Ajker Patrika

কিসের খোঁজে হাজার মাইল পাড়ি দেয় মোনার্ক প্রজাপতিরা

ইশতিয়াক হাসান
আপডেট : ০৫ এপ্রিল ২০২৩, ১২: ৩১
কিসের খোঁজে হাজার মাইল পাড়ি দেয় মোনার্ক প্রজাপতিরা

পরিযায়ী পাখিরা শীতে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে সাইবেরিয়াসহ বিভিন্ন শীতল এলাকা থেকে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন উষ্ণ এলাকায় হাজির হয়। যদি বলি, এরকমই অভ্যাস আছে একধরনের প্রজাপতিরও, তাহলে নিশ্চয় অবাক হবেন। কিন্তু ঠিক এ কাজটাই করে মোনার্ক প্রজাপতিরা। 

হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে শীতে মেক্সিকো পৌঁছায় মোনার্ক প্রজাপতিউত্তর আমেরিকায় যত জাতের প্রজাপতি আছে, এদের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত সম্ভবত মোনার্ক বাটারফ্লাই বা মোনার্ক প্রজাপতিরা। উজ্জ্বল কমলা-লাল ডানা, সেই সঙ্গে শরীরে সাদা-কালো রঙের খেলা একে সহজেই চিনিয়ে দেবে। এ ধরনের প্রজাপতি বিখ্যাত কানাডা থেকে মেক্সিকোর দিকে তাদের যাত্রা ও গ্রীষ্মে কানাডার দিকে ফিরে আসার জন্য।

প্রতিবছর শীতের আভাস পাওয়া শুরু হতেই (কানাডায় এ সময় ফল বা শরৎ) লাখে লাখে এ ধরনের প্রজাপতি কানাডা থেকে তাদের শীতের আশ্রয় মেক্সিকো, কখনো কখনো আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার দিকে রওনা হয়। তাদের চলার পথটাকে রাঙিয়ে দেয় উজ্জ্বল ডানার রঙে। বিশাল কলোনি নিয়ে থাকে এসব প্রজাপতি। কোথাও ঘাঁটি গাড়ার পর সাধারণত পাইন বা দেবদারু গাছে ঝাঁক বেঁধে থাকে এরা। অনেক সময় এতটাই ঘনভাবে অবস্থান করে যে গোটা গাছটিকেই কমলা মনে হবে আপনার। গাছের ডালগুলো নুয়ে পড়ে এদের ওজনে। আর এ দৃশ্য দেখতে ছুটে আসেন বহু পর্যটক। 

তবে যাওয়া-আসার গোটা ভ্রমণটা সম্পন্ন করার সুযোগ হয় না কোনো প্রজাপতিরই। কারণ মোনার্ক প্রজাপতিদের আয়ু এর থেকে অনেকই কম। বলা চলে, এদের তিন-চারটি প্রজন্ম এই আসা-যাওয়ায় অংশ নেয়। এই প্রজাপতিরাই সেই অল্প কিছুসংখ্যক কীট-পতঙ্গের একটি, যারা আটলান্টিক পাড়ি দেয়।

মোনার্কদের যাত্রা শুরু হয় প্রতিবছরের অক্টোবরেমোনার্কদের এই অভিবাসন শুরু হয় প্রতিবছরের অক্টোবরে। তবে আবহাওয়া শীতল হতে থাকলে কখনো কখনো যাত্রাটা আরও আগেই শুরু করে দেয়। কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের কিছু এলাকা থেকে শুরু করে মধ্য মেক্সিকোর অরণ্য পর্যন্ত, যেখানে আবহাওয়া উষ্ণ, ১ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার ৮০০ মাইল ভ্রমণ করে মোনার্ক প্রজাপতিরা। 

একসঙ্গে এত্তো প্রজাপতিযেসব প্রজাপতি রকি পর্বতমালার উত্তরের এলাকাগুলোতে বাস করে, তারা মেক্সিকোতে যায় আর দেদবারু গাছে শীতনিদ্রা বা বিশ্রাম করে। অন্যদিকে মোনার্কদের বসবাস যদি রকি পর্বতমালার পশ্চিমে হয়, এগুলো ক্যালিফোর্নিয়া ও আশপাশের এলাকায় অভিবাসন করে। সেখানকার ইউক্যালিপটাস গাছে আশ্রয় নেয় তারা। মোনার্ক প্রজাপতিরা প্রতি বছর অভিবাসনের সময় সাধারণত আগেরবার যে গাছগুলোতে আশ্রয় নিয়েছিল, সেগুলোতেই আবার ফিরে আসে। এক হিসাবে এটি ভারি অদ্ভুত এক কাণ্ড, কারণ আগের বছরের প্রজাপতিগুলো আর পরের বছরেরগুলো এক নয়।

কয়েকটি প্রজন্মের পর আবার একই জায়গায় কীভাবে ওই প্রজাপতিরা ফিরে আসে, তা নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে। কোনো কোনো গবেষকের ধারণা, এভাবে একই জায়গা ধরে উড়ে একই জায়গায় পৌঁছানোর ব্যাপারটা উত্তরাধিকার সূত্রে হয় বা বংশানুক্রমিক। অন্য গবেষকদের দাবি, ভ্রমণের সময় পাখিরা আকাশে সূর্যের অবস্থান ও পৃথিবীর ম্যাগনেটিক ফিল্ডকে কাজে লাগায়। 

নীল আকাশের পটভূমিতে মোনার্ক প্রজাপতিমজার ঘটনা, কানাডার যেসব জায়গায় মোনার্ক প্রজাপতিদের বাস, একটা সময় সেখানকার মানুষদের রীতিমতো কঠিন এক ধাঁধার মধ্যে ফেলে রেখেছিল এরা। তাঁরা অবাক হয়ে ভাবতেন, এই যে এত এত প্রজাপতি দেখা যায় গ্রীষ্মে, শীতে এগুলো যায় কোথায়। তারপরই ১৯৩৭ সালে কানাডার প্রাণিবিদ এফ এ আরকুহার্ট মোনার্কের ডানায় ট্যাগ লাগিয়ে এরা কোথায় যায় তার অনুসন্ধান শুরু করেন। ৩৮ বছর পর, কয়েক হাজার স্বেচ্ছাসেবীর সহায়তায় প্রথম এদের কোনো শীতকালীন আস্তানার খোঁজ পান। সেটি মোনার্কদের যাত্রা শুরুর জায়গা থেকে পায় ৪ হাজার কিলোমিটার দূরে মেক্সিকোর মিচোয়াকান।  এটি এখন ইউনেসকো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট এবং মোনার্ক প্রজাপতি সংরক্ষণ এলাকা। মেক্সিকোতে মোনার্ক প্রজাপতিদের শীতকালীন আশ্রয়স্থল হিসেবে পরিচিত এমন ডজনখানেক এলাকা আছে, এগুলো সরকারিভাবে সংরক্ষণ করা হয়।   

কমলা রঙের মোনার্কদের দেখলেই যেন মন ভালো হয়ে যায়তবে মোনার্ক প্রজাপতিদের এই অসাধারণ অভিবাসন বড় ঝুঁকিতে পড়েছে। মেক্সিকোতে তাদের শীতকালীন আবাস ও আমেরিকা-কানাডার গ্রীষ্মকালীন আবাসে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে প্রজাপতিদের ভ্রমণেও। মেক্সিকোতে বন-জঙ্গল উজাড়, তৃণভূমিকে খামারে রূপান্তর, কীটনাশকের ব্যবহার, যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণে মিল্কউইড নামে যে বৃক্ষে মোনার্করা ডিম পাড়ে, তার সংখ্যা কমে যাওয়া—এই সবকিছু বিস্ময়কর এসব প্রজাপতিকে অনেকটা কোণঠাসা করে ফেলেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৯৫-৯৬ সালে মেক্সিকোতে মোনার্কদের এলাকা হিসেবে পরিচিত জায়গাগুলোর প্রায় ৪৫ একর বনভূমি ঢেকে থাকত মোনার্ক প্রজাপতিতে। ২০০৩-০৪ সালে এটি নেমে আসে ২৭.৫ একরে, ২০২০ সালে আবার দেখা যায় এটি নেমে এসেছে ৫ একরে, যা আগের বছরের চেয়ে ২৬ শতাংশ কম।

কাজেই প্রকৃতির এই বিস্ময় মোনার্ক প্রজাপতিদের বাঁচিয়ে রাখতে আর তাদের আশ্চর্য যাত্রা অব্যাহত রাখতে সচেতন হতে হবে আমাদের মানুষদের। না হলে একসময় হয়তো শুধু আফসোসই করতে হবে। 

সূত্র: অ্যামিউজিং প্ল্যানেট, ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফ ডট অরগ

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত