ায় কেউ মসজিদ থেকে বের হতে পারেননি। অতর্কিত এমন হামলার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পুলিশের একাধিক টিম পাঠানো হয়। এতে ঘটনাস্থলে চারজন ও হাসপাতালে নেওয়ার পর আরও দুজনের মৃত্যুর হয়। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত মুজিবুর রহমান নামের একজনকে আটক করা হয়েছে। তাঁর কাছ থেকে ছয় রাউন্ড গুলি ও একটি লম্বা ছুরি উদ্ধার করা গেছে।

গতকাল শুক্রবার সিলেটে এক সভায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, প্রত্যাবাসন ঠেকাতেই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন অঘটন ঘটানো হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন যারা চায় না, যাদের স্বার্থে আঘাত লাগে, তারা হয়তো এমন অঘটন ঘটাতে পারে।

এ হত্যাকাণ্ডের পর থেকে রোহিঙ্গা শিবিরে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। রোহিঙ্গা শিবিরগুলোর নেতা, মাঝি ও সাধারণ রোহিঙ্গাদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। কেউই মুখ খুলছে না। অনেকে মোবাইল ফোন বন্ধ করে রেখেছেন। কয়েকজন মাঝি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এ ঘটনার পর থেকে শিবিরে সেবা প্রদানকারী সংস্থা, নেতা, মাঝি ও সাধারণ রোহিঙ্গাদের চলাচল সীমিত হয়ে এসেছে। সর্বত্র ভয়, আতঙ্ক ও ক্ষোভ বিরাজ করছে।

প্রত্যাবাসন নিয়ে খুনোখুনি বাড়ছে
গত মাসের ৩০ তারিখে উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পের ভেতরে আততায়ীদের গুলিতে নিহত হন রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ। তিনি প্রত্যাবাসন নিয়ে সরব ছিলেন। রোহিঙ্গাদের অধিকারের বিষয়ে দেশে-বিদেশে পরিচিত ছিলেন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস (এআরএসপিএইচ)-এর এই চেয়ারম্যান। পুলিশ, সরকার ও ভুক্তভোগীর পরিবার বলছে, প্রত্যাবাসন নিয়ে কাজ করতে গিয়েই খুন হন তিনি।

তবে মুহিবুল্লাহর আগেও স্বদেশে প্রত্যাবাসন নিয়ে সক্রিয়ভাবে যুক্ত আরও অন্তত ১০ জন রোহিঙ্গা নেতা বিভিন্ন সময় খুন হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। গত ১৬ মে উখিয়ার লম্বাশিয়া এলাকায় শওকত আলী নামের এক রোহিঙ্গা ব্যবসায়ী খুন হন। এর আগে খুন হন মো. আরিফ উল্লাহ, মো. হাশিম ও মাওলানা আবদুল্লাহ। তাঁরা সবাই প্রত্যাবাসনের পক্ষের নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন।

পুলিশ সুপার মোহাম্মদ নাঈমুল হক বলেন, প্রত্যাবাসন নিয়ে রোহিঙ্গাদের পক্ষে-বিপক্ষে দল রয়েছে। সম্ভাব্য সব কারণ অনুসন্ধান করে এসব হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করা হচ্ছে।

আধিপত্য বিস্তার ও অন্তর্কোন্দলে ৭১ খুন
উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি রোহিঙ্গা শিবিরে আধিপত্য বিস্তার, অন্তর্কোন্দল ও মতাদর্শগত বিরোধ নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনা বাড়ছেই। গত চার বছরে রোহিঙ্গারা মাদক পাচার, অপহরণ, খুন ও ধর্ষণসহ ১২ ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিবেদন জানা গেছে। এসব ঘটনায় চলতি বছরেই রোহিঙ্গা নেতাসহ অন্তত ১৭ জন খুন হয়েছেন। আর চার বছরে নিজেদের মধ্যে খুনোখুনির শিকার হয়েছেন ৭১ জন। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ দুই নারীসহ অন্তত ১১২ জন রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে।

তবে স্থানীয় লোকজন বলছেন, শুধু নিজেদের মধ্যে খুনোখুনি নয়, তাদের হাতে আক্রান্ত হচ্ছে স্থানীয় জনগোষ্ঠীও। অনেক জায়গায় তাদের দাপটে স্থানীয় লোকজন কোণঠাসা ও আতঙ্কগ্রস্ত। তা ছাড়া, প্রতিনিয়ত রোহিঙ্গা বসতি এলাকার স্থানীয় বাসিন্দারাও তাদের হামলার শিকার হচ্ছেন।

সবশেষ গত ১৪ আগস্ট রাতে টেকনাফের হোয়াইক্যংয়ে মোহাম্মদ আলীর বাড়িতে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা আক্রমণ চালায়। তাঁকে না পেয়ে এ সময় স্ত্রী মোহসেনা আক্তারকে খুন করে সন্ত্রাসীরা। গত ৩০ জুন রাতে হোয়াইক্যং-শামলাপুর সড়ক থেকে স্থানীয় মাহমুদুল করিম ও মিজানুর রহমান রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের হাতে অপহরণের শিকার হন। দুই দিন পর মুক্তিপণ দিয়ে মিজান ছাড়া পেলেও মাহমুদুল করিম নামের এক ব্যবসায়ীকে খুন করা হয়।

সার্বিক বিষয়ে এপিবিএনের ১৪ অধিনায়ক পুলিশ সুপার নাঈমুল হক আজকের পত্রিকাকে বলেন, হত্যাকাণ্ডের পর থেকে রোহিঙ্গা শিবিরে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন ও একাধিক টহল বাড়ানো হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তারে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হত্যা ও নির্যাতনের মুখে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন আট লাখ রোহিঙ্গা। এর আগে আসে আরও অনেক রোহিঙ্গা। বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১১ লাখ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বেনজীরের এক ফ্ল্যাটেই ১৯ ফ্রিজ, আরও বিপুল ব্যবহার সামগ্রী উঠছে নিলামে

ছেলের লাশ পেতে পুলিশের হয়রানির শিকার হতে হয়েছে

ই-মেইলে একযোগে ৫৪৭ ব্যাংক কর্মকর্তা চাকরিচ্যুত, পুনর্বহালের দাবি

সচিবালয়ে শিক্ষার্থীদের মারধরের প্রতিবাদে সিপিবি-বাসদের ওয়াকআউট

এইচএসসির স্থগিত ২২ ও ২৪ জুলাইয়ের পরীক্ষা একই দিনে: শিক্ষা উপদেষ্টা

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত