Ajker Patrika

বিদেশিদের বেতন-ভাতা: আড়াই বছরে চীন-ভারতে ৩৫ হাজার কোটি টাকা

জয়নাল আবেদীন খান, ঢাকা
আপডেট : ২৬ জুন ২০২৩, ১০: ০৩
বিদেশিদের বেতন-ভাতা: আড়াই বছরে চীন-ভারতে ৩৫ হাজার কোটি টাকা

বাংলাদেশে কর্মরত চীন ও ভারতের নাগরিকেরা গত আড়াই বছরে বেতন-ভাতা বাবদ প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ অর্থ নিজ দেশে পাঠিয়েছেন। অর্থ পাঠানোতে শীর্ষে চীনারা। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। এদিকে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) প্রতিবেদন বলছে, ২ লাখ ৪১ হাজার বিদেশি সরকারকে কর না দিয়ে বছরে ২৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা নিজ দেশে নিয়ে যাচ্ছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ১৯ জুন পর্যন্ত আড়াই বছরের কম সময়ে চীন ও ভারতের নাগরিকেরা বাংলাদেশ থেকে ৩১৯ কোটি (৩ দশমিক ১৯ বিলিয়ন) ৮০ লাখ মার্কিন ডলার বৈধ পথে নিজ দেশে রেমিট্যান্স হিসেবে পাঠিয়েছেন। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ (প্রতি ডলার ১০৯ টাকা হিসাবে) ৩৪ হাজার ৮৫৮ কোটি ২০ লাখ টাকা। শীর্ষে থাকা চীনা নাগরিকেরা পাঠিয়েছেন ১৯৪ কোটি ৪৩ লাখ ডলার বা ২১ হাজার ১৯২ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। ভারতীয় নাগরিকেরা পাঠিয়েছেন ১২৫ কোটি ৩৭ লাখ ডলার বা ১৩ হাজার ৬৬৫ কোটি ৩৫ লাখ টাকা।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চীন, ভারতের নাগরিকসহ বিদেশিরা তৈরি পোশাক, বস্ত্র, বায়িং হাউস, বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, মোবাইল ফোন কোম্পানি, তথ্যপ্রযুক্তি, চামড়াশিল্প, চিকিৎসাসেবা, কার্গো সেবা, আন্তর্জাতিক এনজিও, বিজ্ঞাপনী সংস্থা, তেল ও গ্যাস কোম্পানি, অডিট ফার্ম, হোটেল ও রেস্তোরাঁ, প্রকৌশল, ফ্যাশন ডিজাইন, খাদ্য উৎপাদন ও বিপণন, পোলট্রি খাদ্য উৎপাদন এবং আন্তর্জাতিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও মেগা প্রকল্পে বেশি কাজ করেন।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান ড. আবদুল মজিদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, পোশাক, তথ্যপ্রযুক্তি, টেলিকম ও অবকাঠামো প্রভৃতি খাতে বিদেশিরা কাজ করেন। তাঁদের সংখ্যা কম হলেও বেতন-ভাতা বেশি। সরকার-নির্ধারিত হারে কর দিয়ে তাঁদের আয় নিজ দেশে পাঠাতে কোনো বাধা নেই। কর ফাঁকি ও অবৈধভাবে রেমিট্যান্স পাঠানো রোধে তথ্য হালনাগাদ করা জরুরি। বিশেষ করে বিদেশিরা যেসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন, তারাই কর কেটে সরকারি কোষাগারে জমা দিতে পারে। বিদেশিরা অবৈধভাবে কাজ করতে না পারলে কর ফাঁকি বন্ধ হয়ে যাবে।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, চলতি জুনের ২২ তারিখ পর্যন্ত যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাজের অনুমতি (ওয়ার্ক পারমিট) নিয়ে ভারতের ৫ হাজার ৮৭০ জন এবং চীনের ৬ হাজার ৬৫ নাগরিক বাংলাদেশে আছেন। তবে ভিসাধারী ভারতীয়দের সংখ্যা ৩৯ হাজার ৭২০ জন এবং ভিসাধারী চীনা নাগরিক রয়েছেন ৮ হাজার ৭৫০ জন। সব মিলিয়ে বর্তমানে দেশে বৈধভাবে কর্মরত ভারতীয় রয়েছেন ৪৫ হাজার ৫৯০ জন। চীনা নাগরিক আছেন ১৪ হাজার ৭৯৫ জন।

বাংলাদেশে অবস্থানরত ভারতীয়র সংখ্যা চীনাদের তিন গুণের বেশি। অথচ বৈধভাবে চীনাদের পাঠানো অর্থের পরিমাণ ভারতীয়দের দেড় গুণের বেশি। সূত্র বলেছে, এই দুই দেশের নাগরিকদের অর্থ পাঠানোর এই ব্যবধান পাচারের কারণে হয়েছে বলে সন্দেহ জাগায়।

বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান মো. মাসুদ বিশ্বাস আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকলে দেশি-বিদেশি কাউকে ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। ইতিপূর্বে কয়েকজন বিদেশি নাগরিকের তথ্য তলব করেছিলাম। আমরা কারও অপরাধ খুঁজে পেলে তা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অবহিত করি।’

জাতীয় সংসদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের দেওয়া তথ্যমতে, বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প, শিল্পকারখানা, এনজিওসহ বিভিন্ন সংস্থায় ১১৫টি দেশের ২০ হাজার ৯৮৮ জন নাগরিক ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে কাজ করছেন। তাঁদের মধ্যে চীনের ৬ হাজার ৭৫ জন, ভারতের ৫ হাজার ৮৭৬, রাশিয়ার ২ হাজার ৪৬৮, শ্রীলঙ্কার ১ হাজার ২৭৬, দক্ষিণ কোরিয়ার ৯২৪, জাপানের ৫৫৭, পাকিস্তানের ৪১৬, ফিলিপাইনের ৪৬০, থাইল্যান্ডের ৩৯৯, বেলারুশের ৩৭৮ নাগরিক রয়েছেন।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বিদেশিরা ব্যবসা, বিশেষজ্ঞ, কারিগরি, খেলোয়াড়, ক্রীড়া সংগঠক, বিনিয়োগকারী, ব্যক্তিগত কর্মচারী, এনজিওকর্মীদের প্রশিক্ষণ, গবেষণা প্রভৃতি কাজেও জড়িত।

আইটি খাতের একজন উদ্যোক্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সফটওয়্যার ও ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমে ভারতীয় প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে তাদের লোক রাখার বাধ্যতামূলক শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়।

টিআইবির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ২১টি খাতে ৪৪টি দেশের আড়াই লাখ নাগরিক কাজ করছেন। তাঁদের ন্যূনতম মাসিক বেতন ১ হাজার ৫০০ ডলার। বিদেশি কর্মীদের বার্ষিক আয় ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে কর দিচ্ছেন মাত্র ৯ হাজার ৫০০ জন। বাকি ২ লাখ ৪১ হাজার বিদেশি বছরে ২৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা নিয়ে যাচ্ছেন। ফলে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে ১২ হাজার কোটি টাকা। সিইও হিসেবে একজন বিদেশি মাসে ১০ থেকে ১২ হাজার ডলার বেতন পেলেও কাগজপত্রে দেখানো হচ্ছে ৩ থেকে ৪ হাজার ডলার।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দেশের স্বার্থে বিদেশি কর্মী প্রয়োজন। তবে এ জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা জরুরি। নিয়মের শিথিলতার সুযোগে অবৈধ বিদেশি কর্মীও কাজ করেন। কেউ কেউ পর্যটক হিসেবে ভিসা নিয়ে এসেও কাজ করেন। তাঁরা যে অর্থ আয় করে, তা অবৈধভাবে নিজ দেশে নিয়ে যান। এই অপরাধের জন্য শুধু তাঁরা দায়ী নয়, যারা এদের নিয়োগ দেয়, তাদেরও দায় রয়েছে। 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত