Ajker Patrika

সংস্কারের সময়ে সংযমী বাজেট

  • সংসদ না থাকায় টেলিভিশনে বাজেট উপস্থাপন।
  • জীবনমান উন্নয়নে জোর, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বিনিয়োগ-কর্মসংস্থানে অগ্রাধিকার।
  • শৃঙ্খলার মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ে উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা, সামাজিক সুরক্ষায় নজর।
শাহ আলম খান, ঢাকা 
সংস্কারের সময়ে সংযমী বাজেট

অর্থনৈতিক চাপ, মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক সহায়তার কঠোর শর্ত এবং রাজস্ব ঘাটতির বাস্তবতায় আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট ব্যতিক্রমী হতে যাচ্ছে। ভোটের আগে উচ্চাভিলাষী ব্যয়ের বদলে এবার জোর দেওয়া হচ্ছে সংযম, কাঠামোগত সংস্কার এবং জনকল্যাণে কার্যকর বরাদ্দে। জনগণের জীবনমান উন্নয়ন, সামাজিক নিরাপত্তা, রাজস্ব শৃঙ্খলা ও বিনিয়োগ সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টিতে জোর দেওয়া হচ্ছে বাজেটে।

অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আগামী বাজেট হবে একটি ‘দায়িত্বশীল, নির্বাচন-পূর্ব বাস্তববাদী বাজেট’। অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এই বাজেট হবে বাস্তবভিত্তিক, বাস্তবায়নযোগ্য এবং সুশাসন ও বৈষম্য কমাতে সহায়ক।’

সর্বশেষ খসড়া অনুযায়ী, আগামী বাজেটের আকার নির্ধারিত হয়েছে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের তুলনায় ৭ হাজার কোটি টাকা কম। স্বাধীনতার পর এই প্রথম বাজেটের আকার আগের অর্থবছরের তুলনায় কমেছে। অর্থ মন্ত্রণালয় ও পরিকল্পনা কমিশনের ভাষ্য অনুযায়ী, ব্যয় সংকোচনের মূল কারণ—আইএমএফের শর্ত পূরণ, অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাদ দেওয়া এবং রাজস্ব ঘাটতি নিয়ন্ত্রণ।

এবারের বাজেটে ঘাটতি ধরা হচ্ছে জিডিপির ৩.৬২ শতাংশ বা ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের বাজেটে ছিল ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা বা জিডিপির ৫.২ শতাংশ। মূলত চড়া সুদে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ গ্রহণ কমাতে লক্ষ্যমাত্রা সীমিত রাখা হচ্ছে। তবে এবার এ ঘাটতি নিয়ন্ত্রণের অন্যতম অস্ত্র হতে যাচ্ছে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ৫ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকার উচ্চাভিলাষী রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য, যার মধ্যে ৩০ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত সংগ্রহের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন খাত থেকে কর অব্যাহতি কমিয়ে।

এবার জাতীয় বাজেট পবিত্র ঈদুল আজহার আগে আগামী ২ জুন ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কারণ, ৫ থেকে ১৪ জুন পর্যন্ত ঈদের ছুটি। বাজেট ঘোষণার পরদিন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ রেওয়াজ মেনে বাজেট-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেবেন।

জাতীয় সংসদ না থাকায় এবারের বাজেট টেলিভিশনের মাধ্যমে উপস্থাপন করবেন অর্থ উপদেষ্টা। বাজেট কার্যকর করতে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ জারি করা হবে, যা বর্তমান ব্যবস্থার আওতায় অন্তর্বর্তী সরকারের মাধ্যমে বাজেট ঘোষণার আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করবে।

নতুন অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হচ্ছে ৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে যা ছিল ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এ ছাড়া আগামী অর্থবছর শেষে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনতে চায় সরকার। চলতি অর্থবছরেও একই লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। তবে চলতি বছর এপ্রিলে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ১৭ শতাংশ।

অর্থ উপদেষ্টার বাজেট বক্তৃতায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতে কর ব্যবস্থায় থাকবে বড় সংস্কার—কর ও নীতির পৃথকীকরণ, ভ্যাট কাঠামোর বাস্তবায়নযোগ্য সম্প্রসারণ এবং এনবিআর অবকাঠামোয় অটোমেশন জোরদার করা। সেই সঙ্গে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ এবার পুরোপুরি বন্ধ হচ্ছে, যদিও রেজিস্ট্রেশন খাতে করহার কিছুটা কমিয়ে তা নিরুৎসাহিত করার কৌশল রাখা হতে পারে।

আসছে বাজেটে সংযমের বার্তা আরও স্পষ্ট হয়েছে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) কমিয়ে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণে, যা আগের চেয়ে ৩৫ হাজার কোটি টাকা কম। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। তবে এই কাটছাঁটের মধ্যেও কৃষি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে কিছুটা বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকি সংকোচন করে ৩২ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে, যা চলতি অর্থবছরের তুলনায় প্রায় অর্ধেক কম। অর্থ মন্ত্রণালয় বলছে, অব্যবহৃত সক্ষমতা ও অকার্যকর প্রকল্প এই সংকোচনের মূল কারণ। তবে রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের প্রথম ইউনিট চালু করা হবে নতুন অর্থবছরের মধ্যভাগে। এটি বাজেটে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হিসেবে জায়গা পাচ্ছে।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের প্রশাসক মো. হাফিজুর রহমান আশা করেন, আগামী বাজেট এলডিসি-উত্তর বাস্তবতা ও বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বিবেচনায় স্থিতিশীল বিনিয়োগ পরিবেশ গড়তে ভূমিকা রাখবে।

সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিকে কেন্দ্র করেই করা হচ্ছে বাজেটের কল্যাণচিন্তা। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এ খাতে ১ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে, যা বাজেটের ১৭ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। এর মধ্যে সঞ্চয়পত্রে সুদ বাবদ ব্যয় খাতে বরাদ্দ রয়েছে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা। এটিসহ আরও কিছু কর্মসূচি সংস্কার পদক্ষেপের আওতায় বাদ যাওয়ায় আগামী অর্থবছরের বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ রাখা হতে পারে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা, যা যেকোনো খাত বিবেচনায় সর্বোচ্চ। তবে এতে খাদ্য সহায়তা, নগদ ভাতা এবং বৃদ্ধ ভাতা কার্যক্রমকে আরও বিস্তৃত করে প্রকৃত দাবিদারদের আওতায় আনার ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। ভাতার পরিমাণ না বাড়লেও অন্তর্ভুক্তি ও স্বচ্ছতা বাড়ানোই এবার মূল লক্ষ্য।

সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য আসছে মহার্ঘ ভাতা। আনুপাতিক হারে প্রযোজ্য মহার্ঘ ভাতা বর্তমান মূল্যস্ফীতির প্রেক্ষাপটে চাহিদা মেটানোর জন্য গ্রহণযোগ্য পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। অন্যদিকে, বেসরকারি খাতকে চাঙা রাখতে দেওয়া হচ্ছে ব্যবসাবান্ধব সুবিধা, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির উপযোগী প্রণোদনা।

আগামী বাজেট বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘এটি অর্থনৈতিক বাস্তবতা মেনে নেওয়ার একটি ইঙ্গিত, যা ভবিষ্যতে আর্থিক শৃঙ্খলা রক্ষায় সহায়ক হবে।

এসএমই খাতে এবার থাকবে নতুন ধারা। প্রণোদনার অংশ হিসেবে করছাড়, সহজ শর্তে ঋণ এবং প্রশিক্ষণ প্যাকেজের ঘোষণা আসতে পারে। এ খাতকে বাজেট বক্তৃতায় ‘চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রস্তুতির কেন্দ্রবিন্দু’ হিসেবে আখ্যায়িত করার চিন্তাও রয়েছে। বিদ্যমান তহবিল বাড়ানোর পাশাপাশি জাতীয় এসএমই ডেটাবেইস হালনাগাদ করার নির্দেশনা অন্তর্ভুক্ত থাকবে।

অন্তর্বর্তী সরকারের পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘বাজেট রাজনৈতিক জনপ্রিয়তা নয়; বরং অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার এবং কাঠামোগত রূপান্তরকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে তিন বাহিনীর প্রধান

১৭ বছর খাইনি, এবার খাব—টেন্ডার জমা দেওয়া ঠিকাদারকে বললেন বিএনপি নেতা

দেশে এল স্টারলিংক: কতগুলো ডিভাইস যুক্ত করা যাবে, কীভাবে করবেন

যৌথ পরিবারে কোরবানি কার ওপর ওয়াজিব

মধ্যরাতে হাক্কানীর মালিকের বাসায় মবের হানা, আটক তিন সমন্বয়ককে ছাড়িয়ে নিলেন হান্নান মাসউদ

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত