ইমান আলহাজ আলি
রাজধানীর বাদামতলীর ফলের আড়ত সাথী ফ্রেশ ফ্রুটস স্টোরের বোর্ডে সারি করে লেখা খেজুরের নাম। হরেক নামের খেজুরের হরেক দাম। সবই পাইকারি। গত সপ্তাহের রোববার সকালে ১০ কেজির দাব্বাস খেজুরের দাম লেখা ছিল ৩ হাজার ৮০০ টাকা। ১৫ মিনিটের মধ্যে এই প্রতিবেদকের উপস্থিতিতে সে দাম হয়ে যায় ৩ হাজার ৯০০ টাকা। দেখতে দেখতে বদলে গেল আরও সব খেজুরের দাম। এই আড়তে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলে মনে হবে, এ যেন পুঁজিবাজারের ‘ট্রেডিং বোর্ড’, যেখানে মিনিটে মিনিটে দাম ওঠানামা করছে।
সাথী ফ্রেশ ফ্রুটস স্টোরের স্বত্বাধিকারী সিরাজুল ইসলাম সে সময় আড়তেই ছিলেন। বাজারের এই অস্বাভাবিক ওঠানামা নিয়ে বললেন, খেজুর একটি আমদানি ফল, এর দরদাম নির্ভর করে সরবরাহের ওপরে। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে বাড়তি শুল্ক। তবে এখন সরবরাহ বেশি থাকলেও রোজার কারণে বাজারে টান পড়েছে। সে কারণে বাজারও কিছুটা অস্থির।
সিরাজুল ইসলামের বক্তব্যের সত্যতা পাওয়া গেল বাদামতলীর আরও কয়েকটি ফলের আড়ত ঘুরে। সব আড়তেই অন্য সব ফলের সঙ্গে খেজুর নিয়ে বেশ টানাটানি চলছে। পাইকারি বাজারে আসা প্রায় সব খুচরা ফল ব্যবসায়ীর নজর এখন খেজুরের দিকে। যেন অন্য সব ফল না কিনলেও খেজুর তাঁদের চাই-ই।
মরু দেশের তালজাতীয় শাখাবিহীন গাছের সুমিষ্ট ফল খেজুর বাংলাদেশের মতো সবুজ দেশেও বড় বাজার ধরে নিয়েছে। দিন দিন তা বাড়ছেই। রোজার ইফতারে অন্য সব খাবারের সঙ্গে খেজুর গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। রমজান মাস ছাড়া অন্য সময়েও বিপুল পরিমাণ খেজুর কেনাবেচা হচ্ছে। অতিথির হাতে এখন মিষ্টির বদলে খেজুরের সুদৃশ্য বাক্সও শোভা পাচ্ছে।
দেশে কত খেজুর আমদানি করা হয়, তার তথ্য পাওয়া গেছে চট্টগ্রাম বন্দর কাস্টম হাউস থেকে। সেই তথ্যে দেখা গেছে, ২০২০ (করোনার কারণে আংশিক) থেকে ২০২৪ সালের দুই মাস মিলে মোট চার বছরে দেশে ২ লাখ ৯৬ হাজার ৪৪৪ টন খেজুর আমদানি হয়েছে। এসব খেজুরের কাস্টমসের বেঁধে দেওয়া দাম ছিল প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকা। যদিও আমদানিকারকেরা শুরুতে দাম প্রায় ২০ গুণ কম দেখিয়ে আমদানি করেছিলেন।
কোন বছরে কত আমদানি
চট্টগ্রাম বন্দর কাস্টমস সূত্র জানিয়েছে, চার বছরে সবচেয়ে বেশি খেজুর এসেছে ২০২১ সালে, ১ লাখ ১৬৬ টন। আর চলতি বছরের ৩ মার্চ পর্যন্ত এসেছে ৩১ হাজার ৯৩ টন।
সবচেয়ে বেশি খেজুর এসেছে ইরাক থেকে, ৮৩ হাজার ৭৩২ টন। এই সময়ে আরব আমিরাত থেকে এসেছে ৪৬ হাজার ৫৮৩ টন আর ২৩ হাজার ৬৯১ টন এসেছে সৌদি আরব থেকে।
রপ্তানিকারক দেশ ও বাংলাদেশের বাজার পর্যালোচনা করে কাস্টমস এসব খেজুরের দাম নির্ধারণ করে ৪৩৩ কোটি ডলার বা ৪২ হাজার কোটি টাকা (ডলারের গড় দর ৯৭ টাকা ধরে)। এ দাম মেনেই ব্যবসায়ীরা পণ্য খালাস করেছেন, যদিও শুরুতে তাঁরা দর অনেক কম দেখিয়েছিলেন।
তবে বিপুল পরিমাণ আমদানি হলেও দেশের বাজারে খেজুরের দাম কিছুতেই কমছে না। ২৫০ টাকার নিচে খাওয়ারযোগ্য কোনো খেজুরই পাওয়া যায় না। ভালো মানের খেজুরের দাম ১ হাজার থেকে ৪ হাজার টাকা পর্যন্ত।
দাম বাড়াতে শুল্কের দোহাই
ব্যবসায়ীরা বলছেন, আগে সব খেজুরে মোট শুল্ক-কর ছিল ১০ শতাংশ। চলতি অর্থবছর শুল্ক-কর বাড়িয়ে ৫৮ শতাংশ করা হয়। পরে আবার ১০ শতাংশ কমানো হয়। বর্তমানে ৪৮ শতাংশ শুল্ক দিতে হচ্ছে। এর সঙ্গে আছে বন্দর মাশুল, পরিবহন, এলসি মাশুলসহ আরও অনেক খরচ। এসব কারণে দাম কয়েক গুণ বেড়ে যাচ্ছে।
চট্টগ্রাম কাস্টমস সূত্র জানায়, আমদানি করা খেজুরের পাঁচ ধরনের মূল্য শ্রেণিবিন্যাস করা হয়েছে। এর মধ্যে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কনটেইনারে (রেফার) আমদানি করা আজোয়া, মরিয়ম, মেডজুল ও মাবরুম খেজুরের প্রতি কেজির আমদানিমূল্য ৪ ডলার ধরে শুল্কায়ন করা হয়। এ ছাড়া কার্টনে আনা খেজুরের দাম ইনার প্যাক (আড়াই কেজির কম) ২ দশমিক ৭৫ ডলার, কার্টনে আনা বাকি সব খেজুরের আমদানিমূল্য আড়াই ডলার, এ ছাড়া বস্তায় আনা শুকনা খেজুর (ভেজা/গলা) ১ ডলার আমদানিমূল্য ধরে ছাড় করা হয়। তবে এভাবে আমদানিমূল্য ঠিক করে দেওয়ার ঘোর বিরোধী ব্যবসায়ীরা।
বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুট আমদানিকারক সমিতির সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমদানিকারকেরা খেজুরের দাম ঘোষণা করেছে প্রতি টন ৯০০ ডলার। কাস্টমস সেটা মানছে না। তারা আড়াই হাজার ডলার করে ঘোষণা দিয়েছে। কোনো কোনোটির দাম আবার ৪ হাজার ডলারও ধরছে। এতে দামের হেরফের হচ্ছে।
তবে আমদানিমূল্য ঠিক করে দিয়ে শুল্কায়নের পক্ষে কাস্টমস কর্মকর্তাদেরও যুক্তি আছে। চট্টগ্রাম কাস্টমসের উপকমিশনার কাজী ইরাজ ইশতিয়াক আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা অনেক উন্নত মানের খেজুর এনেও শুল্ক ফাঁকি দিতে কম দামি খেজুরের সমান আমদানিমূল্য দেখাচ্ছেন। বাজারে দেখা যায় একেক রকমের খেজুরের একেক দাম। সেই তফাতটা কাস্টমস বিবেচনায় নিয়েছে।’
সংশ্লিষ্টদের ধারণা, আমদানিমূল্য কম দেখিয়ে শুধু খেজুর আমদানি করতে গিয়েই কম করে হলেও ৪০ হাজার কোটি টাকা পাচার করা হয়েছে। জানতে চাইলে শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এম ফখরুল আলম বলেন, ‘খেজুরের প্রকৃত দর গোপন করে একটি অংশ ব্যাংকের মাধ্যমে শোধ করেছে। আর বাকিটা পাঠানো হয়েছে হুন্ডিতে। এর আসল উদ্দেশ্য হলো শুল্ক ফাঁকি দেওয়া।’
কাস্টমসের বেঁধে দেওয়া দরের সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারের দর যাচাই করতে খেজুর কেনাবেচার ওয়েবসাইট সেলিনা ওয়ামুচি, ওয়ার্ল্ড অব ডেটস, কেএসএ ডেটস ডটকম, সিয়াফা ডেটস, আমিরাতের সাহারি ডেটস ডটকম থেকে তথ্য নেওয়া হয়েছে। এতে দেখা গেছে, সৌদি আরবে সাধারণ মানের খেজুরের দাম প্রতি কেজি শূন্য দশমিক ৮৩ ডলার থেকে শূন্য দশমিক ৮৪ ডলার। বাংলাদেশি টাকায় (ডলারপ্রতি ১১০ টাকা হিসাবে) তা হয় ৯১-৯২ টাকা। আজোয়া খেজুরের দর পাইকারিতে ৩ দশমিক ৫৭ ডলার থেকে ৪ দশমিক ৪৭ ডলার। মাবরুম খেজুর ৪ দশমিক ৪৩ ডলার, মেডজুল খেজুর ৪ দশমিক ৪৩ ডলার, সাফাউই খেজুর ৩ দশমিক ৯৪ ডলার। ভালো মানের প্রতি কেজি ইরাকি খেজুরের দর পাইকারিতে ৪ দশমিক ৪৮ ডলার, যা বাংলাদেশি টাকায় ৪৯২ টাকা।
অন্যদিকে সংযুক্ত আরব আমিরাতে পাইকারিতে আজোয়া খেজুর ২ দশমিক ৩৯ ডলার থেকে ৩ দশমিক ৪৬ ডলার। মাবরুম খেজুর ৫ কেজি ১৬৫ দিরহাম, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রতি কেজি ১ হাজার ৮৯ টাকা। অর্থাৎ কাস্টমস যে দর ধরেছে, তার সঙ্গে অনেকটাই মিলে যায়।
কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) চেয়ারম্যান গোলাম রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘খেজুরের কেনা দর কম দেখানো মানেই এতে আন্ডার ইনভয়েসিং হচ্ছে, তা বোঝাই যাচ্ছে। তবে খেজুরের পেছনে খরচ বেড়ে যাওয়া বা আমদানি বেড়ে যাওয়ার অর্থ হলো মানুষ এটা বেশি খাচ্ছে।’
বাজারে যা দেখা গেল
গত সপ্তাহের রোববার রাজধানীর বাদামতলীর পাইকারি আড়ত ‘দুই ভাই এন্টারপ্রাইজে’ দেখা যায়, আজোয়া খেজুর প্রতি ৫ কেজির প্যাকেট ৪ হাজার ৮০০ টাকা, মরিয়ম ৪ হাজার ৭০০ টাকা, কালমি ৪ হাজার টাকা, মাশরুক ২ হাজার ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পাশের বিসমিল্লাহ ফ্রেশ ফ্রুটে দেখা যায়, আজোয়া ৪ হাজার ৬২৫ টাকা, মরিয়ম ৪ হাজার ৪০০ টাকা, কালমি ৪ হাজার ২০০ টাকা, মাশরুক ৪ হাজার টাকা, মাবরুম ৫ হাজার ২৫০ টাকা ও মেডজুল ৫ হাজার ৩০০ টাকায় বিক্রি হয়। আর সব আড়তেই নিম্নমানের খেজুরের বস্তাপ্রতি পাইকারি দর দেখানো হয়েছে ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা কেজি।
পরে দেশের অন্যতম শীর্ষ আমদানিকারক সাথী ফ্রেশ ফ্রুটসের আড়তে গিয়ে তাদের খেজুরের মূল্যতালিকায় দেখা যায়, দাব্বাস, বারনি, জাহেদি, লুলু, খালাসসহ আরও অনেক নামের খেজুরের দাম অন্য আড়তের তুলনায় ২০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত বেশি।
পাইকারি বাজারের পর রাজধানীর কয়েকটি খুচরা বাজারেও খেজুরের দাম পর্যবেক্ষণ করেছে আজকের পত্রিকা। দেখা যায়, একেক বাজারে একেক দামে খেজুর বিক্রি হচ্ছে। একই খেজুর ভিন্ন ভিন্ন দোকানে ভিন্ন ভিন্ন দামে বিক্রি হতে দেখা যায়। ৪ মার্চ কারওয়ান বাজারের আল্লাহর দান ফল বিতানে আজোয়া খেজুর প্রতি কেজি ১ হাজার ৪০০ টাকা, সৌদি মরিয়ম ১ হাজার, মাবরুম ১ হাজার ৩০০ ও ১ হাজার ৬০০ এবং কালমি খেজুর ১ হাজার টাকায় বিক্রি করতে দেখা যায়। অন্যদিকে, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় সুপার শপ আপন ফ্যামিলি মার্টে দেখা যায়, আজোয়া খেজুর ১ হাজার ৯০০ টাকা, মরিয়ম ১ হাজার ৯০০ এবং মেডজুল (জাম্বু) খেজুর ২ হাজার ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এরপর ৯ মার্চ রাজধানীর খিলক্ষেত বাজারে সাড়ে ৪০০ টাকার কমে কোনো খেজুরই বিক্রি করতে দেখা যায়নি। যদিও সুপার শপে দামের হেরফের রয়েছে।
খেজুরের ওপর বাড়তি নির্ভরতাকে বিলাসিতা হিসেবে অভিহিত করেছেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘খেজুরের এখন অনেক দাম। অতি লাভের আশায় অনেক বড় ব্যবসায়ীও খেজুরের দিকে ঝুঁকেছেন। রাজধানীর অভিজাত এলাকায় এখন অতি উচ্চমূল্যে খেজুর বিক্রি হয়। অনেকে খেজুর উপহার দেয়। আমি মনে করি, খেজুর বাজারের একটা নিয়ন্ত্রণ দরকার।’
বাজার কাদের নিয়ন্ত্রণে
দেশের বড় বড় শিল্প গ্রুপের চোখ এখন খেজুর বাজারের দিকে। তারাই এখন খেজুরের বাজারের বড় নিয়ন্ত্রক। কাস্টম হাউস সূত্র বলছে, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে দেশের অন্যতম শীর্ষ খেজুর আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান হলো ঢাকার হাজি সেলিমের মালিকানাধীন মেসার্স মদিনা ফ্রুটস, বাংলাদেশ ফ্রেশ ফুড ইম্পোর্টার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. সিরাজুল ইসলামের মালিকানাধীন সাথী ফ্রেশ ফ্রুটসসহ একাধিক প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া ঢাকার আমদানিকারক মদিনা ডেটস অ্যান্ড নাটসও বৃহৎ আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের একটি। মূলত বিপুল আমদানির কারণে এরাই খেজুরের বাজারের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রক।
জানতে চাইলে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর গবেষণা পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. সায়মা হক বিদিশা আজকের পত্রিকাকে বলেন, অবস্থা এখন এমন অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে যে খেজুরকে সবাই নিত্যপণ্য বানিয়ে নিয়েছে। এটা না করলেই বরং ভালো হতো। দিনে দিনে খেজুরের চাহিদা বাড়ার কারণে একটি অসাধু ব্যবসায়ী চক্র অতি মুনাফার সুযোগও নিচ্ছে। সব মিলে ক্ষতিগ্রস্ত ক্রেতা। তাকে বেশি দামেই কিনতে হচ্ছে।
রাজধানীর বাদামতলীর ফলের আড়ত সাথী ফ্রেশ ফ্রুটস স্টোরের বোর্ডে সারি করে লেখা খেজুরের নাম। হরেক নামের খেজুরের হরেক দাম। সবই পাইকারি। গত সপ্তাহের রোববার সকালে ১০ কেজির দাব্বাস খেজুরের দাম লেখা ছিল ৩ হাজার ৮০০ টাকা। ১৫ মিনিটের মধ্যে এই প্রতিবেদকের উপস্থিতিতে সে দাম হয়ে যায় ৩ হাজার ৯০০ টাকা। দেখতে দেখতে বদলে গেল আরও সব খেজুরের দাম। এই আড়তে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলে মনে হবে, এ যেন পুঁজিবাজারের ‘ট্রেডিং বোর্ড’, যেখানে মিনিটে মিনিটে দাম ওঠানামা করছে।
সাথী ফ্রেশ ফ্রুটস স্টোরের স্বত্বাধিকারী সিরাজুল ইসলাম সে সময় আড়তেই ছিলেন। বাজারের এই অস্বাভাবিক ওঠানামা নিয়ে বললেন, খেজুর একটি আমদানি ফল, এর দরদাম নির্ভর করে সরবরাহের ওপরে। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে বাড়তি শুল্ক। তবে এখন সরবরাহ বেশি থাকলেও রোজার কারণে বাজারে টান পড়েছে। সে কারণে বাজারও কিছুটা অস্থির।
সিরাজুল ইসলামের বক্তব্যের সত্যতা পাওয়া গেল বাদামতলীর আরও কয়েকটি ফলের আড়ত ঘুরে। সব আড়তেই অন্য সব ফলের সঙ্গে খেজুর নিয়ে বেশ টানাটানি চলছে। পাইকারি বাজারে আসা প্রায় সব খুচরা ফল ব্যবসায়ীর নজর এখন খেজুরের দিকে। যেন অন্য সব ফল না কিনলেও খেজুর তাঁদের চাই-ই।
মরু দেশের তালজাতীয় শাখাবিহীন গাছের সুমিষ্ট ফল খেজুর বাংলাদেশের মতো সবুজ দেশেও বড় বাজার ধরে নিয়েছে। দিন দিন তা বাড়ছেই। রোজার ইফতারে অন্য সব খাবারের সঙ্গে খেজুর গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। রমজান মাস ছাড়া অন্য সময়েও বিপুল পরিমাণ খেজুর কেনাবেচা হচ্ছে। অতিথির হাতে এখন মিষ্টির বদলে খেজুরের সুদৃশ্য বাক্সও শোভা পাচ্ছে।
দেশে কত খেজুর আমদানি করা হয়, তার তথ্য পাওয়া গেছে চট্টগ্রাম বন্দর কাস্টম হাউস থেকে। সেই তথ্যে দেখা গেছে, ২০২০ (করোনার কারণে আংশিক) থেকে ২০২৪ সালের দুই মাস মিলে মোট চার বছরে দেশে ২ লাখ ৯৬ হাজার ৪৪৪ টন খেজুর আমদানি হয়েছে। এসব খেজুরের কাস্টমসের বেঁধে দেওয়া দাম ছিল প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকা। যদিও আমদানিকারকেরা শুরুতে দাম প্রায় ২০ গুণ কম দেখিয়ে আমদানি করেছিলেন।
কোন বছরে কত আমদানি
চট্টগ্রাম বন্দর কাস্টমস সূত্র জানিয়েছে, চার বছরে সবচেয়ে বেশি খেজুর এসেছে ২০২১ সালে, ১ লাখ ১৬৬ টন। আর চলতি বছরের ৩ মার্চ পর্যন্ত এসেছে ৩১ হাজার ৯৩ টন।
সবচেয়ে বেশি খেজুর এসেছে ইরাক থেকে, ৮৩ হাজার ৭৩২ টন। এই সময়ে আরব আমিরাত থেকে এসেছে ৪৬ হাজার ৫৮৩ টন আর ২৩ হাজার ৬৯১ টন এসেছে সৌদি আরব থেকে।
রপ্তানিকারক দেশ ও বাংলাদেশের বাজার পর্যালোচনা করে কাস্টমস এসব খেজুরের দাম নির্ধারণ করে ৪৩৩ কোটি ডলার বা ৪২ হাজার কোটি টাকা (ডলারের গড় দর ৯৭ টাকা ধরে)। এ দাম মেনেই ব্যবসায়ীরা পণ্য খালাস করেছেন, যদিও শুরুতে তাঁরা দর অনেক কম দেখিয়েছিলেন।
তবে বিপুল পরিমাণ আমদানি হলেও দেশের বাজারে খেজুরের দাম কিছুতেই কমছে না। ২৫০ টাকার নিচে খাওয়ারযোগ্য কোনো খেজুরই পাওয়া যায় না। ভালো মানের খেজুরের দাম ১ হাজার থেকে ৪ হাজার টাকা পর্যন্ত।
দাম বাড়াতে শুল্কের দোহাই
ব্যবসায়ীরা বলছেন, আগে সব খেজুরে মোট শুল্ক-কর ছিল ১০ শতাংশ। চলতি অর্থবছর শুল্ক-কর বাড়িয়ে ৫৮ শতাংশ করা হয়। পরে আবার ১০ শতাংশ কমানো হয়। বর্তমানে ৪৮ শতাংশ শুল্ক দিতে হচ্ছে। এর সঙ্গে আছে বন্দর মাশুল, পরিবহন, এলসি মাশুলসহ আরও অনেক খরচ। এসব কারণে দাম কয়েক গুণ বেড়ে যাচ্ছে।
চট্টগ্রাম কাস্টমস সূত্র জানায়, আমদানি করা খেজুরের পাঁচ ধরনের মূল্য শ্রেণিবিন্যাস করা হয়েছে। এর মধ্যে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কনটেইনারে (রেফার) আমদানি করা আজোয়া, মরিয়ম, মেডজুল ও মাবরুম খেজুরের প্রতি কেজির আমদানিমূল্য ৪ ডলার ধরে শুল্কায়ন করা হয়। এ ছাড়া কার্টনে আনা খেজুরের দাম ইনার প্যাক (আড়াই কেজির কম) ২ দশমিক ৭৫ ডলার, কার্টনে আনা বাকি সব খেজুরের আমদানিমূল্য আড়াই ডলার, এ ছাড়া বস্তায় আনা শুকনা খেজুর (ভেজা/গলা) ১ ডলার আমদানিমূল্য ধরে ছাড় করা হয়। তবে এভাবে আমদানিমূল্য ঠিক করে দেওয়ার ঘোর বিরোধী ব্যবসায়ীরা।
বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুট আমদানিকারক সমিতির সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমদানিকারকেরা খেজুরের দাম ঘোষণা করেছে প্রতি টন ৯০০ ডলার। কাস্টমস সেটা মানছে না। তারা আড়াই হাজার ডলার করে ঘোষণা দিয়েছে। কোনো কোনোটির দাম আবার ৪ হাজার ডলারও ধরছে। এতে দামের হেরফের হচ্ছে।
তবে আমদানিমূল্য ঠিক করে দিয়ে শুল্কায়নের পক্ষে কাস্টমস কর্মকর্তাদেরও যুক্তি আছে। চট্টগ্রাম কাস্টমসের উপকমিশনার কাজী ইরাজ ইশতিয়াক আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা অনেক উন্নত মানের খেজুর এনেও শুল্ক ফাঁকি দিতে কম দামি খেজুরের সমান আমদানিমূল্য দেখাচ্ছেন। বাজারে দেখা যায় একেক রকমের খেজুরের একেক দাম। সেই তফাতটা কাস্টমস বিবেচনায় নিয়েছে।’
সংশ্লিষ্টদের ধারণা, আমদানিমূল্য কম দেখিয়ে শুধু খেজুর আমদানি করতে গিয়েই কম করে হলেও ৪০ হাজার কোটি টাকা পাচার করা হয়েছে। জানতে চাইলে শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এম ফখরুল আলম বলেন, ‘খেজুরের প্রকৃত দর গোপন করে একটি অংশ ব্যাংকের মাধ্যমে শোধ করেছে। আর বাকিটা পাঠানো হয়েছে হুন্ডিতে। এর আসল উদ্দেশ্য হলো শুল্ক ফাঁকি দেওয়া।’
কাস্টমসের বেঁধে দেওয়া দরের সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারের দর যাচাই করতে খেজুর কেনাবেচার ওয়েবসাইট সেলিনা ওয়ামুচি, ওয়ার্ল্ড অব ডেটস, কেএসএ ডেটস ডটকম, সিয়াফা ডেটস, আমিরাতের সাহারি ডেটস ডটকম থেকে তথ্য নেওয়া হয়েছে। এতে দেখা গেছে, সৌদি আরবে সাধারণ মানের খেজুরের দাম প্রতি কেজি শূন্য দশমিক ৮৩ ডলার থেকে শূন্য দশমিক ৮৪ ডলার। বাংলাদেশি টাকায় (ডলারপ্রতি ১১০ টাকা হিসাবে) তা হয় ৯১-৯২ টাকা। আজোয়া খেজুরের দর পাইকারিতে ৩ দশমিক ৫৭ ডলার থেকে ৪ দশমিক ৪৭ ডলার। মাবরুম খেজুর ৪ দশমিক ৪৩ ডলার, মেডজুল খেজুর ৪ দশমিক ৪৩ ডলার, সাফাউই খেজুর ৩ দশমিক ৯৪ ডলার। ভালো মানের প্রতি কেজি ইরাকি খেজুরের দর পাইকারিতে ৪ দশমিক ৪৮ ডলার, যা বাংলাদেশি টাকায় ৪৯২ টাকা।
অন্যদিকে সংযুক্ত আরব আমিরাতে পাইকারিতে আজোয়া খেজুর ২ দশমিক ৩৯ ডলার থেকে ৩ দশমিক ৪৬ ডলার। মাবরুম খেজুর ৫ কেজি ১৬৫ দিরহাম, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রতি কেজি ১ হাজার ৮৯ টাকা। অর্থাৎ কাস্টমস যে দর ধরেছে, তার সঙ্গে অনেকটাই মিলে যায়।
কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) চেয়ারম্যান গোলাম রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘খেজুরের কেনা দর কম দেখানো মানেই এতে আন্ডার ইনভয়েসিং হচ্ছে, তা বোঝাই যাচ্ছে। তবে খেজুরের পেছনে খরচ বেড়ে যাওয়া বা আমদানি বেড়ে যাওয়ার অর্থ হলো মানুষ এটা বেশি খাচ্ছে।’
বাজারে যা দেখা গেল
গত সপ্তাহের রোববার রাজধানীর বাদামতলীর পাইকারি আড়ত ‘দুই ভাই এন্টারপ্রাইজে’ দেখা যায়, আজোয়া খেজুর প্রতি ৫ কেজির প্যাকেট ৪ হাজার ৮০০ টাকা, মরিয়ম ৪ হাজার ৭০০ টাকা, কালমি ৪ হাজার টাকা, মাশরুক ২ হাজার ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পাশের বিসমিল্লাহ ফ্রেশ ফ্রুটে দেখা যায়, আজোয়া ৪ হাজার ৬২৫ টাকা, মরিয়ম ৪ হাজার ৪০০ টাকা, কালমি ৪ হাজার ২০০ টাকা, মাশরুক ৪ হাজার টাকা, মাবরুম ৫ হাজার ২৫০ টাকা ও মেডজুল ৫ হাজার ৩০০ টাকায় বিক্রি হয়। আর সব আড়তেই নিম্নমানের খেজুরের বস্তাপ্রতি পাইকারি দর দেখানো হয়েছে ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা কেজি।
পরে দেশের অন্যতম শীর্ষ আমদানিকারক সাথী ফ্রেশ ফ্রুটসের আড়তে গিয়ে তাদের খেজুরের মূল্যতালিকায় দেখা যায়, দাব্বাস, বারনি, জাহেদি, লুলু, খালাসসহ আরও অনেক নামের খেজুরের দাম অন্য আড়তের তুলনায় ২০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত বেশি।
পাইকারি বাজারের পর রাজধানীর কয়েকটি খুচরা বাজারেও খেজুরের দাম পর্যবেক্ষণ করেছে আজকের পত্রিকা। দেখা যায়, একেক বাজারে একেক দামে খেজুর বিক্রি হচ্ছে। একই খেজুর ভিন্ন ভিন্ন দোকানে ভিন্ন ভিন্ন দামে বিক্রি হতে দেখা যায়। ৪ মার্চ কারওয়ান বাজারের আল্লাহর দান ফল বিতানে আজোয়া খেজুর প্রতি কেজি ১ হাজার ৪০০ টাকা, সৌদি মরিয়ম ১ হাজার, মাবরুম ১ হাজার ৩০০ ও ১ হাজার ৬০০ এবং কালমি খেজুর ১ হাজার টাকায় বিক্রি করতে দেখা যায়। অন্যদিকে, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় সুপার শপ আপন ফ্যামিলি মার্টে দেখা যায়, আজোয়া খেজুর ১ হাজার ৯০০ টাকা, মরিয়ম ১ হাজার ৯০০ এবং মেডজুল (জাম্বু) খেজুর ২ হাজার ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এরপর ৯ মার্চ রাজধানীর খিলক্ষেত বাজারে সাড়ে ৪০০ টাকার কমে কোনো খেজুরই বিক্রি করতে দেখা যায়নি। যদিও সুপার শপে দামের হেরফের রয়েছে।
খেজুরের ওপর বাড়তি নির্ভরতাকে বিলাসিতা হিসেবে অভিহিত করেছেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘খেজুরের এখন অনেক দাম। অতি লাভের আশায় অনেক বড় ব্যবসায়ীও খেজুরের দিকে ঝুঁকেছেন। রাজধানীর অভিজাত এলাকায় এখন অতি উচ্চমূল্যে খেজুর বিক্রি হয়। অনেকে খেজুর উপহার দেয়। আমি মনে করি, খেজুর বাজারের একটা নিয়ন্ত্রণ দরকার।’
বাজার কাদের নিয়ন্ত্রণে
দেশের বড় বড় শিল্প গ্রুপের চোখ এখন খেজুর বাজারের দিকে। তারাই এখন খেজুরের বাজারের বড় নিয়ন্ত্রক। কাস্টম হাউস সূত্র বলছে, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে দেশের অন্যতম শীর্ষ খেজুর আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান হলো ঢাকার হাজি সেলিমের মালিকানাধীন মেসার্স মদিনা ফ্রুটস, বাংলাদেশ ফ্রেশ ফুড ইম্পোর্টার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. সিরাজুল ইসলামের মালিকানাধীন সাথী ফ্রেশ ফ্রুটসসহ একাধিক প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া ঢাকার আমদানিকারক মদিনা ডেটস অ্যান্ড নাটসও বৃহৎ আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের একটি। মূলত বিপুল আমদানির কারণে এরাই খেজুরের বাজারের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রক।
জানতে চাইলে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর গবেষণা পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. সায়মা হক বিদিশা আজকের পত্রিকাকে বলেন, অবস্থা এখন এমন অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে যে খেজুরকে সবাই নিত্যপণ্য বানিয়ে নিয়েছে। এটা না করলেই বরং ভালো হতো। দিনে দিনে খেজুরের চাহিদা বাড়ার কারণে একটি অসাধু ব্যবসায়ী চক্র অতি মুনাফার সুযোগও নিচ্ছে। সব মিলে ক্ষতিগ্রস্ত ক্রেতা। তাকে বেশি দামেই কিনতে হচ্ছে।
আধুনিক যুগের সবচেয়ে বিস্ময়কর প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারগুলোর একটি হচ্ছে গৌতম বুদ্ধের দেহাবশেষের সঙ্গে সম্পর্কিত ঐতিহাসিক রত্নসম্ভার। গতকাল বুধবার হংকংয়ে বিখ্যাত আর্ট নিলাম কোম্পানি সাদাবি’স-এর এক নিলামে এগুলো তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
৭ দিন আগেপাকিস্তানে ভারতের হামলার সমালোচনা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। চীনও এই হামলাকে ‘দুঃখজনক’ বলে অভিহিত করেছে। উদ্বেগ জানিয়েছে জাতিসংঘও। উত্তেজনা যেন আরও না বাড়ে, সে জন্য দুই পক্ষকে সংযত থাকার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশ। এদিকে ভারতের অবস্থানকে সমর্থন করেছে...
৭ দিন আগেভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলা নিয়ে দুই চিরবৈরী প্রতিবেশীর মধ্যে উত্তেজনার পারদ ক্রমেই চড়ছিল। তা তুঙ্গে উঠল এবার পাকিস্তানের ভূখণ্ডে ভারতের ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামের ক্ষেপণাস্ত্র ও বিমান হামলা দিয়ে। পাশাপাশি সীমান্তেও দুই দেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যে ব্যাপক গোলাগুলি হয়েছে...
৭ দিন আগেঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা এলাকায় যাত্রীবাহী বাসে ডাকাতি বেড়েই চলছে। এ কারণে চালক ও যাত্রীদের কাছে আতঙ্কের নাম হয়ে উঠছে এই সড়ক। ডাকাতির শিকার বেশি হচ্ছেন প্রবাসফেরত লোকজন। ডাকাতেরা অস্ত্র ঠেকিয়ে লুট করে নিচ্ছে সর্বস্ব। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়েও ঘটছে ডাকাতির ঘটনা।
০২ মার্চ ২০২৫