Ajker Patrika

মহাবিপন্ন তমালগাছ

চয়ন বিকাশ ভদ্র
আপডেট : ০৭ জুলাই ২০২২, ১০: ১৬
মহাবিপন্ন তমালগাছ

কোন তমালের কাননতলে মধ্যদিনের তাপে;

বনচ্ছায়ার শিরায় শিরায় তোমার সুর কাঁপে।

—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

রবীন্দ্রনাথের চেয়েও তমালগাছকে জনপ্রিয় করেছে কিংবদন্তির রাধা। কৃষ্ণের বিরহে রাধা তাঁর সখীদের বলেছিলেন, মৃত্যুর পর তাঁর দেহ যেন তমালের ডালে বেঁধে রাখা হয়। সে জন্য বৈষ্ণব কবিতায় তমাল মর্যাদার সঙ্গে আসীন। তমালগাছের বাকলের রং কালো আর কৃষ্ণের গায়ের রংও কালো। তাই তমাল শ্রীরাধারও প্রিয়। রাধার জবানিতে কবি লিখেছেন,

না পুড়াইও রাধার অঙ্গ

না ভাসাইও জলে,

মরিলে বাঁধিয়া রেখো

তমালেরই ডালে…

বাঙালি বিরহ ভালোবাসে। বিরহের এই আতিশয্য আমাদের কাছে জনপ্রিয় করেছে তমাল নামের তরুটিকে। অথচ মাঝারি উচ্চতার এ বৃক্ষটি এখন মহাবিপন্নের তালিকায় ওপরের দিকে রয়েছে।

তমাল বনগাব, মহেশ কাণ্ড ইত্যাদি নামেও পরিচিত আমাদের দেশে। এর ইংরেজি নাম মটলড অ্যাবনি। তমালগাছের বৈজ্ঞানিক নাম ডায়াসপাইরোজ কর্ডিফোলিয়া। এটি অ্যাবেনেসি পরিবারের সদস্য। এর আদি নিবাস মিয়ানমার, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের উষ্ণ অঞ্চল। তমাল সাধারণত দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, চীন, ক্রান্তীয় অস্ট্রেলিয়া ইত্যাদি অঞ্চলে জন্মে। ঢাকার রমনা পার্ক ও বোটানিক্যাল গার্ডেনে কয়েকটি অপরিণত তমালগাছ আছে। বেনাপোল পাঠবাড়ী আশ্রম, ঠাকুরগাঁও গোবিন্দজীউ মন্দির, দিনাজপুর রাজবাড়ী ও কান্তজীউ মন্দির প্রাঙ্গণে এ গাছ রয়েছে। মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত যাওয়ার আগে পথের বাঁ দিকে মহাদেব মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটি তমালগাছ। এ ছাড়া বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেনে, ময়মনসিংহে ব্রহ্মপুত্র তীরের জয়নুল উদ্যানের প্রবেশপথের পূর্ব দিকে এবং কাচিঝুলিতে বন বিভাগের বিভাগীয় কার্যালয়ের উল্টো দিকে তমালগাছ রয়েছে। বাংলাদেশের ২০১২ সালের বন্য প্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইনের তফসিল-৪ অনুযায়ী এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত।

তমালের কাণ্ড খাটো, ঘন কালো গিঁটযুক্ত। এর শাখা-প্রশাখা ছড়ানো এবং ছাতা আকৃতির। এটি চিরসবুজ ও পত্রঘন উদ্ভিদ। তমাল খুব ধীরে ধীরে বড় হয়। ফলে অনেক দিন লাগে বড় হতে। এর পাতা একান্তর, ৩ দশমিক ৮ থেকে ১৪ সেন্টিমিটার লম্বা, ডিম্বাকার বা উপবৃত্তকার এবং পাতার গোড়ার দিক গোলাকার। ফুল আকারে বেশ ছোট ও সাদা রঙের। এদের পুরুষ ও স্ত্রী গাছ আলাদা আলাদা। তমালের পুরুষ ফুল ১ সেন্টিমিটার লম্বা, স্ত্রী ফুল ১ দশমিক ৩ সেন্টিমিটার লম্বা ও একক। ফল গোলাকার এবং ২ দশমিক ৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। এ ছাড়া ফল পাকলে লালচে বাদামি রঙের ও গাবের মতো বৃতিযুক্ত। তমালের বিষাক্ত ফল পাকে গ্রীষ্মকালে। এর কাঠ লালচে হলুদ ও শক্ত। তমালের বীজে পাওয়া যায় বিটুলিনিক অ্যাসিড ও ১ দশমিক ৫ শতাংশ তেল। এই তেলে আছে পামিটিক অ্যাসিড, স্টিয়ারিক ও লিনোলিক অ্যাসিড। এ ছাড়া আছে লুপিয়ল, বেটা সিটুস্টেরল, স্টিগমাস্টেরল।

তমালের পাতা চূর্ণ মাছের জন্য বিষ। ভেষজ চিকিৎসায় এর বিভিন্ন ব্যবহার আছে। জ্বর, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, প্রস্রাবে সমস্যা, নিউরালজিয়া, প্লুরিসি, মিনোরেজিয়া, প্রসব-পরবর্তী জ্বর, বিষাক্ত মাকড়সার কামড় ইত্যাদিতে তমালগাছের বিভিন্ন অংশ ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া এর ছালের নির্যাসে প্রদাহরোধী গুণ আছে। এর অ্যালকোহলিক নির্যাসে ইঁদুরের ক্যানসার নিরাময়ের গুণ আছে বলে পরীক্ষায় প্রমাণ পাওয়া গেছে।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ, মুমিনুন্নিসা সরকারি মহিলা কলেজ, ময়মনসিংহ

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত