Ajker Patrika

সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষায় পরিবার

কাজী ফারজানা আফরীন
আপডেট : ২২ জুলাই ২০২২, ১২: ২৫
Thumbnail image

পরিবার সমাজের ভিত্তিমূল। এটি একটি সর্বজনীন ব্যবস্থা এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের দর্পণ। সমাজবিজ্ঞানী সামনার ও কেলারের মতে, ‘পরিবার হলো ক্ষুদ্র সামাজিক সংগঠন, যেখানে মানুষ তার প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করে।’ গবেষণায় দেখা যায়, পারিবারিক ইতিবাচক-নেতিবাচক দিকনির্দেশনা, আচার-ব্যবহার আর আদব-শিষ্টাচারের মধ্য দিয়েই একটি শিশুর বিবেক, বুদ্ধি ও দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে। শিশুর ভাষার বিকাশ, নৈতিক মূল্যবোধ গঠন, ব্যক্তিত্বের বিকাশ, বৃত্তি নির্বাচন, মানসিক বিকাশ ইত্যাদি ক্ষেত্রে পরিবার মুখ্য ভূমিকা পালন করে। মানুষ যেমন পরিবারের সদস্য, তেমনি সমাজেরও সদস্য। ইসলাম মানুষকে যেসব মৌলিক বিষয়ে শিক্ষা দেয় তার মধ্যে পারিবারিক শিক্ষা অন্যতম।

সুন্দর, মার্জিত ও শিষ্টাচারসম্পন্ন পরিবারগুলোর সমন্বয়েই গড়ে ওঠে একটি আদর্শ সমাজ। তাই ইসলাম পরিবারের সংশোধন ও শৃঙ্খলাকে অধিক গুরুত্ব দেয়। পরিবারের সব সদস্যের চাহিদা ও প্রয়োজন বিবেচনা করে পরিবারের জন্য কিছু বিধিবিধান ও নিয়মনীতি প্রদান করেছে। যার মাধ্যমে দয়া-অনুগ্রহ-সহমর্মিতা ও সহযোগিতার ভিত্তিতে একটি আদর্শ পরিবার গড়ে ওঠে। কারণ শিশুর জ্ঞান-বিবেক-বুদ্ধিসহ আত্মিক, মানসিক ও জৈবিক গঠন ও উন্নয়নসাধনে পরিবারের ভূমিকা অনন্য। পরিবার থেকে শিক্ষা নিয়েই ব্যক্তি সমাজের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনে সক্ষম হয়। তাই পরিবারের প্রতিটি সদস্যের জন্য পারিবারিক শিক্ষা অতিগুরুত্বপূর্ণ।

মহান আল্লাহ জগতের সামাজিক শৃঙ্খল তৈরি করার লক্ষ্যে প্রথম নর-নারী হজরত আদম (আ.) ও হজরত হাওয়া (আ.)-এর মাধ্যমে পৃথিবীতে প্রথম মানব পরিবার সৃষ্টি করেছেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন, ‘হে মানুষ, আমি তোমাদের এক নারী ও এক পুরুষ থেকে সৃষ্টি করেছি আর তোমাদের বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি। যাতে তোমরা পরস্পর পরিচিত হতে পারো। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সে-ই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন, যে তোমাদের মধ্যে অধিক তাকওয়াসম্পন্ন।’ (সুরা হুজরাত: ১৩)

ইসলামের নির্দেশনা অনুযায়ী, পরিবার সমাজ গড়তে হলে আগেই পরিবারের কয়েকটি বিষয়ের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। যেমন আদর্শ স্ত্রী নির্বাচন, পরিবারে ইসলামের চর্চা অব্যাহত রাখা, সদস্যদের প্রয়োজনীয় ধর্মীয় শিক্ষা নিশ্চিত করা, পারস্পরিক জবাবদিহি, সময়ের শৃঙ্খলা, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা, পরস্পরকে সহযোগিতা, পর্দা ও শালীনতা রক্ষা ইত্যাদি অতিগুরুত্বপূর্ণ। পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের থেকেই স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি পাও। আর তিনি তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয়ই এর মধ্যে চিন্তাশীল জাতির জন্য নিদর্শন রয়েছে।’ (সুরা রুম: ২১)

পরিবারের সব সদস্যের মধ্যে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক থাকা চাই। বাবা-মা, ভাইবোন অন্যান্য আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কীভাবে সম্পর্ক অটুট রাখতে হয়, ইসলাম তা অনুপুঙ্খভাবে শিখিয়েছে। সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় যা অনবদ্য ভূমিকা রাখে; বিশেষ করে মা-বাবার প্রতি সন্তানের যে বিরাট কর্তব্যের কথা ইসলাম বলেছে, তা পালন করলে পরিবার ও সমাজব্যবস্থা কখনোই ভেঙে পড়বে না। এরশাদ হয়েছে, ‘আপনার প্রভু এ বলে নির্দেশ দিচ্ছেন যে তোমরা তিনি ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করবে না এবং মা-বাবার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে। তাঁদের একজন বা উভয়জন তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হলে তুমি তাঁদের বিরক্তিসূচক কোনো শব্দ বলবে না এবং তাঁদের ভর্ৎসনাও করবে না; বরং তাঁদের সঙ্গে সম্মানসূচক নম্র কথা বলবে। দয়াপরবশ হয়ে তাঁদের প্রতি সর্বদা বিনয়ী থাকবে এবং সর্বদা তাঁদের জন্য এ দোয়া করবে যে, হে আমার প্রভু, আপনি তাঁদের প্রতি দয়া করুন—যেমনিভাবে শৈশবে তাঁরা আমার প্রতি অশেষ দয়া করে আমাকে লালন-পালন করেছেন।’ (সুরা ইসরা: ২৩-২৪)

পরিবার মানুষকে দায়িত্বশীল বানায় এবং শুদ্ধ হওয়ার প্রয়োজনীয়তা বুঝতে শেখায়; বিশেষ করে সমাজের দায়িত্বশীল, ক্ষমতাবান ও প্রভাব-প্রতিপত্তিসম্পন্ন লোক যাঁরা সমাজ পরিচালনা করেন, তাঁদের শুদ্ধতার প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে বেশি। কারণ তাঁদের ভালো-মন্দ কর্ম পুরো সমাজকে প্রভাবিত করে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘শপথ প্রাণের এবং যিনি তা সুবিন্যস্ত করেছেন, এরপর তাকে সৎকর্ম ও মন্দকর্মের জ্ঞানদান করেছেন। যারা আত্মশুদ্ধি অর্জন করে, তারাই প্রকৃত সফল আর যারা আত্মা কলুষিত করে, তারা ব্যর্থ। (সুরা শামস: ৭-১০)

দায়িত্বশীলতার শুরু হয় ব্যক্তি ও পরিবার থেকেই। হাদিসে এসেছে, ‘প্রত্যেক মানুষই দায়িত্বশীল, সুতরাং প্রত্যেকেই তার অধীনদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে। দেশের শাসক জনগণের দায়িত্বশীল, সে তাদের ব্যাপারে জবাবদিহি করবে। একজন পুরুষ তার পরিবারের দায়িত্বশীল, অতএব সে পরিবারের বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। স্ত্রী তার স্বামী ও সন্তানের দায়িত্বশীল, কাজেই সে তাদের বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল। সুতরাং প্রত্যেকেই নিজ নিজ অধীনের ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে।’ (বুখারি ও মুসলিম)

সামাজিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য পারিবারিক জীবনে নারী-পুরুষ উভয়কে তার অবস্থানুযায়ী দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে। তারা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করলেই একটি পরিপূর্ণ ও আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠা সম্ভব। ইসলামি আদর্শ ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে গড়া একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ শুধু সমাজের জন্য নেয়ামত নয়; বরং সমাজ গড়ার কারিগরও, যিনি দুনিয়া ও আখিরাতের পথপ্রদর্শকের দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এরশাদ করেন, ‘হে ইমানদারগণ, তোমরা নিজেদের ও তোমাদের পরিবার-পরিজনকে জাহান্নাম থেকে বাঁচাও, যার জ্বালানি হবে মানুষ ও পাথর।’ (সুরা তাহরিম: ৬)

কাজী ফারজানা আফরীন, সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত