অনলাইন ডেস্ক
প্রতিবেশী বড় দেশগুলোর তুলনায় আকারে ছোট হলেও, বাংলাদেশ এখন ধীরে ধীরে নিজেকে কৌশলগত অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে গড়ে তুলছে। মূলত বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (এফডিআই) আকর্ষণের মাধ্যমেই দেশটি নিজেদের অবস্থান মজবুত করছে।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার চীন। দেশটিই বাংলাদেশে বিনিয়োগে শীর্ষস্থান দখল করে আছে। চীন সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছে, বাংলাদেশে তারা দুটি নতুন বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি করবে। এসব অঞ্চলে চীনা বিনিয়োগকারীরা মূলত টেক্সটাইল, সিরামিকস ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক পণ্য উৎপাদনে কাজ করবেন।
তবে শুধু চীন নয়, দক্ষিণ কোরিয়ার ক্রমবর্ধমান উপস্থিতিও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এখন বড় ভূমিকা রাখছে। এটি শুধু অর্থনৈতিক সহযোগিতা নয়, বরং দুই দেশের কৌশলগত লক্ষ্য—বিশেষ করে বাংলাদেশের ডিজিটাল রূপান্তরের আকাঙ্ক্ষা এবং দুই দেশেরই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির আগ্রহ—এই সবকিছুরই মিলনস্থল।
বর্তমানে বাংলাদেশে দক্ষিণ কোরিয়ার বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ১ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশে তৃতীয় সর্বোচ্চ এফডিআই উৎস হিসেবে কোরিয়ার অবস্থানকে নিশ্চিত করেছে। ২০২৩ সালের পর থেকে দেশটি প্রতি বছর এই অবস্থানে উন্নতি করছে। ক্রমবর্ধমান এই ধারা স্পষ্ট করে যে, বাংলাদেশ দিন দিন দক্ষিণ কোরিয়ার বিনিয়োগকারীদের জন্য আরও বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে।
২০২৪ সালে বাংলাদেশে ব্যাপক বিক্ষোভ ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন দীর্ঘদিনের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন। এই রাজনৈতিক পরিবর্তন প্রথম দিকে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে সংশয় সৃষ্টি করলেও, ইউনূসের সরকারের সংস্কারের প্রতিশ্রুতি ফের নতুন করে আস্থা ফিরিয়ে আনে।
এর অন্যতম প্রমাণ, ২০২৫ সালে আয়োজিত বাংলাদেশের ইনভেস্টমেন্ট সামিট, যেখানে প্রায় ২ হাজার ৫০০ জন অংশগ্রহণকারী উপস্থিত ছিলেন—যার বেশির ভাগই ছিলেন বিদেশি বিনিয়োগকারী। যদি বাংলাদেশ এই সংস্কারপন্থী পথ ধরে এগিয়ে যেতে পারে, তাহলে দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশের কাছে এটি আরও বেশি মূল্যবান বিনিয়োগ গন্তব্য হয়ে উঠবে। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান, তরুণ জনসংখ্যা এবং ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সম্ভাবনা—এই সবই বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য যথেষ্ট।
দক্ষিণ কোরিয়ার বিনিয়োগকারীরা এখন শুধু তৈরি পোশাক বা নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে সীমাবদ্ধ থাকছেন না। এখন তারা আগ্রহী আধুনিক খাতেও—যেমন সেমিকন্ডাক্টর, ডিজিটাল ইলেকট্রনিকস ইত্যাদি। এটি কোরিয়ার কোম্পানিগুলোর একটি কৌশলগত পদক্ষেপ, যা বাংলাদেশের শিল্প খাতের পরিবর্তনশীল চাহিদা এবং ভোক্তা বাজারের বিকাশের সঙ্গে মিল রেখে চলছে।
২০২৫ সালের এপ্রিলে দক্ষিণ কোরিয়ার বিনিয়োগকারী একটি প্রতিনিধি দল—যার মধ্যে এলজি’র কর্মকর্তারাও ছিলেন—চট্টগ্রামের কোরিয়ার এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন (কেইপিজেড) পরিদর্শন করেন। এই কেইপিজেড একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক অঞ্চল যেখানে টেক্সটাইল এবং গ্রিন এনার্জি (সবুজ জ্বালানি) উৎপাদনের কারখানা রয়েছে। এই অঞ্চলে কোরিয়ার পোশাক নির্মাতা কোম্পানি ইয়াংওয়ান গ্রুপ নতুন করে বিনিয়োগ করে টেক্সটাইল ও সৌরশক্তিভিত্তিক প্রকল্প শুরু করেছে।
এর এক মাস আগেই, ২০২৫ সালের মার্চে কোরিয়ার বিখ্যাত অটোমোবাইল নির্মাতা হুন্দাই, বাংলাদেশের ডিএক্স গ্রুপের সঙ্গে এক অংশীদারত্ব ঘোষণা করে বাংলাদেশের ইলেকট্রনিকস ও হোম অ্যাপ্লায়েন্সের বাজারে প্রবেশ করে। এই যৌথ উদ্যোগ স্মার্ট টিভি, রেফ্রিজারেটর ও অন্যান্য উপকরণ উৎপাদন করবে।
দক্ষিণ কোরিয়ার কোম্পানি স্যামসাং এরই মধ্যে বাংলাদেশের ফেয়ার গ্রুপের সঙ্গে যৌথভাবে মোবাইল ফোন, টেলিভিশন ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এয়ার কন্ডিশনার) উৎপাদন করছে। এসব কর্মকাণ্ড স্পষ্ট করে যে, দক্ষিণ কোরিয়া এখন বাংলাদেশে উৎপাদন, প্রযুক্তি এবং নতুন শিল্প খাতে দীর্ঘমেয়াদি উপস্থিতি গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করছে।
দুই দেশের সরকারই বাংলাদেশে উদীয়মান স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমকে সহায়তা করে যাচ্ছে। ২০২৩ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাস একটি ভার্চুয়াল ডেস্ক চালু করে, যার মাধ্যমে আইটিভিত্তিক বিদেশি বিনিয়োগ বাংলাদেশে টানা সম্ভব হচ্ছে।
বাংলাদেশের আইসিটি ডিভিশন এবং কোরিয়া প্রোডাকটিভিটি সেন্টার একত্রে একটি মেন্টরশিপ প্রোগ্রাম চালু করেছে, যার লক্ষ্য হচ্ছে নতুন উদ্যোক্তাদের সহায়তা প্রদান। সরকারি পর্যায়ে আরও অনেক উদ্যোগ—যেমন স্বাস্থ্যসেবা খাতে সহযোগিতা, এবং দুই দেশের মধ্যে মান নির্ধারণে সমন্বিত নীতি তৈরি—প্রমাণ করে যে, দুই দেশ দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
এই নীতিগুলোর বাস্তব সুফলও মিলছে। যেমন, কোরিয়ার উদ্যোক্তাদের গঠিত ফুড-টেক স্টার্টআপ, এমএফএম কোরিয়া বাংলাদেশি নারীদের জন্য কাজের সুযোগ তৈরি করছে। এই উদ্যোগ পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপকরণ দিয়ে খাদ্যপণ্য তৈরি করে। একইভাবে, বাংলাদেশের তরুণ উদ্যোক্তাদের তৈরি ‘চারদিকে’ নামের একটি ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম কোরিয়ার পণ্যের বাজার গড়ে তুলেছে।
শুধু স্টার্টআপ নয়, প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলোও কৌশলগত অংশীদারত্বের দিকে এগোচ্ছে। যেমন, ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে গ্লোবাল ব্র্যান্ড পিএলসি (একটি বাংলাদেশি আইটি পণ্য বিপণনকারী কোম্পানি) এবং কোরিয়ার ফিনটেক কোম্পানি হায়োসাং টিএনএস একযোগে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত আধুনিকীকরণের উদ্যোগ ঘোষণা করে। এর আগেই দক্ষিণ কোরিয়ার বৃহৎ আর্থিক প্রতিষ্ঠান উরি ব্যাংক, বাংলাদেশের বিকাশ এবং ব্যাংককম্পেয়ারবিডির সঙ্গে পার্টনারশিপে যুক্ত হয়।
বাংলাদেশ শুধু উৎপাদনভিত্তিক অর্থনীতিতে আটকে থাকতে চায় না। ডিজিটাল অর্থনীতি গঠনের লক্ষ্য এখন ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। এই রূপান্তর দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলোর জন্য বিশাল সুযোগ তৈরি করছে, বিশেষ করে ডিজিটাল পেমেন্ট, ই-কমার্স এবং স্মার্ট সিটি প্রকল্পের মাধ্যমে।
এর একটি বড় উদাহরণ মিরসরাই। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের এই এলাকাকে বর্তমানে ‘ন্যাশনাল স্পেশাল ইকোনমিক জোন’ হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে, যেখানে স্মার্ট শহরের কাঠামো তৈরি হচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রযুক্তি ব্যবহার করে। দক্ষিণ কোরিয়া এই অঞ্চলটিকে ২০২৮ সালের মধ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ স্মার্ট শহরে রূপান্তরের পরিকল্পনা করেছে। এ জন্য তারা উলসান ও শেনজেনের মতো উপকূলীয় শহর থেকে অনুপ্রেরণা নিচ্ছে—যেগুলো এখন বিশ্বের অন্যতম বড় শিল্প ও অর্থনৈতিক কেন্দ্র।
মিরসরাইয়ের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল কেবল শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জন্যই নয়, বরং প্রযুক্তি-নির্ভর স্টার্টআপ ও বড় প্রযুক্তি কোম্পানির জন্যও সুবর্ণ সুযোগ। চট্টগ্রাম বন্দর ও বিমানবন্দরের কাছাকাছি হওয়ায় এই অঞ্চলটি একটি স্বনির্ভর ডিজিটাল শহরে রূপান্তরিত হতে পারে, যেখানে ঐতিহ্যবাহী শিল্প ও ডিজিটাল সেবা একসঙ্গে বিকশিত হবে।
ক্রমবর্ধমান জটিল ও আন্তঃসংযুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে, বাংলাদেশ এখন এক উদীয়মান কৌশলগত অংশীদার। দেশটি বিপুল জনসংখ্যা, কৌশলগত অবস্থান এবং ডিজিটাল রূপান্তরের পরিষ্কার লক্ষ্য নিয়ে এশিয়ার পরবর্তী প্রবৃদ্ধির গল্পে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে, দক্ষিণ কোরিয়ার জন্য বাংলাদেশে আরও গভীর সম্পৃক্ততা এক অনন্য সুযোগ। এটি কোরিয়াকে তার আঞ্চলিক অর্থনৈতিক কৌশলকে বৈচিত্র্যময় করতে, উদ্ভাবনে নেতৃত্ব দিতে এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ দক্ষিণ এশীয় দেশের স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে সহায়তা করবে। ঢাকা ও সিউলের এই উদীয়মান অংশীদারত্ব কেবল বাণিজ্যিক সম্পর্ক নয়—বরং এটি একটি যৌথ অগ্রযাত্রার দিকেই ইঙ্গিত দেয়, যেখানে দুই দেশই একে অপরের পাশে দাঁড়িয়ে একটি ভাগ্যগঠনের গল্প লিখতে চলেছে।
লেখক: হিউ হারসানো, প্রযুক্তি ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক, ব্লকচেইন, ডিজিটাল মুদ্রা এবং উদীয়মান প্রযুক্তিগুলোর আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা, প্রযুক্তি নীতি ও কৌশলগত প্রতিযোগিতার প্রভাব গবেষক। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলে থেকে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন।
আরও খবর পড়ুন:
প্রতিবেশী বড় দেশগুলোর তুলনায় আকারে ছোট হলেও, বাংলাদেশ এখন ধীরে ধীরে নিজেকে কৌশলগত অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে গড়ে তুলছে। মূলত বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (এফডিআই) আকর্ষণের মাধ্যমেই দেশটি নিজেদের অবস্থান মজবুত করছে।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার চীন। দেশটিই বাংলাদেশে বিনিয়োগে শীর্ষস্থান দখল করে আছে। চীন সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছে, বাংলাদেশে তারা দুটি নতুন বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি করবে। এসব অঞ্চলে চীনা বিনিয়োগকারীরা মূলত টেক্সটাইল, সিরামিকস ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক পণ্য উৎপাদনে কাজ করবেন।
তবে শুধু চীন নয়, দক্ষিণ কোরিয়ার ক্রমবর্ধমান উপস্থিতিও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এখন বড় ভূমিকা রাখছে। এটি শুধু অর্থনৈতিক সহযোগিতা নয়, বরং দুই দেশের কৌশলগত লক্ষ্য—বিশেষ করে বাংলাদেশের ডিজিটাল রূপান্তরের আকাঙ্ক্ষা এবং দুই দেশেরই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির আগ্রহ—এই সবকিছুরই মিলনস্থল।
বর্তমানে বাংলাদেশে দক্ষিণ কোরিয়ার বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ১ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশে তৃতীয় সর্বোচ্চ এফডিআই উৎস হিসেবে কোরিয়ার অবস্থানকে নিশ্চিত করেছে। ২০২৩ সালের পর থেকে দেশটি প্রতি বছর এই অবস্থানে উন্নতি করছে। ক্রমবর্ধমান এই ধারা স্পষ্ট করে যে, বাংলাদেশ দিন দিন দক্ষিণ কোরিয়ার বিনিয়োগকারীদের জন্য আরও বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে।
২০২৪ সালে বাংলাদেশে ব্যাপক বিক্ষোভ ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন দীর্ঘদিনের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন। এই রাজনৈতিক পরিবর্তন প্রথম দিকে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে সংশয় সৃষ্টি করলেও, ইউনূসের সরকারের সংস্কারের প্রতিশ্রুতি ফের নতুন করে আস্থা ফিরিয়ে আনে।
এর অন্যতম প্রমাণ, ২০২৫ সালে আয়োজিত বাংলাদেশের ইনভেস্টমেন্ট সামিট, যেখানে প্রায় ২ হাজার ৫০০ জন অংশগ্রহণকারী উপস্থিত ছিলেন—যার বেশির ভাগই ছিলেন বিদেশি বিনিয়োগকারী। যদি বাংলাদেশ এই সংস্কারপন্থী পথ ধরে এগিয়ে যেতে পারে, তাহলে দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশের কাছে এটি আরও বেশি মূল্যবান বিনিয়োগ গন্তব্য হয়ে উঠবে। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান, তরুণ জনসংখ্যা এবং ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সম্ভাবনা—এই সবই বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য যথেষ্ট।
দক্ষিণ কোরিয়ার বিনিয়োগকারীরা এখন শুধু তৈরি পোশাক বা নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে সীমাবদ্ধ থাকছেন না। এখন তারা আগ্রহী আধুনিক খাতেও—যেমন সেমিকন্ডাক্টর, ডিজিটাল ইলেকট্রনিকস ইত্যাদি। এটি কোরিয়ার কোম্পানিগুলোর একটি কৌশলগত পদক্ষেপ, যা বাংলাদেশের শিল্প খাতের পরিবর্তনশীল চাহিদা এবং ভোক্তা বাজারের বিকাশের সঙ্গে মিল রেখে চলছে।
২০২৫ সালের এপ্রিলে দক্ষিণ কোরিয়ার বিনিয়োগকারী একটি প্রতিনিধি দল—যার মধ্যে এলজি’র কর্মকর্তারাও ছিলেন—চট্টগ্রামের কোরিয়ার এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন (কেইপিজেড) পরিদর্শন করেন। এই কেইপিজেড একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক অঞ্চল যেখানে টেক্সটাইল এবং গ্রিন এনার্জি (সবুজ জ্বালানি) উৎপাদনের কারখানা রয়েছে। এই অঞ্চলে কোরিয়ার পোশাক নির্মাতা কোম্পানি ইয়াংওয়ান গ্রুপ নতুন করে বিনিয়োগ করে টেক্সটাইল ও সৌরশক্তিভিত্তিক প্রকল্প শুরু করেছে।
এর এক মাস আগেই, ২০২৫ সালের মার্চে কোরিয়ার বিখ্যাত অটোমোবাইল নির্মাতা হুন্দাই, বাংলাদেশের ডিএক্স গ্রুপের সঙ্গে এক অংশীদারত্ব ঘোষণা করে বাংলাদেশের ইলেকট্রনিকস ও হোম অ্যাপ্লায়েন্সের বাজারে প্রবেশ করে। এই যৌথ উদ্যোগ স্মার্ট টিভি, রেফ্রিজারেটর ও অন্যান্য উপকরণ উৎপাদন করবে।
দক্ষিণ কোরিয়ার কোম্পানি স্যামসাং এরই মধ্যে বাংলাদেশের ফেয়ার গ্রুপের সঙ্গে যৌথভাবে মোবাইল ফোন, টেলিভিশন ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এয়ার কন্ডিশনার) উৎপাদন করছে। এসব কর্মকাণ্ড স্পষ্ট করে যে, দক্ষিণ কোরিয়া এখন বাংলাদেশে উৎপাদন, প্রযুক্তি এবং নতুন শিল্প খাতে দীর্ঘমেয়াদি উপস্থিতি গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করছে।
দুই দেশের সরকারই বাংলাদেশে উদীয়মান স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমকে সহায়তা করে যাচ্ছে। ২০২৩ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাস একটি ভার্চুয়াল ডেস্ক চালু করে, যার মাধ্যমে আইটিভিত্তিক বিদেশি বিনিয়োগ বাংলাদেশে টানা সম্ভব হচ্ছে।
বাংলাদেশের আইসিটি ডিভিশন এবং কোরিয়া প্রোডাকটিভিটি সেন্টার একত্রে একটি মেন্টরশিপ প্রোগ্রাম চালু করেছে, যার লক্ষ্য হচ্ছে নতুন উদ্যোক্তাদের সহায়তা প্রদান। সরকারি পর্যায়ে আরও অনেক উদ্যোগ—যেমন স্বাস্থ্যসেবা খাতে সহযোগিতা, এবং দুই দেশের মধ্যে মান নির্ধারণে সমন্বিত নীতি তৈরি—প্রমাণ করে যে, দুই দেশ দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
এই নীতিগুলোর বাস্তব সুফলও মিলছে। যেমন, কোরিয়ার উদ্যোক্তাদের গঠিত ফুড-টেক স্টার্টআপ, এমএফএম কোরিয়া বাংলাদেশি নারীদের জন্য কাজের সুযোগ তৈরি করছে। এই উদ্যোগ পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপকরণ দিয়ে খাদ্যপণ্য তৈরি করে। একইভাবে, বাংলাদেশের তরুণ উদ্যোক্তাদের তৈরি ‘চারদিকে’ নামের একটি ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম কোরিয়ার পণ্যের বাজার গড়ে তুলেছে।
শুধু স্টার্টআপ নয়, প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলোও কৌশলগত অংশীদারত্বের দিকে এগোচ্ছে। যেমন, ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে গ্লোবাল ব্র্যান্ড পিএলসি (একটি বাংলাদেশি আইটি পণ্য বিপণনকারী কোম্পানি) এবং কোরিয়ার ফিনটেক কোম্পানি হায়োসাং টিএনএস একযোগে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত আধুনিকীকরণের উদ্যোগ ঘোষণা করে। এর আগেই দক্ষিণ কোরিয়ার বৃহৎ আর্থিক প্রতিষ্ঠান উরি ব্যাংক, বাংলাদেশের বিকাশ এবং ব্যাংককম্পেয়ারবিডির সঙ্গে পার্টনারশিপে যুক্ত হয়।
বাংলাদেশ শুধু উৎপাদনভিত্তিক অর্থনীতিতে আটকে থাকতে চায় না। ডিজিটাল অর্থনীতি গঠনের লক্ষ্য এখন ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। এই রূপান্তর দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলোর জন্য বিশাল সুযোগ তৈরি করছে, বিশেষ করে ডিজিটাল পেমেন্ট, ই-কমার্স এবং স্মার্ট সিটি প্রকল্পের মাধ্যমে।
এর একটি বড় উদাহরণ মিরসরাই। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের এই এলাকাকে বর্তমানে ‘ন্যাশনাল স্পেশাল ইকোনমিক জোন’ হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে, যেখানে স্মার্ট শহরের কাঠামো তৈরি হচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রযুক্তি ব্যবহার করে। দক্ষিণ কোরিয়া এই অঞ্চলটিকে ২০২৮ সালের মধ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ স্মার্ট শহরে রূপান্তরের পরিকল্পনা করেছে। এ জন্য তারা উলসান ও শেনজেনের মতো উপকূলীয় শহর থেকে অনুপ্রেরণা নিচ্ছে—যেগুলো এখন বিশ্বের অন্যতম বড় শিল্প ও অর্থনৈতিক কেন্দ্র।
মিরসরাইয়ের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল কেবল শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জন্যই নয়, বরং প্রযুক্তি-নির্ভর স্টার্টআপ ও বড় প্রযুক্তি কোম্পানির জন্যও সুবর্ণ সুযোগ। চট্টগ্রাম বন্দর ও বিমানবন্দরের কাছাকাছি হওয়ায় এই অঞ্চলটি একটি স্বনির্ভর ডিজিটাল শহরে রূপান্তরিত হতে পারে, যেখানে ঐতিহ্যবাহী শিল্প ও ডিজিটাল সেবা একসঙ্গে বিকশিত হবে।
ক্রমবর্ধমান জটিল ও আন্তঃসংযুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে, বাংলাদেশ এখন এক উদীয়মান কৌশলগত অংশীদার। দেশটি বিপুল জনসংখ্যা, কৌশলগত অবস্থান এবং ডিজিটাল রূপান্তরের পরিষ্কার লক্ষ্য নিয়ে এশিয়ার পরবর্তী প্রবৃদ্ধির গল্পে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে, দক্ষিণ কোরিয়ার জন্য বাংলাদেশে আরও গভীর সম্পৃক্ততা এক অনন্য সুযোগ। এটি কোরিয়াকে তার আঞ্চলিক অর্থনৈতিক কৌশলকে বৈচিত্র্যময় করতে, উদ্ভাবনে নেতৃত্ব দিতে এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ দক্ষিণ এশীয় দেশের স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে সহায়তা করবে। ঢাকা ও সিউলের এই উদীয়মান অংশীদারত্ব কেবল বাণিজ্যিক সম্পর্ক নয়—বরং এটি একটি যৌথ অগ্রযাত্রার দিকেই ইঙ্গিত দেয়, যেখানে দুই দেশই একে অপরের পাশে দাঁড়িয়ে একটি ভাগ্যগঠনের গল্প লিখতে চলেছে।
লেখক: হিউ হারসানো, প্রযুক্তি ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক, ব্লকচেইন, ডিজিটাল মুদ্রা এবং উদীয়মান প্রযুক্তিগুলোর আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা, প্রযুক্তি নীতি ও কৌশলগত প্রতিযোগিতার প্রভাব গবেষক। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলে থেকে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন।
আরও খবর পড়ুন:
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন শুল্ক আরোপের ফলে ভারত এক গুরুতর বাণিজ্য সংকটের মুখে পড়েছে। যদি আগামী তিন সপ্তাহের মধ্যে কোনো চুক্তি না হয়, তাহলে ভারতীয় পণ্যের ওপর শুল্কের হার ৫০ শতাংশে উন্নীত হবে, যা ভারতের রপ্তানি খাতকে প্রায় অচল করে দিতে পারে। ভারত এখন আলোচনার জন্য ট্রাম্পের কাছে ভারত
৩ ঘণ্টা আগেচুক্তিটি ভেস্তে যাওয়ার পেছনে আরেকটি বড় কারণ হলো প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে সরাসরি যোগাযোগের অভাব। মার্ক লিন্সকট নামে একজন প্রাক্তন মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি বলেন, ‘একপর্যায়ে উভয় পক্ষই চুক্তি সই করার খুব কাছাকাছি ছিল।’ একজন ভারতীয় কর্মকর্তা বলেন, ‘কিন্তু মোদি সরাসরি ট্র
১ দিন আগেবাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি দক্ষিণ এশিয়ার ভূ–রাজনৈতিক অঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হয়ে উঠেছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ও অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার যে পালাবদল ঘটেছে, তা এই অঞ্চল ঘিরে পরাশক্তিগুলোর প্রভাবে নতুন আলোড়ন তুলেছে। বিশেষ ভারত, চীন ও যুক্তর
১ দিন আগেভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যাকে ‘বন্ধু’ বলে সম্বোধন করেছিলেন, সেই ডোনাল্ড ট্রাম্পই তাঁর দেশের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক এবং ‘পেনাল্টি’ আরোপ করেছেন। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এই শুল্কের খামখেয়ালিপনার মুখে ভারত ভয় পাবে না, তবে কৌশল বদলাতে পারে—বলে মনে করেন শশী থারুর। কংগ্রেসের এই এমপি...
৪ দিন আগে