Ajker Patrika

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় দক্ষিণবঙ্গের স্বপ্নের বিদ্যাপীঠ

পার্থিব পার্থ
আপডেট : ২৬ মে ২০২২, ১১: ৪১
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় দক্ষিণবঙ্গের স্বপ্নের বিদ্যাপীঠ

অনিন্দ্যসুন্দর কীর্তনখোলা নদীর তীর ঘেঁষে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমিতে স্থাপিত হয়েছে দক্ষিণবঙ্গের স্বপ্নের বিদ্যাপীঠ বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়। দেশের অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় নবীন হলেও শত প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে আলো ছড়াচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলের সেরা এই বিদ্যাপীঠ। লিখেছেন পার্থিব পার্থ

প্রাচ্যের ভেনিসখ্যাত বরিশাল নগরীর পাশ দিয়ে বয়ে চলা কীর্তনখোলা নদীর অপরূপ স্নিগ্ধতার রেশ না কাটতেই দেখা মেলে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের। বিশ্ববিদ্যালয়ের নান্দনিক সৌন্দর্য মুহূর্তেই মায়ার বাঁধনে বেঁধে ফেলে। ঋতুভেদে প্রকৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে নবরূপে সজ্জিত হয় ক্যাম্পাস। শরতে শুভ্র কাশফুলে ছেয়ে যায়, বসন্তে পলাশ ফুলে রঙিন হয়ে ওঠে, শীতে কুয়াশায় চাদর মুড়ি দেয় পুরো ক্যাম্পাস। শিক্ষার্থীদের আড্ডা-গানে মুখরিত হয়ে ওঠে মুক্তমঞ্চ, সবুজ প্রাঙ্গণ, করিডর। সম্প্রতি এক যুগে পা রেখেছে দক্ষিণবঙ্গের সেরা এ বিদ্যাপীঠ। 

ইতিহাসের খেরোখাতা
দক্ষিণবঙ্গের মানুষ একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্ন দেখছিল অনেক দিন ধরেই। সেই স্বপ্ন দেখার শুরু ১৯৭৩ সালে। সে বছর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বরিশালের বেলস পার্কে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু উদ্যান) এক জনসভায় এ অঞ্চলে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ঘোষণা দেন। পরে তা আর বাস্তবায়ন হয়নি। ২০০৯ সালে জাতীয় সংসদে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস হয়। ২০১১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরিশালের কর্ণকাঠিতে ৫০ একর জমিতে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এর মধ্য দিয়ে শুরু হয় বরিশালবাসীর দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্নের বাস্তবায়ন। ২০১২ সালের ২৪ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে শিক্ষার্থী ভর্তির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রমের শুভ সূচনা হয়।

স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে
প্রাথমিক পর্যায়ে ৪টি অনুষদে ৪০০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ২৪টি বিভাগে প্রায় ৯ হাজার শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছেন। শিক্ষার্থীদের জন্য আছে বঙ্গবন্ধু হল, শেরেবাংলা হল, শেখ হাসিনা হল ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল। শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের যাতায়াতের জন্য রয়েছে বাস, মিনিবাস ও মাইক্রোবাসের সুবিধা। শিক্ষার্থীদের চিত্তবিনোদন ও খেলাধুলার জন্য আছে খেলার মাঠ ও মুক্তমঞ্চ। নির্মিত হয়েছে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, ছয় দফা বেদি, কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি ও ক্যাফেটারিয়া। স্থাপন করা হয়েছে অত্যাধুনিক ভিডিও কনফারেন্স রুম, শীতাতপনিয়ন্ত্রিত অডিটোরিয়াম, কীর্তনখোলা হল ও শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র। ক্যাম্পাসের সৌন্দর্যবর্ধনে লাগানো হয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির ফলদ ও বনজ বৃক্ষ।  

পিছিয়ে নেই সহশিক্ষা কার্যক্রমে
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে নানা সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের সংগঠন বাঁধন, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ডিবেটিং সোসাইটি, উচ্ছ্বাস, ইচ্ছে ফেরি, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় আইটি সোসাইটি, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় কুইজ সোসাইটি, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যারিয়ার ক্লাব, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় বিজ্ঞান ক্লাব, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ফটোগ্রাফিক সোসাইটি, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় নাট্যদল, কীর্তনখোলা ফিল্ম সোসাইটি। ছাত্র-শিক্ষকদের অংশগ্রহণে বছরজুড়েই চলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, বিভিন্ন অলিম্পিয়াড, বইমেলা, পিঠা উৎসবসহ নানা আয়োজন। যথাযথভাবে পালন করা হয় সব জাতীয়, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক দিবস ও উৎসব। আন্তবিশ্ববিদ্যালয় খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে বিজয়ী হওয়ার গৌরব অর্জন করেন অনেক শিক্ষার্থী। 
তারুণ্যের আবাহন
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে একঝাঁক তরুণ ও মেধাবী শিক্ষকমণ্ডলী। তাঁদের পাঠদান ও গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়কে সমৃদ্ধ করছে। ১৯০ জন শিক্ষক, ১০৫ জন কর্মকর্তা এবং ১৫৬ জন কর্মচারীর সমন্বয়ে পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়টি দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির কারখানা হিসেবে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে স্বমহিমায়। বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের প্রতিটি সদস্যের আন্তরিকতা ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় একাডেমিক, গবেষণা, সহশিক্ষা কার্যক্রমে এগিয়ে যাচ্ছে এ বিদ্যাপীঠ। প্রতিবছরই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জার্নালে গবেষণা অভিসন্দর্ভ প্রকাশ করে আসছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।

শিক্ষার্থীদের গৌরবগাথা
উদ্ভাবন, আবিষ্কার ও সৃজনশীলতার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গৌরবময় স্বাক্ষর রাখতে শুরু করেছেন। সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত স্পাইক এশিয়া ফেস্টিভ্যাল অব ক্রিয়েটিভিটিতে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী গোলাম রব্বানী। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিএসই বিভাগের শিক্ষার্থীরা কৃষিকাজে ব্যবহার উপযোগী ড্রোন উদ্ভাবন করেছেন। অন্ধদের জন্য টকিং গ্লাস আবিষ্কার করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীরা নিজেদের ব্যবহারের জন্য তৈরি করেছেন অ্যাপস, চালু করেছেন অনলাইন রেডিও। উচ্চশিক্ষার জন্য উন্নত দেশগুলো থেকে স্কলারশিপ অর্জন করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। 

সমস্যাও আছে
অগ্রগতির পরও নানাবিধ সমস্যা রয়ে গেছে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রায় ৯ হাজার শিক্ষার্থীর এ বিদ্যাপীঠে আবাসন-সুবিধা আছে হাজারখানেক শিক্ষার্থীর। আছে ক্লাসরুম, শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অফিস কক্ষের সংকট। নেই পর্যাপ্ত গবেষণাগার। লাইব্রেরিতে প্রয়োজনীয় বইয়ের সংকট রয়েছে। এখনো পুরোপুরি পরিবহন-সুবিধা নিশ্চিত করা যায়নি। ২৪টি বিভাগে পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই। কর্মরত অধ্যাপক আছেন মাত্র একজন। নেই সহ-উপাচার্য, স্থায়ী রেজিস্ট্রার, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক। এসব সমস্যা সমাধানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কাজ করছে। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন ট্রেজারার নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে, এটি ইতিবাচক উদ্যোগ। 

স্বপ্ন যাবে বহুদূর
যুগোপযোগী শিক্ষাকার্যক্রম অদূর ভবিষ্যতে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়কে দেশের উচ্চশিক্ষার নেতৃত্বের আসনে প্রতিষ্ঠা করবে। এককথায় স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে এগিয়ে চলছে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়।

প্রফেসর ড. মো. ছাদেকুল আরেফিন অধ্যাপক, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়।শিক্ষার গুণগত মান, পরিবেশ উন্নয়ন ও গবেষণার পরিধি সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি সমন্বিত কর্মকৌশল প্রয়োজন। আশা করি অচিরেই বিশ্ববিদ্যালয়টি শিক্ষা ও গবেষণার বিস্তার, মুক্তচিন্তার উন্মেষ ও বিকাশ, প্রযুক্তিনির্ভরতা এবং সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে নতুন দিগন্ত উন্মোচনকারী উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে।

গবেষণা ও সহশিক্ষা কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার মাধ্যমে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় দেশের ৫৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে তার স্বতন্ত্র অবস্থান বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। একঝাঁক তরুণ-মেধাবী শিক্ষকমণ্ডলী, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীর নিরলস পরিশ্রমে এগিয়ে চলেছে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে অচিরেই বিশ্ববিদ্যালয়টি শিক্ষা ও গবেষণার বিস্তার, মুক্তচিন্তার বিকাশ এবং সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে একটি কার্যকর উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়কে শিক্ষা, গবেষণা ও সহশিক্ষা কার্যক্রমের সমন্বয়ে বিশ্বমানের বিদ্যাপীঠে পরিণত করা আমার লক্ষ্য। অপেক্ষাকৃত নবীন এ বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নিতে সবার সহযোগিতা ও সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা দরকার। বর্তমান সরকার মানসম্মত গবেষণাধর্মী উচ্চশিক্ষার বিষয়ে যথেষ্ট আন্তরিক। আমি বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়কে অভীষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে নিতে সবার সহযোগিতা কামনা করছি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

তোমাদের যে কিছু করিনি, তা-ই ভাগ্য—ডাকাতির সময় দুই কিশোরীকে সাবেক সেনা কর্মকর্তা

গাজীপুরে সাংবাদিককে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা

সাধুর বেশে এসে সাবেক স্ত্রীকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে হত্যা

স্টার্টআপ থেকে স্মার্ট সিটি: যেভাবে দক্ষিণ কোরিয়ার বিনিয়োগ টানছে বাংলাদেশ

বরিশাল-১: স্বপন-কুদ্দুসের দ্বন্দ্বে নির্বাচনের আগে দলে অস্থিরতা

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত