মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী
আজ শুক্রবার সকাল ৮টার পর থেকে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা শেষ। রোববারেই বহুল আলোচিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। গত ১৮ ডিসেম্বর থেকে প্রার্থীরা এবং তাদের সমর্থকেরা প্রচার-প্রচারণায় ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন। অবশ্য যতজন প্রার্থী নির্বাচনী প্রচারণায় নেমেছিলেন, তাঁদের সবাইকে ভোটাররা সমানভাবে দেখেছেন— এমনটি নয়। কোনো কোনো দলের প্রার্থীর নামধাম কিছুই নির্বাচনী আসনের ভোটাররা জানতেও পারেননি। বোঝাই গেছে, ওই সব দলের প্রার্থীরা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা কিংবা জয়লাভ করার কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে অংশ নেননি। তবে তাঁরা কেন ব্যালট পেপারে নাম অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর কোনো প্রচার-প্রচারণায় অংশ নেননি, তা বোঝা গেল না। আবার কোনো কোনো দলের প্রার্থীরা শেষের দিকে এসে দলের সিদ্ধান্ত ছাড়াই নিজেদের প্রার্থিতা নিজেরাই প্রত্যাহারের কথা ঘোষণা দিচ্ছেন।
যে সময় তাঁরা নাম প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছেন, সেই সময় ব্যালট পেপার থেকে নাম মুছে ফেলা নির্বাচন কমিশনের পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু এখন বলছেন, প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে তাঁরা সরে যাচ্ছেন। বিশেষ করে জাতীয় পার্টির ডজনখানেক প্রার্থী নিজেদের নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান তাঁর পূর্বসূরি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মতোই এবারের নির্বাচনে নানা ধরনের ভূমিকায় নিজেকে অবতীর্ণ করেছেন। জি এম কাদেরকে অনেকে আগে বেশ সিরিয়াস মানুষ হিসেবেই মনে করতেন, কিন্তু দলের সভাপতি হওয়ার পর থেকে তিনি বোধ হয় তাঁর ভাইকেও অনেক ক্ষেত্রে ছাড়িয়ে যাচ্ছেন। তবে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণার খবরাখবর গণমাধ্যমে যেভাবে গত কয়েক দিন প্রচারিত হয়েছে, তাতে জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের মধ্যে বেশির ভাগেরই জয়ের সম্ভাবনা নিয়ে নানা রকম সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। সে কারণেই হয়তো অনেকে তাঁদের নাম প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়ে পরাজয়ের গ্লানি থেকে নিজেকে রক্ষা করার মতো একটি উত্তর হাতে রেখেছেন।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে শুরু থেকেই রাজনৈতিক অঙ্গনে অনেক নাটকীয়তা সবাইকে দেখতে হয়েছে। বিএনপি এবং যুগপৎ আন্দোলনকারী দলগুলো আগে থেকেই এক দফার আন্দোলন করে আসছিল। তারা নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল। সরকার সংবিধানসম্মতভাবেই দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠানের অবস্থানে অনড় ছিল। যুগপৎ আন্দোলনকারীরা সরকারপতনে দেশে গণ-আন্দোলন সৃষ্টি করতে পারেনি। ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি পূরণ করার কোনো বাস্তব অবস্থা তৈরি হয়নি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিএনপির হিসাব-নিকাশ ছিল নানা ধরনের। বিএনপির ধারণা ছিল, বিদেশিদের সমর্থনে সরকারকে ২৮ অক্টোবরের পর ক্ষমতাচ্যুত করতে তারা সক্ষম হবে। বিএনপি ও যুগপৎ আন্দোলনকারী নেতৃবৃন্দ সরকারকে সে ধরনের হুঁশিয়ারিও দিয়ে আসছিলেন। সরকার পতনের ডেডলাইনও দেওয়া ছিল।
কিন্তু এর কোনোটাই বাস্তবে না ঘটার পর হরতাল, অবরোধ ও সহিংস কর্মসূচি দেওয়ার পরও জনসমর্থন খুব একটা আন্দোলনের পক্ষে বাড়ার লক্ষণ দেখা যায়নি। এরই মধ্যে নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণা করে। বিএনপি এবং যুগপৎ আন্দোলনকারীরা নির্বাচন বর্জন এবং হরতাল ও অবরোধের কর্মসূচি চালিয়ে যেতে থাকে। সেই অবস্থায় বিএনপি ও যুগপৎ আন্দোলনকারীদের অনুপস্থিতিতে নির্বাচন যেভাবে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতায় উত্তপ্ত হয়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিল, সেটি না ঘটারই বাস্তবতা তৈরি হলো। নির্বাচনকে গুরুত্বহীন করার জন্যই বিএনপি ও যুগপৎ আন্দোলনকারীরা নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের ধারণা ছিল, এর ফলে আওয়ামী লীগ এবারও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করার পথে হাঁটবে কিংবা হাঁটতে বাধ্য হবে। তেমনটি ঘটলে দেশে-বিদেশে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নির্বাচনব্যবস্থা ধ্বংস করার অভিযোগটি প্রমাণ করা তাদের পক্ষে সহজ হবে।
বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এক পক্ষে আওয়ামী লীগ, বিপরীতে বিএনপি অবতীর্ণ হলেই কেবল নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হতে পারে। এক পক্ষ অংশ না নিলে নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হয় না, তা একটি শিশুও বলে দিতে পারে। বিএনপির হাতে যেসব অপশন ছিল, তার মধ্যে সর্বশেষ অপশন হলো নির্বাচন বর্জন করা। হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নতুবা নির্বাচন বর্জন। বিএনপি শেষটি হাতে রেখেছিল এবং তফসিল ঘোষণার পর সেটিই তারা প্রয়োগ করল। সেই অবস্থায় আওয়ামী লীগ নির্বাচনটিকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করার জন্য দলীয় মনোনীত প্রার্থী ছাড়াও স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার সুযোগ দিয়েছে। এটি আওয়ামী লীগের মতো এত বড় রাজনৈতিক দলের পক্ষে উন্মুক্ত করার বিষয়টি বেশ ঝুঁকিপূর্ণ।
সব জেনেশুনেই আওয়ামী লীগকে নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক করার জন্য দলীয় নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার পথ খোলা রেখে দিতে হলো। এর ফলে নির্বাচন ঝুলে না পড়ে বরং বেশ উত্তপ্ত এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সারা দেশেই অন্তত দুই শতাধিক আসনে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা বেশ জমে উঠেছে। অনেক আসনেই প্রার্থী ও সমর্থকদের মধ্যে সংঘাত-সংঘর্ষ ঘটেছে। আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীদের অনেকেই নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় এবার বেশ হিমশিম খাওয়ার অবস্থায় পড়েছেন। নির্বাচনী ফলাফলে অনেক চমকপ্রদ ঘটনা দেখা যেতে পারে। স্বতন্ত্রদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বিজয়ী হতে পারে।
প্রার্থীদের সবার মধ্যেই এখন টান টান উত্তেজনা এবং নাভিশ্বাস ওঠার মতো হাবভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। অনেক আসনেই নির্বাচন ত্রিমুখী, চতুর্মুখী লড়াইয়ে পরিণত হতে যাচ্ছে। কার গলায় বিজয়ের মালা উঠবে, তা আগে থেকে বলা মুশকিল। তবে অবিশ্বাস্য অনেক কিছুই যে ঘটবে, সে ব্যাপারে পর্যবেক্ষক মহল নিশ্চিত। সেরকম কিছু ঘটলে সরকার গঠন এবং বিরোধী দলের অবস্থান কী হবে, তা বোধ হয় সোমবার থেকে অনেকেরই চিন্তার বিষয়ে পরিণত হতে পারে।
অন্যদিকে নির্বাচন কমিশন এবার জটিল এই পরিস্থিতির মধ্যেও বেশ স্বাধীনভাবে নিজেদের সিদ্ধান্ত নেওয়াসহ নির্বাচন অনুষ্ঠানের যাবতীয় ব্যবস্থা গুছিয়ে এনেছে। আচরণবিধি ভঙ্গ করার দায়ে অনেক প্রার্থীকেই কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে, বেশ কয়েকজন শাস্তিও পেয়েছেন।
৯১-ই অনুচ্ছেদের বিধানে একজনের প্রার্থিতা বাতিল করেছে, আর্থিক জরিমানাও কয়েকজনকে করা হয়েছে। নির্বাচনী মাঠ তীব্র উত্তেজনাপূর্ণ হওয়ায় অনেক প্রার্থী এবং তাঁদের সমর্থকেরা আচরণবিধি লঙ্ঘনে জড়িয়ে পড়েন। ফলে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এবারই সবচেয়ে বেশিসংখ্যক প্রার্থী নির্বাচন কমিশনের দেওয়া শাস্তির আওতায় পড়েছেন। নির্বাচন কমিশন আরও কঠোরতা প্রদর্শন করলে শাস্তির আওতা এবং কঠোরতায় আরও অনেককেই পড়তে হতো, কিন্তু কমিশন মডারেট পন্থা অনুসরণ করেছে। নির্বাচন কমিশন নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু করার জন্য দেশের গোটা প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সামরিক বাহিনীর সদস্যদের এরই মধ্যে মাঠে নামিয়েছে।
কমিশন থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত সবাইকেই নিয়ম ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দ্বিধা না করার অনুরোধ জানানো হয়েছে। একইভাবে অংশগ্রহণকারী সব দল ও নির্দলীয় প্রার্থীদের নির্বাচনী আচরণবিধি যথাযথভাবে পালনের জন্য কমিশন থেকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, বেশির ভাগ আসনেই ভোটার উপস্থিতি সন্তোষজনক হবে। একটি পক্ষ অংশ না নেওয়ায় ভোটার উপস্থিতি নিয়ে যে শঙ্কা তৈরি হয়েছিল, আশা করা যাচ্ছে সেটি অনেকটাই কেটে যাবে। যেসব আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা তেমন তীব্র হবে না বলে বোঝা যাচ্ছে, সেই সব আসনে হয়তো ভোটারের উপস্থিতি তুলনামূলকভাবে কম হতে পারে। রোববার সকালে সবাই দেখতে পাবে ভোটারের উপস্থিতি বাস্তবে কতটা ঘটবে। অন্যদিকে বিএনপিসহ যুগপৎ আন্দোলনকারীরা ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত না হওয়ার জন্য লিফলেট বিতরণ করছে।
তাদের প্রচেষ্টা কতটা সফল হবে তা-ও রোববারেই দেখা যাবে। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যেহেতু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত, রাশিয়া গভীর মনোযোগের সঙ্গে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছে, তাই তাদেরও চোখ রোববারের নির্বাচনের দিকে। নির্বাচনটি শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হলে কারও কিছু বলার থাকবে না। বিশেষত ব্যালট পেপারে কেউ অনিয়ম ঘটাতে চাইলে সেটির বিরুদ্ধে কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করলে বিষয়টি সবারই সমর্থন লাভ করবে। এর ব্যতিক্রম দু-একটি কেন্দ্রে ঘটলেও তা নিয়ে নির্বাচনবিরোধী এবং বিদেশি পর্যবেক্ষকেরাও হইচই কিংবা সমালোচনার সুযোগ পাবেন। সে কারণে সব অংশগ্রহণকারী দল ও প্রার্থীর উচিত হবে শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে তাদের সক্রিয় সমর্থন যেন শতভাগ থাকে, কোনো ধরনের আইন ও নিয়ম ভাঙার চেষ্টা প্রার্থী, সমর্থক ও ভোটারদের কেউ যেন করতে না পারে, সে ব্যাপারে শতভাগ সচেষ্ট থাকা।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে অযথাই অনেক কিছু করা হয়েছে। নদী-সাগরের মতো অথই পানিও যেন ঘোলা করতে কোনো কোনো মহল যারপরনাই চেষ্টা করেছে, এখনো করছে। একটি জাতীয় নির্বাচনকে এভাবে দলীয় কিংবা ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহার করার প্রবণতা রাষ্ট্রের জন্য কতটা লজ্জা এবং ক্ষতিকর, তা অনেকেই যেন বুঝতে চাইছে না। সে কারণেই ৭ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে এত শ্লেষ, অপবাদ ও অর্থহীন করার অপচেষ্টা ধারাবাহিকভাবে করতে দেখা গেছে। গণতন্ত্র যদি সত্যিকার অর্থেই আমাদের রাষ্ট্রে ধারণ করার রাজনীতি ক্রিয়াশীল থাকত, তাহলে প্রতিবারই জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে এমন টানাহেঁচড়া এবং বিবাদ-বিসংবাদ আমাদের দেখতে হতো না। কিন্তু মুখে গণতন্ত্র, বগলের তলে ইট-পাথর রেখে যারা গণতন্ত্রের কথা শোনাতে চায়, তারা আসলেই গণতন্ত্র থেকে বহু দূরে অবস্থান করছে। ৭ তারিখের নির্বাচন যেন সত্যিকার অর্থেই শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয়, সেটিই দেশপ্রেমিক সব মানুষের কাম্য।
লেখক: মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী, অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ ও কলামিস্ট
আজ শুক্রবার সকাল ৮টার পর থেকে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা শেষ। রোববারেই বহুল আলোচিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। গত ১৮ ডিসেম্বর থেকে প্রার্থীরা এবং তাদের সমর্থকেরা প্রচার-প্রচারণায় ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন। অবশ্য যতজন প্রার্থী নির্বাচনী প্রচারণায় নেমেছিলেন, তাঁদের সবাইকে ভোটাররা সমানভাবে দেখেছেন— এমনটি নয়। কোনো কোনো দলের প্রার্থীর নামধাম কিছুই নির্বাচনী আসনের ভোটাররা জানতেও পারেননি। বোঝাই গেছে, ওই সব দলের প্রার্থীরা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা কিংবা জয়লাভ করার কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে অংশ নেননি। তবে তাঁরা কেন ব্যালট পেপারে নাম অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর কোনো প্রচার-প্রচারণায় অংশ নেননি, তা বোঝা গেল না। আবার কোনো কোনো দলের প্রার্থীরা শেষের দিকে এসে দলের সিদ্ধান্ত ছাড়াই নিজেদের প্রার্থিতা নিজেরাই প্রত্যাহারের কথা ঘোষণা দিচ্ছেন।
যে সময় তাঁরা নাম প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছেন, সেই সময় ব্যালট পেপার থেকে নাম মুছে ফেলা নির্বাচন কমিশনের পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু এখন বলছেন, প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে তাঁরা সরে যাচ্ছেন। বিশেষ করে জাতীয় পার্টির ডজনখানেক প্রার্থী নিজেদের নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান তাঁর পূর্বসূরি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মতোই এবারের নির্বাচনে নানা ধরনের ভূমিকায় নিজেকে অবতীর্ণ করেছেন। জি এম কাদেরকে অনেকে আগে বেশ সিরিয়াস মানুষ হিসেবেই মনে করতেন, কিন্তু দলের সভাপতি হওয়ার পর থেকে তিনি বোধ হয় তাঁর ভাইকেও অনেক ক্ষেত্রে ছাড়িয়ে যাচ্ছেন। তবে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণার খবরাখবর গণমাধ্যমে যেভাবে গত কয়েক দিন প্রচারিত হয়েছে, তাতে জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের মধ্যে বেশির ভাগেরই জয়ের সম্ভাবনা নিয়ে নানা রকম সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। সে কারণেই হয়তো অনেকে তাঁদের নাম প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়ে পরাজয়ের গ্লানি থেকে নিজেকে রক্ষা করার মতো একটি উত্তর হাতে রেখেছেন।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে শুরু থেকেই রাজনৈতিক অঙ্গনে অনেক নাটকীয়তা সবাইকে দেখতে হয়েছে। বিএনপি এবং যুগপৎ আন্দোলনকারী দলগুলো আগে থেকেই এক দফার আন্দোলন করে আসছিল। তারা নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল। সরকার সংবিধানসম্মতভাবেই দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠানের অবস্থানে অনড় ছিল। যুগপৎ আন্দোলনকারীরা সরকারপতনে দেশে গণ-আন্দোলন সৃষ্টি করতে পারেনি। ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি পূরণ করার কোনো বাস্তব অবস্থা তৈরি হয়নি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিএনপির হিসাব-নিকাশ ছিল নানা ধরনের। বিএনপির ধারণা ছিল, বিদেশিদের সমর্থনে সরকারকে ২৮ অক্টোবরের পর ক্ষমতাচ্যুত করতে তারা সক্ষম হবে। বিএনপি ও যুগপৎ আন্দোলনকারী নেতৃবৃন্দ সরকারকে সে ধরনের হুঁশিয়ারিও দিয়ে আসছিলেন। সরকার পতনের ডেডলাইনও দেওয়া ছিল।
কিন্তু এর কোনোটাই বাস্তবে না ঘটার পর হরতাল, অবরোধ ও সহিংস কর্মসূচি দেওয়ার পরও জনসমর্থন খুব একটা আন্দোলনের পক্ষে বাড়ার লক্ষণ দেখা যায়নি। এরই মধ্যে নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণা করে। বিএনপি এবং যুগপৎ আন্দোলনকারীরা নির্বাচন বর্জন এবং হরতাল ও অবরোধের কর্মসূচি চালিয়ে যেতে থাকে। সেই অবস্থায় বিএনপি ও যুগপৎ আন্দোলনকারীদের অনুপস্থিতিতে নির্বাচন যেভাবে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতায় উত্তপ্ত হয়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিল, সেটি না ঘটারই বাস্তবতা তৈরি হলো। নির্বাচনকে গুরুত্বহীন করার জন্যই বিএনপি ও যুগপৎ আন্দোলনকারীরা নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের ধারণা ছিল, এর ফলে আওয়ামী লীগ এবারও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করার পথে হাঁটবে কিংবা হাঁটতে বাধ্য হবে। তেমনটি ঘটলে দেশে-বিদেশে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নির্বাচনব্যবস্থা ধ্বংস করার অভিযোগটি প্রমাণ করা তাদের পক্ষে সহজ হবে।
বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এক পক্ষে আওয়ামী লীগ, বিপরীতে বিএনপি অবতীর্ণ হলেই কেবল নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হতে পারে। এক পক্ষ অংশ না নিলে নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হয় না, তা একটি শিশুও বলে দিতে পারে। বিএনপির হাতে যেসব অপশন ছিল, তার মধ্যে সর্বশেষ অপশন হলো নির্বাচন বর্জন করা। হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নতুবা নির্বাচন বর্জন। বিএনপি শেষটি হাতে রেখেছিল এবং তফসিল ঘোষণার পর সেটিই তারা প্রয়োগ করল। সেই অবস্থায় আওয়ামী লীগ নির্বাচনটিকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করার জন্য দলীয় মনোনীত প্রার্থী ছাড়াও স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার সুযোগ দিয়েছে। এটি আওয়ামী লীগের মতো এত বড় রাজনৈতিক দলের পক্ষে উন্মুক্ত করার বিষয়টি বেশ ঝুঁকিপূর্ণ।
সব জেনেশুনেই আওয়ামী লীগকে নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক করার জন্য দলীয় নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার পথ খোলা রেখে দিতে হলো। এর ফলে নির্বাচন ঝুলে না পড়ে বরং বেশ উত্তপ্ত এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সারা দেশেই অন্তত দুই শতাধিক আসনে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা বেশ জমে উঠেছে। অনেক আসনেই প্রার্থী ও সমর্থকদের মধ্যে সংঘাত-সংঘর্ষ ঘটেছে। আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীদের অনেকেই নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় এবার বেশ হিমশিম খাওয়ার অবস্থায় পড়েছেন। নির্বাচনী ফলাফলে অনেক চমকপ্রদ ঘটনা দেখা যেতে পারে। স্বতন্ত্রদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বিজয়ী হতে পারে।
প্রার্থীদের সবার মধ্যেই এখন টান টান উত্তেজনা এবং নাভিশ্বাস ওঠার মতো হাবভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। অনেক আসনেই নির্বাচন ত্রিমুখী, চতুর্মুখী লড়াইয়ে পরিণত হতে যাচ্ছে। কার গলায় বিজয়ের মালা উঠবে, তা আগে থেকে বলা মুশকিল। তবে অবিশ্বাস্য অনেক কিছুই যে ঘটবে, সে ব্যাপারে পর্যবেক্ষক মহল নিশ্চিত। সেরকম কিছু ঘটলে সরকার গঠন এবং বিরোধী দলের অবস্থান কী হবে, তা বোধ হয় সোমবার থেকে অনেকেরই চিন্তার বিষয়ে পরিণত হতে পারে।
অন্যদিকে নির্বাচন কমিশন এবার জটিল এই পরিস্থিতির মধ্যেও বেশ স্বাধীনভাবে নিজেদের সিদ্ধান্ত নেওয়াসহ নির্বাচন অনুষ্ঠানের যাবতীয় ব্যবস্থা গুছিয়ে এনেছে। আচরণবিধি ভঙ্গ করার দায়ে অনেক প্রার্থীকেই কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে, বেশ কয়েকজন শাস্তিও পেয়েছেন।
৯১-ই অনুচ্ছেদের বিধানে একজনের প্রার্থিতা বাতিল করেছে, আর্থিক জরিমানাও কয়েকজনকে করা হয়েছে। নির্বাচনী মাঠ তীব্র উত্তেজনাপূর্ণ হওয়ায় অনেক প্রার্থী এবং তাঁদের সমর্থকেরা আচরণবিধি লঙ্ঘনে জড়িয়ে পড়েন। ফলে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এবারই সবচেয়ে বেশিসংখ্যক প্রার্থী নির্বাচন কমিশনের দেওয়া শাস্তির আওতায় পড়েছেন। নির্বাচন কমিশন আরও কঠোরতা প্রদর্শন করলে শাস্তির আওতা এবং কঠোরতায় আরও অনেককেই পড়তে হতো, কিন্তু কমিশন মডারেট পন্থা অনুসরণ করেছে। নির্বাচন কমিশন নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু করার জন্য দেশের গোটা প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সামরিক বাহিনীর সদস্যদের এরই মধ্যে মাঠে নামিয়েছে।
কমিশন থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত সবাইকেই নিয়ম ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দ্বিধা না করার অনুরোধ জানানো হয়েছে। একইভাবে অংশগ্রহণকারী সব দল ও নির্দলীয় প্রার্থীদের নির্বাচনী আচরণবিধি যথাযথভাবে পালনের জন্য কমিশন থেকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, বেশির ভাগ আসনেই ভোটার উপস্থিতি সন্তোষজনক হবে। একটি পক্ষ অংশ না নেওয়ায় ভোটার উপস্থিতি নিয়ে যে শঙ্কা তৈরি হয়েছিল, আশা করা যাচ্ছে সেটি অনেকটাই কেটে যাবে। যেসব আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা তেমন তীব্র হবে না বলে বোঝা যাচ্ছে, সেই সব আসনে হয়তো ভোটারের উপস্থিতি তুলনামূলকভাবে কম হতে পারে। রোববার সকালে সবাই দেখতে পাবে ভোটারের উপস্থিতি বাস্তবে কতটা ঘটবে। অন্যদিকে বিএনপিসহ যুগপৎ আন্দোলনকারীরা ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত না হওয়ার জন্য লিফলেট বিতরণ করছে।
তাদের প্রচেষ্টা কতটা সফল হবে তা-ও রোববারেই দেখা যাবে। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যেহেতু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত, রাশিয়া গভীর মনোযোগের সঙ্গে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছে, তাই তাদেরও চোখ রোববারের নির্বাচনের দিকে। নির্বাচনটি শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হলে কারও কিছু বলার থাকবে না। বিশেষত ব্যালট পেপারে কেউ অনিয়ম ঘটাতে চাইলে সেটির বিরুদ্ধে কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করলে বিষয়টি সবারই সমর্থন লাভ করবে। এর ব্যতিক্রম দু-একটি কেন্দ্রে ঘটলেও তা নিয়ে নির্বাচনবিরোধী এবং বিদেশি পর্যবেক্ষকেরাও হইচই কিংবা সমালোচনার সুযোগ পাবেন। সে কারণে সব অংশগ্রহণকারী দল ও প্রার্থীর উচিত হবে শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে তাদের সক্রিয় সমর্থন যেন শতভাগ থাকে, কোনো ধরনের আইন ও নিয়ম ভাঙার চেষ্টা প্রার্থী, সমর্থক ও ভোটারদের কেউ যেন করতে না পারে, সে ব্যাপারে শতভাগ সচেষ্ট থাকা।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে অযথাই অনেক কিছু করা হয়েছে। নদী-সাগরের মতো অথই পানিও যেন ঘোলা করতে কোনো কোনো মহল যারপরনাই চেষ্টা করেছে, এখনো করছে। একটি জাতীয় নির্বাচনকে এভাবে দলীয় কিংবা ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহার করার প্রবণতা রাষ্ট্রের জন্য কতটা লজ্জা এবং ক্ষতিকর, তা অনেকেই যেন বুঝতে চাইছে না। সে কারণেই ৭ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে এত শ্লেষ, অপবাদ ও অর্থহীন করার অপচেষ্টা ধারাবাহিকভাবে করতে দেখা গেছে। গণতন্ত্র যদি সত্যিকার অর্থেই আমাদের রাষ্ট্রে ধারণ করার রাজনীতি ক্রিয়াশীল থাকত, তাহলে প্রতিবারই জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে এমন টানাহেঁচড়া এবং বিবাদ-বিসংবাদ আমাদের দেখতে হতো না। কিন্তু মুখে গণতন্ত্র, বগলের তলে ইট-পাথর রেখে যারা গণতন্ত্রের কথা শোনাতে চায়, তারা আসলেই গণতন্ত্র থেকে বহু দূরে অবস্থান করছে। ৭ তারিখের নির্বাচন যেন সত্যিকার অর্থেই শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয়, সেটিই দেশপ্রেমিক সব মানুষের কাম্য।
লেখক: মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী, অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ ও কলামিস্ট
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা এলাকায় যাত্রীবাহী বাসে ডাকাতি বেড়েই চলছে। এ কারণে চালক ও যাত্রীদের কাছে আতঙ্কের নাম হয়ে উঠছে এই সড়ক। ডাকাতির শিকার বেশি হচ্ছেন প্রবাসফেরত লোকজন। ডাকাতেরা অস্ত্র ঠেকিয়ে লুট করে নিচ্ছে সর্বস্ব। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়েও ঘটছে ডাকাতির ঘটনা।
৫ দিন আগেবিআরটিসির বাস দিয়ে চালু করা বিশেষায়িত বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) লেনে অনুমতি না নিয়েই চলছে বেসরকারি কোম্পানির কিছু বাস। ঢুকে পড়ছে সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। উল্টো পথে চলছে মোটরসাইকেল। অন্যদিকে বিআরটিসির মাত্র ১০টি বাস চলাচল করায় সোয়া চার হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্প থেকে...
১৬ জানুয়ারি ২০২৫গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
২৪ নভেম্বর ২০২৪ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
২০ নভেম্বর ২০২৪