Ajker Patrika

কবরীও কেঁদেছিলেন তাঁর মৃত্যুতে

কামরুল হাসান
আপডেট : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৭: ১৭
কবরীও কেঁদেছিলেন তাঁর মৃত্যুতে

সুভাষ দত্তের ‘সুতরাং’ সিনেমায় জরিনার চরিত্রের জন্য মায়াবী মুখের একজন অভিনেত্রী চাই। সেই অডিশন দিতে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এলেন মিনা পাল। সিনেমার স্ক্রিপ্ট লিখেছেন সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক। মেয়েটিকে দেখেই নাম বদলে রাখলেন ‘কবরী’, সেটা ১৯৬৪ সালে। এরপর পাহাড়সম জনপ্রিয়তা নিয়ে পাখির মতো উড়তে থাকেন কবরী। এই মিষ্টি মেয়ে ১৯৭৮ সালে এক পীরের আস্তানায় গিয়ে ধর্মান্তরিত হন, সেখানেই বিয়ে করেন নারায়ণগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা শামীম ওসমানের চাচা, ব্যবসায়ী সফিউদ্দীন সারওয়ার বাবুকে। পীরের নাম মজিবর রহমান চিশতি।

সেই পীর যেদিন খুন হলেন, সেদিন সকাল থেকে দুপুর অবধি আমি কবরী সারওয়ারকে মোহাম্মদপুরে পীরের আস্তানায় বসে কাঁদতে দেখেছি। তবে কবরী সারওয়ারের সঙ্গে পীরের এত সুসম্পর্ক বাইরের লোকেরা খুব কমই জানতেন। মজিবর রহমান চিশতি সম্পর্কে প্রচলিত ছিল, তিনি পাকিস্তানের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর পীর।

সাংবাদিকতা জীবনের শুরুতে চলনে-বলনে মহাক্ষমতাধর এই পীর নিয়ে অনেক সত্য-মিথ্যা শুনেছি। এমন পীর দেখে নিজের চোখ জুড়ানোর ইচ্ছেও বার কয়েক উঁকি দিয়েছে মনে। কিন্তু যাব-যাচ্ছি করে শেষমেশ আর যাওয়া হয়নি। যেদিন গেলাম, সেদিন গিয়ে দেখি, দোতলায় বাথরুমের মেঝেতে তাঁর জবাই করা লাশ উপুড় হয়ে পড়ে আছে।

পুলিশের ঢাকা নগর বিশেষ শাখার (সিটিএসবি) এসএস ছিলেন মো. ইমামুল হোসেন। আমরা ডাকতাম ফিরোজ ভাই বলে। চাকরি থেকে অবসর নিয়ে অনেক দিন হাইকোর্টে ওকালতিও করেছিলেন। সেই ফিরোজ ভাই ২০০০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর সকালে ফোন করে ঘুম ভাঙালেন পীর খুনের খবর দিয়ে। তড়িঘড়ি তৈরি হয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেখি, উত্তর বিভাগের ডিসি মোস্তাক আহমেদ দলবল নিয়ে আগেই হাজির। সিআইডির একটি দল এসেছে। তারা ঘুরে ঘুরে ‘অপরাধের চিহ্ন’ খুঁজছে।

মোহাম্মদপুরে ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের পেছনে এখন যেখানে মা ও শিশু হাসপাতাল, তার ঠিক উত্তর দিকের দেয়াল ঘেঁষে যে সড়ক চলে গেছে, তারই নাম শের শাহ সুরি রোড। এই সড়ক ধরে একটু এগোতেই একটি পুরোনো দোতলা বাড়ির নাম ‘বাগদাদি মহল’। এটাই পীর মজিবর রহমানের আস্তানা। বাড়িটি ছিল পরিত্যক্ত সম্পত্তি। এরশাদের আমলে চিশতি সেটা বরাদ্দ পান। এ বাড়ির নিচতলায় ৪টি এবং ওপরের তলায় ৫টি কক্ষ। নিচতলায় নুরে মদিনা আজমেরী দরবার, ওপরে চিশতির খাসকামরা ও ইবাদতখানা। দোতলায় একটি কক্ষে থাকেন বাংলাদেশ টেলিভিশনের পদস্থ কর্মকর্তা হুমায়ুন চৌধুরীর স্ত্রী রিজিয়া চৌধুরী। অন্য কক্ষে এতিমখানা ও মাদ্রাসার মালামাল। সরু বারান্দার পাশে চিশতির থাকার ঘর। মেঝেতে ভেলভেটের কার্পেটের ওপর বিঘত-পুরু গদির ধবধবে সাদা বিছানা।

ক্রাইম রিপোর্ট লেখার ক্ষেত্রে একটি প্রচলিত সহজ পদ্ধতি হলো, শুরুতেই অকুস্থলের আদ্যোপান্ত পাঠককে জানিয়ে দেওয়া, যাতে পাঠক পরিবেশ-পরিস্থিতিটা ভালোভাবে বুঝতে পারেন। এ বাড়ির বাসিন্দা মোট তিনজন। চিশতি ছাড়াও দোতলায় একটি কক্ষে থাকেন রিজিয়া চৌধুরী।

নিচতলায় থাকেন পীরের কাজের ছেলে আলমগীর। তিনতলা থেকে দোতলায় আসার একটিমাত্র সিঁড়ি। সিঁড়ি থেকে চিশতির খাসকামরায় আসতে ৪টি লোহার গেট। অনুমতি ছাড়া বহিরাগত কারও ভেতরে আসা দুঃসাধ্য। সব গেটের চাবি থাকত আলমগীরের কাছে।

মোহাম্মদপুর থানার ওসি মহসিন উজ্জামান ততক্ষণে আলমগীরকে পাকড়াও করে গাড়িতে বসিয়ে রেখেছেন। ওসির অনুমতি নিয়ে আলমগীরের কাছে জানতে চাইলাম, রাতে কী হয়েছিল? আলমগীর বললেন, বৃহস্পতিবারের বিশেষ প্রার্থনার পর ১৫-১৬ জন লোক খাওয়াদাওয়া করেন। তাঁরা চলে যাওয়ার পর আসেন চিশতির খালাতো ভাই আমান ও তাঁর বন্ধু এরশাদ। রাতে খাওয়াদাওয়া শেষে তাঁরা চিশতির সঙ্গে বসে গল্প করতে থাকেন। এসব দেখে তিনি ঘুমাতে যান। সকালে উঠে দেখেন, আমান ও এরশাদ নেই, দরজায় বাইরে থেকে তালা দেওয়া। ভেতরে উঁকি মেরে দেখেন রক্তের দাগ। এরপর রিজিয়া চৌধুরীকে ডাকেন।

রিজিয়া চৌধুরী খুবই শক্ত মানুষ। সাংবাদিকদের সঙ্গে কোনো কথা বলবেন না। আমার সামনে পুলিশকে বললেন, এ ঘটনা দেখে তিনি বাইরে গিয়ে সাবেক ব্যাংকার মঞ্জুরুল বারী, ভালুকার তৎকালীন এমপি আবদুল্লাহ চৌধুরী ও ব্যারিস্টার মনসুরকে ফোন করেন। এরপর পুলিশকে ফোন করেন। পুলিশ এসে দরজা ভেঙে দেখে, বাথরুমের ভেতরে পড়ে আছে জবাই করা মরদেহ।

মজিবর রহমান চিশতির বয়স তখন ৫০-৫২ হবে, তিনি ছিলেন অবিবাহিত। তাঁর বাবা আনিস রহমান জয়পুরহাট জেলার চকবরকত গ্রামের সাধারণ কৃষক। তিন ভাই আর দুই বোনের মধ্যে তিনি চতুর্থ। তাঁর বড় ভাই আফাজ উদ্দিন ১৯৮৫ সালে ক্যানসারে মারা যান। মেজ ভাই শেখ সাদি ১৯৮৭ সালের ৫ জুলাই জয়পুরহাটে জমিজমা নিয়ে বিরোধে খুন হয়। চিশতির দুই বোন রহিমা ও মোমেনা ঢাকায় থাকেন। পরিবারের লোকজনের সঙ্গে চিশতির কোনো পারিবারিক সম্পর্ক ছিল না। তিনি একাই মোহাম্মদপুরের আস্তানায় থাকতেন। মোহাম্মদপুরের সেই দরবার ছাড়াও মিরপুর ও ক্যান্টনমেন্ট থানা এলাকায় তাঁর আরও দুটি বাড়ি ছিল। আর জয়পুরহাটে ছিল কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি। মিরপুরের বাড়িতে একসময় এরশাদ ও জিনাত অভিসারে যেতেন। ঢাকা সেনানিবাসের একটি বাড়ি নিয়ে তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল নাসিম আপত্তি জানিয়েছিলেন।  

এই লেখার শুরুতে আমি পীর মজিবর রহমানকে অত্যন্ত ‘ক্ষমতাধর’ লোক হিসেবে উল্লেখ করেছিলাম। সেটা এবার বলি। পীর মজিবর রাজশাহী ও নাটোরের দুটি মাদ্রাসায়  কয়েক বছর পড়েছিলেন। তবে সেটাও শেষ করতে পারেননি। গ্রামের লোকজনের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে ষাটের দশকে আজমির শরিফে গিয়ে বছরখানেক কাটান। ফিরে এসে নিজের নামের সঙ্গে চিশতি শব্দটি জুড়ে দেন। গ্রামে দরবার খুলে বসেন। স্বাধীনতার পর চলচ্চিত্র পরিচালক ইবনে মিজান একবার সেই আস্তানায় গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। ফিরে আসার পর সে বছর ইবনে মিজানের একটি ছবি ব্যবসাসফল হয়। এরপর চলচ্চিত্রের লোকজন দলে দলে তাঁর আস্তানায় ভিড় করতে থাকেন। সেই জোয়ারে কবরী সারওয়ারও মুরিদ হন।

এরপর ঢাকায় এসে মজিবর রহমান আস্তানা গাড়েন। ১৯৭৫ সালের দিকে কোতোয়ালির একটি আস্তানা থেকে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। শোনা যায়, সে সময় তিনি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর সে কথা ছড়িয়ে পড়লে তিনি ‘কামেল পীর’ খ্যাতি পেয়ে যান। এরপর জিয়াউর রহমানের সরকার ক্ষমতায় এসে তাঁকে মুক্তি দেন। ১৯৯৩ সালে তিনি সাদ্দাম হোসেনের আমন্ত্রণে ইরাক সফরে যান, সেখান থেকে ফেরার পথে ইসরায়েল ভ্রমণ করেন। ইসরায়েল থেকে দেশে ফেরার সময় ইমিগ্রেশন পুলিশ তাঁকে দেশে ঢুকতে না দিয়ে আবার ফেরত পাঠায়। পরে বেশ কিছুদিন বাইরে কাটিয়ে দেশে ফেরেন। ২০০০ সালের ৮ সেপ্টেম্বর আমেরিকা যাওয়ার সময় পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) তাঁর পাসপোর্ট আটক করে। এসবির কাছে খবর ছিল, একটি গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করতে তিনি আমেরিকায় যাচ্ছেন। সেই থেকে তিনি আর বিদেশ যেতে পারেননি।

পীর মজিবর রহমান একবার সাপ্তাহিক বিচিত্রায় একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। তাতে বলেছিলেন, রিয়াজ আহমদ নামের তাঁর এক পাকিস্তানি মুরিদ ছিলেন, যাঁর ভাই জেনারেল ইমতিয়াজ ছিলেন পাকিস্তানি সেনা গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের প্রধান। আইএসআই প্রধানের মাধ্যমে তিনি পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর আস্তানায় দাওয়াত করেছিলেন। সেই দাওয়াত কবুল করতে ১৯৮৯ সালের ১ অক্টোবর ৪৩ ঘণ্টার বাংলাদেশ সফরে এসে জয়পুরহাটে তাঁর আস্তানায় যান বেনজির। তিনি সেখানে ১০-১২ মিনিট অবস্থান করেন। শোনা যায়, সে সময় তিনি বেনজিরকে নিয়েও ভবিষ্যদ্বাণী করেন। বেনজির বাংলাদেশ থেকে চলে যাওয়ার পর মজিবর রীতিমতো ‘তারকা’ পীরে পরিণত হন। দেশের বিভিন্ন সংস্থা, বাহিনী ও সরকারি পদস্থ লোকেরা তাঁর আস্তানায় ভিড় করতে থাকেন। ধানমন্ডিতে সে সময় শের এ খাজা নামে আরেকজন বিখ্যাত হয়ে উঠছিলেন। তিনি একবার আমাকে বলেছিলেন, মজিবর রহমান হলেন ঢাকায় পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার ‘সেন্টার পয়েন্ট’।

এত কিছু শোনার পর প্রশ্ন উঠতেই পারে, এমন ক্ষমতাধর মানুষ খুন হলেন কী করে, কারাই-বা তাঁকে খুন করল। মজিবর রহমান খুনের ঘটনায় বাদী হয়ে মামলা করেছিলেন তাঁর মুরিদ আমানুল্লাহ চৌধুরী। সেই মামলা এখনো সিআইডি তদন্ত করছে। এত বছরেও তদন্ত শেষ হয়নি। ২০০৬-০৭ এর দিকে আমার সন্দেহ হয়, এই খুনে জেএমবি জঙ্গিদের হাত থাকতে পারে। কিন্তু জেএমবির প্রধান শায়খ আবদুর রহমান, আতাউর রহমান সানি ও বাংলা ভাইয়ের জবানবন্দি আমি তন্নতন্ন করে খুঁজেছি। অন্য অনেক পীর খুনের কথা বললেও তাঁরা কোথাও মজিবর খুনের কথা স্বীকার করেননি।

এখন একটাই আফসোস! যে পীর দুনিয়ার তাবৎ বড় বড় মানুষের ভবিষ্যদ্বাণী করে গেলেন, তিনি শুধু নিজের পরিণতির কথাটাই বুঝতে পারেননি।

আরও পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত