Ajker Patrika

যে অস্ত্রভান্ডারের সলিলসমাধি

কামরুল হাসান
আপডেট : ২২ অক্টোবর ২০২২, ০৮: ৪৯
যে অস্ত্রভান্ডারের সলিলসমাধি

সবে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। গভীর সমুদ্রে নিয়মিত কাজে ব্যস্ত নৌবাহিনীর টহল জাহাজ এস আর আমিন। সেই জাহাজ থেকে আবছা আলোয় দূরে দেখা যাচ্ছিল বড় আকারের একটি ট্রলারের পাশে দুটি ছোট ট্রলার। ক্যাপ্টেন দুরবিন দিয়ে দেখতে পান, বড় ট্রলার থেকে বাক্সের মতো কিছু জিনিস নামানো হচ্ছিল ছোট ট্রলারে। ক্যাপ্টেনের সন্দেহ হলো। তিনি সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে বোঝার চেষ্টা করলেন, কী হচ্ছে সেখানে। এরপর আদেশ দিলেন জাহাজের মুখ ঘুরিয়ে ট্রলারের কাছে যেতে।

নৌবাহিনীর জাহাজ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছিল নৌযানগুলোর দিকে। কিন্তু যত কাছে যাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল বাক্সগুলো ট্রলারে তোলার গতি কমে যাচ্ছে। একপর্যায়ে দেখা গেল, বড় ট্রলার থেকে ছোট ট্রলারে না তুলে বাক্স ফেলা হচ্ছে পানিতে। এস আর আমিন যখন নৌযানগুলো ঘিরে ফেলল, ততক্ষণে সব শেষ। তিন ট্রলারে আর কোনো মালপত্রই অবশিষ্ট নেই। সব সাগরে তলিয়ে গেছে।

কী ছিল সেই জাহাজে? কেউ কিছু বলেন না। নৌবাহিনীর কর্মকর্তাদের সন্দেহ, বড় ট্রলারটি বিদেশি মালিকানার। ছোট ট্রলার দুটি দেশি—একটির নাম খিজির-১, অন্যটি খিজির-২। তিনটি নৌযানের সবাইকে নামিয়ে আনা হলো। গুনে দেখা গেল, সাকল্যে ২৮ জন। প্রথমে তাঁরা কেউ কিছুই বললেন না। পরে একজনকে সন্দেহ করে জিজ্ঞাসাবাদ করতেই স্বীকার করলেন, তাঁর নাম মোহাম্মদ, তিনি পাকিস্তানি। ট্রলারে কী ছিল? তাঁর পরিষ্কার উত্তর, অস্ত্রের বাক্স ছিল। নৌবাহিনীর টহল জাহাজ দেখে ভয়ে সব অস্ত্র সাগরে ফেলে দেওয়া হয়েছে। কত অস্ত্র ছিল? তার কোনো হিসাব নেই তাঁদের কাছে। তাঁরা শুধু জানেন, ট্রলারে আড়াই বাক্স অস্ত্র ছিল।

এ ঘটনা ২০০০ সালের ১৭ ডিসেম্বরের। গভীর সাগর থেকে নৌযান তিনটি আটক করা হলো। ২৮ জনকে গ্রেপ্তার করে আনা হলো পতেঙ্গা থানায়। তৎপর হয়ে উঠল গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। মোহাম্মদকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হলো। তিনি স্বীকার করলেন, আরশাদ নামের এক ব্যক্তির কথামতো তিনি বাংলাদেশে এসেছেন। তাঁর দায়িত্ব ছিল বাক্সগুলো আনোয়ারার গহিরা উপকূলে পৌঁছে দেওয়া। কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা গেল, ছোট আকারের ট্রলার দুটির মালিক গহিরার জলিল কোম্পানি। বড় ট্রলারের কাগজপত্রে পাওয়া গেল ইলিয়াস নামের এক ব্যক্তির নাম।

গোয়েন্দারা খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারলেন, আরশাদ নামের সেই ব্যক্তি ১৪ ও ১৫ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের সেন্টমার্টিন হোটেলে ছিলেন। ১৬ ডিসেম্বর বেলা দুইটার দিকে চট্টগ্রামের ব্রিজঘাটা থেকে খিজির-১ ও খিজির-২ নামের নৌযান দুটি নিয়ে গভীর সাগরে রওনা হন। মোহাম্মদ গোয়েন্দাদের বলেছিলেন, আরশাদ তাঁকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন বাক্সগুলো গহিরায় পৌঁছে দিতে। বলা হয়েছিল, বাক্সগুলো গন্তব্যে পৌঁছে দিতে পারলে মোটা অঙ্কের অর্থ দেওয়া হবে তাঁকে। দুটি ছোট নৌযানের একটিতে ছিল ১২ জন, অন্যটিতে ১৬ জন। যে ট্রলারে করে বাক্সগুলো আনা হয়েছিল, সেটির ক্যাপ্টেন ছিলেন গুজরাটি। মোহাম্মদ ট্রলারে উঠে সংকেত দেওয়ার পরই বাক্সগুলো খালাসের অনুমতি দেন ক্যাপ্টেন। সেই সংকেত আরশাদ তাঁকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন। ট্রলারের প্রতিটি বাক্সের ওজন ছিল ২০-২৫ কেজি।

মনে হয়, সে সময় ঘটনাটি নিয়ে ভালো প্রতিবেদন করেছিলেন চট্টগ্রামের সাংবাদিক মোয়াজ্জেমুল হক। সাগরে অস্ত্র ফেলে দেওয়ার ঘটনা নিয়ে সে সময় সরকারি মহলে ব্যাপক হইচই পড়েছিল। বিভিন্ন সংস্থা অনুসন্ধানও শুরু করেছিল একজোট হয়ে। কিন্তু তারা খুব বেশি এগোতে পারেনি। অস্ত্র ডুবিয়ে দেওয়ার ঘটনাস্থল ছিল এলিফ্যান্ট পয়েন্ট থেকে ৯৮ নটিক্যাল মাইল দূরে। সেখানে সাগরের গভীরতা ৯০ মিটারের মতো। নৌবাহিনীর জাহাজ শৈবাল অনেক চেষ্টা করেও কোনো বাক্সের হদিস করতে পারেনি। ছোট দুটি ট্রলার থেকে যাঁদের আটক করা হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে একটির মাঝি ছিলেন ইউসুফ, অন্যটির সৈয়দ। তাঁরা বলেছিলেন, দুজনেই সেই ট্রলারে নতুন। কাউকে তাঁরা চেনেন না। ফিশারিঘাটের শফি কেরানি তাঁদের ওই ট্রলারে নিয়োগ দিয়েছিলেন। ট্রলারের বাকি লোকেরাও কথা বলেছিলেন একই সুরে। এঁদের সবাইকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠানো হলে আদালত তাঁদের সাত দিনের রিমান্ড (জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হেফাজত) মঞ্জুর করেন। যেহেতু তাঁদের কাছ থেকে কোনো কিছুই উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি, সে কারণে পাকিস্তানি মোহাম্মদ ছাড়া সবাইকে কিছুদিন পর মুক্তি দেওয়া হয়। কয়েক মাস জেল খেটে মোহাম্মদও ছাড়া পেয়ে দেশ ছাড়েন। ধীরে ধীরে সবাই ভুলতে থাকেন সাগরে অস্ত্র ফেলে দেওয়ার সেই ঘটনা। এ নিয়ে আর কোনো অনুসন্ধানও হয়নি।

এ ঘটনার চার বছর আগে ১৯৯৬ সালের ২৪ মার্চ কক্সবাজার শহর থেকে ১২ কিলোমিটার উত্তরে, মহেশখালীর পূর্ব পাশে চৌফলদণ্ডীতে ধরা পড়েছিল এক জাহাজভর্তি অস্ত্রের চালান। সেই চালানটি ধরেছিলেন কক্সবাজারের তৎকালীন পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আবদুল হান্নান। পরে তিনি ডিবির (গোয়েন্দা শাখা) ডিসি (উপকমিশনার) হিসেবে অবসরে যান। মোহাম্মদ আবদুল হান্নান আমাকে বলেছিলেন, সাগরে ডুবিয়ে দেওয়া সেই অস্ত্রের চালান ছিল ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপ উলফার। সে সময় তারা অস্ত্রগুলো কিনেছিল কম্বোডিয়ার খেমার রুজ গেরিলাদের কাছ থেকে। সেই চালান কেনার অস্ত্র জুগিয়েছিল পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই।

২০০৩ সালের ২৭ জুন বগুড়ার কাহালুতে নাগর নদের পাশে একটি ইটভাটায় পাওয়া গিয়েছিল আনারসভর্তি ট্রাকের ভেতরে চায়নিজ রাইফেলের এক লাখ গুলি এবং উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ১৭৪ কেজি বিস্ফোরক। সে সময় পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) সেই ট্রাকচালককে আটক করেছিল। চালক স্বীকার করেছিলেন, চালানটি এসেছিল হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের টিপরা বস্তি থেকে। তেলিয়াপাড়া চা-বাগানের ভেতরে ট্রাকে তোলা হয়েছিল ওগুলো। চা-বাগানটির মালিক ছিল বিএনপি আমলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোরশেদ খানের পরিবার। গুলি ও বিস্ফোরকের চালানটি পাঠিয়েছিল ত্রিপুরার বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন এনএলএফটি।

এরপর ২০০৪ সালে ১০ ট্রাক অস্ত্রের চালান ধরা পড়ে চট্টগ্রাম থেকে। ১০ ট্রাক অস্ত্রের চালান নিয়ে তদন্তে বেরিয়ে আসে, সেই চালানের জন্যও অর্থ জুগিয়েছিল আইএসআই। আর তাদের হয়ে চালানের মূল্য বাবদ অর্থ অস্ত্র নির্মাতা কোম্পানিকে পরিশোধ করেছিলেন দুবাইয়ের এআরওয়াই টিভির মালিক আবদুল রাজ্জাক ইয়াকুব।

কিছুদিন আগে দেখলাম, আসামের গোয়াহাটিতে বসবাসরত সাবেক উলফা নেতা অনুপ চেটিয়া বাংলাদেশের সময় টিভিকে বলছেন, ১০ ট্রাক অস্ত্রও ছিল উলফার। সেগুলো আসামে নেওয়ার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু তিনি একবারও বললেন না, অবৈধ অস্ত্রের চালান এনে একটি স্বাধীন দেশকে অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দেওয়ার অপচেষ্টার দায় তাঁরা এড়াতে পারেন না। তাঁদের গোষ্ঠীগত স্বার্থের জন্য বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করায় প্রতিবেশী দুটি দেশের যে টানাপোড়েন ছিল, সেই দায়ও নিলেন না তিনি।

আরও পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত