মামুনুর রশীদ
মানুষের জীবনের দীর্ঘ যাত্রাটি শুরু হয় শিশুর ছোট্ট দুটি পা দিয়ে। তারপর পৃথিবীর বুকে তার অভিযান চলে নিরন্তর। ওয়াশিংটন ডিসির বইমেলাও শুরু হয় একেবারেই ছোট একটা জায়গা থেকে। একেবারে সূচনায় দাস্তগীর জাহাঙ্গীর উদ্যোগ নেন। এর আগে বাঙালির চিরদিনের সংস্কৃতির ছোট বাক্সটি সঙ্গেই ছিল। এই প্রিয় অমূল্য বাক্সটিতে থাকে বাংলার গান, আবৃত্তি, নাচ আর অসংখ্য স্মৃতি। তাই প্রবাসে এই চর্চা ছোট আর বড় আকারে চলতেই থাকে।
এর মধ্যেই দ্রুত সাড়া দেন বেশ কজন, যাঁদের মধ্যে আছেন ডা. আনোয়ার ইকবাল, সামিনা আমিন, আতিয়া মাহজাবীন, ডা. নজরুল ইসলাম। তাঁরা সবাই সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করেন। ২০১৮ ও ২০১৯-এ বইমেলা হয়ে গেল। এরপর দুই বছর কোভিডের জন্য হতে পারেনি। আবার ২০২২ থেকে শুরু হয়েছে। সেই ভাবনাটি বড় হতে হতে এখন ওয়াশিংটন ডিসির বইমেলা আমেরিকার বিভিন্ন প্রান্ত এবং ইউরোপ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। এবারের বইমেলায় যে আভাস পাওয়া গেল, তাতে ভবিষ্যতে আরও সম্প্রসারণ হতেই থাকবে।
মেলায় প্রথম দিনই সকালে দেখা হয়ে গেল বইমেলার এক অনুঘটক ও আমার প্রিয় ড. নুরুন্নবীর সঙ্গে। আমার আরেক প্রিয়জন, তাঁর স্ত্রী। নুরুন্নবীর সঙ্গে দেখা হলেই আমার স্মৃতিতে দ্রুত ফ্ল্যাশব্যাক হতে থাকে সেই ৫২ বছরের কত ঘটনা—মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধোত্তর জন্মঝড়ের বাংলাদেশ (তাঁরই বইয়ের নাম)। এরপর কত আয়োজন, কত উদ্যোগ। আর যেকোনো শুভ উদ্যোগেই পাওয়া যায় নুরুন্নবীকে। কথা এবং কাজের ঐক্যে বাঙালিদের যে খুব একটা পাওয়া যায়, তা নয়। যেখানে যাই, সেখানেই আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ি।
১৯৯২ সালে যখন ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত হয়, তখন আমাকে যুক্তরাষ্ট্রে যেতে হয়েছিল অন্য একটা কাজে। শহীদজননী জাহানারা ইমাম আমাকে দায়িত্ব দিলেন আমি যেন নিউইয়র্কে গিয়ে ওখানে একটা শাখা কমিটি গঠন করি। ঠিকানা—ড. নুরুন্নবী। নুরুন্নবীকে খবর দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নিউ জার্সি থেকে নিউইয়র্কে এলে শাখা করা হলো। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে নানাভাবে উদ্যোগ নিলেন নুরুন্নবী। নুরুন্নবী তাঁর পেশাগত দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি কত ধরনের উদ্যোগে যে অংশ নিয়েছেন, তা সম্ভবত এখন আর হাতে গোনা যাবে না। স্বদেশেও তাঁর নানা উদ্যোগ চলেছে। কত মানুষকে, কত সংগঠনকে তিনি সাহায্য করেই চলেছেন। এ রকম মানুষ প্রবাসে আরও যে আছে, এ ব্যাপারে আমার কোনো সন্দেহ নেই। আছে বলেই অনেক বড় বড় আয়োজন করা সম্ভব হচ্ছে।
দেখা হলো সবচেয়ে বয়স্ক তরুণ মাজহারুল হক সাহেবের সঙ্গে। ৯১ বছরের এই তরুণ ঘুরে বেড়াচ্ছেন বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে। প্রতিটি সেমিনারে অংশ নিচ্ছেন, কথা বলছেন। মাঝে মাঝে উত্তেজিতও হচ্ছেন। ১৯৭১ সালে ফিলাডেলফিয়া থেকে একটি জাহাজে করে পাকিস্তানিরা অস্ত্র নিয়ে আসছিল। সেখানকার তরুণ ছাত্রছাত্রীরা এই সংবাদ জানতে পেরে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। অনেকেই গ্রেপ্তার হন। নিপীড়ন হয় তাঁদের ওপর। সেই সময় কিছু বাঙালিও যুক্ত হয়। (তখনকার একজন নেতা এখনো জীবিত। একজনের কাছে আমার পুত্র আমাকে নিয়েও গিয়েছিল। সে-সম্পর্কে পরে বিস্তারিত লিখব।) এই ঘটনার ওপর নির্মিত প্রামাণ্যচিত্রটি দেখতে দেখতে একসময় মাজাহার সাহেব উত্তেজিত হয়ে নিজেই গিয়ে প্রদর্শনীটি বন্ধ করে দেন এবং পরের অংশটিকে অপ্রয়োজনীয় মনে করেন। কিন্তু উদ্যোক্তারা গিয়ে তাঁকে বুঝিয়ে আবার চালু করেন এবং দেখা গেল, অত্যন্ত প্রয়োজনীয় অংশ তার মধ্যে রয়ে গেছে।
দুটি হলেই চলছিল সেমিনার, প্রামাণ্যচিত্র, আবৃত্তি, গানের অনুষ্ঠান। সাহিত্যের আলোচনা ছাড়াও চলছিল বিজ্ঞানভিত্তিক, গবেষণাভিত্তিক আলোচনা। এর মধ্যেই সবাই দুপুরের খাবার, চা, কফি, হালকা নাশতা সেরে নিচ্ছে। সবচেয়ে প্রশংসনীয় হচ্ছেন, প্রায় সবাই পরিবার নিয়ে এসেছেন। শিশু, পুত্র, কন্যা নিয়েও এসেছেন। তবে আমার প্রত্যাশা ছিল পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরাও এখানে আসবেন এবং অংশ নেবেন। কিন্তু সেটি দেখতে পেলাম না। হয়তো এসেছেন কিন্তু আমার সঙ্গে দেখা হয়নি। এ কথা সত্যি, প্রবাসে, বিশেষ করে ইউরোপ-আমেরিকায় প্রচুরসংখ্যক অধ্যাপক, বিশেষজ্ঞ, চিকিৎসক প্রবাসজীবনে বিশেষ কৃতিত্বের ছাপ রেখে থাকেন। তাঁদের একটা বড় অংশ এই পূর্ব বাংলা থেকেই গেছে। অন্তত অশোক মিত্রের আপিলা-চাপিলা এবং তপন রায় চৌধুরীর বাঙালনামা পড়ে তা-ই মনে হয়েছে। অমর্ত্য সেনও পূর্ব বাংলার কথা বহুবার স্মরণ করেছেন। এ বিষয়ে উদ্যোক্তাদের নিশ্চয়ই ভাবনা আছে।
বইমেলার অংশটি সব সময় খুব সরগরম থাকছিল। বাংলাদেশ দূতাবাসের একটি বড় স্টল থাকলেও সে জায়গাটি প্রায়ই শূন্য থাকত। এর কারণ কিছু বোঝা গেল না। সারা দিনের কর্মব্যস্ততার পর এসে গেল সমাপনী অনুষ্ঠান। নৃত্য, সংগীত, আবৃত্তির সঙ্গে কিছু কিছু ব্যক্তিত্বের ছোট ছোট আলোচনা। প্রায় শেষের দিকে আমার সাক্ষাৎকারভিত্তিক উপস্থাপন। উপস্থাপনা করলেন ২০১৯ সালের সমন্বয়ক ও এবারের কর্মব্যস্ত সংগঠক সামিনা আমিন। বাংলাদেশের শিশুসাহিত্য নিয়ে প্রশ্ন এবং আমার সাধ্যমতো জবাব। মাঝে মাঝে একটু বিতর্কও। সেই সঙ্গে কিছু অভিনয়-আবৃত্তি। বোধ হয় বিষয়টি বিরক্তিকর হয়নি বলে বেশ অনেকক্ষণ ধরে চলল। সবারই দেশের শিল্প-সাহিত্যের খবর জানার প্রচুর আগ্রহ।
অবশেষে যবনিকা নামল ওয়াশিংটন ডিসি বইমেলার। যবনিকা টানলেই কি হয়? ছোট ছোট আড্ডা জমে ওঠে সর্বত্র। কখনো হোটেলের ভেতরে, কখনো বাইরে। সেখানেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা হয়। সাহিত্য-সংস্কৃতি, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা—সবকিছু নিয়ে। যেমন অভিবাসনের প্রক্রিয়া অনেকটাই নদীর মতো বহমান। কেউ এক জায়গায় স্থির হয়ে থাকে না। এই শহর থেকে সেই শহর আবার এই দেশ থেকে অন্য দেশ। অনেকেই এসেছেন সোভিয়েত দেশ থেকে। আবার সোভিয়েতের বিপর্যয়ের পর ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক ব্লক থেকে। সে রকম একজন মানুষ দাস্তগীর জাহাঙ্গীর। এসেছেন চেক রিপাবলিক থেকে। তিনি সেই সময়ে চেক রিপাবলিকে ছিলেন, যখন গ্লাসনস্ত-পেরস্ত্রোয়কা চলছে। স্নায়ুযুদ্ধের শেষ সময়। ইউরোপ খুলে গেছে। একজন নাট্যকার তখন সেখানকার প্রেসিডেন্ট। সে এক উত্তেজনার সময়। কপর্দকহীন অবস্থায় দাস্তগীর ইউরোপ ঘুরে বেড়িয়েছেন।
আমার পুত্রের কল্যাণে এসে ‘ওপেনহাইমার’ ছবিটি দেখেছিলাম, বইটিও কিনে দিয়েছিল। এটাও কখনো আলোচনার কেন্দ্রে এসে গেছে। ক্রিস্টোফার নোলান পরিচালিত ছবিটি সারা বিশ্বে প্রদর্শিত হচ্ছে। দেশে এসে দেখলাম, ঢাকার সিনেমা হলেও চলছে। সারা বিশ্বেই এখন শিল্প-সাহিত্যের একটা সংকট চলছে। জীবনের প্রতিটি পরতে যেভাবে ডিজিটাল সংস্কৃতি ঢুকে গেছে, তাতে নতুন ধরনের মানবিক সংকট শুরু হয়েছে। তবে মানবজাতি অপ্রয়োজনীয় কিছু রক্ষা করে না। কিন্তু বর্তমান সংকটকে কী করে মোকাবিলা করবে, সেটাই প্রশ্ন। এসব নিয়ে আড্ডা কখনো ভোররাত পর্যন্ত চলে।
পরদিন বিদায়ের পালা। এ এক বিষণ্ন সময়। হোটেল রুমের অংশীদার প্রিয় ছড়াকার অটোয়ার পথে। নুরুন্নবী চলে যাচ্ছেন নিউ জার্সি। সকালে নাশতার টেবিলেই অনেক বিদায় পর্ব হয়ে গেল। আমার আরও এক দিন থাকতে হবে। কোথায় কীভাবে থাকব, এসব নিয়ে আমার ভাবনা নেই। একজন মুশকিল আসান পাওয়া গেছে। তিনি দিলওয়ার। কোথায় কার কী সমস্যা হচ্ছে, ঘরের খাবার প্রয়োজন—সেখানে দিলওয়ার ব্যবস্থা করবেন। কোথায় কার মান-অভিমান, কার গাড়ি লাগবে—সেখানেই দিলওয়ার।
ভাঙা মেলাও ছোট আকারে চলতে থাকবে। উদ্যোক্তারা সেখানেও সক্রিয়। শান্তিনিকেতনের পৌষ মেলা শেষ হয়ে গেলে ভাঙা মেলা চলে বেশ কদিন।
সামিনার বাসায় রাত্রিকালীন আহারের ব্যবস্থা। সেখানে পৌঁছেই আবার দেখা হলো সুধীজনদের সঙ্গে। মেরিল্যান্ডের নির্জনে বেশ জায়গা নিয়ে চমৎকার নিবাস। খোলা জায়গায় বসার ব্যবস্থা। ঘন পাইনবন কাছাকাছি। ইরাজের পরিবেশনায় চমৎকার খাবার আর সেই সঙ্গে গানের আয়োজন। বেশ রাত পর্যন্ত চলল।
ফিরে এলাম কবিতা-দিলওয়ারের বাসভবনে। সে-ও এক দোতলা বাড়ি। পাশেই ঘন পাইন বন। উঁচু উঁচু পাইনগাছের মধ্য দিয়ে আজন্মের চেনা চাঁদটা উঁকি দিচ্ছে। বৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত সেখানেই বসে থাকলাম। পরদিন সকালে নাশতা খেয়ে এয়ারপোর্ট। একে একে সবাই এসেছে। একটু বিঘ্ন হলেও আমার চিন্তার কিছু ছিল না। কারণ, মুশকিল আসান সঙ্গেই আছেন! কোনো কোনো সম্পর্ক ক্ষণিকের হলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হয়ে যায়। জীবনের পথে পথে এ অমূল্য সম্পদকে সঙ্গে নিয়েই যাত্রা। যাত্রা শুভ হোক—আবার এই শুভকামনা নিয়ে বিদায় নিলাম। সুদীর্ঘ যাত্রা শুভই হলো।
মামুনুর রশীদ, নাট্যব্যক্তিত্ব
মানুষের জীবনের দীর্ঘ যাত্রাটি শুরু হয় শিশুর ছোট্ট দুটি পা দিয়ে। তারপর পৃথিবীর বুকে তার অভিযান চলে নিরন্তর। ওয়াশিংটন ডিসির বইমেলাও শুরু হয় একেবারেই ছোট একটা জায়গা থেকে। একেবারে সূচনায় দাস্তগীর জাহাঙ্গীর উদ্যোগ নেন। এর আগে বাঙালির চিরদিনের সংস্কৃতির ছোট বাক্সটি সঙ্গেই ছিল। এই প্রিয় অমূল্য বাক্সটিতে থাকে বাংলার গান, আবৃত্তি, নাচ আর অসংখ্য স্মৃতি। তাই প্রবাসে এই চর্চা ছোট আর বড় আকারে চলতেই থাকে।
এর মধ্যেই দ্রুত সাড়া দেন বেশ কজন, যাঁদের মধ্যে আছেন ডা. আনোয়ার ইকবাল, সামিনা আমিন, আতিয়া মাহজাবীন, ডা. নজরুল ইসলাম। তাঁরা সবাই সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করেন। ২০১৮ ও ২০১৯-এ বইমেলা হয়ে গেল। এরপর দুই বছর কোভিডের জন্য হতে পারেনি। আবার ২০২২ থেকে শুরু হয়েছে। সেই ভাবনাটি বড় হতে হতে এখন ওয়াশিংটন ডিসির বইমেলা আমেরিকার বিভিন্ন প্রান্ত এবং ইউরোপ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। এবারের বইমেলায় যে আভাস পাওয়া গেল, তাতে ভবিষ্যতে আরও সম্প্রসারণ হতেই থাকবে।
মেলায় প্রথম দিনই সকালে দেখা হয়ে গেল বইমেলার এক অনুঘটক ও আমার প্রিয় ড. নুরুন্নবীর সঙ্গে। আমার আরেক প্রিয়জন, তাঁর স্ত্রী। নুরুন্নবীর সঙ্গে দেখা হলেই আমার স্মৃতিতে দ্রুত ফ্ল্যাশব্যাক হতে থাকে সেই ৫২ বছরের কত ঘটনা—মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধোত্তর জন্মঝড়ের বাংলাদেশ (তাঁরই বইয়ের নাম)। এরপর কত আয়োজন, কত উদ্যোগ। আর যেকোনো শুভ উদ্যোগেই পাওয়া যায় নুরুন্নবীকে। কথা এবং কাজের ঐক্যে বাঙালিদের যে খুব একটা পাওয়া যায়, তা নয়। যেখানে যাই, সেখানেই আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ি।
১৯৯২ সালে যখন ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত হয়, তখন আমাকে যুক্তরাষ্ট্রে যেতে হয়েছিল অন্য একটা কাজে। শহীদজননী জাহানারা ইমাম আমাকে দায়িত্ব দিলেন আমি যেন নিউইয়র্কে গিয়ে ওখানে একটা শাখা কমিটি গঠন করি। ঠিকানা—ড. নুরুন্নবী। নুরুন্নবীকে খবর দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নিউ জার্সি থেকে নিউইয়র্কে এলে শাখা করা হলো। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে নানাভাবে উদ্যোগ নিলেন নুরুন্নবী। নুরুন্নবী তাঁর পেশাগত দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি কত ধরনের উদ্যোগে যে অংশ নিয়েছেন, তা সম্ভবত এখন আর হাতে গোনা যাবে না। স্বদেশেও তাঁর নানা উদ্যোগ চলেছে। কত মানুষকে, কত সংগঠনকে তিনি সাহায্য করেই চলেছেন। এ রকম মানুষ প্রবাসে আরও যে আছে, এ ব্যাপারে আমার কোনো সন্দেহ নেই। আছে বলেই অনেক বড় বড় আয়োজন করা সম্ভব হচ্ছে।
দেখা হলো সবচেয়ে বয়স্ক তরুণ মাজহারুল হক সাহেবের সঙ্গে। ৯১ বছরের এই তরুণ ঘুরে বেড়াচ্ছেন বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে। প্রতিটি সেমিনারে অংশ নিচ্ছেন, কথা বলছেন। মাঝে মাঝে উত্তেজিতও হচ্ছেন। ১৯৭১ সালে ফিলাডেলফিয়া থেকে একটি জাহাজে করে পাকিস্তানিরা অস্ত্র নিয়ে আসছিল। সেখানকার তরুণ ছাত্রছাত্রীরা এই সংবাদ জানতে পেরে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। অনেকেই গ্রেপ্তার হন। নিপীড়ন হয় তাঁদের ওপর। সেই সময় কিছু বাঙালিও যুক্ত হয়। (তখনকার একজন নেতা এখনো জীবিত। একজনের কাছে আমার পুত্র আমাকে নিয়েও গিয়েছিল। সে-সম্পর্কে পরে বিস্তারিত লিখব।) এই ঘটনার ওপর নির্মিত প্রামাণ্যচিত্রটি দেখতে দেখতে একসময় মাজাহার সাহেব উত্তেজিত হয়ে নিজেই গিয়ে প্রদর্শনীটি বন্ধ করে দেন এবং পরের অংশটিকে অপ্রয়োজনীয় মনে করেন। কিন্তু উদ্যোক্তারা গিয়ে তাঁকে বুঝিয়ে আবার চালু করেন এবং দেখা গেল, অত্যন্ত প্রয়োজনীয় অংশ তার মধ্যে রয়ে গেছে।
দুটি হলেই চলছিল সেমিনার, প্রামাণ্যচিত্র, আবৃত্তি, গানের অনুষ্ঠান। সাহিত্যের আলোচনা ছাড়াও চলছিল বিজ্ঞানভিত্তিক, গবেষণাভিত্তিক আলোচনা। এর মধ্যেই সবাই দুপুরের খাবার, চা, কফি, হালকা নাশতা সেরে নিচ্ছে। সবচেয়ে প্রশংসনীয় হচ্ছেন, প্রায় সবাই পরিবার নিয়ে এসেছেন। শিশু, পুত্র, কন্যা নিয়েও এসেছেন। তবে আমার প্রত্যাশা ছিল পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরাও এখানে আসবেন এবং অংশ নেবেন। কিন্তু সেটি দেখতে পেলাম না। হয়তো এসেছেন কিন্তু আমার সঙ্গে দেখা হয়নি। এ কথা সত্যি, প্রবাসে, বিশেষ করে ইউরোপ-আমেরিকায় প্রচুরসংখ্যক অধ্যাপক, বিশেষজ্ঞ, চিকিৎসক প্রবাসজীবনে বিশেষ কৃতিত্বের ছাপ রেখে থাকেন। তাঁদের একটা বড় অংশ এই পূর্ব বাংলা থেকেই গেছে। অন্তত অশোক মিত্রের আপিলা-চাপিলা এবং তপন রায় চৌধুরীর বাঙালনামা পড়ে তা-ই মনে হয়েছে। অমর্ত্য সেনও পূর্ব বাংলার কথা বহুবার স্মরণ করেছেন। এ বিষয়ে উদ্যোক্তাদের নিশ্চয়ই ভাবনা আছে।
বইমেলার অংশটি সব সময় খুব সরগরম থাকছিল। বাংলাদেশ দূতাবাসের একটি বড় স্টল থাকলেও সে জায়গাটি প্রায়ই শূন্য থাকত। এর কারণ কিছু বোঝা গেল না। সারা দিনের কর্মব্যস্ততার পর এসে গেল সমাপনী অনুষ্ঠান। নৃত্য, সংগীত, আবৃত্তির সঙ্গে কিছু কিছু ব্যক্তিত্বের ছোট ছোট আলোচনা। প্রায় শেষের দিকে আমার সাক্ষাৎকারভিত্তিক উপস্থাপন। উপস্থাপনা করলেন ২০১৯ সালের সমন্বয়ক ও এবারের কর্মব্যস্ত সংগঠক সামিনা আমিন। বাংলাদেশের শিশুসাহিত্য নিয়ে প্রশ্ন এবং আমার সাধ্যমতো জবাব। মাঝে মাঝে একটু বিতর্কও। সেই সঙ্গে কিছু অভিনয়-আবৃত্তি। বোধ হয় বিষয়টি বিরক্তিকর হয়নি বলে বেশ অনেকক্ষণ ধরে চলল। সবারই দেশের শিল্প-সাহিত্যের খবর জানার প্রচুর আগ্রহ।
অবশেষে যবনিকা নামল ওয়াশিংটন ডিসি বইমেলার। যবনিকা টানলেই কি হয়? ছোট ছোট আড্ডা জমে ওঠে সর্বত্র। কখনো হোটেলের ভেতরে, কখনো বাইরে। সেখানেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা হয়। সাহিত্য-সংস্কৃতি, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা—সবকিছু নিয়ে। যেমন অভিবাসনের প্রক্রিয়া অনেকটাই নদীর মতো বহমান। কেউ এক জায়গায় স্থির হয়ে থাকে না। এই শহর থেকে সেই শহর আবার এই দেশ থেকে অন্য দেশ। অনেকেই এসেছেন সোভিয়েত দেশ থেকে। আবার সোভিয়েতের বিপর্যয়ের পর ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক ব্লক থেকে। সে রকম একজন মানুষ দাস্তগীর জাহাঙ্গীর। এসেছেন চেক রিপাবলিক থেকে। তিনি সেই সময়ে চেক রিপাবলিকে ছিলেন, যখন গ্লাসনস্ত-পেরস্ত্রোয়কা চলছে। স্নায়ুযুদ্ধের শেষ সময়। ইউরোপ খুলে গেছে। একজন নাট্যকার তখন সেখানকার প্রেসিডেন্ট। সে এক উত্তেজনার সময়। কপর্দকহীন অবস্থায় দাস্তগীর ইউরোপ ঘুরে বেড়িয়েছেন।
আমার পুত্রের কল্যাণে এসে ‘ওপেনহাইমার’ ছবিটি দেখেছিলাম, বইটিও কিনে দিয়েছিল। এটাও কখনো আলোচনার কেন্দ্রে এসে গেছে। ক্রিস্টোফার নোলান পরিচালিত ছবিটি সারা বিশ্বে প্রদর্শিত হচ্ছে। দেশে এসে দেখলাম, ঢাকার সিনেমা হলেও চলছে। সারা বিশ্বেই এখন শিল্প-সাহিত্যের একটা সংকট চলছে। জীবনের প্রতিটি পরতে যেভাবে ডিজিটাল সংস্কৃতি ঢুকে গেছে, তাতে নতুন ধরনের মানবিক সংকট শুরু হয়েছে। তবে মানবজাতি অপ্রয়োজনীয় কিছু রক্ষা করে না। কিন্তু বর্তমান সংকটকে কী করে মোকাবিলা করবে, সেটাই প্রশ্ন। এসব নিয়ে আড্ডা কখনো ভোররাত পর্যন্ত চলে।
পরদিন বিদায়ের পালা। এ এক বিষণ্ন সময়। হোটেল রুমের অংশীদার প্রিয় ছড়াকার অটোয়ার পথে। নুরুন্নবী চলে যাচ্ছেন নিউ জার্সি। সকালে নাশতার টেবিলেই অনেক বিদায় পর্ব হয়ে গেল। আমার আরও এক দিন থাকতে হবে। কোথায় কীভাবে থাকব, এসব নিয়ে আমার ভাবনা নেই। একজন মুশকিল আসান পাওয়া গেছে। তিনি দিলওয়ার। কোথায় কার কী সমস্যা হচ্ছে, ঘরের খাবার প্রয়োজন—সেখানে দিলওয়ার ব্যবস্থা করবেন। কোথায় কার মান-অভিমান, কার গাড়ি লাগবে—সেখানেই দিলওয়ার।
ভাঙা মেলাও ছোট আকারে চলতে থাকবে। উদ্যোক্তারা সেখানেও সক্রিয়। শান্তিনিকেতনের পৌষ মেলা শেষ হয়ে গেলে ভাঙা মেলা চলে বেশ কদিন।
সামিনার বাসায় রাত্রিকালীন আহারের ব্যবস্থা। সেখানে পৌঁছেই আবার দেখা হলো সুধীজনদের সঙ্গে। মেরিল্যান্ডের নির্জনে বেশ জায়গা নিয়ে চমৎকার নিবাস। খোলা জায়গায় বসার ব্যবস্থা। ঘন পাইনবন কাছাকাছি। ইরাজের পরিবেশনায় চমৎকার খাবার আর সেই সঙ্গে গানের আয়োজন। বেশ রাত পর্যন্ত চলল।
ফিরে এলাম কবিতা-দিলওয়ারের বাসভবনে। সে-ও এক দোতলা বাড়ি। পাশেই ঘন পাইন বন। উঁচু উঁচু পাইনগাছের মধ্য দিয়ে আজন্মের চেনা চাঁদটা উঁকি দিচ্ছে। বৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত সেখানেই বসে থাকলাম। পরদিন সকালে নাশতা খেয়ে এয়ারপোর্ট। একে একে সবাই এসেছে। একটু বিঘ্ন হলেও আমার চিন্তার কিছু ছিল না। কারণ, মুশকিল আসান সঙ্গেই আছেন! কোনো কোনো সম্পর্ক ক্ষণিকের হলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হয়ে যায়। জীবনের পথে পথে এ অমূল্য সম্পদকে সঙ্গে নিয়েই যাত্রা। যাত্রা শুভ হোক—আবার এই শুভকামনা নিয়ে বিদায় নিলাম। সুদীর্ঘ যাত্রা শুভই হলো।
মামুনুর রশীদ, নাট্যব্যক্তিত্ব
ভারতের স্থলবন্দর নিষেধাজ্ঞার পর সীমান্তে আটকে থাকা তৈরি পোশাক, খাদ্যসহ বিভিন্ন পণ্যের ট্রাকগুলো ফেরত আনছেন রপ্তানিকারকেরা। তবে যেসব ট্রাক বন্দরে ঢুকে গিয়েছিল, সেগুলো ভারতে প্রবেশ করানোর চেষ্টা চলছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এসব ট্রাক ঢুকতে পারবে কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে।
২০ দিন আগেআধুনিক যুগের সবচেয়ে বিস্ময়কর প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারগুলোর একটি হচ্ছে গৌতম বুদ্ধের দেহাবশেষের সঙ্গে সম্পর্কিত ঐতিহাসিক রত্নসম্ভার। গতকাল বুধবার হংকংয়ে বিখ্যাত আর্ট নিলাম কোম্পানি সাদাবি’স-এর এক নিলামে এগুলো তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
০৮ মে ২০২৫পাকিস্তানে ভারতের হামলার সমালোচনা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। চীনও এই হামলাকে ‘দুঃখজনক’ বলে অভিহিত করেছে। উদ্বেগ জানিয়েছে জাতিসংঘও। উত্তেজনা যেন আরও না বাড়ে, সে জন্য দুই পক্ষকে সংযত থাকার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশ। এদিকে ভারতের অবস্থানকে সমর্থন করেছে...
০৮ মে ২০২৫ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলা নিয়ে দুই চিরবৈরী প্রতিবেশীর মধ্যে উত্তেজনার পারদ ক্রমেই চড়ছিল। তা তুঙ্গে উঠল এবার পাকিস্তানের ভূখণ্ডে ভারতের ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামের ক্ষেপণাস্ত্র ও বিমান হামলা দিয়ে। পাশাপাশি সীমান্তেও দুই দেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যে ব্যাপক গোলাগুলি হয়েছে...
০৮ মে ২০২৫