Ajker Patrika

আওয়ামী লীগকে উৎখাত করা কঠিন...

আওয়ামী লীগকে উৎখাত করা কঠিন...

আজকের পত্রিকা: শেখ হাসিনা সম্প্রতি বলেছেন, ‘সরকার উৎখাত করা এত সহজ?’ এ বিষয়ে আপনি কী মনে করেন?
আসিফ নজরুল: সরকার উৎখাত বলতে তিনি কী বলেছেন, সেটা আমি জানি না। তবে আমরা যদি আওয়ামী লীগের ইতিহাস দেখি, আওয়ামী লীগ কিন্তু কোনো দিনও গণ-আন্দোলনের মুখে ক্ষমতা থেকে সরে যায়নি। ১৯৭৫ সালে অত্যন্ত নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে তারা ক্ষমতা হারায়। এরপর তারা ২০০১ সালে নির্বাচনে পরাজিত হয়। গণ-আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে সরানো খুব কঠিন, এটা সত্যি।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারবিরোধী আন্দোলন যখন হয়েছিল, তখন আন্দোলনের মুখে বিএনপি কিন্তু ক্ষমতা থেকে সরে গিয়ে নির্বাচন দিয়েছে এবং আন্দোলনের দাবি মেনে নিয়েছে। আওয়ামী লীগ আন্দোলন দমন করার জন্য যে পরিমাণ শক্তি প্রয়োগ করে, সেটা বিএনপি বা জাতীয় পার্টির সরকার অতীতে করেনি। ফলে এটা ঠিক আছে, প্রধানমন্ত্রী যে বলেছেন, আওয়ামী লীগকে উৎখাত করা সোজা নয়।

আসলেই সোজা নয়। তবে আওয়ামী লীগকে সরকার থেকে পরিবর্তন করা নির্বাচনের মাধ্যমে খুবই সম্ভব। যদি দেশে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন হয়, তাহলে আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে অবশ্যই পরাজিত হবে বলে আমি বিশ্বাস করি। কারণ, এন্টি এনকম্বেন্সি বলে একটা জিনিস বাংলাদেশে কাজ করে। পৃথিবীর যেকোনো দরিদ্র, অনুন্নত, গণতন্ত্রহীন দেশে শক্তিশালীভাবে এটা কাজ করে। আওয়ামী লীগ ১৪ বছর ধরে ক্ষমতায় আছে। ১৪ বছর ধরে সাধারণ জনগণের মনে অনেক রাগ, ক্ষোভ জমেছে। যেভাবে দেশের টাকা লুট হচ্ছে, বিদেশে টাকা পাচার হচ্ছে, রিজার্ভ খালি হচ্ছে, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, রাজনীতিকীকরণ, দলীয়করণ ও নিপীড়ন হচ্ছে, এগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের পরাজয় হওয়ার জোরালো আশঙ্কা রয়েছে। কিন্তু এখন যদি নির্বাচন-প্রক্রিয়াটাকেই হাইজ্যাক করা হয়, নির্বাচন-প্রক্রিয়াটাকে এমন করা হয় যে কোনোভাবেই দেশে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন সম্ভব না, তাহলে অবশ্যই আওয়ামী লীগকে উৎখাত করা কঠিন। 

আজকের পত্রিকা: ১০ ডিসেম্বর নিয়ে দেশে একটি রাজনৈতিক উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল। এর ফলাফল কী হলো বলে আপনি মনে করেন? 
আসিফ নজরুল: এই রাজনৈতিক উত্তেজনার আসলে খুব বেশি প্রয়োজন ছিল বলে আমি মনে করি না। বিএনপির দু-একজন নেতা অপরিণামদর্শী কিছু বক্তব্য দিয়েছেন। সেটা তাঁরা সম্ভবত পরে বুঝতে পেরেছেন এবং বলেছেন, পলিটিক্যাল রেটরিক হিসেবে বলা হয়েছে, মিন করে বলা হয়নি। এই রাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্য দিয়ে দেশের আসলে কী লাভ হলো, তা আমি বুঝলাম না।

সরকার হয়তো ভাবতে পারে বিএনপিকে তারা অনেক বড় সমাবেশ করতে দেয়নি। অনেক বড় সমাবেশ করতে না দিয়ে সরকারের হয়তো লাভ হয়েছে রাজনৈতিকভাবে। বিএনপিকে কিছুটা হলেও দমানো গেছে। কিন্তু যেভাবে নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যেভাবে মির্জা ফখরুল ইসলামের মতো নেতাকে মধ্যরাতে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যেভাবে দলটির অফিসে অভিযান চালানো হয়েছে, যেভাবে পুলিশকে ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হতে দেবে কি না, সে বিষয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। মানুষের মনে প্রশ্ন আসবে, যারা একটা শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করতে দেয় না, পুলিশকে অন্যায় ও যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করে—তারা কীভাবে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন করতে দেবে? ১০ ডিসেম্বরের আগে বিএনপি যে সভাগুলো করেছিল, যেভাবে শান্তিপূর্ণভাবে হয়েছিল, কোনো রকম ঝামেলা হয়নি এবং কোনো সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেনি, তারপরও ১০ ডিসেম্বর সরকারের এ রকম মরিয়া হয়ে শক্তি প্রয়োগ করার কোনো প্রয়োজন ছিল না। চূড়ান্ত বিচারে আওয়ামী লীগ, বিএনপি কেউই লাভবান হয়নি। দেশে যারা হতাশা, নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে চায়, আসলে তারাই লাভবান হয়েছে।

আজকের পত্রিকা: বিএনপি সম্প্রতি ২০ দলীয় 
জোট ভেঙে দিয়েছে। আর গণতন্ত্র মঞ্চসহ আরও কয়েকটি দলকে নিয়ে যে যুগপৎ আন্দোলন করার ঘোষণা দিয়েছে, এর ভবিষ্যৎ কী হবে বলে আপনি মনে করেন? 
আসিফ নজরুল: প্রথমত, বিএনপি যদি সত্যিই জামায়াত থেকে সরে এসে থাকে, তাহলে আমি এটাকে সাধুবাদ জানাব। আমি মনে করি, এটা তাদের সঠিক সিদ্ধান্ত হবে। বিএনপি, জামায়াত একসঙ্গে থাকলে একে অপরের জন্য বোঝা হয়ে যায়। এটা বোঝার মতো রাজনৈতিক পরিপক্বতা তাদের থাকা উচিত ছিল।

আর বিএনপি যে ক্রমে প্রগতিশীল ও বাম সংগঠনগুলোর দিকে ঝুঁকছে, আগ্রহ তৈরি হচ্ছে এবং তাদের সঙ্গে জোট করছে—এটাকে আমি রাজনৈতিকভাবে ইতিবাচক মনে করি। এতে বিএনপির রাজনীতির গুণগত উত্তরণ হবে।

আর যুগপৎ আন্দোলনের যে রূপরেখা দিয়েছে, বাংলাদেশে অতীতে এ রকম আন্দোলন বিভিন্নভাবে সফল একটা পদ্ধতি হিসেবে কাজ করেছে। কিন্তু এ আন্দোলনে সবার সমান কমিটমেন্ট দেখাতে হবে। এখন যদি বড় দল ছোট দলকে অবহেলা দেখায়, আবার ছোট দল যদি বেশি অহমিকা দেখায়, তাদের যে শক্তি তার তুলনায় তার দাবি-দাওয়া বেশি হয়ে যায়, তখন একটা সমস্যা হবে।

এই যুগপৎ আন্দোলন সরকারের ওপর একটা চাপ সৃষ্টি করতে পারবে বলে আমি মনে করি। কারণ, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া থেকে আপনি বুঝতে পেরেছেন, তিনি এটা পছন্দ করছেন না।

আমি মনে করি, যে জোটই হোক না কেন, তাদের লক্ষ্য যদি ভালো সরকারব্যবস্থা, প্রকৃত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, মানুষের কল্যাণ এবং যারা দেশের টাকা লুটপাট ও পাচার করেছে, তাদের অবশ্যই দৃষ্টান্তমূলক বিচার করা, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুম বন্ধ করা, তাহলে দেশের মানুষের উপকার হবে।

আজকের পত্রিকা: বিএনপি সম্প্রতি রাষ্ট্র মেরামতের রূপরেখা উত্থাপন করেছে। এ নিয়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী? 
আসিফ নজরুল: ১৯৯০ সালে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও বামেরা মিলে তিন জোটের রূপরেখা দিয়েছিল। সেখানে তারা রেডিও-টেলিভিশনের স্বায়ত্তশাসন দেবে, শিক্ষানীতি করবে, স্থানীয় শাসনের প্রসার করবে। কালো আইন বাতিল করবে। সেখানে আরও ভালো ভালো কর্মসূচি ছিল। কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে কেউই তা বাস্তবায়ন করেনি। ফলে আজ বিএনপির রাষ্ট্র মেরামতের রূপরেখা দেখতে ভালো লাগছে, এতে ভালো ভালো জিনিস আছে। দীর্ঘদিন ধরে নাগরিক সমাজ, বাম ও প্রগতিশীল মহল যে দাবি করে আসছিল, তার অনেক কিছুই সেখানে আছে। এখন কথা হলো, এসবের কতটুকু বাস্তবায়ন করা হবে। দলগুলোর মধ্যে এ চিন্তাগুলো ঢুকেছে কি না? আরেকটা কথা, দলের মধ্যে গণতন্ত্রায়ণের প্রক্রিয়াটা আনতে হবে।

আজকের পত্রিকা: বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি আপনার কোনো পরামর্শ বা বক্তব্য আছে কি? 
আসিফ নজরুল: আমার প্রত্যাশা হচ্ছে, আওয়ামী লীগকে নিজ উৎসে ফিরে আসতে হবে। বঙ্গবন্ধুর যে আওয়ামী লীগ ছিল, তারা তো ভোটাধিকারে বিশ্বাস করত। তিনি ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জিতে এসে পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকতে পারতেন। কিন্তু তারপরও তিনি ১৯৭৩ সালে নির্বাচন দিয়েছিলেন। ১৯৭২ সালে যখন গণপরিষদ হয়েছিল, তখন তিনি বলেছিলেন, যে দল ক্ষমতায় আসবে তাকে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। এটাই গণতন্ত্রের ভিত্তি।

এখন তাঁরা নির্বাচন-প্রক্রিয়াকে যেভাবে বাধাগ্রস্ত করছেন, যেভাবে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছেন—দেশের সব প্রতিষ্ঠানের ওপর—পুলিশ, আদালত সবকিছুর ওপর, এতে আগামী নির্বাচনে যেকোনো বিবেকবান সাধারণ মানুষের মনে প্রচণ্ড প্রশ্ন তৈরি হবে। আমি যখন ক্লাসে আমার ছাত্রদের জিজ্ঞাসা করি, তোমরা কি ভোট দিয়েছ? তখন তারা একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে থাকে, হাসে। আমার এসব দেখতে ভালো লাগে না।

এখন আমি যখন আওয়ামী লীগ নিয়ে কথা বলি, তখন ওই চেতনাবোধ থেকে কথা বলি, আপনারা কোন অধিকারবলে দেশের কোটি কোটি তরুণকে ভোট দিতে দেন না। আমি যখন ক্লাসে ছাত্রদের বলি, জনপ্রতিনিধি ছাড়া দেশ শাসন করতে পারবে না, তখন তারা আমার দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে।

আমি বিশ্বাস করি, আওয়ামী লীগ যদি আগামী নির্বাচনে পরাজিত হয়, পাঁচ বছর পর আবারও ফিরে আসার মতো সাংগঠনিক শক্তি, দৃঢ়তা, ঐতিহ্য, দলের মধ্যে রয়েছে। ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়। দলের সুনাম, দেশের স্বার্থ চিরস্থায়ী। আওয়ামী লীগকে যদি প্রয়োজন হয় বিরোধী দলে গিয়ে রাজনৈতিক চর্চার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করতে দিতে হবে। নির্বাচনে জয়ী হলে দেশের জন্য কী করবে, তার প্রস্তুতির পাশাপাশি, পরাজিত হলে সেটা মেনে নিয়ে কী কী করবে, তারও মানসিক অবস্থান তৈরি করতে হবে।আওয়ামী লীগকে আওয়ামী লীগ হতে হবে। তারা আওয়ামী লীগ হওয়া থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। আশা করব, তারা যেন সত্তরের আওয়ামী লীগে পরিণত হয়। তাদের যেন ঐতিহ্য ফিরে আসে। তারা যেন ১৯৯৬ সালের আওয়ামী লীগে পরিণত হয়, যখন তারা মানুষের ওপর, ভোটাধিকারের ওপর আস্থা রাখত।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

‘তুমি ঘুমাও কীভাবে’, সৌদি যুবরাজকে নিয়ে ট্রাম্পের বিস্ময়

বিদ্যালয়ে সময় দেন না শিক্ষক, ইউএনওর কাছে অভিযোগ করায় সহকর্মীকে মারধর

কুয়েটে ক্লাস বর্জন নিয়ে শিক্ষক সমিতিতে মতবিরোধ, এক শিক্ষকের পদত্যাগ

এনবিআর বিলুপ্তির জেরে প্রায় অচল দেশের রাজস্ব কর্মকাণ্ড

দুটি নোবেলের গৌরব বোধ করতে পারে চবি: প্রধান উপদেষ্টা

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত