Ajker Patrika

‘হায় রে কালীগঙ্গা! নদীই এখন আমাদের ফসলের মাঠ’

আব্দুর রাজ্জাক, ঘিওর (মানিকগঞ্জ)
আপডেট : ০৫ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৪: ৩৮
‘হায় রে কালীগঙ্গা! নদীই এখন আমাদের ফসলের মাঠ’

‘এইখানে নদী ছিল। স্রোতও ছিল খুব। বড় বড় স্টিমার চলত। বর্ষা এলেই দুকূল ভাঙত। এখন নদী শুকিয়ে গেছে। জেগে উঠেছে চর, দুপাড় ভরে গেছে পলিতে। নদীর ঠিক মাঝে ধানের চারা রোপণ করেছি। পাড়ে ৩০ শতাংশ জায়গায় বুনেছি মাষকলাই আর গোল আলু। হায় রে কালীগঙ্গা! এই নদীই এখন আমাদের ফসলের মাঠ।’ আক্ষেপ করে বলছিলেন মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার আশাপুর গ্রামের কৃষক বদর উদ্দিন (৬৫)। 

ঘিওরের কালীগঙ্গার অনেক অংশেই এখন ধু ধু বালুচর। কোথাও চাষাবাদ করেছেন কৃষকেরা, কোথাও আবার গরু চরানো কিংবা শিশু-কিশোরদের খেলার দৃশ্য চোখে পড়ে। নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়া, দীর্ঘমেয়াদি ও পরিকল্পিত খনন না করা, অবৈধ-অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলন, দূষণ ও দখলে কালীগঙ্গার অস্তিত্ব আজ হুমকির মুখে বলে মনে করেন এলাকাবাসী ও নদী নিয়ে কাজ করা মানুষ। 

পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, দৌলতপুরের যমুনা থেকে কালীগঙ্গা নদী উৎপন্ন হয়ে জাবরা হাটের কোল ঘেঁষে সিঙ্গাইরের ধল্লা পর্যন্ত এর বিস্তৃতি। ৭৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য কালীগঙ্গার। জেলার বুক চিরে বয়ে গেছে পদ্মা, যমুনা, ইছামতী, কালীগঙ্গা, কান্তাবতী, মনলোকহানী, গাজীখালী, ক্ষীরাই, মন্দা, ভুবনেশ্বর ও ধলেশ্বরী নদ-নদী। ১ হাজার ৩৭৯ বর্গকিলোমিটার আয়তনের মানিকগঞ্জে নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ২৪১ কিলোমিটার। এই নদীগুলোতে বছরজুড়েই পানির প্রবাহ ছিল ভালো। 

একসময়ের প্রমত্তা কালীগঙ্গার প্রলয়ংকরী রূপ ছিল ভয়াবহ। এই নদীতে চলত স্টিমার, ফেরি। দুকূল ছাপিয়ে ভাঙত বসতি ও ফসলি জমি। এখন হেমন্তেই যেন মরা খালে পরিণত হয়েছে কালীগঙ্গা। কয়েক স্থানে একটা সরু ধারা প্রবাহিত হচ্ছে। অনায়াসেই ডিঙিয়ে চলাচল করে গরু-ঘোড়ার গাড়ি। 

কালীগঙ্গাপারের সিংজুরী গ্রামের বাসিন্দা হাবিবুর রহমান বলেন, দুই দশক আগেও বছরজুড়ে পানি থাকত নদীতে। নদীর বেশির ভাগ অংশই শুকিয়ে গেছে। নৌকার পরিবর্তে চলাচল করে ঘোড়ার গাড়িসহ বিভিন্ন যানবাহন। 

পানির উৎস বাঁচিয়ে রাখার দাবিতে সম্প্রতি মানিকগঞ্জ নদী বাঁচাও আন্দোলন কমিটি জেলা প্রশাসক ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছে। জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত নদী ও খালের নাব্য রক্ষায় নিয়মিত খনন কার্যক্রমের দাবি জানিয়ে আসছে তারা। 

এই নদীকে কেন্দ্র করে জেলার কয়েক শ জেলে পরিবারের রুজি-রোজগার হতো। নদীতে পানি না থাকায় জেলেরা বদল করছেন পেশা। 

শুকিয়ে যাওয়া কালীগঙ্গার কোনো কোনো অংশে চাষাবাদ করেছেন কৃষকেরাজাবরা গ্রামের পরীক্ষিত হালদার বলেন, ‘নদীতে পানি শুকিয়ে গেছে। পানি না থাকায় মাছও নেই। বাধ্য হয়ে পূর্বপুরুষদের পেশা বাদ দিয়ে স্বর্ণের দোকানে কাজ করছি।’ 

ঘিওর উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, কালীগঙ্গা নদী পানিশূন্য হয়ে পড়ায় মাছের উৎপাদন কমেছে ৪৫ ভাগ, হুমকির মুখে জেলেদের জীবন-জীবিকা। পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। 

কালীগঙ্গা নদীপারের তরা গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি আবুল কাশেম বলেন, এই নদীতে নিয়মিতভাবে স্টিমার, বড় বড় লঞ্চ ও বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচল করতে দেখেছি। ঘিওর হাট, জাবরা হাট, তরা হাট, বেউথা বন্দর ছিল নদীকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য প্রসিদ্ধ এলাকা। 

জেলা কৃষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম বলেন, এই অঞ্চলের অধিকাংশ চাষি আগে নদী থেকে পানি তুলে জমিতে সেচ দিতেন। নদীগুলো মরে যাওয়ায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। এতে মারাত্মক সেচসংকটে পড়েছেন কৃষকেরা। ফলে কৃষি মৌসুমে উৎপাদন হুমকিতে পড়ছে। 

পরিবেশ ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক দীপক কুমার ঘোষ বলেন, নদীমাতৃক বাংলাদেশে মানিকগঞ্জে নদীর প্রভাব ছিল বিস্তর। নদীকে ঘিরেই গড়ে উঠেছিল এই অঞ্চলের কৃষি, অর্থনীতি, কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও সভ্যতা। কিন্তু সেই ঐতিহ্য ক্রমশই সংকুচিত হয়ে আসছে। আজ পানির দেশে পানির জন্যই হাহাকার। সমন্বিত নদী ব্যবস্থাপনায় সরকারের আরও মনোযোগ ও কার্যকর পদক্ষেপ জরুরি। 

নদী রক্ষা আন্দোলন কমিটি, মানিকগঞ্জ শাখার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম বিশ্বাস বলেন, নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়া, পরিকল্পিত খনন না হওয়া, অবৈধভাবে বালু উত্তোলন, দূষণ, দখলসহ বিভিন্ন কারণে কালীগঙ্গার আজ এই হাল। 

মানিকগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, মানিকগঞ্জে প্রবহমান নদীগুলো, বিশেষ করে কালীগঙ্গা ও ধলেশ্বরীর অবস্থা খুবই করুণ। বেশির ভাগ নদীতেই পানির অভাব। এতে তাপমাত্রা বৃদ্ধি, কৃষি, মৎস্য, জীববৈচিত্র্যসহ সর্বত্র বিরূপ প্রভাব পড়ছে। মারাত্মক পরিবেশগত বিপর্যয় ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। 

মানিকগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাঈন উদ্দিন বলেন, নদী খনন ও পুনঃখনন প্রকল্পের আওতায় নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্পের কাজ করা হয়েছে। কিছু কাজ চলমান রয়েছে। আরও খননের জন্য জলবায়ু ট্রাস্ট এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বরাবর কয়েকটি প্রকল্প দাখিল করা হয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত