Ajker Patrika

পোড়া মুখটি নয়নের নাকি আমার?

পলাশ আহসান
আপডেট : ১৬ জুন ২০২২, ১০: ২৭
পোড়া মুখটি নয়নের নাকি আমার?

সীতাকুণ্ডে আগুনের ১১ দিন পেরিয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের দগদগে ক্ষতের ওপর হালকা প্রলেপও পড়েছে। তাই এখন নয়নকে নিয়ে লেখার সাহস করলাম। কারণ, এ লেখায় বারবার তাঁর কথা আসবে। কারও মনে হতে পারে এ বুঝি নেতিবাচক উপস্থাপন। কোনো মৃত মানুষকে নিয়ে নেতিবাচক চিন্তা আমাদের স্বস্তি দেয় না। ভুল বুঝবেন না পাঠক, নয়ন আসলে আমাদের কাছে একটি উদাহরণ। ইংরেজিতে অনেকে ব্রেক-থ্রু বলতে পারেন। তাই ওকে নিয়ে না লিখে উপায় নেই।

মানুষ সাধারণত কাজ করে অনুসরণীয় হন। তাঁর দেখানো পথে সবাই চলেন। নয়নের কাজটিও অনুসরণীয়। কিন্তু সেটা তাঁর পথে চলার জন্য নয়। ওই পথে না চলার জন্য। জীবন দিয়ে নয়ন আমাদের শিখিয়ে গেছেন, তাঁর পথে যেন কেউ না চলেন। নয়নের ভুল থেকে আমাদের শিখতে হবে। পাঠক, নয়নকে নিশ্চয়ই এতক্ষণে মনে পড়েছে? সেদিন রাতে সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে দাউ দাউ করে জ্বলছিল একের পর এক কনটেইনার। বোঝাই যাচ্ছিল শুধু লেলিহান শিখা জ্বালিয়ে এই আগুন শেষ হবে না।

নিজের কাজের জায়গায় আগুনের খবর পেয়ে ডিপোতে এসেছিলেন অলিউর রহমান নয়ন। মেস থেকে আসার সময় সঙ্গে এনেছিলেন রুহেলসহ ১০-১৫ জন শ্রমিক বন্ধু। কিন্তু বিপদ আঁচ করে একে একে সবাই চলে গেলেন। সবশেষে গেলেন রুহেল। শুধু থেকে গেলেন নয়ন। বারবার ওকে ডেকেও মনোযোগ কাড়তে পারেননি রুহেল। শেষমেশ একরকম পালিয়েই জীবন বাঁচালেন। তখন নয়নের সর্বোচ্চ মনোযোগ লাল আগুনের ফেসবুক লাইভে। প্রাণ হাতে নিয়ে আগুনের পাশে দাঁড়ানো যে ঠিক নয়, সেই সাধারণ বুদ্ধি তাঁর ততক্ষণে লোপ পেয়েছে।

টানা ৪০ মিনিট নিজের স্মার্টফোনটা আগুনের দিকে তাক করে দাঁড়িয়ে ছিলেন নয়ন। লাইভ হচ্ছে। মুহূর্তেই সেই লাইভ শেয়ার হচ্ছে। লাইক পড়ছে। এই লাইভ ছেড়ে যায় কী করে? অথচ সামনে তখন গুটিকয় ফায়ার কর্মী। যৎসামান্য হলেও তাঁদের জীবন রক্ষার কিছু প্রস্তুতি আছে। ওর সেসবের বালাই নেই। কিন্তু শেয়ার-লাইকের টানে ওর মাথা তখন ফাঁকা। যুক্তি, ভয়, পরিবার—সবকিছু মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে। কারণ আর কিচ্ছু নয়। একধরনের অসুস্থ মন্ত্রমুগ্ধতা। যদিও অনেকে অনেক কথা বলেছেন। সবচেয়ে বেশি বলেছেন, লাইক পেয়ে টাকা আয়ের কথা। আমি তাঁর ফেসবুকে গিয়েছি। এ রকম কোনো আলামত পাইনি। তিনি আসলে ছিলেন অকারণ লাইক শিকারি।

নয়নের এই জীবন-মরণ লাইভের ৪০ মিনিট পর কনটেইনার বিস্ফোরণ শুরু হয়। চারদিক অন্ধকার। নয়ন কোথায় যেন ছিটকে পড়লেন। তাঁর ফোন ছুটে গেল আরেক দিকে। তখনো লাইভ চলছে। সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করছে অসহায় মানুষ। অথচ নয়ন সেটাও পারলেন না শেষ পর্যন্ত। কারণ, ততক্ষণে আগুন আর গরম লোহার পাতের আঘাতে তাঁর জীবন জমা হয়ে গেছে খরচের খাতায়। অথচ প্রযুক্তির কল্যাণে তখনো ফেসবুকের টাইম লাইনে যুক্ত নয়ন। তার সঙ্গে যুক্ত বহু মানুষ। ঠিক যে রকমটা তিনি চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁরা শুধুই অন্ধকার দেখছেন। কেউ তখনো বুঝতে পারছেন না, এই ঘোর অন্ধকার শুধু নয়নের জীবনের।

পলাশ আহসান

ছেলেটির বয়স মাত্র ২২ বছর। এখনো জীবনটাই শুরু হয়নি ভালো করে। এর আগেই শেষ হয়ে গেল। ওই মরণপণ লাইভ শুরু করার ঘণ্টাখানেক আগেও বাবাকে ১ হাজার টাকা পাঠিয়েছিলেন তিনি। কে জানত এটাই বাবা-মা-ভাইবোনের সংসারে তাঁর শেষ অংশগ্রহণ! সংসার চলে না। তাই মৌলভীবাজারের দিনমজুর বাবা ছেলেকে মাস চারেক আগে সীতাকুণ্ডে পাঠিয়েছিলেন কাজ করতে। ছেলের দাফনের আগে তিনি বারবার আহাজারি করছিলেন, ‘আমার সব শেষ হয়ে গেল।’ হয়তো গেলও শেষ হয়ে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এমন হলো? কেন নেশার মতো ফেসবুক লাইভে থাকতে হলো সব তুচ্ছ করে?

এই আসক্তি একধরনের মানসিক অসুস্থতা। এই আচরণ যে প্রথমবারের মতো দেখলাম, এমন নয়। আগেও বহু দুর্ঘটনায় এই লাইভ শিকারিদের দেখা গেছে। দুর্ঘটনার সময়ই সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে। রাস্তাঘাটেও দেখা যায়। তাদের ভিড়ে দুর্ঘটনায় পড়া মানুষদের রক্ষার কাজও দুরূহ হয় কখনো কখনো। বলতে দ্বিধা নেই, এই লাইভ বা লাইক শিকারিদের দুর্ঘটনায় পড়া মানুষের কষ্টের ছবিই টানে। মানুষকে কষ্ট থেকে মুক্তি দেওয়ার বিষয়টি টানে না। কিন্তু এ তো আমাদের সংস্কৃতি নয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরাই তো পাকিস্তানিদের পোড়া মাটির নীতি রুখে দিয়েছিলাম।

আগেই বলেছি, নয়নের সেই ভয়ানক লাইভ কোনো আর্থিক লাভের বিষয় ছিল না। কিন্তু আর্থিক লাভের লাইভ শিকারিদের একটি গল্প বলি। ঘটনাটা বছর তিনেক আগে উপকূলে একটি ঘূর্ণিঝড় আঘাত করার সময়ের। কলকাতার কোনো এক ইউটিউব চ্যানেলের লাইভ হচ্ছিল। ঠিক ওই সময়ে ঘূর্ণিঝড়টি আঘাত করছে। একটি ছাদে দাঁড়িয়ে শক্ত করে কার্নিশ ধরে রিপোর্টার লাইভ করছেন। বাতাসে প্রায় উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে রিপোর্টারকে। ওই ঝড়ের যে গতিবেগ ছিল তাতে যেকোনো সময় ওই রিপোর্টার বা ক্যামেরাপারসন উড়ে বাইরে পড়তে পারতেন। যেকোনো মুহূর্তে তাঁর গায়ে এসে লাগতে পারত বড় গাছের ডাল অথবা টিনের চালা। তবু সেই লাইভ হচ্ছিল। শত লাইক-শেয়ারও হচ্ছিল। কমেন্টসে ভর্ৎসনাও ছিল। বিরক্তিও ছিল।

আমাদের নয়ন ওই ইউটিউবারেরই উত্তরসূরি। প্রাণ বাজি রেখে লাইভের অসভ্যতা এ-জাতীয় উদাহরণ থেকেই শেখে তরুণ ছেলেমেয়েরা। আজকের নেট দুনিয়ার হাজারো সভ্য কনটেন্ট ভাসে। সেগুলো কি মানুষ এতটা অনুসরণ করে?

অনেকেই ভাবছেন নয়নের পরিবারের কী হবে? আমি ভাবছি হাজারো নয়নময় আমাদের চারপাশের কী হবে? এই অবাধ নেট দুনিয়া থেকে আমাদের কী নেওয়ার কথা ছিল, কী নিচ্ছি? কী শিখছি? বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় স্বাধীনভাবে বলার যে ক্ষমতা, সেটা আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? এখানে স্বাধীনতার চর্চা দেখি না। আমরা যেটা দেখি, সেটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই স্বেচ্ছাচার বা শত্রু দমনের অপচেষ্টা।

সোশ্যাল মিডিয়াচর্চার শত শত ইতিবাচক দিক আছে। মানুষের কথা বলার ফল পাওয়া যায় হাতে। মুহূর্তেই অনেক অজানাকে জানা হয়ে যায়। সমস্যা একটাই। এর আক্ষরিক প্রাণ নেই। তাই সে অন্যের হাতে কলের পুতুল। অনেকটা পানির মতো। যখন যে পাত্রে রাখা হয়, তখন সেই পাত্রের আকার ধরতে বাধ্য হয়। কী যে ভালো হতো, যদি সে অপব্যবহারকারীকে বাধা দিতে পারত! যদি সে বিপদ বুঝতে পেরে নিজেই বন্ধ হয়ে যেতে পারত। তাহলে নিশ্চয়ই আজকের নয়নকে পুড়তে হতো না।

নয়নকে দাফনের আগে কাফনের কাপড় ঢিলে করে দিয়েছিলেন স্বজনেরা। ধর্মীয় বিধি। তাই শেষবারের মতো তাঁর মুখটা দেখিয়েছিলেন স্বজনদের। সেই মুখের ছবি এসেছিল আমার কাছে। সেই ছবি প্রচারের কোনো সুযোগ বা ইচ্ছে কোনোটাই নেই। ছেলেটির পোড়া মুখ দেখার ঘণ্টাখানেক আগে তাঁর ফেসবুক ওয়ালে যেতে হয়েছিল আমাকে। এর পর থেকে একটি হাস্যোজ্জ্বল মুখ এবং পোড়া মুখ ঘুরছে মাথার মধ্যে। এক বীভৎস অনুভূতি হচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। আতঙ্ক সৃষ্টি হচ্ছে। যখন ভাবছি অনিয়ন্ত্রিত সোশ্যাল মিডিয়ার অপব্যবহারে এমন একটি পোড়া মুখ আমার বা কোনো স্বজন বা বন্ধুরও হতে পারে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

কোটি টাকা আত্মসাৎ করে লাপাত্তা: কে এই ফ্লাইট এক্সপার্ট এমডি সালমান, বাবার হাত ধরে যাঁর উত্থান

আ.লীগের এমপি শাম্মীর বাসায় ১০ লাখ টাকা চাঁদাবাজি ও ভাগ-বাঁটোয়ারার বিবরণ দিলেন রিয়াদ

কিশোরগঞ্জে হর্টিকালচারের উপপরিচালকের বিরুদ্ধে ‘সমকামিতার’ অভিযোগ, মামলা বাবুর্চির

অতিরিক্ত ফি দাবি করায় বিমানবন্দর স্টাফের চোয়াল ভেঙে দিলেন যাত্রী

ইউটিউবে ১০০০ ভিউতে আয় কত

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত